গঙ্গার দিকে মুখ ফেরানো এক ভাঙা বাড়ি । কাছেই এক ভাঙা ঘাট । নিত্যই নতুন করা হচ্ছে গঙ্গার বাকি ঘাট গুলো । এই ঘাটটিই সকলের নজর এড়িয়ে যায় । আরো একটু দূরের সুসজ্জিত ঘাট ‘রাধার ঘাট’ । সেখান থেকে যাত্রী বোঝাই ভটভটি নৌকো ছাড়ার ঘোষণা হচ্ছে মাইকে । আরেকটি ঘাট ‘নিয়াল্লিশপাড়া ঘাট’ , সেখান থেকেও মাইক ভেসে আসছে । শুধু পরিত্যক্ত এই ভাঙা ঘাটটি । এর নাম কি ভাঙা ঘাট ? যাত্রী বোঝাই নৌকো তেমন একটা এসে ভেড়ে না এ ঘাটে । এক-দুজন স্নান করতে যায় । তাছাড়া ভিড় জমে না এ ভাঙ্গা ঘাটে । চারপাশটা বেশ জংলা । একটা বুড়ো পাকুড় গাছ ঝুঁকে আছে গঙ্গার জলে । এ গল্প ভাঙা ঘাটের গল্প নয় । যদিও পাঠক দেখুন এ গল্পের নাম ‘ঘাট’ ।
গঙ্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ভাঙা বাড়িতে বাসিন্দা আছে । আপাতত বাড়িটির ভাঙা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । বাসিন্দার বয়স ছেচল্লিশ হল আজ । বাসিন্দাটি পুরুষ না মহিলা না হিজরে সে প্রসঙ্গ থাক । মানুষ বটে । পশু-পক্ষী , ভুত-প্রেত নয় । মাঘী পূর্নিমার রাত আজ । রাধার ঘাট , নিয়াল্লিশ পাড়া ঘাট থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নৌকো পারাপার চলে । এই ভাঙা ঘাটে কখনো সখনো মাছধরার মাঝি-নৌকোগুলো ভেড়ে । আঁশটে গন্ধ গঙ্গার বাতাসে ভর করে ভাঙা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে । কিছুক্ষণ থেকে আবার গঙ্গার নির্মল হাওয়ায় আঁশটে গন্ধ মিলিয়ে যায় । বাড়ি টা বেশ পুরোনো । কড়ি-বরগার ছাদ । খড়খড়ি দেওয়া জানালা । ক্ষয়ে যাওয়া কবেকার সবুজ শেওলা ধরা রঙ জানালা দরজায় । এ গল্প ভাঙা বাড়িটার গল্পও নয় । তাহলে পাঠক হয়ত এ গল্পের নাম দেখতে পেতেন ‘বাড়ি’ ।
একটু পর চাঁদ উঠবে । একটু পর পূর্নিমার আলোয় ভাসবে গঙ্গা । গঙ্গায় কত কি ভেসে যায় । আর ‘ও ও ও মা পতিত পাবনি গঙ্গে’ ভেসে যায় পূর্নিমার জ্যোৎস্নায় । একটু পর ভাঙা বাড়ির বাসিন্দা এসে দাঁড়াবে ভাঙা ঘাটের পাশে বুড়ো পাকুড়ের তলায় । মাঘী পূর্নিমায় তার জন্ম । কে বা তাকে পায়েস রেঁধে দেয় । কে বা রাখে তার জন্মদিনের হিসাব । আসল বাড়ি খাগড়ায় । মুর্শিদাবাদের খাগড়াই কাঁসার নাম সবাই জানে । বাসিন্দাটির পারিবারিক সূত্রে মস্ত কাঁসার দোকান খাগড়ায় । বাবা মা ভাই বোন সকলেই দিব্য আছে দোকান সংলগ্ন আদি বাড়িতে । বাসিন্দাটি শুধু বাস করে গঙ্গার এই ভাঙা ঘাটের ধারে কোন কালের পুরোনো এই ভাঙা বাড়িতে । বাসিন্দাটি পুরুষ ও না মহিলাও না হিজরেও না । তবে কি ? মানুষ তো বটে । আচ্ছা এই গল্পটি কি তাহলে এই বাসিন্দার ? না । তাহলে পাঠক অবশ্যই দেখতেন যে গল্পটির নাম রাখা হয়েছে ‘বাসিন্দা’ ।
এবার খুব অতিষ্ট পাঠক উঠে যাবেন গল্প পড়া ফেলে রেখে । না কি পড়েই ফেলবেন । এক পাঠক তো ইতিমধ্যে পাতা উলটে দেখেও নিলেন গল্পটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ । ধুর তত বড় তো নয় । পড়ে ফেলা যাক । রহস্য রোমাঞ্চের গন্ধ আসছে যেন । না পাঠক এ গন্ধ রহস্য রোমাঞ্চের নয় । বাসিন্দার ভাঙা বাড়িতে একটি পাম্প স্টোভে ভাত ফুটছে । ফ্যান উথলে উঠলে ঐরকম গন্ধ বেরোয় । নাক টেনে গন্ধ শুঁকে দেখলে টগবগে ফুটন্ত ভাতের গন্ধ পাঠক পেয়ে যাবেন । ভাতে দেওয়া শীতের নতুন আলুর গন্ধও পাবেন । কি কান্ড বলুন তো ! শেষে কি না আলু সেদ্ধ-ভাতের গপ্প ! না তাহলে তো গল্পের নাম রাখা হত ‘ভাত’ । বাসিন্দাটি সেদ্ধ ভাত একটু সরষের তেল আর কাঁচা লংকা মেখে খেয়ে নেবে একটু পর । ক্ষিদে পেয়েছে বৈ কি তার । আজ তার জন্মদিন । কে বা তাকে পায়েস রেঁধে দেয় । কে বা মনে রাখে । কাঁসার বাসন তৈরির কারখানার শিল্পী গুলোর হাতে নিশ্চয়ই নানান নকশা ফুটে উঠছে । কত পুরুষের ব্যবসা তাদের । ছোটোতে এই বাসিন্দাটি নরেশ কাকার কাছে বসে দেখত সোনা রঙ এর কাঁসার বাসনের গায়ে আশ্চর্য নকশা ফুটিয়ে তোলার কেরামতি । কত হবে বাসন্দাটির বয়স তখন ? পাঁচ ছয় সাত ... বাচ্চা মানুষ । স্কুলের পড়া তৈরি করে এসে বসত । সেই নরেশ কাকা বুড়ো হল । তবু বাসিন্দার এই ভাঙ্গা বাড়িতে এসে দ্যাখা করে যায় মাঝে মাঝে । পাম্প স্টোভের আরেকবার পাম্প করে বাসিন্দা । উবু হয়ে বসে পাম্প করতে শুরু করতেই পেটে সেই মোচড় দিয়ে উঠল । না ক্ষিধের মোচড় নয় । তলপেটে । আজ মাসের কত তারিখ ? ওহ বাসিন্দা তাহলে মহিলা ? এতক্ষণে পাঠক নিশ্চিন্ত হলেন । মাসিকের তারিখ আর মেয়েরা ছাড়া কারা গুনবে ? পুরুষ রাও গোনে । তাদের স্ত্রী দের মাসিকের তারিখ। সেফ পিরিয়ডটা মাথায় রাখতে হয় । নইলে একটা বিপদ হলেই আবার অ্যাবর্শন করাতে ছোটাছুটি । কাজ কম্ম যার যা আছে ফেলে রেখে বিরক্তির একশেষ । এই জন্য একটা দুটো গার্লফ্রেন্ড রাখার চেষ্টা করে মিউনিসিপ্যালিটির ক্যাসুয়াল সুইপারটা থেকে রাজা গজা শ্রেণীর সকলে । পেট বেঁধে গেলে নিজের বুঝ নিজে বুঝে নেবে মেয়েগুলো । পাখোয়াজ মেয়ে সব । বেশি কাঁইমাঁই করলে বলে দিলেই হল ‘কা’কে দিয়ে পেট বাঁধিয়েছো তার ঠিক আছে? আমার ঘাড়ে চাপাতে এসো না’ । ব্যাস টাইট । এবার পুরুষ পাঠক ক্ষেপে উঠছেন তো ? আরে মাসিকের পেট মোচড়ের কথা যখন হয়েই গ্যালো তখন এত ভ্যান্তারা ভাজা কেন বাপু । বিরক্তি নিয়ে লেখক থুড়ি লেখিকার নাম টা দেখে নিলেন আরেকবার পুরুষ পাঠক রা । কে এটা , নাম ধাম শোনেননি আগে । ধুর । ‘আজকাল শালা যে কেউ গপ্প ফেঁদে বসে, আর ছাপাও হয় শেষমেস’ । ভুল করছেন শালা না শালী । লেখিকা দেখলেন না ? ‘লে হালুয়া এ তো গপ্প বলতে এসে জ্ঞানও ঝাড়ে ...’ ছুঁড়ে ফেলে দেবেন ? নাহ আবার পড়তে শুরু করলেন আদৌ মাল টা ঠিক কি গপ্প লিখেছে দেখার ইচ্ছেটা জেগে গেছে এত ভ্যান্তারা শুনে । মহিলা পাঠকরা ক্লান্তি বোধ করছেন । ধুর সেই মাসিক , অ্যাবর্শন এর কথা , আর ভাল্লাগে না ।
আবার পেটে মোচড় । মুখ কুঁচকে গেল বাসিন্দাটির । ভাত ফুটে উথলে পড়ছে । এখুনি না নামালে গলে যাবে । পাশে রাখা ভাতের হাঁড়ি ধরা ন্যাতাটি দিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে গড় দেয় একটা ডেচকির ওপর । তারপর পেট চেপে ধরে উঠে দাঁড়ায় । হ্যাঁ থাই বেয়ে নামতে শুরু করল । পাশের ঘরে প্যাডের প্যাকেট রাখা । স্টেই ফ্রী । কোথায় একটা বড় হোর্ডিং এ স্টেই-ফ্রীর বিজ্ঞাপনে থাই বের করা পেট বের করা , বুক প্রায় বের করা এক মডেলের ক্যাপশন দেখেছিল ‘উই মেনস্ট্রুয়েট’ । গর্বের সঙ্গে হাসি মুখের মডেল । ভাঙ্গা ঘরের বাসিন্দাটি ঐ প্যাড পরে নেয় । কিন্তু ঐ মডেলের মতো বলতে পারে না হাত তুলে ‘উই মেনস্ট্রুয়েট’ ।
‘চির দারিদ্রকে যিনি বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত নহেন , তিনি যেন চিকিৎসা কার্যে ব্রতী না হন’ – ছাত্রদের বলতেন ধন্বন্তরী গঙ্গাধর কবিরাজ । তাঁর শিষ্যদের মুখে মুখে এ কথা প্রচারিত হতে থেকেছে । আয়ুর্বেদ চর্চার ব্যপ্তি ঘটেছে অনেক । ১৭৯৮ খীষ্টাব্দে , বাংলা ১২০৫ সালের ২৪ আষাঢ় যশোহর জেলার মাগুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা বৈদ্যবংশের বিশিষ্ট পন্ডিত ভবানীপ্রসাদ রায় । পারিবারিক সূত্রে আয়ুর্বেদ চর্চার পরিবেশ । আঠারো বছর বয়েসে রাজশাহী জেলার বৈদ্য বেলঘরিয়ায় প্রখ্যাত কবিরাজ পন্ডিত রামকান্ত সেনের কাছে শিক্ষার জন্য যান । চিকিৎসা শাস্ত্রে অসামান্য পারদর্শীতা অর্জন করেন খুব তাড়াতাড়ি । কলকাতায় আসেন কর্মজীবন শুরু করার জন্য । পরে চলে আসেন মুর্শিদাবাদের সৈদাবাদে। সেখানেই বসবাস ও কর্মজীবন শুরু করেন । ছাত্র তৈরির কাজেও ব্রতী হন । কাশিমবাজার রাজবাড়িতে তাঁর বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয় । মহারাণী স্বর্ণময়ী দেবীর কঠিন অসুখ সারিয়ে দেন গঙ্গাধর কবিরাজ মহাশয় ।ধন্বন্তরী নামে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । মারা যান ৮৬ বছর বয়েসে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে , ১২৯২ বঙ্গাব্দের ১৯ জৈষ্ঠ । শিষ্য ছাত্র এবং উত্তরসুরীদের জন্য রেখে যান আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের ওপর ১১ খানি গ্রন্থ আরও কিছু সাহিত্য ও দর্শন গ্রন্থ , নামকরা ছাত্র কবিরাজ শ্রী ইন্দুভূষণ সেন এর মতো আরও কিছু নিমগ্ন ছাত্র । সময় বয়ে গেছে তারপর যেমন যায় আমাদের ভাঙ্গা বাড়ির বাসিন্দার ভাঙ্গা ঘাট হয়ে গঙ্গার স্রোত । এবার পাঠক পাঠিকা আরও বিরক্ত কিন্তু কৌতুহলিও নিশ্চয়ই । গল্পটার সঙ্গে গঙ্গাধর কবিরাজের যোগ কোথায় । হুম নিশ্চয়ই জন্ম নিরোধক কিছু আয়ুর্বেদিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে । মাল টা পেট বাঁধিয়েছিল , কবিরাজি জড়িবুটি খেয়ে খালাস করছে । অথবা এমন কোনো কবরেজি ওষুধ খেয়ে ভাঙ্গা ঘাটের ধারে ভাঙ্গা বাড়িতে নিশ্চিন্তে বেশ্যাগিরি চালাচ্ছে । পাঠক পাঠিকা ক্রুদ্ধ হবেন না আমার এই ভাবে গপ্প বলতে বসায় । আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাই আমি জানি যে আপনারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত রুচিশীল পাঠক পাঠিকা । এভাবে মনে মনে ভেবে ফেলেন আর কি, মুখে বলেন না । এই গপ্পের গঙ্গার ধার বসবাসকারী বাসিন্দা টির মাসিকের পেট মোচড় দেওয়ার সঙ্গে শ্রদ্ধেয় গঙ্গাধর কবিরাজের যোগসূত্র একটিই – ১৯২০ খৃষ্টাব্দে সৈদাবাদ অর্থাৎ ধন্বন্তরী মহাশয়ের নিবাস এলাকায় স্থাপিত হয় রাষ্ট্রীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসালয় , যেখানে আমাদের বাসিন্দাটির পারিবারিক কাঁসা শিল্পী নরেশ কাকার বাড়ি । নরেশ কাকার বাড়িতে সে অনেক আয়ুর্বেদ এর পুরোনো সব গ্রন্থ দেখেছে । নরেশ কাকার পূর্ব পুরুষ কেউ কবিরাজ ইন্দুভূষণ সেনের ছাত্র থেকে থাকবেন ।
আমাদের ভাঙ্গা বাড়ির বাসিন্দাটি এতক্ষনে পেট চেপে এসে দাঁড়িয়েছে ভাঙ্গা ঘাটে পাকুড় গাছ তলায় । হলই বা মাঘ । শীতের কনকনে হাওয়া গা কেটে দিচ্ছে যেন ফালা করে । তবু জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া গঙ্গার তীরে এসে সে দাঁড়াল । কাছেই শ্মশান ঘাট থেকে মড়া কান্নাও ভেসে আসে দিনরাত । ইলেকট্রিক চুল্লীতে তোলার আগে মৃত ব্যক্তির লোকজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । সুশিক্ষিত রুচিশীল বাড়ির মড়া হলে তেমন কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায় না । কাতার দিয়ে গাড়ি আর বাইক এর ভিড় হয় । নামকরা কেউকেটারা কেউ গত হলে বা কোনো দুর্ঘটনা মানে খবের গন্ধযুক্ত কিছু হলে সাংবাদিকদের ভিড় । এই মাঘী পুর্ণিমার রাতে অবশ্য অনেকক্ষণ থেকে একটা মড়া কান্না শোনা যাচ্ছে । পেট চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বাসিন্দাটি । প্যাড ভিজে যাচ্ছে গলগল করে । ইলেভেন ক্লাশে পড়ার সময় শুরু হয় । মেয়েদের মাসিক শুরুর নরম্যাল বয়েস পার করে , না ? বেশ দেরিতে । স্কুল ছেড়ে দিতে হয় । বাড়িতে তুমুল কান্ড শুরু হয় ওর মাসিক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে । বাবা কাকাদের মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি । পুরো পরিবারের মাথা হেঁট । স্কুলে ক্লাস চলাকালীন শুরু হয় । প্যান্ট ভিজে বেঞ্চে রক্ত লেপটে একশা । ও হতচকিত । সহপাঠীরা তুমুল হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি করতে থাকে । হেড টীচার ফোনে ডেকে পাঠায় ওর বাবা মা কে । এসে নিয়ে যান ওরা । কি লজ্জা । কি অপদস্থ হওয়া । ওর মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যান বাথরুমে । এত বড় ধুম্বো কে পুরো উলঙ্গ করেন । প্যাড নেওয়া দেখিয়ে দেন । তারপর এসে লুটিয়ে পড়েন শোবার ঘরের বিছানায় । পরিবারের মাথারা গোল টেবিল বৈঠকে বসে অ্যালোপ্যাথি না হোমিও না কবিরাজি এই নিয়ে । নরেশ কাকা শুধু এই কংসবনিক পরিবারের কাঁসা শিল্পী মাত্র নন । একজন বিশিষ্ট সদস্যও । নরেশ কাকা মাথা নেড়ে বলে ‘এরকম খুব কম হয় , অ্যালোপ্যাথিতে চিকিৎসা করে লাভ নেই , অপারেশন করতে বলবে । তাতে প্রাণসংশয় হতে পারে । কবিরাজি কিছু চিকিৎসা আছে । নিয়ম মেনে চললে সুস্থ থেকে যাবে , বড় কবিরাজ দ্যাখাতে পারেন’ । বাড়ির প্রধানরা সেসব কানে তোলে না । ওকে নিয়ে কলকাতা ব্যাঙ্গালোর বিস্তর ছোটাছুটি করে । সর্বত্র একটাই কথা ডক্টরদের ওর অপুষ্ট ওভারি কেটে বাদ দিতে হবে । তাহলেই ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে । কিন্তু নরেশ কাকা বারবার আপত্তি জানায় এতে । ওর বাবা মা অপারেশনের সিদ্ধান্তই নেন ।
কংসবনিক বাড়ির ছেলে সুলগ্ন কংসবনিক যখন ক্লাস এইটের ছাত্র , বালক অবস্থা হঠাৎ একদিনে পেরিয়ে গেল যেন । ছেলেদের কমবেশি এরকমই হয়ে থাকে । গলার স্বর ভেঙ্গে যায় । হাত পা গুলো না বালক বেলার মতো কোমল থাকে না বাবা কাকা দের মতো শক্ত পোক্ত হয়ে ওঠে । বিশ্রী লাগে নিজেকে নিজেদেরই । গালে হালকা রোম গুলো হঠাত বড় হয়ে উঠছে । গোঁফ গজিয়েও গজাচ্ছে না । সুলগ্ন কংসবনিকের না বালক না কিশোর বেলা উপস্থিত । মার্চ মাসের প্রচন্ড তাতে তপ্ত হয়ে স্কুলের ব্যাগ কাঁধে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বাড়ি ফিরছে । সাইকেল টা ঘচাং করে থামায় বাড়ির গেটে ধাক্কা দিয়ে । ওদের বাড়ি লাগা পাশের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে নতুন কাকীমা । পাড়ায় নতুন কেউ বিয়ে হয়ে এলেই সে নতুন কাকীমা হয়ে যায় সুলগ্নদের বয়সী ছেলে মেয়েদের কাছে । এই তো সেদিন বৌভাত ছিল । ওবাড়ির অনেক অতিথি সুলগ্ন দের বাড়িতে থেকেছিল বিয়ে বৌভাতের ক’দিন । এই মার্চের গরমে পড়ন্ত বেলায় ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে নতুন বৌ টি । গঙ্গার হাওয়া আসে সুন্দর । ছাদের রেলিং ধরে নতুন কাকিমার ঝুঁকে থাকা দেখে আচমকা হাত পা শিরশির করে ওঠে সুলগ্নর । কেমন যেন একটা কাঁপুনি ধরা অনুভুতি । নতুন বৌ টি রেলিং এ বুক চেপে দাঁড়িয়ে । রেলিং টা কোমর অবধি উঁচু । কিন্তু বৌ টি ঝুঁকে রেলিং এ বুক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে । স্তন দুটি ঈষৎ চেপে গেছে রেলিং এ চাপ লেগে । সুলগ্নকে দেখে হাসে সুন্দর করে । সুলগ্ন’র কান মাথা কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে থাকে । তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে হুড়মুড় করে সাইকেল নিয়ে বাড়ির গেট ঠেলে ঢুকে পড়ে । নরেশ কাকা সেসময় বাইরে বেরিয়ে আসছিল । সুলগন কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ওর নিজের ঘরে চলে যায় । উপুড় হয়ে বিছানায় নিজেকে যতটা সম্ভব চেপে ধরে শুয়ে থাকে ছেলেটা । কি যেন একটা হতে চলেছে । কি যেন একটা হয়ে যায় । ওর পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ব্যাথা করতে থাকে । ছেলেটা আরও চেপে ধরে বিছানার সঙ্গে নিজেকে । নিজেকে হঠাত পাশের বাড়ির দোতলা ছাদের রেলিং বলে মনে হয় । চোখে অন্ধকার নেমে আসে । প্রথম স্খলন হয় ছেলেটার । পুরুষ হয় ছেলেটা । নরম্যাল আর পাঁচটা ছেলেরও কোনো না কোনো একদিন এরকম হয় । সুলগ্নর বালক বেলার অবসান ।
আমাদের ভাঙা ঘাটের ধারে ভাঙা ঘরের বাসিন্দার যখন ক্লাস ইলেভেনে মাসিক শুরু হওয়া নিয়ে পুরো কংসবনিক পরিবারে ঝড় বইছে , অপারেশন করে অপুষ্ট ওভারি কেটে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে , সুলগ্ন কংসবনিক ছেলেটি প্রতিবাদ করে ওঠে । কিছুতেই ও মেনে নেবে না এটা । ও অপারেশন হতে দেবে না । রমেশ কাকার সঙ্গে এক কবিরাজের সঙ্গে কথা বলেছে সুলগ্ন । খুব কম এরকম হয় । তবে হয় । মাসের ক’টা দিন যদি সহ্য করে নেয় তবে সুস্থ জীবন কাটানো সম্ভব । কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে শুধু । আর কিছু কবিরাজি ওষুধ । সুতরাং সুলগ্ন অপারেশন হতে দেবে না । আমাদের গল্পের বাসিন্দা টি’র বাবা গর্জে ওঠেন । মা চিৎকার করে বলে ‘শেষে আমার পেটে হিজরের জন্ম হল , জন্মের সময় বোঝা গেলে আমার আজ এই দিন দেখতে হত না ঈশ্বর’ । কাকা বলে ‘যা রে সুলগ্ন হাতে তালি দিয়ে পয়সা কামানোর পথ ধর , কাঁসার ব্যবসা তোর জন্য না’ । রমেশ কাকা ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে । সৈদাবাদ এ যেখানে ধন্বন্তরী গঙ্গাধর কবিরাজের কর্মভূমি ছিল । আমাদের ভাঙা ঘাটের ভাঙা ঘরের বাসিন্দাটির নাম সুলগ্ন কংসবনিক । খাগড়ার নাম করা কংসবনিক পরিবারের ছেলে । অদ্ভুত তার দেহের কলকব্জা । এক সঙ্গে সে সম্পূর্ন সুস্থ একটি পুরুষ । কিন্তু শরীরে মধ্যে আছে একটি অপুষ্ট স্ত্রী অঙ্গ । পুরো মাস সে পুরুষ , মাসের কয়েকটি দিন সে নারীর অনুভুতি বোধ করার অধিকারি । সে নপুংসক নয় । সে একই অঙ্গে নারী ও পুরুষ । সুলগ্ন নারী অঙ্গটি কেটে বাদ দিতে চায় নি । সে আলাদা । কিন্তু সে অসুস্থ তা মানতে নারাজ । সে দেহে মনে পুরুষ । যেকোনো সুস্থ পুরুষের মতই তার পুরুষাঙ্গের উত্থান পতন । মাসের ক’টি দিন সে নারীর অনুভুতি বুঝতে সক্ষম ।
পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে থাকে আমাদের ভাঙ্গা ঘরের বাসিন্দা সুলগ্ন । দীর্ঘদিন অকৃতদার রমেশ কাকার বাড়িতে কাটায় । প্রথাগত পড়াশোনায় বাধা আসায় স্কুল কলেজে যাওয়া হয় না ওর । বন্ধু রা কথায় কথায় হাতে তালি দিয়ে দ্যাখাত , হিজরে বলে খ্যাপাত । ও নপুংসক নয় । যদি নপুংসক হত ও মেনে নিত কিন্তু এই মিথ্যা আরোপ ও মেনে নেবে না । পড়াশোনা করতে থাকে আয়ুর্বেদ নিয়ে । রমেশ কাকার চেনা এক কবিরাজের বাড়িতে দিনরাত পড়াশোনা করতে থাকে । রমেশ কাকার পূর্ব পুরুষদের কেউ কবিরাজ ইন্দুভূষণ সেনের ছাত্র হওয়ায় প্রচুর প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের গ্রন্থ পায় সে । ওর শিক্ষক কবিরাজ সুলগ্ন কে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা দান করেন । প্রাচীণ পুঁথি পত্র পড়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকে সুলগ্ন । বড় হয় । তরুণ বয়েস আসে তার । সুপুরুষ বলিষ্ঠ সে । যেকোনো নারী মনোগ্রাহী পুরুষ সে । কিন্তু সে জানে যে কোনো নারী যে মুহূর্তে তার বিশেষ দৈহিক অবস্থার কথা শুনবে কিছুতেই তাকে পুরুষ বলে মেনে নেবে না । একসময় সুলগ্নর শিক্ষক কবিরাজ মারা যান । তাঁরই পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত একটি ভাঙ্গা প্রাচীন বাড়ি গঙ্গার ভাঙ্গা ঘাটের ধারে । কেউ থাকে না সেখানে । খাগড়ার প্রতিষ্ঠিত কংসবনিক পরিবারের ছেলে সুলগ্ন কংসবনিক পুঁথিপত্র সহ উঠে আসে এই ভাঙ্গা ঘাটের বাড়িতে ।গঙ্গার ওপারে নিয়াল্লিশ পাড়া গোয়ালজান পঞ্চায়েত এলাকা , রাধার ঘাট পঞ্চায়েত এলাকায় ঘুরে ঘুরে দরিদ্র কৃষক পরিবার গুলির সেবা করে । দূর থেকে কিছু রুগী আসে ওর ভাঙ্গা ঘরে । চাল ডাল তেল নুনের জোগাড় হয়ে যায় ।রাতে স্বপ্নে দেখতে পায় গঙ্গাধর ধন্বন্তরীকে । শুনতে পায় “‘চির দারিদ্রকে যিনি বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত নহেন , তিনি যেন চিকিৎসা কার্যে ব্রতী না হন” ।
মাঘী পূর্নিমার রাত । পেটের মোচড় অনেক কমেছে বাসিন্দাটির । গঙ্গা ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে কত কি , গঙ্গাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে যেন আজকের আকাশ ভাঙ্গা জ্যোতস্নার ঢল । শ্মশান থেকে ভেসে আসা মড়া কান্নাও থামল যেন । ক্ষিদে টা চাগাড় দিয়ে উঠছে বাসিন্দার । পাঠক পাঠিকা এখন নিশ্চিন্ত যে গল্প টা এখানে শেষ । এবং ভ্রূ কুঁচকে ভাবছেন ফালতু সময়টা নষ্ট হল কিনা । ভাবতে ভাবতেই দেখছেন গল্পটা এখনও শেষ হয়নি । গল্প কি শেষ হয় আদৌ ? আরও কয়েক লাইন যেন লেখা আছে নীচে । আর সেটাও পড়ে ফেলছেন ।
কি একটা এসে ঠেকল যেন ঘাটে । বড় কিছু ভেসে এল । গঙ্গার স্রোত তো সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় । কচিৎ কখনও এসে ঠেকে কোনো পশুর পচা গলা দেহ । কাঠে গুঁড়ি ও ভেসে আসে । আবার একটা বাঁশ জাতীয় কিছু দিয়ে ঠেলে দিলে স্রোতে ভেসে যায় । হবে সেরকম কিছু । গোঙানি যেন । মানুষ দেহ কোনো ! প্রাণ আছে ! বাসিন্দা টি ভাঙ্গা ঘাটে জলে নামে । এক নগ্ন নারী দেহ । পাঁজা কোলা করে তুলে ভাঙ্গা ঘরে নিয়ে আসে । শুইয়ে দেয় মেঝেতে । কবিরাজ সুলগ্ন কংসবনিক নাড়ী টিপে দেখে । প্রাণের মধ্যে আছে আরেকটি প্রাণ । অল্প স্ফীত উদর মেয়েটির । গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল দুটি প্রাণ একসঙ্গে নিশ্চিণহ করার উদ্দেশ্যে । মরা কি এত সহজ ? বাঁচাই কি এত সহজ ? ভাবে ছেচল্লিশ বছরের সুলগ্ন কবিরাজ । তার পুরুষের শরীর নারী শরীরের নিয়ম মানে মাসে ক’টি দিন । বিছানার চাদর দিয়ে যত্নে ঢেকে দেয় নগ্ন নারী শরীরটি । সুশ্রূষা শুরু করে ...... এক দেহে দুটি প্রাণ । যে আসছে সে নারী না পুরুষ , না নপুংসক , না কি তার মত পুরুষের দেহে নারীর নিয়ম মেনে চলা কোনও প্রাণ । সে তো মানুষ । মানুষের দেহ থেকে জন্ম নেওয়া নতুন এক প্রাণ । প্রাণের আর অন্য কিই বা নাম আছে ......
পরিচিতি
পরিচিতি
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন