প্রণব বসুরায়





আজ ‘একুশ ফেব্রুয়ারী’—আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনে বিশ্বের সব ভাষা ভাষী নিজের মাতৃভাষার সম্প্রচারে শ্রদ্ধায়, পরম মমতায় সচেষ্ট থাকবেন। সকলের মতো, আছি আমরাও। বরং তা একটু বেশিই—ন্যায্য কারণেই। একথা তো অনস্বীকার্য যে বাংলা ভাষার জন্যে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আন্দোলন হয়েছে, পৃথিবীর আর কোথাও তা হয় নি। এই বিশেষ ভাষার জন্য লড়াই অবশেষে বিশ্বের বুকে এক নতুন রাস্ট্রের পত্তন ঘটিয়েছে। শুধু এই ভাষার এক কবির রচনা তিনটি স্বতন্ত্র দেশের রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত! এইসব কারণেই ইউনেস্কো দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এবার একটু ইতিহাসে ফেরা যাক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা।  কিন্তু তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল উর্দু, রাস্ট্রভাষা হিসেবে। জনমানসে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে ঐ সিদ্ধান্ত এবং ক্ষত গভীরতর হতে থাকে। বিস্তৃত ঘটনায় না গিয়েও উল্লেখ্য ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঝরে গেল কয়েকটি তাজা প্রাণ—বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার দাবীতে। সেই আন্দোলন পরে রাজনৈতিক চেহারা পায়, যার ফলশ্রুতিতে নতুন রাস্ট্র ‘বাংলা দেশ’ তার পতাকা ওড়াতে সমর্থ হলো ১৯৭১-এ, পৃথিবীর আকাশে।

আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার মানুষেরও ভাষা ছিল বাংলাই। তাদের ওপরও আসামী ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ কিছুতেই তা মানতে রাজি নন। শুরু হলো জবরদস্তি। এ ক্ষেত্রেও মানুষ গর্জে উঠলেন—১৯৬১-র ১৯ মে তারিখে শিলচরের তারাপুর স্টেশনে প্রশাসনের গুলি ছু্টলো। ১৯  আর ২০ তারিখে ভাষার জন্যে শহিদ হলো ১১ জন যুবক যুবতী যার মধ্যে অন্যতম ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনও পেরেছিল কাছাড়ে বাংলা ভাষাকে মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে, তবে তা কতদিন টিকবে, বলা শক্ত। তবু, ঝকঝকে হরফে বাংলায় লেখা শিলচর স্টেশনের ছবি দেখে প্রতি বাঙালীই খুশী হন, নিশ্চিত।

এই দু’টি ঘটনার কথা প্রায় সবাই জানি, হয়ত খুঁটিয়ে নয়, তবু জানি। কিন্তু যে ঘটনাটি আলোচনায় আসেই না তা হচ্ছে মানভূম জেলার (স্থাপিত ১৮৩৩) মানুষের বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন ও আত্মত্যাগের কথা। গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকের শেষ ভাগ থেকে ৫০-এর দশকের মাঝামাঝি অবধি এর উজ্জ্বলতম ব্যাপ্তি।

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের প্রয়াস আটকানো গেলেও ১৯১২ সালে ‘বিহার-উড়িষ্যা’ নামের এক রাজ্য বা প্রদেশের সৃস্টি করা হয়, যার সীমানার ভেতর মানভূম জেলা (তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অঙ্গ)ও ছিলো। সারা মানভূম জেলার অধিবাসী তীব্র আপত্তি জানান এই অন্তর্ভূক্তিতে। এর পুরোভাগে ছিল ‘ভাষা আন্দোলন’ । এদের প্রধান দাবী ছিল মানভূমকে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করা হোক। কিন্তু তখন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে ওই আপত্তি ও দাবী সাময়িক ভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপর ১৯২১ সালে মানভূমে কংগ্রেস দলের জন্ম হয়, সভাপতি হন নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত, সম্পাদক অতুল চন্দ্র ঘোষ। ১৯৩৫-এ নিবারণ চন্দ্র প্র্য়াত হলে নতুন সভাপতি হন অতুল চন্দ্র দাশগুপ্ত আর সম্পাদক পদে বৃত হন বিভূতি ভূষণ দাশগুপ্ত।

১৯৪৭ –এর ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয় আর মানভূম জেলাকে জুড়ে দেওয়া হয় বিহার রাজ্যের সঙ্গে। মানভূমের সমস্ত বাঙালী অফিসারকে বদলি করে দেওয়া হয় প্রশাসনিক স্তরে, অন্য জেলায়। এ ঘটনা ১৯৪৮ –এর। ডি আই দপ্তর থেকে নির্দেশনামা জারী করা হয় প্রাথমিক ক্লাস থেকে হিন্দী শেখানোর। জেলা স্কুল থেকে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হ’লো। স্কুল ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে হিন্দীতে লেখা সাইন বোর্ড বাধ্যতামূলক করা হয়। শুধু এইটুকুই নয়, মানভূম জেলায় হিন্দীকে অফিসিয়াল ল্যাংগুয়েজ করে দেওয়া হয় আর সমস্ত বাঙালী অধিবাসীকে ডমিসাইল সার্টিফিকেট দেখাতে বাধ্য করা হয়।

বাংলাকে মানভূম জেলার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাব ৪৩—৫৫ ভোটে হেরে গেল কংগ্রেস পার্টিতে—দিনটা ছিল ৩০মে ১৯৪৮। এই ঘটনার অভিঘাতে সভাপতি, সম্পাদকসহ ৩৫ জন কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্য কংগ্রেস দল ত্যাগ করেন মানভূম জেলায়। এরপরের ঘটনা একটু দ্রুত ঘটে। ১৪ জুন ১৯৪৮-এ পাকবিরা গ্রামে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করতে, বাংলাভাষীর ওপর জোর করে হিন্দী চাপিয়ে দেবার সরকারী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ‘লোক সেবক সংঘ’-র প্রতিষ্ঠা হ’লো। শুধুমাত্র বাংলা ভাষার জন্যে আন্দোলন –  এই প্রথম শুরু হলো, সারা বিশ্বে। অতএব এই সময়ের আন্দোলনকেই পথিকৃত বলে ধরতে হবে।

লোক সেবক সংঘ ওই আন্দোলনকে বিভিন্ন পর্যায়ে এবং স্তরে নিয়ে গেল, সত্যাগ্রহ আন্দোলন (১৯৪৯ থেকে ’৫১), হল-জোয়াল আন্দোলন আর টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন—এক কথায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব, একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন এবং একটি ভাষা আন্দোলন, যার অন্তঃস্থলে ছিল নিজের মাতৃভাষা ভাষা আর সংস্কৃতির জন্য প্রবল ও আন্তরিক ভালবাসা। এই উপলক্ষে অজস্র নতুন গান বাঁধা শুরু হ’লো, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল সেই গা গরম করা গান।মানভূমের মানুষজন জানতেন তাঁদের গানের অন্তর্নিহিত শক্তির কথা। শুধুমাত্র ভাষার জন্যে বাঁধা টুসু গান কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ “টুসু গানে মানভূম”। বইটির এক লাখ কপি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। এখনকার কোন লেখক কি কল্পনাও করতে পারবেন এক লাখ কপি বিক্রির কথা? এই ঘটনাতেই বোঝা যায় পারদের মাত্রা কি পরিমাণে চড়েছিল এই আন্দোলনের ফলে। অসংখ্য টুসু গানের মধ্যে “  শুন্‌ বিহারী ভাই / তোরা রাখতে লারবি, ড্যাং দেখাই / তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি / বাংলা ভাষায় দিলি ছাই”  জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে।

এই অবসরে টুসু গান নিয়ে দু’চার কথা বলা দরকার। এটা একটা ট্র্যাডিশনাল লোকগীতি যা মকর সংক্রান্তিতে গাওয়া হয়। এই গান শুনে শুনে শিখতে হয়। পদকর্তার নাম কেউ মনে রাখে না, জানতে চায় না, বলতেও পারে না। একই গান, বছরের পর বছর গাওয়া হয়, যেমন মহালয়ায় “ মহিষাসুরমর্দিনী”, কিন্তু গত ৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন নতুন গান বাঁধা শুরু হলো এবং লোকমুখে সেগুলির দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়া গ্রাম থেকে গ্রামে। তেমনই একটি গানের কথা “ বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে / মারবি তোরা কি করে / এই ভাষাতেই কাজ চলেছে / সাতপুরুষের আমলে / এই ভাষাতেই মায়ের কোলে / মুখ ফুটেছে মা বলে” ।

টুসু গানই ছিল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বিখ্যাত গায়ক পিটার সিগারের সেই অমোঘ উক্তি—‘’ Throughout history, the leaders of countries have been very particular of what songs should be sung. We know the power of songs.”। ১৯৫৪ সাল ছিল এই আন্দোলনের ভয়ংকরতম সময়। মিটিং, মিছিল বন্ধ করে দেওয়া হলো, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার নারী পুরুষকে আটক করা, অকথ্য অত্যাচার চালানো চরমে উঠল। এক কথায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলো চরম ভাবে। কিন্তু যে আন্দোলনের সঙ্গে মন প্রাণ জড়িয়ে থাকে, তাকে বলপূর্বক থামানো যায় না।

অতঃপর কেন্দ্রীয় সরকার, ১৯৫৫ সালে State Re-Organisation Commission গঠন করলেন। এই কমিশন মানভূম জেলা কেটে, বাঙালী অধ্যূষিত একটি নতুন জেলা (পুরুলিয়া) গঠনের ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখলেন।এর ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। প্রো-বিহারী জনগন ১৭ থেকে ২০জুন, ১৯৫৬ হরতালের ডাক দিলেন, অপর পক্ষে মানভূমের ধানবাদ অংশ বিহারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না স্থানীয় বাঙালী সমাজ। ফলে অসন্তোষ চলতেই থাকলো।

ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণ সিং যৌথ ভাবে বাংলা বিহার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব রাখলেন। আগুনে যেন ঘি পড়ল এই প্রস্তাবে। এর প্রতিবাদে “লোক সেবক সংঘ” খালি পায়ে অহিংস পন্থায় বিখ্যাত ‘’পদযাত্রা’’ শুরু করলেন পাকবিরা গ্রাম থেকে কলকাতা অভিমুখে, তারিখ বিশে এপ্রিল ১৯৫৬। ১০০৫ জনের সত্যাগ্রহী দল কলকাতায় পা রাখলেন ৭ মে, ১৯৫৬ এবং তৎক্ষণাৎ তাদের গ্রেপ্তার করা হলো।

পরে অবশ্য ওই প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায় ‘বাংলা- বিহার সীমানা নির্ধারণ বিল’ এনে যা লোকসভায় ১৭ আগস্ট ১৯৫৬-এ আর রাজ্যসভায় ২৮ আগস্ট তারিখে অনুমোদিত হয়।  অবশেষে পয়লা নভেম্বর ১৯৫৬ তারিখে ২০০৭ স্কোয়ার মাইল ও ১৬টি পুলিশ স্টেশন, ১১,৬৯,০৯৭ জনসমষ্টির পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবেঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ধানবাদ অবশ্য থেকে গেল তৎকালীন বিহারের সঙ্গেই।

মাতৃভাষার জন্যে প্রবল আবেগ শত বাধা বিপত্তিতেও লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারে নি ভাষা আন্দোলনকে। এই উদ্যোগ বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, ইতিহাসের পাতায় সোনার আখরে লেখা হয়ে গেছে সে কাহিণী।  এই দীর্ঘ ইতিহাসে অসংখ্য সেনানীর না্ম ও অবস্থান, সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবু পুরুলিয়ার ভাষা সংগ্রামীদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।তাঁদের মধ্যেও দু’জন মহিলার নাম আমি আলাদা করে উচ্চারণ করতে চাই, যথাক্রমে লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ও ভাবিনী মাহাতো। ইচ্ছুক যাঁরা, এঁদের সম্পর্কে আলাদা করে পড়ুন, এই স্বল্প পরিসরে সব লেখা সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমরা নতুন করে শপথ নেব, মনে রাখব বাংলা ভাষার জন্যে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনার কথা। সারা পৃথিবীতে ভাষার মাপকাঠিতে বাংলা ভাষার স্থান অতি উজ্জ্বল, কিন্তু স্বাধীন ভারতে এই ভাষা ক্রমেই বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অন্যকে দায়ী না করে, আসুন নিজেদের দিকে তাকাই। নিজেকেই প্রশ্ন করি আমিই কি এই ভাষার প্রতি যথেষ্ঠ যত্নশীল? যদি না হই, তবে এখনই ঘুরে দাঁড়াতে হবে, না হলে বাংলা ভাষার জন্যে অপেক্ষা করছে চতুর্থ আন্দোলন।

পরিচিতি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন