ভাষায় ভেসে ভেসে চলেছি সেই মুখে ভাষা ফোটার দিন থেকে তবু ঠিকঠাক ফুটে উঠতে পারল কি? ভাষায় আন্দোলন সেও তো ক্রমাগত চলছেই তবে আন্দোলন অর্থে ভাঙ্গাগড়া। যে ভাষায় নিতি নিতি কথা বলছি ভাবছি প্রকাশ করছি সেই ভাবনার স্বপ্ন দেখছি তার মধ্যেও থেকে যাচ্ছে গোলমাল। মনের ভাষা আর মুখের ভাষা এক হয় কি? যদিও মহাজনে বলে গেছেন দুটোকেই এক করতে ( এ যেন সেই সুদখোর মহাজন ভেবে বসবেন না), কিন্তু সহজ ভাষায় বলছি তা সম্ভব নয় মোটে। এই যেমন ছেলে পেটানো শুধু রাগ দেখাতে নয় ভালবাসা যে অনেকটাই থাকে সে কথা বলা চলে না তাহলেই আলগা আহ্লাদ দেওয়া হয়, স্বামীর পছন্দ করে কিনে আনা সব শাড়িই যে পছন্দ হয় না তা বলতে গেলে... আর নাই বা বললাম, পাশের বাড়ির রান্নাঘর মডিউলার হচ্ছে দেখেও এ বাড়ির গিন্নীর মাথা ঠিক রাখা কতটা কঠিন সেসব কথা বলতে গেলে এ লেখার শিরোনাম দিতে হবে – ভাবের ঘরে চুরি। আমার সে উদ্দেশ্য নয় তবে কিনা এসব কথা একেবারে ফেলনা তো নয়।
এই পৃথিবীর সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে সবকিছু এই যেমন ছোটবেলায় পড়া ‘বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ ... ’ এই সব ছড়া মেনে ঋতু আজকাল আর চলে না, পুরনো দিনের ফোনগ্রাফ গা ঝেড়ে হয়ে গেছে গ্রামোফোন, টরেটক্কা যে কি এই প্রজন্ম জানবেও না হয়ত কোনোদিন, কুল মানে যে আজকাল হট’ও হয় তাতো এখন বুঝতে পেরেছি, আতা নামের সুস্বাদু ফলটি ‘কেলানে’ সহযোগে যে কি পরিমাণ লেজে গোবরে হয়ে ওঠে তা আর পাঠককে বলতে হয়না। এমনকি গড়ের মাঠের মত প্রকাণ্ড জায়গা পকেটে সেঁধোলে যে মানেটাই বিপরীত হয়ে যায় এও কি ভেবে দেখেছি কখনো? ঝক্কাস্, ঝিঙ্কু, সেন্টু, মাল্লু,বিন্দাস এসব শব্দের ভিড়ে আসল শব্দগুলো যে কোথায় গেল তা আর জানতে চাইবে না কেউ কোনোদিন।
কখনো কখনো মিথ্যের আবরণটা থাকলেই যেন বেশী ভাল লাগে, ডুয়ার্সের সবুজ দেখে যদি ভাবি এসব ক্লোরোফিলের খেলা, বিবাহবার্ষিকীর উপহারের চুনির আংটিতে যদি ক্রোমিয়ামের আধিক্য দেখি তাহলে সকালগুলোই মাটি, তার চেয়ে সবুজে থাক প্রাণের পরশ, লালে থাক প্রিয়তমের প্রেম, চেতনায় জাগুক পান্না। গায়ের রং কালো হলে কি রাঙা বৌ হয় না নাকি মাটির ঘরে জন্মালে মা ছেলেকে রাজপুত্তুর বলে না। আমার বেশ কালো জামাইবাবুকে তো আমার মা বলেন কালচে লাল, ফর্সা না হওয়ার দুঃখের চেয়েও তার সাদা মনের দিকটাতেই মনোযোগ বেশী। সেই ‘গিফট অফ দা ম্যাজাই’ গল্পের নায়ক যখন বিহ্বল দৃষ্টিতে নায়িকার বাদামী ঝর্নার মত চুলের অভাব সত্ত্বেও পূর্ণ প্রেমের সাথে বলে ‘খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়’ তখন সেকি আর মিথ্যে থাকে? কিংবা মা যখন বলেন "ফটিক আমার হাড় জ্বালাতন করিয়াছে।" তখন সেটাই বা কেমন সত্য? ভাষা সেখানে শুধু জিহ্বার অধীন থাকে না, প্রাণের সাথে মিশে হয়ে ওঠে স্বর্গীয়।
‘ভাষা প্রবাহ নদী প্রবাহের মত’ এ কথা আমার নয়, স্বয়ং প্রমথনাথ বিশী মশাই বলে গেছেন সুবোধ বাবুর ‘ভারত প্রেমকথা’ র ভূমিকায়। নদীপ্রবাহের গতি দেশদেশান্তরে আর ভাষার দেশকালের ওপারে। স্রোতে ভেসেই কত দেশের শব্দ চলে যায় কত নতুন দেশে কখনো মূল রূপে যেমন মাস্টার মশাই(master) আবার কখনো কায়াবদলে যেমন ‘গুলাচি’- চীনা শব্দ, হয়ে গেল গুল(ফুল)। এদিকে ‘ফুল’ নিজেও যে বার্মিজ শব্দ যেমন কিনা ‘লুঙ্গি’, ভাবা যায় বাঙালী জীবনের অতি পরিচিত জিনিষ দুটি বলতে কিনা পড়শি দেশের শব্দমালাকে দরকার? যে ‘ম্যালেরিয়া’ বাঙালীর ঘরে জলভাত তা কিনা ইটালি থেকে আমদানি, আর এ রোগে ভুগে যখন ‘সাগু’ খেয়ে মরি তখন কি ভাবি সেটি মালয় থেকে এসেছে? খাব আর কি? জিনিষের ‘দাম’ যে হারে বাড়ছে, রাজ্য আর ‘কেন্দ্র’ দায় নিয়ে লোফালুফি করছে তাতে কি মনে আনা যায় এগুলি গ্রীক শব্দ। আমাদের বসন্তের ‘আবির’, এয়োতির ‘সিঁদুর’, ‘গেঞ্জি’,’কামিজ’ ‘বোতাম’, ‘আতর’ ‘পায়জামা’ তে সুসজ্জিত ‘দিলদার’, ছুটির দিনে রক কাঁপানো ‘তাস’ এর দেশের রুইতন ইসকাপনের দল, কত আর বলি? বলতে বলতে ‘ফুরসৎ’ হবে না। এমন কি আমাদের ছেলেদের ভয় দেখাতে ‘জুজু’ অবধি এসেছে আফ্রিকা থেকে। আমাদের দেশ দীর্ঘদিন বিদেশী শাসনে থাকার প্রভাব স্বরূপ আরবি, ফার্সি, তুর্কি, পর্তুগীজ, ইংরেজি ও আরও নানা দেশের শব্দ এদেশীয় ভাষার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে।
ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা যদিও ৫২’ র আন্দোলনকেই এক ডাকে চিনি তবু মনে রাখা প্রয়োজন ভাষার জন্য আন্দোলন কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই হয়েছে, ১৯৪৮ সালের বিহার সরকারের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি ভাষার প্রতিবাদে মানভুম অঞ্চলের মানুষের আন্দোলনের ফসল আজকের পুরুলিয়া জেলা। বাংলা ভাষার জন্য সেখানকার মানুষও অকাতরে দিয়েছেন প্রাণ হেলায় করেছেন কারাবরণ। ৬১’র মে মাসে শিলচরে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ফল ১১ জনের মৃত্যু এবং কতশত বাঙালী পরিবারের অসহায় দেশত্যাগ। অসমীয়া ভাষাকে সরকারী ভাষা বলে মানতে পারেননি সেখানকার দশ লক্ষাধিক বাঙালী, আবার এই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ওড়িয়া মানুষেরা। কটক, পুরী, বালাসোর নিয়ে সম্পূর্ণ এলাকা তখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীন যেখানে ডাক্তার, মোক্তার, মাস্টার থেকে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব মানুষেরাই ছিলেন বাঙালী এবং বাংলা তাদের কাজের ভাষা, এমন কি স্কুল কলেজ, আদালতেও বাংলাই সরকারী ভাষার সম্মান পেত। এ নিয়ে ১৮৬০ থেকেই বিক্ষোভ ছিল যা আন্দোলন হয়ে ওঠে ১৮৭২ এ একটি ছোট বইকে কেন্দ্র করে-‘ওড়িয়া একটি ভাষা নয়’।তৎকালীন উড়িষ্যায় ওড়িয়াকে দক্ষিনে তেলেগু, মধ্যভাগে হিন্দি আগেই গ্রাস করছিল, এবার বাংলা নিতে চাইল পূর্ব দিক।এই আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলেও অবশেষে ওড়িয়ার জয় হয়। এই হালফিলেই বলা চলে, ১৯৮০ তে কর্ণাটকে ‘গোকক বিক্ষোভ’ এ সংস্কৃতর বদলে কন্নড় ভাষাকে স্কুল শিক্ষার ভাষা করার দাবী জানানো হয়। এর আগে স্কুলের গণ্ডী পার করেও শিক্ষার্থীদের নিজের ভাষা শেখবার সুযোগ ছিল না। এই একই চাহিদা ছিল দার্জিলিঙে নেপালিদের, ১৯২০ থেকে নেপালিকে স্কুলশিক্ষার ভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু ক’রে অধুনা গোর্খাল্যান্ড পর্যন্ত সেই আন্দোলনেরই পরিবর্তিত রূপ। ১৮৭৫ এ টয়েট সাহেব আফ্রিকান ভাষাকে ডাচ ভাষার থেকে আলাদা বলে মত প্রকাশ করেন এবং এইটাই আফ্রিকার প্রথম ভাষা আন্দোলন বলে পরিচিত আবার ১৯০২ এর ব্যুওর যুদ্ধের পর যদিও আফ্রিকান ভাষা আরও বিস্তৃত হয় ১৯৯৪ এ সে দেশের ১১ টি সরকারী ভাষার মধ্যে একটি হয়েই আপাতত খুশী থাকতে হচ্ছে। ইংরেজিই সেখানে বেশী আদরের।
সব ভাষাকেই যে অক্ষরে চিনতে হবে এমন নয়, প্রিয়ার চোখের কটাক্ষে যে বক্তব্য লুকিয়ে থাকে তা অক্ষরে প্রকাশ করলে জোলো হয়ে যায়। জনা’র মা বাসন মাজে রোজ দুপুরে পাশের বাড়িতে আর তার দুড়ুম দাড়াম আওয়াজে ওদের টমি’টার অসহায় চিৎকার শুনলেই বোঝা যায় দুপুর দুটো বাজে। আমার প্রায় নব্বই ছুঁই দাদু রান্নাঘরে রাঁধুনি সবিতা’র চুড়ির আওয়াজ পেলেই বলে ওঠে ‘তোমার দিদার চুড়ির আওয়াজ আরও মধুর ছিল’, তার শূন্য দৃষ্টি আকাশের নীলে যা খুঁজে ফেরে সে ভাষাকে কোন অক্ষরে প্রকাশ করি? যে ভাষায় মা তার সদ্যজাত সন্তানকে আপন করে নেয় তার খোঁজই বা পাই কিভাবে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন