আজ আমরা ‘আত্মার সান্নিধ্যে’ র পক্ষ থেকে মুখোমুখি বিশিষ্ট কবি,বাচিক শিল্পী, গায়িকা, অসাধারণ ইভেন্ট ম্যানেজার, শ্রীমতি মৌমিতা ঘোষ এর। যিনি নিজেকে একজন ‘এন্টারটেইনার ‘ বলতে পছন্দ করেন , যিনি বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখতে পারেন এবং সেটা সাকার করে দেখান। যিনি আবার একজন প্রখ্যাত সঞ্চালক , ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলনে ডাক পান সঞ্চালনার জন্য। আমরা মৌমিতার কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের এতটা সময় দেবার জন্য, আমাদের সব প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব দেবার জন্য। তার জন্য আমাদের অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা …
বাংলা কবিতার জগতে তোমার আবির্ভাব গ্রন্থটি প্রকাশ হয়েছে মাত্র বছর তিনেক । কিন্তু তোমার লেখালেখির ব্যাকগ্রাউন্ডটা আদতে কত দিনের ?

আমার আবির্ভাব গ্রন্থ "চেয়ে আছো আকাশ জুড়ে " । প্রকাশিত হয়হ2013 সালে। 2014 তে "শুভ সংবাদ এসো" আর 2015 তে "আনমন মেঘ"। কলেজের সময় থেকে লিখি। উল্লেখযোগ্য কিছু তখন লিখতে পেরেছি বলে মনে হয় না । লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে খুব কম বয়স থেকে জড়িত। ক্লাস এইট থেকে। তখন টিম মেম্বার হিসেবে কাজ করতাম। পরে বড় হয়ে সম্পাদনা করি। আমার পত্রিকায় আমি কখনো নিজের লেখা ছাপিনি। যখন প্রকাশের যোগ্য হয়েছে তখন ই প্রথম বই প্রকাশের কথা ভেবেছি।
তুমি একজন প্রখ্যাত বাচিক শিল্পিও বটে । কার কাছে তালিম নিয়েছ ? কবে থেকে ?

প্রথম শিক্ষা শ্রীমতি কৃষ্ণা মজুমদারের থেকে, যার কাছে আমি পড়াশোনা, গান , আবৃত্তি সব শিখেছি প্রথমবার। পরে শ্রী প্রদীপ ঘোষ, শ্রীমতি ব্রততী বন্দোপাধ্যায় , রঞ্জনা মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিখি। এখনো শিখি শ্রীমতি বিজয় লক্ষী বর্মন ও শ্রী শোভন সুন্দর বসুর কাছে । একদম তিন বছর বয়স থেকে কবিতা বলি।
তোমার অনুষ্ঠান মানেই গ্রাঞ্জার , আর নতুনত্ব । কিভাবে সাহস পাও এত বড় করে ভাবতে ? এতজন শিল্পি নিয়ে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা কি চাপের নয় ?

সাহসটা ভিতর থেকে আসে। আমার প্রথম একক পরিচালনায় ও প্রচেষ্টায় বড় অনুষ্ঠান, ‘কবিতা নয় মুহূর্তরা’ মঞ্চস্থ হয় নভেম্বর, 2014 তে। একটু টেনশন ছিল। আমি প্রচলিত সব ধ্যান ধারনা ভেঙে দিয়েছিলাম। কিশোর কুমারের গান ব্যবহার করেছি "সেই রাতে রাত ছিল" জয় গোস্বামীর কবিতার সাথে। অনুপমের গান ব্যবহার করেছি। চন্দ্রবিন্দুও। গান বা কোরিওগ্রাফি কোনটাই কবিতাকে ছাপিয়ে যায়নি। এই অনুষ্ঠানটি আমাকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় । অনেকজন কে নিয়ে কাজ করা সত্যিই চাপের। ওটাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ মনে হয় যেটা আমি নিজেই অ্যাকসেপ্ট করি। সবার সাথে কাজ করার মজাই আলাদা। নিজের সাংগঠনিক ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ হয়ে যায় । এখনো অবধি সব অনুষ্ঠানে আমি সকলকে নিয়ে সফল। আসলে অনেকেই চাননা অন্য কোন শিল্পীকে mileage দিতে, হয়তো তারা insecured feel করেন। আমার কোন insecurity নেই। আমার সহশিল্পীদের প্রত্যেক কে আমি সম্মান করি ও তাদের প্রতিভাকে সমানভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করি।
তোমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রণথের প্রকাশ অনুষ্ঠানে তুমি একসাথে কাজ করেছ প্রখ্যাত সংগীত শিল্পি শ্রীমতি শ্রাবণী সেন এর সাথে । একটুও টেনশান বা ইগো প্রব্লেম হয় নি ? কিভাবে হ্যান্ডেল করলে ?

আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ "আনমন মেঘ " প্রকাশিত হয়েছিল 2015 এর নভেম্বরের 3 তারিখ জ্ঞান মঞ্চে, অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘এসেছ প্রেম, এসেছ আজ’ । শ্রাবণী সেন ছিলেন রবীন্দ্র গানে, তার সাথে আমার নিজের লেখা কবিতা । পুরো বিষয়টি সাজানোর গুণে, স্ক্রিপ্টের গুণে, সকলের পারফরমেন্সের গুণে প্রশংসিত হয় । শ্রাবণী সেনের মত গুণী শিল্পীর সাথে কাজ করতে পেরে ভালো লেগেছে, কোন টেনশন সত্যিই হয়নি, ইগো প্রবলেমের তো প্রশ্নই নেই । শ্রাবণী দি অসাধারণ মানুষ । ওনার সঙ্গে কাজ করার সময় মনেই হয়নি, উনি এত বিখ্যাত, আর আমি কিছুদিন কাজ করছি।
বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে তো অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হয় । সেরকম কিছু আছে যা আমাদের পাঠক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে চাও ?

মজার ঘটনা অনেক হয় । একবার আমি সময়ের চাপে স্ক্রিপ্টেরবেশ কিছু জায়গা বাতিল করে দিয়েছি। এবারে জয়জিৎ মিউজিক কি করবে বুঝতে পারছেনা, সব অর্ডার চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমি জয়জিৎকে হাত দেখালাম, থামতে বললাম। তালের কবিতা বলতে থাকলাম, দর্শকদের বললাম হাততালি দিতে। বাচ্চাদের জন্য দুটো সুকুমার রায়, বড়দের জন্য অন্যান্য তিনটে তালের কবিতা বলে দর্শককে involve করে নিলাম।শেষ কবিতায় এসে বললাম, "এবারে জয়জিতের একটা দারুণ মিউজিক শোনাই আপনাদের... বলে বললাম শেষ কবিতায় আবার আমাদের যুগলবন্দি.... ম্যানেজ করে দিয়েছি এযাত্রা।
পেশাগত ভাবে তুমি কর্পোরেট ট্রেনার । সেটা কিভাবে তোমার নিজের জীবনে মেথডিকাল হতে হেল্প করেছে ? লাইফ ইভেন্টগুলিও সাক্সেসফুলি ম্যানেজ করতে কি হেল্প করে সেটা ?

কর্পোরেট ট্রেনার হওয়ার সুবাদে আমি অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড্। অনেক ভালো ম্যান ম্যানেজমেন্ট বুঝি। আর ট্রেনিং এর জন্য শেখা এ নানা রকমের স্কিল আমার কমিউনিকেশনকে আরো ভালো করেছে। কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট পড়াই আমি একটা মডিউলে। সেটা লাইভ ইভেন্ট ম্যানেজ করতে হেল্প তো করেই।
তোমার দ্বিতীয় বই এর নাম রেখেছ , ‘শুভ সংবাদ এসো’ । এই ‘শুভ’ শব্দে কি কোন অন্য গল্প আছে ? নাকি নিছক ‘গুড নিউজ’ অর্থেই ধরবো ?
শুভ আমার কবিতার নায়ক, তার খবরের আশায় ই থাকি কিনা!
প্রেমের কবিতায় তোমার মুন্সিয়ানা প্রশ্নাতীত । আবার পারিবারিক বন্ধন নিয়েও অগুন্তি লিখেছ। সামাজিক অন্যায়ের বিরূদ্ধে গর্জে ওঠে তোমার কলম । এককথায় তোমার লেখারা বহুমুখি । এতগুলো সত্বা কিভাবে মেলাও ?

এত কঠিন করে কিছু বলতে পারবনা গো। যা কিছু প্রভাবিত করে, নাড়া দিয়ে যায় তাই নিয়েই লিখি। আর এমনিতে আমরা সকলেই তো অনেকগুলো সত্তার সমষ্টি। তবে প্রেমই আমাকে নাড়া দিয়ে যায় সবথেকে বেশি। আমি একটা জিনিস ই দেখি, প্রেম বা প্রতিবাদ, দুইই যেন সহজ করে লিখতে পারি। আমার কবিতা সকলে বুঝতে পারেন, এতটা সহজ যেন হয়!
যদি লেখালেখি আর বাচিক শিল্পের মধ্যে কোনো একটাকে বেছে নিতে বলা হয় কখোনো , কোনটাকে নেবে , কেন ?
ডেফিনিটলি লেখালিখি । কারণটা খুবই simple. Iam a better poet than a performer
সংসার , অফিস সামলে কিভাবে নিজেকে মোটিভেট কর ? চাপ হয় না ?

খুব চাপ হয় । তবু আমাকে যে করে যেতেই হবে সবকিছু। আমার মাতৃভাষা কে কথা দিয়েছি যে! আজকের প্রজন্ম যারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়, অথবা অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলে, আমার অক্ষরমালার দিব্যি, তাদের ফেরাবই বাংলা ভাষার দিকে।
তোমাকে দেখা যায় ‘জাগো বাংলার’ মঞ্চে । তুমিই আবার কলম ধরো বিরোধীতায় । কিভাবে ম্যানেজ কর ?
‘জাগো বাংলা’ য় আমি কবিতা লিখেছি, আমন্ত্রিত হয়েছি কবি হিসেবে। তারা আমার রাজনৈতিক মতামত জানতে চাননি, আনুগত্য ও দাবী করেন নি । অসুবিধে কোথায়?
তোমার কেরিয়ারের পেছনে তোমার পরিবারের প্রভাব কতটা ? পরিবারের বাইরে আর কারো প্রভাব পড়েছে তোমার এখানে পৌঁছনোয় ?

কেরিয়ারের পিছনে আমার জেদটা, আর ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রভাব সবচেয়ে বেশি । আমার মা সবসময় পাশে ছিলেন যে কোন সিদ্ধান্তে । আজকের সিনারিও তে, আমার শাশুড়ি, ননদ, জা , আমার বোন মাম, দাদা, ভাই সকলে সাপোর্ট করেন। বর আর ছেলে তো আমার সঙ্গে পারফর্ম ই করে। এখন আমার অনুষ্ঠান, আমাদের সবার অনুষ্ঠান । পরিবারের বাইরে কৃষ্ণা পিসির প্রভাব বোধহয় সবচেয়ে বেশি । অগুনতি মানুষের সাপোর্ট তো আছেই।
তোমার কি মনে হয় সাফল্যের জন্য প্রচার এবং পুরস্কারের বড় ভূমিকা আছে ?

প্রচার হয়তো জরুরী, পুরস্কার নয়। প্রচার না হলে লোকে কি করে জানবে আমি কি লিখি, কি বলি? আমার মতো একজন কবি যে দেশে কোনদিন ও লেখেনি, তার প্রতি এত মানুষের ভালোবাসা দেখলে বুঝি পুরস্কার বোধহয় সত্যিই কোন দরকারে আসেনা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে এলে , ‘জীবনানন্দ কবিতা মেলা ২০১৫’ উপলক্ষ্যে । নিশ্চয় আমন্ত্রণমূলক ছিল সেটা ? একটু বিশদে যদি বল …

বাংলাদেশে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম রাজশাহীতে জীবনানন্দ কবিতা মেলায়। আর তার পরেই বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বার কবি মহঃ নুরুল হুদা আয়োজিত কবিতার শান্তি যাত্রায়। রাজশাহী আমায় ভালোবাসা দিয়ে কিনে নিয়েছে, আর ঢাকা- কক্সবাজার আমায় পরিণত করেছে, বিনয়ী করেছে আরো। অনবদ্য অভিজ্ঞতা । বাংলাদেশের হৃদয়েই আছে শ্রেষ্ঠ কবিতা, এটুকু বলতে পারি। আর অসহিষ্ণুতার তে ছবিটা আমরা জানতে পারি, তার সঙ্গে মেইন স্ট্রীম জীবনতাত্রার কোন মিলই নেই। খুবই ভালো মানুষজন। আমার কবিতা তে এত পছন্দ করবেন ওখানে ভাবিনি।সেরা প্রাপ্তি, কথাসাহিত্যিক স্যার হাসান আজিজুল হকের স্নেহ ও সান্নিধ্য ,ওখানে উত্তরা প্রতিদিন নামক নিউজ পেপারে আমার বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ।
পরবর্তী পরিকল্পনা কি ? আবির্ভাবেই নজর কেড়েছ তুমি । এটা কি পূর্ব প্রস্তুতির ফসল ? নাকি ভাগ্য ?

পূর্ব প্রস্তুতি র ফসল। ভাগ্যে আমি বিশ্বাস করি না । রামকৃষ্ণ দেব, সারদা মায়ের ভক্ত আমি। তাদের স্মরণ করে চলি।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন