সাঈদা মিমি




যেখানটায় নীল ফিতের মতন হাওয়া ওড়া একটা নদী আছে, পাশের পাহাড়শৈলির মাঝারি উচ্চতায় দাঁড়ালে সেইরকমই মনে হয়। হাওয়ার তোড়ে নীল ফিতে মনখুশি মত বেঁকে গেছে এবং রূক্ষ কাঁটাতারের বেড়া, নো ম্যানস ল্যাণ্ডে বেয়াড়া ধূলার ঘূর্ণি, তারপর একই রক্তের দুইভাগ হয়ে যাওয়া । আদম অনেকদিন ভেবেছে, সেনা ক্যাম্পের রাত্রি যখন নিথর হয়ে আসে, তারও পরে জেগে জেগে অসংখ্যবার, এই বিভাজনে সূক্ষবুদ্ধির মানুষেরা লাভবান হয়েছে, সে হয়নি । তার পূর্বপুরুষদের কবর ওখানে, বাবার ফেলে আসা দিনের ঘ্রাণ । সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট আলী আদম বোরহান সীমান্তের দিকে চোখ রেখে কাঁদে, চক্ষু জলহীন । মেজর রায়হান ওকে প্রায়ই সতর্ক করে, :আদম তুমি অতিরিক্ত ইমোশনাল । এই বৈশিষ্ট একজন সিভিলিয়ান কে মানায়, আর্মি কে নয় । ওর সহকর্মীরাও বলে কখনও, কিন্তু সেরকমভাবে নয় । কেননা তারাও সৈনিক জীবনের সাথে মানিয়ে চলতে শুরু করেছে মাত্র কয়েকবছর ।

আদম বিয়ের জন্য ছুটি পেয়েছিলো পনেরদিন । কিন্তু পাঁচদিনের মধ্যে তাকে রিপোর্ট করতে হয় সুপিরিয়রের কাছে, সীমান্তে সংঘাত শুরু হয়েছে আচমকা, ছুটি ক্যানসেল। ঠিক বাসরজাগার পরদিন, হলুদের দাগ তখনও ঘোঁচেনি, নতুন বৌয়ের অচেনা ঘ্রাণ টাটকা… আদম কর্মস্থলে; এই জঙলা সীমান্তে । ম্যালেরিয়ার জীবানু বয়ে চলা মশাদের আক্রমণ, পাহাড়ি জোঁক আর সাপের আনাগোনা । মাঝে মধ্যে দুইপাশে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলো আরও নয়দিন পর, পতাকা বৈঠক শেষে । আদমের আর ছুটি পাওয়া হলো না । ঘরে নতুন বৌ, তাকে স্পর্শ করার মূহুর্ত কেবল একটা স্বপ্ন, চুমু খাওয়াটা এক ঘোর । আদম অস্থির হয়ে ওঠে, এই নীরব জলজঙ্গল পাহাড়ে পোকাদের সাথে প্রণয়কথন চলে না । নাসিমার কথা মনে পড়ে, অর্ধেক আলোর রাতে একটু সময়ের জন্য যাকে একান্তে পেয়েছিলো ।

নাসিমা ওদের প্রতিবেশি বরকত কাকার মেয়ে । ভাবলে এখনও হাসি পায়, ছেলেবেলায় ভারী কুচ্ছিত ছিলো মেয়েটা। বেড়ালের মত চোখ, শনের মত চুল, খসখসে ত্বক । মাকে সে বলতো, এমন বিচ্ছিরী দেখতে মেয়েটা! কেউ ওকে বিয়ে করবে না!! মা হেসে ফেলতেন, কখনও রাগও হতেন: মানুষকে নিয়ে বাজে কথা বলতে তোকে শিখিয়েছি আমি? এই বাচ্চা মেয়েটার বিয়ে নিয়ে তুই ভাবতে লেগেছিস কেনো? তিনবছর আগে সেই মেয়েকে দেখে আদম অবাক! মসৃণ সোনালী ত্বক, বাদামী কালো মিশেল চুল নেমে গেছে হাঁটুর কাছে, আয়ত চোখের তারায় রূপালী ঝলক; ক্যটস আই । :কবে এত সুন্দর হলে, নাসিমা! :জানেন না, রাজহাঁসের বাচ্চারা কুৎসিত থাকে! বাব্বাহ, আদম ভাবে, মেয়ের বোল ফুটেছে! হ্যান্স ক্রিস্চিয়ান অ্যাণ্ডারসনের গল্পের ভাষায় কথা বলছে!! সেই থেকে নাসিমা তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠলো, তখন আদম তরুণ লেফটেন্যান্ট ।

মা বুঝেছিলেন আদমের আচরণের পরিবর্তন, নাসিমা ওদের বাসায় এলে অকারণেই চারপাশে ঘুরঘুর করতো সে । শেষতক মা বলেই ফেললেন, :বাবা আদু, নাসিমা তো কুচ্ছিত, বিয়ের বয়সও হলো, মেয়েটার পাত্র কোথায় পাই বলতো? খোঁচাটা বুঝতে পেরে লাল হয়ে উঠলো সে । মা কৃত্রিম গাম্ভীর্য খসিয়ে ফেললেন, :তোর বাবারও খুব ইচ্ছা, তুই মত দিলে বরকত ভাইয়ের সাথে কথা বলবো । কি মত তোর? আদম মাথা নীচু করে কেবল বলতে পেরেছিলো, তোমাদের ইচ্ছাই আমার মত । এই মতপ্রকাশের সময়টুকুই মিলেছিলো এবং সীমান্তের এই একঘেয়ে কর্মস্থলে ফিরে আসা । স্যাঁতসেতে বনভূমি, জোঁক, মশা, পিপড়ে, জঙ্গিদের উপদ্রব, নিষিদ্ধ বিপ্লবীদের ঘাটি, আর কাঁটাতারের বেড়ার নিরাপত্তা দেখা । আদম অক্ষম আক্রোশে ফুঁসে ওঠে । এই দূর্গম ঘাটিতে সীমান্ত প্রহরার কাজ সৈনিক জীবনের জন্য এক অভিশাপ ।

নাসিমা গর্ভবতী, খবরটা পাওয়ার পর যে নিবিড় পূলক তার মন থেকে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিলো, তা প্রকাশের বায়বীয় ভাষাও আদমের অজানা ছিলো । সহকর্মীরা মস্করা করে বলেছিলো, তুমি যেমন দক্ষ বপনকারী, তোমার গিন্নিও ততটাই উর্বর! এই কথাটা মস্তিষ্ক গরম করে তুলেছিলো তার । হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিলো কয়েকজনের সাথে । এ-জন্য পানিশমেন্ট হলো আদমের, পিঠে বালির বস্তা নিয়ে মাঝারি পাহাড়ের চূড়ায় ক্রল করে উঠতে হবে তাকে, ফিরবে হাঁটাদৌড়ে; সঙ্গে এক ক্যন্টিন পানি আর শুকনো চিড়া । কষ্টের চেয়েও বেশি হয়েছিলো ঘৃণা, নাসিমাকে নিয়ে কেউ নোংরা মশকরা করবে এটা আদমের পছন্দ নয় । পানিশমেন্ট শেষে দুইদিন পড়ে ছিলো সে ক্যাম্পের হাসপাতালে, প্রায় অচেতন হয়ে পড়া জ্বর নিয়ে। সৈনিক তো কখনও এত নাজুক হয় না! কায়িক শ্রমে সে ভাঙেনি, ভেঙেছিলো মনের চাপে । তার কয়েকদিন পরেই পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা একদল বিপ্লবীদের সাথে সংঘর্ষ, সাতজন বিপ্লবী মরেছিলো, দু’জন সৈনিক । পুরো অপারেশন শেষে নীলফিতে নদীতে স্নান করেছিলো তারা, খেয়েছিলো মোরগ পোলাও, পান করেছিলো কার্লসবার্গ আর পাহাড়ী চুরুটের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিলো চারপাশ । এটাই সৈনিকের জীবন! এই রক্ত, বারুদপোড়া রাত, বাঙ্কারে ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্ন… সবকিছুর কাছে অতীতের ঘ্রাণ অর্থহীন, পানসে । 

সীমান্তে উত্তেজনা শুরু হয়েছে আবার । ওই ক্ষয়িষ্ণু বেড়ার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই আদম ভাবে, ভূখণ্ড তো আগেই টুকরো হয়েছে, আত্মাগুলি কবে থেকে টুকরো হওয়া শুরু করলো? বিয়ের পরদিন যখন তাকে চলে আসতে হলো…. মা খুব কাঁদছিলেন, অসহায় লাগছিলো বাবার মুখ । ‘আমি সৈনিক হতে চাইনি, মনে মনে বলেছিলো আদম। মনে পড়ে বাবা, আমি সাহিত্য পড়তে চেয়েছিলাম? বাবা তুমি আমাকে ঠেলে পাঠালে ক্যাডেট স্কুলের নিয়মবাঁধা জীবনে! নিজের হাতে দস্তখত করে এলে চুক্তিপত্রে, আমি দেশের জন্য উৎসর্গকৃত!! অন্য কোনোভাবেও তো দেশসেবা করতে পারতাম? এসব কিছুই বাবা মাকে বলা হয় না তার । গেলো সপ্তাহে ছুটির দরখাস্ত করেছে, আজ সেটায় স্বাক্ষর পড়ার কথা । আরো কিছু এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ ভেসে আসে । অন্যভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, এখন মরা ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে তাকে ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ