অমলেন্দু বসাক,পেশায় সরকারি তৃতীয় শ্রেণীর কেরাণী। সমাজ গাড়ির সর্বাধিক চর্চিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি। বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। রোজ সকালে বাস রাস্তার ধারে অনিলের চায়ের দোকানে বসে এককাপ চা না খেলে অফিসের কাজে মন বসে না তার। মনে হয় সকালটা ফ্যাকাশে,রোদ না উঠলে বর্ষাকালে মনটা যেমন হয়। যদিও বাড়িতে গিন্নি বিষয়টা জানেন না। চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি হলফ করে বলতে পারেন,বাড়ি থেকে বাস রাস্তা পর্যন্ত আসার ভ্যান ভাড়াটা নিছক হাত থেকে ফস্কে যেত।–রোজ চা খান ঠিকই তবে,এর জন্য অতিরিক্ত ব্যয় তিনি করেন না। উপরন্ত রোজ একটাকা তিনি বাঁচান। গিন্নি ভাড়া বাবদ রোজ পঁচিশ টাকা দেন। রোজ যাওয়া-আসা ভ্যান ভাড়া বাবদ দশটাকা আর বাস ভাড়া চোদ্দ টাকা। বাড়ি ফিরে একটাকা গিন্নির হাতে তুলে দিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন গিন্নির হাসি মুখটা দেখার জন্য। আর গিন্নি রমলা সন্ধ্যে বেলা ফিরে আসা এক টাকার কয়েনটা বারবার মাথায় ঠেকাতে ঠেকাতে তুলে রাখেন লক্ষ্মীর ভাঁড়ে।অমলেন্দু বাবুর চায়ের পয়সা তাহলে কোথা থেকে আসে?—বাড়ির লোক ছাড়া আর সকলেই জানে অমলেন্দু বাবু রোজ সকালে বাস রাস্তা পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই যান। যদি কখনও সকালে দেরির কারণে ভ্যানে যেতে হয় তবে সেদিন তিনি ফেরার পথে পায়ে হেঁটে আসেন। এক ফেয়ার ভ্যান ভাড়া বাবদ পাঁচ টাকা থেকে চার টাকা তিনি দেন চায়ের দাম আর অতিরিক্ত একটাকা তুলে রাখে অফিসের ড্রয়ারে, তালা দিয়ে। অমলেন্দু বাবুর ঐ ডেস্ক নিয়ে অনেকেরই বেজায় কৌতূহল আছে।বিশেষত যারা ইয়াং অর্থাৎ যুবা। সকলেই এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে, কিন্তু কেউ জানে না ঐ একটাকা অমলেন্দু বাবু কী ভাবে সঞ্চয় করেন।
নিম্নবিত্ত অনিল চা-ওয়ালা বুড়োবাবু অমলেন্দুকে ভীষণ সমীহ করে। সেই ছোটো বেলায় বাবার সাথে যখন চায়ের দোকানে বসতো,তখন থেকে চেনে এই বুড়োবাবুকে তাই অন্য সব খদ্দের থেকে চায়ের দাম পাঁচ টাকা নিলেও বুড়োবাবুর থেকে সে একটাকা কম নেয়। মাসের প্রথমেই বুড়োবাবু তাকে একশ কুড়িটাকা দিয়ে দেন। তবে টাকার হিসাবটা বুড়োবাবুর উপস্থির উপর নির্ভর করে।
অমলেন্দু মানুষটা মনের দিকে বেশ খাঁটি। সংসারের শত টানাটানির মাঝেও দান করার বড় বাসনা হয় তাঁর। চা বাবদ যে টাকাটা তিনি বাঁচান তার থেকে পাঁচ টাকা প্রতিমাসে তিনি দান করেন। গিন্নির জন্য একটা মিষ্টি পান কেনেন আর অবশিষ্ট জমা রাখেন অন্য ফান্ডে। তিনি আর ঈশ্বরই জানেন প্রয়োজনে কতবার সেটা তার কাজে লেগেছে। এহেন হিসাবি অমলেন্দু বাবুর তবুও মাসের শেষটা যেন কাটতে চায় না। বাড়িতে দুই ছেলে এক মেয়ে। গত বছর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।জামাই উচ্চবিত্ত না হলেও উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা যায়। মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন খচ্চাপাতি বুঝি কমবে এবার। সে গুড়ে বালি।খচ্চাপাতি কমার বদলে যেন বেড়ে গেছে। শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের মান বজায় রাখতে এটা-ওটা দেওয়া তো লেগেই আছে। সে না হয় এক রকম করে চালিয়ে নিচ্ছিলেন কিন্তু মেয়ে এখন পোয়াতি। সামনের মাসে মেয়ের মা আর দাদা যাবে মেয়েকে আনতে।গিন্নি বলেছেন বাচ্চা হলে, বাচ্চাকে মাস দুয়েকের না করে তিনি মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না।
চেয়ারের উপর কালো কাপড়ের অফিস ব্যাগটা রাখতে রাখতে অমলেন্দু বলল, ‘গিন্নি, এখন থেকে অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হবে।অতিরিক্ত যোগাতে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হবে’।
রমলা এক হাতে সন্ধ্যা প্রদীপ ধরে অন্য হাত অমলেন্দুর সামনে পেতে বলল, ‘ মেয়েটা তো তোমারই। না হয় মেয়ের মুখ চেয়ে একটু বেশি সময় অফিসেই কাটালে’।
‘কিন্তু বয়সটাতো বাড়ছে গিন্নি,অতিরিক্ত সময় আর অফিসে থাকতে ভালো লাগে না’।
রমলা ফেরৎ আসা কয়েনটা কপালে ঠেকেতে ঠেকাতে বড় ঘরের দিকে পা বাড়ায়। হাত-মুখ ধুয়ে অমলেন্দু গিয়ে বসে টিভির সামনে।মৌমাছির চাকের মাঝ থেকে ছবি খুঁজে দেখতে গিয়ে চোখ কুঁচকে যায় অমলেন্দু বাবুর। এই ভাবে চোখ কুঁচকে টিভি দেখার থেকে ভাড়া বাড়ির বারান্দায় বসে স্বপ্ন দেখা তার কাছে ঢেড় বেশি আনন্দের। ছোটো ছেলেটা মাধ্যমিক দেবে। বড় ছেলে পলিটেক্নিক পড়ে। দুই ছেলের পড়ার পিছনেই তার আয়ের অর্ধেক চলে যায়। এত সাংসারিক চাপের মাঝে বাড়িটা আর করে উঠতে পারেননি। দেখতে দেখতে জীবনের ছাপান্নটা বছর কাটিয়ে দিলেন,স্বপ্নটা এখনও মরে যায়নি। এখনও আশা করেন অবসর গ্রহনের পর প্রভিডেন্ট ফান্ডের যে লাখ ছয়েক টাকা পাবেন,সেই টাকায় একটা ছোট্ট বাড়ি বানাবেন। কোন দেওয়ালে কি রং হবে তা সে ভেবেই রেখেছেন। বাড়ির ব্যাপারে তিনি কাউকে নাক গলাতে দেবেন না। বড়জোর মেয়ে স্মৃতিকণার সাথে একটু পরামর্শ করতে পারেন। তারপর শুভদিন দেখে গৃহপ্রবেশ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন। দেখিয়ে দেবেন বুড়ো হাড়েও কত জোড় তার। এমন স্বপ্ন কতবার তিনি এই ভাড়া বাড়ির বারান্দায় বসে দেখেছেন তবু পুরানো হয় না।
স্বপ্নের মাঝে গিন্নিকে আসতে দেখেই বলে উঠলেন, ‘ জানো গিন্নি, বাড়িটা কিন্তু তিন কামড়ার হতেই হবে। তা নাহলে বিমল আর বিকাশ থাকবে কোথায়? ওদেরও তো সংসার হবে। বাড়ির ভিতটা তিনতলার করবো। পরে না হয় ওরা মাথার উপর ঘর তুলে নেবে’।
গিন্নি কাছে এসে দাঁড়াতেই গিন্নির থুঁতনিতে হাত দিয়ে বললেন, ‘কি গো,আমাকে সঙ্গ দেবে তো? আমি কিন্তু তখন সংসারের কোনো কাজ করবো না। শুধু বারান্দায় বসে থাকবো আর তোমার সঙ্গে সোহাগ করবো’। বলতে বলতে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে যান। তারপর আপন মনেই বলেন, ‘ বাড়িটা তাড়াতাড়ি করতে পারলে অনেক দিন ভোগ করতে পারতাম,আর মাসে মাসে ভাড়ার টাকাও গুনতে হত না’। ফস্ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ‘এই হচ্ছে মধ্যবিত্তের জ্বালা, বুঝলে গিন্নি। সময়ের জিনিস কে সময়ে পায় না’। রমলা নিরুত্তর থাকে।এই সত্যটা তার থেকে বেশি আর কে জানে।
রমলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অমলেন্দু আবার বলতে থাকে, ‘ শুধু বাড়িই বা বলি কেন,কোন জিনিসটা নয় বলত? খাদ্য –বস্ত্র-বাসস্থান সবেতেই আমাদের মত মধ্যবিত্তের স্বাদ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য’।
এই তো সেদিন অফিস থেকে আসার সময় দেখলাম,আনন্দ বাজারে ইলিশ মাছ দর করছেন।দেখে আমারো লোভ হলো। –জানি অত দাম দিয়ে নিতে পারবো না তবুও পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দর শুনেই তো চক্ষু চরক গাছ। দেখলাম আনন্দ মাছটাকে বেশ টিপেটুপে দাঁড়িপাল্লায় তুললো। দাম দাঁড়ালো প্রায় হাজার টাকা। মাছওয়ালা সেটা কাটতেই যাবে,আনন্দ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও,ওজনটা একটু কম হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে অনেক লোক,তুমি বরং আরেকটু বেশি ওজনের চাপাও’। মাছওয়ালা বেশ বড় দেখে আরেকটা মাছ দাঁড়িতে চাপালো। ওটা কাটতে যাবে,হঠাৎ আনন্দ বললো—‘ ভাই থাক, আজ আর নেবো না,অতো টাকা আজ সঙ্গে নেই,আর আমি ধারে মাছ খাই না’। একটু ঢোক গিলে বললো,---তুমি তো রোজ এখানেই বসো,আমি এপথেই বাড়ি ফিরি। কাল-পরশু যাবার পথে নিয়ে যাবো,একটা ভালো দেখে মাছ রেখে দিও ভাই আমার জন্য’। মাছ ওয়ালার বেজার মুখ দেখতে আমিই বা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি কেন? —তাই দ্রুত ফিরে এলাম।
রমলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে এই চরম সত্যটা তার থেকে বেশি ভালো আর কে জানে? রমলাও তো কতদিন ভেবেছে একটা ভালো শাড়ি কিনবে।কিন্তু মুখফুটে কখনও বলেনি। অমলেন্দুরও ইচ্ছা হয় গিন্নিকে একটা ভালো শাড়ি পড়াতে। সে অনেক বছর আগের কথা,বিয়ের পরে পরেই অমলেন্দু একটা মুর্শিদাবাদ সিল্কের শাড়ি কিনে দিয়েছিল রমলাকে। তখন পাড়ায় অবিনাশ পুরোকায়েত নামে একটা ছেলে বাড়ি বাড়ি শাড়ি নিয়ে আসতো। তাকে দিয়ে খোদ মুর্শিদাবাদ থেকে শাড়িটা আনিয়েছিল অমলেন্দু।আট মাস ধরে কিস্তির টাকা গুনেছিল। রমলা সেই শাড়িটা আজও যত্নে রেখেছে। প্রতিবার পড়ার পর ভালো করে রোদে দিয়ে ভাঁজ করে তুলে রাখতো। নিমন্ত্রণ বাড়িতে গেলে ঐ শাড়িটায় পড়ে যেত,সকলের মুখচেপা হাসি,চোখ টেপা সব কিছুকে উপেক্ষা করেই। তবু কখনও মুখ ফুটে নিজের জন্য একটা শাড়ি চায় নি,চায়তে পারেনি। পরপর তিন সন্তান,তাদের দুধের জোগাড় বড় হলে একসাথে তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ, এসবের মাঝে নিজের ইচ্ছার বিসর্জন দিয়েছে শুধু।
স্ত্রীকে নিরব থাকতে দেখে অমলেন্দু পাশে রাখা কাঠের টুলটাতে রমলাকে টেনে বসিয়ে বলে—‘আরো মজার কথা শুনবে? ---গত রবিবার বাজার থেকে ফিরছিলাম,হঠাৎ ওই মোহোনের সাথে দেখা। বাজার ঢোকার মুখে কালভাটটা আছে না, ওখানে আসতেই একটা কাক আমার মাথায় দিল হেগে। আমি কালভাটের উপর বাজারের ব্যাগ দুটো রেখে একটা গাছের পাতা দিয়ে মাথাটা সবে মুছতে যাচ্ছি,হঠাৎ দেখি মোহোন একটা চকচকে স্কুটি নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমার অবস্থা দেখে খানিক হা হা করে হাসলো। আমি মাথাটা মুছে ব্যাগ দুটো হাতে ঝোলাতেই বলে উঠলো, --‘আরে অমলদা, আর কতদিন এভাবে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার করবেন? —এবার একটা স্কুটি কিনে ফেলুন’। বলেই অমলেন্দু হা হা করে হেসে বলল—‘মজার কথা কি জানো গিন্নি,দু’দিন আগেই নিজে মপেট চালাতো,আজ স্কুটি কিনেই লোককে জ্ঞান দিতে শুরু করেছে’। –শেষের কথা গুলো বলার সময় অমলেন্দুর গলাটা একটু কেঁপে গেল যেন,সেই যৌবন থেকে একটা গাড়ি কেনার সখ,এজীবনে যে আর সেটা পূরণ হওয়ার নয়,এই সত্যটা অমলেন্দু ভালো করেই বোঝে।
[২]
মাসের প্রথম রবিবারটা যে কোনো সরকারি কর্মচারিদের জন্য একটা আদর্শ হলিডে...। ছুটি কাটাতে গিন্নিকে নিয়ে অমলেন্দু কখনও কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি,ইচ্ছা আছে একবার দিঘা যাওয়ার।রাতে ঘুমের মধ্যে অবশ্য গিন্নির সাথে সমুদ্রে অনেকবারই রোমান্স করেছেন । গতরাতের স্বপ্নটা মনটাকে বেশ ফুরফুরে করে তুলেছে। পকেটও বেশ গরম আছে। যদিও জানেন সন্ধ্যেবেলায় সংসারের সব খাতে খরচ রাখতে গিয়ে পকেট গড়ের মাঠ হবে তবুও মেজাজ বেশ ফুরফুরে।মনে ভাবলেন জম্পেস করে আজ বাজার করবেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাতটা বাজে । তাড়াতাড়ি এককাপ চা খেয়ে বাজারের থলি হাতে বেরোতে যাবেন,দেখন চটিটা যথাস্থানে নেই। অমলেন্দু কে চটি খুঁজতে দেখে বাড়িয়ালী তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল—‘ওটা বাড়িতে খুঁজে লাভ নেই,আমি রাস্তায় ফেলে দিয়েছি। আমার বাড়ির সিঁড়ির তলায় জুতোর বাজার না সড়ালে আবার ফেলে দেব’। অমলেন্দুর মুখটা পাংশুটে হয়ে যায়। এই হয়েছে আর এক জ্বালা,নিত্য দিন জুতো রাখা নিয়ে অশান্তি। কতবার ভেবেছেন পুরানো বাদ দেওয়া জুতো গুলো ফেলে দেবেন,কতবার হাতে নিয়ে ফেলতেও গেছেন,কিন্তু পারেননি। ফেলতে গিয়েই মনে হয়েছে যদি আবার কাজে লাগে। আবার এনে যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। অমলেন্দু মুখটা নিচু করে বাইরে এসে জুতো দুটো কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটা লাগালো বাজারের দিকে।
কি যেন আনমনে ভাবতে ভাবতেই যাচ্ছিল,চোখ পড়ল পাড়ার মোড়ে বসে থাকা ভিখারিটার দিকে। সকাল হতেই বাটি হাতে খানিক এদিক ওদিক ঘুরে আবার এসে বসেছে ওই মোড়ের মাথায়। আবার রোজ ওই জায়গাটায় ওর চায়। - --অমলেন্দুর নিজেকে অপদার্থ মনে হয়।এতবড় একটা শহরে আজও অমলেন্দু একখন্ড জমি নিজের বলে দাবি করতে পারেনি—অথচ ভিখারিটাকে দেখ---‘যেন ওর বাপের সম্পত্তি’। কোথা থেকে আরেকজন এসে জুটেছে,তার সঙ্গে জায়গা নিয়ে মাড়ামাড়ি করছে। এক সুতো জায়গা সে ছাড়বে না। আবার একটা বড় চট নিয়ে এসে বিছিয়ে বসেছে,ডান হাতের পাশে একটা লাঠি । পাশের জন একটু সরে এলেই লাঠি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। অমলেন্দু ভাবে বিচিত্র জীবন এদের। সুখ নেই,দুঃখনেই,--নেই কোনো চাওয়া –পাওয়া । আছে শুধু লজ্জাহীন চামড়া। শুধু একটায় লক্ষ সবার কষ্টের উপার্জনে ভাগ বসানো,না দিলে গুষ্টির পিন্ডি চটকানো। ---রাস্তায় খাওয়া,শোয়া,সন্তান প্রসব করা আবার লাশ হয়ে রাস্তাতেই পড়ে থাকা। এদের না ইহকালের চিন্তা না পরকালের। চিতার আগুনের স্বপ্নও এরা দেখে না। যত স্বপ্ন এই মধ্যবিত্তের চোখেই এঁকে দিয়েছেন ঈশ্বর। ----অমলেন্দু ভাবে কে বেশি সুখি?---সে না, ওই ভিখারি?---কোনটা বেশি আনন্দের স্বপ্ন না দেখা,নাকি স্বপ্ন দেখতে দেখতে দু’চোখের মাঝে স্বপ্ন পুরে একদিন চিতার আগুনে ঝলসে যাওয়া? ---জানে না অমলেন্দু, শুধু জানে এভাবেই তার মত মধ্যবিত্তের জীবন গড়িয়ে চলে। বাজারে ভালো মাছটা দেখেও না কিনতে পারার অক্ষমতা কে স্বীকার করার থেকে বাড়িতে অনেক মাছ আছে ,আজ থাক বলাটা অনেক সহজ।
[৩]
বিবাহ বার্ষিকীর দিনটা আজ এত বছর পরেও ভোলেনি অমলেন্দু তাই,অফিস থেকে একটু আগেই বেড়িয়ে পড়ল। বাড়ি ফেরার পথে বাজার হয়েই যাবে। বাড়ি ফিরেই বেশ একটা হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিল। চিৎকার করে ডাকল, ‘কৈ গো গিন্নি, গেলে কোথায়? তাড়াতাড়ি একবার এদিকে এসো দেখি’।
রমলা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, ‘কি হল কি ? এত হাঁকাহাকি করছো কেন?
অমলেন্দু ব্যাগ থেকে শাড়ির প্যাকেটটা বের করে গিন্নির হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘চট করে এটা পড়ে একবার সামনে এসো তো গিন্নি’।
অমলেন্দু শাড়িটা কেনার পর থেকে কল্পনায় রমলার যে মুখ দেখেছিল,তার বিন্দু মাত্র লক্ষণ রমলার মুখে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলো। রমলা শাড়ির প্যাকেটটা অমলেন্দুর হাত থেকে নিয়ে আলমারীতে তুলে রাখতে রাখতে বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নাও।আমি তোমার চা আনছি’।
জীবনের এত গুলো বছর কেটে যাওয়ার পর আর শাড়ির সখ নেই রমলার। এখন আর এই সব শাড়ি ভালো লাগে না। অনেক বছর আগে একটা জামেবার শাড়ি ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছিল,শাড়িটা যেন এখনও চোখে লেগে আছে। মেয়ের বিয়েতে ছেলের বাড়ি থেকে প্রণামী দেওয়া শাড়িটা এখনও গায়ে ঠেকায় নি রমলা। অত দামী শাড়ি এখন আর পড়তে ইচ্ছা করে না । মাড় দেওয়া তাঁতের শাড়িতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। মানুষের সাথে সাথে সময়েরও বয়স যে বাড়ে সেটা ইদানিং যেন রমলা ভীষণ ভাবে টের পায়।শরীরের সাথে ইচ্ছা গুলোও যেন অবসর নিতে চায়। এখন কেউ রমলাকে কিছু দিলে সেটা সোজা আলমারীতে তুলে রাখায় ওর স্বভাব হয়ে গেছে।সঞ্চয়টা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রাত গভীর,অমলেন্দুর চোখে ঘুম নেই। রমলার উচ্ছ্বাসহীন মুখটা রাতের অন্ধকারেও যেন ভেসে উঠছে।নিজেকে কেমন যেন অপদার্থ মনে হয়। সত্যিই তো নদী শুকিয়ে গেলে তাতে যতই জল ঢালা হোক না কেন,ভরা নদীর যৌবন আর ফিরে আসে না। কিন্তু ইচ্ছা করে তো সে রমলার ইচ্ছা গুলো অপূর্ণ রাখে নি। সেই প্রথম দেওয়া সিল্কের শাড়িটা রমলা আজও যেভাবে যত্নে রেখেছে,যেন কোনো মূল্যবান সম্পদ। সত্যিই তো ওটা ওর কাছে মূল্যবানই। পাশে শুয়ে থাকা গিন্নির গায়ে হাত রেখে বলে, ‘ বুঝলে গিন্নি, মেয়ের বিয়ের ধারটা প্রায় শোধ হয়ে এলো। আর মাত্র চারমাস দিলেই ধার শোধ’।
রমলার দিক থেকে কেবল শব্দ আসে ‘হুম্ম’। রমলা আর কোনো কথা বলে কিনা সেটা শোনার অপেক্ষা না করেই আবার বলতে শুরু করে – ‘ভাবছি এই ধারটা শোধ হলেই প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে কিছু টাকা লোন নেব। তোমার কতদিনের সখ একটা রঙীন টিভি আর ফ্রিজের। আর ছেলে গুলোও তো বড় হয়ে গেল। আমাদের না হয় তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে,ওদের ও তো সখ আহ্লাদ আছে’ । বলেই বিছানা থেকে উঠে বসলেন,টেবিলের উপর রাখা খাতা-পেন হিসাব কষতে শুরু করলেন বাকি থাকা ইচ্ছা গুলো পূরণ করতে কত টাকা লোন নিতে হবে। রাত আরো গভীর হয়, রমলা স্পষ্ট শুনতে পায় অমলেন্দু ঘুমের ঘোরেও বিরবির করছেন,টিভি না ফ্রিজ কিসের যেন একটা দরদাম চলছে।
![]() |
| পরিচিতি |
রুমকি রায় দত্ত
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন