দেশে ফিরতে চান নি তিনি আর কখনো, এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও না। সেই ইচ্ছের কথা মাথায় রেখেই উপায় ভেবেছিল তাঁরই আত্মজা... মানসী। চার দশক পুরনো তার সেই জীবনে পিতার সাহচর্য সর্বমোট একটা গোটা সপ্তাহও নয়, অবশ্য সেই জন্মের পরের দশ মাস সময়কে বাদ দিলে। সেই থেকেই তিনি দেশত্যাগী, তবে সেই অর্থে তিনি নিজে ত্যাগ করেননি মোটেই বরং দেশের বিদ্বেষের কারনে আর ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর... অপরাধ? দেশের মানুষকে নরক দর্শন করানো। একটা জাঁদরেল অপরাধ বটে, তবে কিনা একে ‘স্বর্গীয়’ আখ্যা দিয়ে গেছেন তাঁরই এক যোগ্য উত্তরসূরি বোকাচ্চিও(বোকাচ্য)।
সে সময় পৃথিবী সূর্যকে নয় বরং সূর্যই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করত পৃথিবীকে আর এক সক্রেতিসকে ছাড়া কারুকে সত্য বলার অপরাধে দেশের দ্বেষে সেভাবে নিশ্চিহ্ন হতে হয় নি কোপারনিকাস, লেওনার্দো বা গ্যালিলিওর মত তবু সব সত্য যে বলা যায় না কোনদিন, তার প্রামান্য দলিল তাঁর জীবন। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সময় যদিও তাঁর নাম ছিল দুরান্তে (যার অর্থ সহনশীল)আমরা তাঁকে চিনি দান্তে (অর্থ দাতা)নামেই। দুরান্তে আলিগিয়েরির জন্ম ১২৬৫ খ্রি. ইতালির ফ্লোরেন্সে। সে সময় ইতালি বিভক্ত ছিল ছোট ছোট অনেকগুলি শক্তিশালী রাজ্যে... ভেনিস, মিলান, ফ্লোরেন্স, নেপলস্ প্রভৃতি। সমকালীন ইতালিতে দুটি রাজনৈতিক দল গুয়েলফি আর গিবেল্লিনির মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যা আদতে রূপ নিয়েছিল দান্তের জন্মেরও আগে একটি বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
সে সময় বিবাহ হত দু’ভাবে, এক প্রেম বিবাহ অর্থাৎ নিজের পছন্দের সঙ্গী নির্বাচন করে যা কিনা সাধারণ বা নিচু তলার মানুষের মধ্যেই বেশী হত, আর রাজনৈতিক, যেখানে দুটি প্রভাবশালী পরিবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য ছেলে মেয়েদের বিবাহে বাধ্য করত। দ্বিতীয় বিবাহটির ক্ষেত্রে অধিকাংশই বর কনের মনের মিল হত না তদুপরি তাদের বিবাহপূর্ব প্রেম তাদের জীবনের একটা অংশ জুড়ে থাকত। এক গুয়েলফি পরিবারের বরের সঙ্গে বাগদান হয়েছিল গিবেল্লিনি পরিবারের কনের, ইতিমধ্যে বর আচমকা দোনাতি পরিবারের এক সুন্দরীর প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে এক্কেবারে বিয়ে করে বসল লুকিয়ে এবং অনিবার্য ভাবে সম্মানরক্ষার যুদ্ধ বাধল দুই দলের মধ্যে। গিবেল্লিনি পরিবারটি সদলবলে আক্রমণ করে গুয়েলফি পরিবারকে কচুকাটা করল আর সেই থেকেই ফ্লোরেন্স মূলত ভাগ হয়ে গেল এই দুই রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে।
এরও অনেক পরে আরও কিছু ঘটনার জেরে গুয়েলফিরা সাদা আর কালো এই দুই দলে দ্বিধাবিভক্ত হয় যাদের ভেতর কালোরা কিছু প্রাচীনপন্থী অর্থাৎ ক্রীতদাস প্রথা, বেগার খাটানো এবং প্রথম রাত্রির অধিকার এই সব প্রথার পক্ষ্যে। সাদারা চাইত এইসব নৃশংস প্রথার বিলুপ্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয় কিন্তু গোল বাধল ওই ‘প্রথম রাত্রির অধিকার’ নিয়ে। সে সময় বিবাহের রাত্রে খানাপিনা হই হুল্লোড় মিটে গেলে বরকে কনের হাত ধরে গ্রামের জমিদার মশাই বা স্থানীয় রাজ প্রতিনিধির কাছে নিয়ে যেতে হত, তিনি সারারাত ভালো করে দেখে শুনে বুঝে নিতেন কন্যাটি প্রকৃতই কুমারী কিনা এবং রাত্রি শেষে প্রসাদী করে ‘কুমারী’ সার্টিফিকেট সহ ফেরত দিতেন বর বাবাজীবনের হাতে যে কিনা সারারাত দুর্গের বাইরে মশার কামড়ে রাত কাটিয়েছে।
সাদারা চেয়েছিল এই প্রথার অবলুপ্তি এবং কালোদের আপত্তিও ছিল ঘোরতর যেহেতু রাজা গজা তাদের দলেই বেশী, তুলনায় সাদারা খানিকটা ‘সর্বহারা’। কালোরা বিচার চাইল পোপ অষ্টম বনিফাতসিও র কাছে যিনি আবার বিচার করতেন হাতে তুলাদণ্ড নিয়ে, মুদ্রার ভার যেদিকে বেশী সেদিকেই বিচারের বানী। অতয়েব পোপের নির্দেশে রাজকুমার শার্ল সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন আর কলিঙ্গের যুদ্ধে যেমন দয়া নদী কলিঙ্গবাসীদের রক্তে লাল হয়েছিল তেমনি সাদা গুয়েলফিদের রক্তে লাল হয়ে উঠল আর্নো। বাকি বন্দী সাদা গুয়েলফিদের পোপ নির্বাসন দণ্ড দিলেন যাদের মধ্যে কবি দান্তে তখন প্রবাসে, বয়স সাঁইত্রিশ, তিনটি জীবিত সন্তানের জনক ও ‘লা ভিতা নুওভা’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ’র রচয়িতা। কবি রাভেন্না’র ফ্রাঞ্চেস্কান চার্চের শরণ নিলেন কিন্তু প্রতিবাদে পিছিয়ে থাকেন নি , অচিরেই সামনে এল তাঁর মহাকাব্য ‘কোম্মেদিয়া’ র প্রথম পর্ব ‘ইনফেরনো’ বা নরক।
কবি স্বপ্নে চলেছেন স্বর্গে তাঁর মানসী বিয়াত্রিচের আহ্বানে, মহাকবি ভারজিল তাঁর পথ প্রদর্শক কিন্তু স্বর্গের পথের ত্রিবেণী সঙ্গমে এসে দেখেন সে পথের প্রথমটিতে পাহারা দিচ্ছে এক চিতাবাঘ যার হলদে গায়ের কালো কালো ছোপগুলি যেন কালো কালো সীলমোহর যা দেশের ক্ষমতাবান, বিলাসী নাগরিক সমাজকে চিহ্নিত করে, দ্বিতীয় পথটি অবরুদ্ধ করে আছে এক সিংহ যা কিনা সাম্রাজ্যলোভী ফরাসী রাজকুমার শার্ল এর প্রতীক যে কোন সময়ে পোপের নির্দেশে আল্পস পেরিয়ে এসে ছারখার করে দেবে ফ্লোরেন্স নামের পুষ্পনগরী, আর তৃতীয় পথের বাধা একটি লোলজিহ্বা নিত্যক্ষুধিত নেকড়ে যে কিনা পোপ অষ্টম বনিফাতসিও র প্রতীক। এহেন বাধা অতিক্রম করে সাধারণ মানুষের স্বর্গারোহণ অসম্ভব জেনে কবি ভারজিল প্রস্তাব করেন অন্য একটি পথের যা কিনা নরকের মধ্যে দিয়ে যায় এবং যা সংক্ষিপ্তও বটে। শুরু হয় নরক দর্শন, কত পরিচিত আর কল্পিত মৃত মানুষের চরম পরিণতির সাক্ষী এই কাব্য। অসম সাহসী কবিকে হাজার হাজার কুর্ণিশ জানাই আজও এই সহস্রাব্দপার থেকে যিনি নির্বাসন দণ্ডকে ফুৎকারে উড়িয়ে প্রকাশ্যে আনলেন এই স্বর্গীয় নরক দর্শন।
পোপের দ্বেষানলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ফতোয়া জারি হল ‘পাগান’ কবি দুরান্তের নামে, কবির উত্তর কোম্মেদিয়ার পরবর্তী দুটি পর্ব পুরগাতরিও এবং পারাদিজো। পাঁচ বছরে মা’ আর বারো বছরে বাবাকে হারিয়ে সংসারের ভার নেওয়া কাঁধটা দৃঢ় ছিল বরাবরই, ডোমিনিকান চার্চের পণ্ডিত সন্ন্যাসী ফারেয়ার ছত্রছায়ায় তৎকালীন বিশ্বসাহিত্যের অনেক হিরেমানিককেই আত্মস্থ করেছিলেন, ব্যতিক্রমী ছিলেন বলেই ললনার কটাক্ষে পেয়েছিলেন ঈশ্বরের নির্দেশ... আর্তকে উদ্ধারের। বিয়াত্রিচের (তাঁর দেওয়া নাম) প্রেম তাই তাঁর মনে কোন দেহজ কামনা জাগায় নি সেই কারণেই অবলীলায় তাঁর মানসীর নামটি দিতে পেরেছিলেন তাঁর কন্যাকে যাকে ছেড়ে এসেছিলেন তার দশ মাস বয়সে। জীবনের শেষ প্রান্তে দেখা হয়েছিল পিতা পুত্রীর, কন্যা তখন সন্ন্যাসিনী, এসেছেন মাদার সুপিরিয়রের অনুমতিক্রমে মহাকবিকে শুশ্রূষা করতে। কবি তখন ছাপ্পান্ন কন্যা কুড়ি, তিনি ডেকেছিলেন কন্যার নাম ধরে আসলে কন্যা নয় মানসীকেই আহ্বান করেন কবি জ্বরের ঘোরে। ১৩২১ সালে মহাপ্রয়াণের পঁচাত্তর বছর পর ফ্লোরেন্স প্রথম উদ্যোগ নেয় কবির দেহাবশেষ সেখানে ফেরত নিয়ে যেতে যা রাভেন্না দ্বারা সরাসরি নাকচ করা হয়। এরও পরে তিনবার অনুরূপ চেষ্টা হয়, উত্তর অপরিবর্তিত অগত্যা তদানীন্তন ফ্লোরেন্সের নগরপাল সাহায্যপ্রার্থী হলেন পোপের। পোপ বদলায় কিন্তু দিন বদলায় না, প্রচুর উপঢৌকনের তলা থেকে পোপের নির্দেশ এল রাভেন্নার বিরুদ্ধে। কবরস্থানের শান্তি নষ্ট করে বহু জাঁক করে বিজয়ী নগরপাল এলেন মহাকবিকে সসম্মানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে কিন্তু দু’শ বছরের সমাধি খুঁড়ে মেহগিনির কফিনটি খুলে দেখা গেল পড়ে আছে কেবল কবির প্রিয় লাল আলখাল্লা আর লরেল পাতার মুড়মুড়ে হয়ে যাওয়া মুকুট। পূত অস্থির সমস্ত হিসেব গরমিল করে কবি কোথায় গেলেন? সে সংবাদ অন্য অবসরে...
এ কবির প্রতিবাদ, মৃত্যুর পরেও যিনি দ্বেষের দেশে চান নি ফিরে যেতে। আমরা কেবল লিখে যেতে পারি আর কালের নিয়মে সে কালির আঁচড় বিলীন হয়ে যায়। আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের মতই দুর্বল তবু কেউ কেউ মৃত্যুঞ্জয়ী হন, আমরা তাঁদের দেখে আমাদের না হতে পারার দুঃখ ভুলি।
পরিচিতি
পরিচিতি
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন