অনেকদিন পরে আজ ভাতের থালায় মাছ পেয়ে আনন্দে চোখটা চকচক করে উঠল দাশুর। আজ কমলি মাছ নিয়ে এসেছে ফেরার পথে। কারখানার চাকরীটা চলে যাবার পর থেকে ভালো করে দুবেলা ভাত জোটানোই দায় হয়ে উঠেছে,মাছ তো অনেক পরের ব্যাপার। অনেকদিন তো শুধু নুন দিয়ে মেখেই ভাত খেয়ে নেয় দাশু।
মাত্র পাঁচ বছর আগে অবধিও এই হাল ছিলনা সংসারটার। মেয়ে কমলি আর ছোট ছেলে বিশুকে নিয়ে ভালই এগোচ্ছিল ওদের সংসার। কিন্তু কথায় বলে না, নিয়তি যখন যাকে যা দেখায়। নইলে কি আর দাশুর এই পোড়া কপাল হত? কারখানার লেদ মেশিনটাতে সেদিন দাশুর কাজ করার কথা ছিলই না । বন্ধু জাকিরকে সাহায্য করতেই তো সেদিন ওর হয়ে ডিউটিটা করতে গিয়েছিল দাশু। আর তাই ওকে চিরদিনের মত ওর ডান হাতটাকে খোয়াতে হল অ্যাকসিডেন্টে। মালিক বেশী টাকা দিলনা এই অজুহাতে যে দাশু সেদিন অন্যমনস্ক ছিল বলেই হাত কেটেছে। “শালা হারামীর বাচ্ছা” ইউনিয়ন দাশুর হয়ে বলেছিল ঠিক কথা,কিন্তু তারাও তো চেপে গিয়েছিল শেষ অবধি। অনেকদিন অবধি মালিক পক্ষ আর ইউনিয়নকে গালাগালি করেছিল দাশু। কিন্তু শেষে যখন দেখল লাভ নেই এতে আর ওর মনের শান্তিও হবেনা,তখন নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিল।
এমনকি দাশুদের পাশের বাড়ি ভাড়া আসা ছোকরা ড্রাইভারটার সাথে যেদিন দাশুর বউ মীনা পালিয়ে গেল,পাড়ায় ঢিঢি পড়ে গেলেও সেদিনও নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিয়েছিল দাশু। বউটা এই গরিবী আর কত সহ্য করবে? আজ কত মাস হল একটা ভালো শাড়ি পড়তে পায়না,খাওয়াও ভালো জোটেনা। ওকে লোকের বাড়ি বাসন মাজার কাজ ধরতে হয়েছে। তবে একবার রাগ যে হয়নি তা না। কত বউতো নিজের স্বামী সংসার দেখার জন্য কত কষ্ট করে। নাহয় মীনাও তাই করতো,ও কেন কমলি বা বিশুর কথা ভেবে থেকে গেলনা। তবে রাগ করে আর কিই বা পাবে? তাই ওর খুব কষ্ট হলেও রাগ সামলে নিয়েছিল দাশু। মাঝেমাঝে কমলিটার মুখের দিকে তাকালে চোখে জল আসে। কোথায় এখন ওর বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে ওকে পার করা উচিত বাবা হিসাবে।কিন্তু কিইবা করতে পারবে দাশু? আর পারলেও কখনও কখনও মানুষ বড় স্বার্থপর হয়ে ওঠে,ত্যাগ শব্দের অর্থ তখন বড় দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে তার কাছে। তাই এখন আর কমলির বিয়ের কথা ভাবেনা দাশু। ছেলেটা এখনো ছোট, তাও কমলি সেলাই এর কাজ করে,এদিক ওদিক করে কিছু টাকা রোজগার করে আনে বলে ওদের সংসারটা চলে। ছেলে বিশুকে কষ্ট করে মাধ্যমিক অবধি পড়ালে একটা কাজের ব্যাবস্থা করান যাবে,ইউনিয়ন এর রাঘবদা এটুকু আশা দিয়েছে। ছেলে নিশ্চয় দেখবে।
মাছের ঝোলটা দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে মেখে একটু একটু করে ভাত খায় দাশু। বিশুও বসেছে পাশে খেতে,সে খাওয়া শেষ করে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দাশুর পাতের দিকে,দাশু দেখেও দেখেনা। সব ভাত খাওয়া হবার পর যখন কিছুটা মাছ রয়ে গ্যাছে,খাবার গতি একদম কমিয়ে দিয়েছে দেখে কমলি জিজ্ঞাসা করল, “ আরেকটু ভাত দি বাবা?” দাশু কিছুক্ষন চুপ থেকে আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
কমলি দুহাতা ভাত দেবার পর মুখে একটু হাসি ফুটল দাশুর। খেয়েদেয়ে উঠে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ও শুতে গেল। কলতলা থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসার পর দেখতে পেল রান্নাঘরের আলোটা জ্বলছে। এগিয়ে গিয়ে দেখল ঢকঢক করে জল খেয়ে শূন্য হাঁড়ি বার করে দিয়ে কমলি শুতে চলে গেল। কাল আবার ভোরে উঠে বেরতে হবে ওকে।
গলার কাছটা কিরকম একটা জ্বালা করে উঠল দাশুর। এই একরত্তি মেয়েটা সংসারের সব দায় মাথায় নিয়ে নিজেকে তিলেতিলে শেষ করছে হয়ত,কিন্তু বাবা হয়ে দাশু কি করছে? এখন ওদের বাবা-মা দুটোই তো দাশু। নাহঃ,কাল সকালে উঠেই পঙ্কজদার কাছে গিয়ে পড়বে দাশু, ক্লাবের দেওয়া রিকশা পেতেই হবে ওকে , যে করেই হোক একহাতে রিকশা চালানোটা শিখে উঠতে হবে। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে যে। শুধু কমলি একা কেন পারবে? আর দেরী না করে দাশু শুতে গেল,পরের সকালটার জন্য।
শর্মিষ্ঠা দে
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন