ট্রেনের টিকিট'টা বুক করে নিয়েছি ঋ। শুনছ। কি গো।
স্নানঘর থেকে মৃদু জলের আওয়াজ পাচ্ছি। মিঠে সুগন্ধ । যুবতী নারী আর সাবানের মেলামেশার গন্ধ। নিশ্বাস তরল হচ্ছে উষ্ণ বাতাসে।
আমি রক্তিম সেন সাহিত্যিক ঋতমা সেনের কুৎসিত স্বামী,পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আর কয়েক দিন পর আমার আরও একটা নতুন পরিচয় হবে। ‘স্ত্রীঘাতক‘ । আমি আমার পরমাসুন্দরী স্ত্রী কে খুন করে আমাদের ছয় মাসের বিবাহিত জীবন শেষ করব। সম্পূর্ণ ভাবে ভেবেচিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দেখুন মশাই এই আমার মত কদাকার চেহেরার মানুষকে দেখে লোকে নাক সিঁটকোয় নিদেনপক্ষে একটু আধটু সহানুভূতি দেখায়। কিম্বা আমার মোটা মাইনের দয়ায় ছিঁটেফোঁটা সম্মানও পেয়ে থাকি। কিন্তু প্রেম? তাও প্রথম দর্শনে? অবিশ্বাস্য।
আমাকে দেখে কিনা ঋতমা প্রেমে পড়ে গেল? অবাক কান্ড। না। না। না। কিছুতেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছিনা। গত ছয় মাস রাতে ঘুমোতে পারিনি। ওর ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। উঠে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেছি আর কুঁকড়ে গেছি ভেতরে বাইরে।
ঋতমা কে প্রথম দেখি বইমেলায় । সেদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরছিলাম। বেসমেন্ট থেকে গাড়ি টা সবে সিকিউরিটি চেক করিয়ে টার্ন নেব, সাইড উইন্ডোতে টক টক আওয়াজ। কালো কাঁচ নামিয়ে দেখি অমিত। বলল আমাকে একটু মিলনমেলা ড্রপ করবে। অমিত আমার পাশের কিউবিকলে বসে। ভালো ছেলে ,স্মার্ট, হ্যান্ডসাম। বললাম উঠে এসো। সেদিন অমিতের সাথে গাড়িতে কি কথা হয়েছিল মনে নেই আজ। শুধু মনে আছে ও আমাকে জোর করে নিয়ে গেছিল বইমেলায়। সাহিত্যিক ঋতমা রায়ের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে। পরে জেনেছিলাম ঋতমা ওর মামাতো বোন।
সারারাত মোটামুটি জেগে কাটিয়ে ছিলাম। অসাধারণ সুন্দরী ঋতমা। অবয়বটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিলাম না। চোখের উপর কেউ যেন ফ্রেমবন্দী করে দিয়েছে ওকে। ঋতমা রায় আমার থেকে বছর দশেকের ছোট হবে,তীক্ষ্ণ নাক, চোখ,মুখ। এ মেয়ে কে সাহিত্যিক ছাড়া মানাতো না। আমি আমার এই বছর পয়ত্রিশের জীবনে অনেক নারী দেখেছি, কিন্ত এমন ঝাঁ চকচকে বুদ্ধিমত্তার সাথে চোখ ধাঁধানো রুপ, নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব বলাই বাহুল্য আমি আগে দেখেনি।
ঋতমার সাথে দেখা হওয়ার ঠিক তিনদিন পর লাঞ্চ ব্রেকে বেরিয়েছি। স্মোকিং জোনে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা সবে জ্বালিয়েছি, ফোনটা কেঁপে উঠল। অচেনা নম্বর দেখে বার দুয়েক ফোনটা কেটে বন্ধ করে পকেটে রেখে দিলাম। আমার চেনা গন্ডির বাইরে কেউই তেমন ফোন করে না।সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরে পকেট থেকে ফোনটা বের করার সময় মনে পড়ল ওটা বন্ধ পড়ে আছে। অন করার কিছুক্ষনের মধ্যে কেঁপে উঠল ফোনটা। টেক্সট মেসেজ । সকালের নাম্বারটা থেকে। মেসেজটা খোলার সাথে সাথে আমি স্থবির হয়ে গেছিলাম। দুটো শব্দ মাত্র “আমি ঋতমা”।
এই রুকু আমাকে কাল একবার অমিত'দা দের বাড়ি যেতে হবে। মামা অসুস্থ।
মোবাইলে বসে গেম খেলছিলাম একমনে! ঋর কথায় চটক ভাঙল!
আলিস্যি তোলার ভঙ্গীতে বললাম "উমমমমম! যেও", বলে তাকিয়ে দেখি স্নান সেরে একটা সাদা খোলের উপর কাঁচা হলুদ বুটি দেওয়া তাঁত পড়েছে ও। ঘন কাজল রেখা চোখে। কালো ছোট্ট একটা টিপ ভ্রূর মাঝখানে । ঋতমার গভীর সত্তা আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি কে অবশ করে দেয় ভীষণভাবে! মনে মনে বললাম তোমাকে মরতেই হবে ঋ মরতেই হবে।
ঋ দুজনের খাবার বাড়তে বাড়তে জিগ্যেস করল ,আচ্ছা বেড়াতে যাবে বললে যে,তা কি প্ল্যান? কোথায় যাচ্ছি? আগেভাগে বোলো কাজগুলো সেরে রাখতে হবে তো। হুমম বলবো। মাথা নীচু করে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি দেখে ঋ আমার হাতের উপর হাল্কা চাপ দিল। বলল , এনিথিং রং বেবী।
মনে মনে নিজেকে গালাগালি করছি। সামলাচ্ছি, যাতে ওর চোখে ধরা না পড়ি ! বললাম “অনেকদিন তোমাকে আদর করিনি ঋ”। ঋ বেসিনে হাত ধুচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে সেই অদ্ভুত খেলাটা ফুটিয়ে তুলল। ও জানে ওর এই খেলা আমাকে কতখানি পোড়ায়! পা দুটো যেন মাটির গভীরে মিশে যাচ্ছে আমার । আমি ঘামছি। ঋ এক পা দু পা করে একেবারে কাছে চলে এসেছে। ওর ওডি কোলোনের গন্ধ আমার শরীরেও। থুঁতনি ধরে আমার ঠোঁট দুটো তুলে ধরল। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।ওর নিশ্বাসের শব্দ আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠিক ওর লিপস্টিক ছোঁয়া মুহূর্তে ও বলে উঠল “পরে রুকু সোনা, এখন অনেক কাজ আছে! টাটা” বলে বেড়িয়ে গেল ঋ। আমি তখন ও ধুম জ্বরে কাঁপছি।
আচ্ছা এ মেয়ের মরে যাওয়া কি উচিৎ নয়?
ঋতমা যে আমার অফিসে চলে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। হঠাৎ সেদিন বিকেলবেলায় ওর নম্বর থেকে মেসেজ এল “নীচে আসুন এখুনি”। দেখি ফ্লোরাল পালাজো আর গুর্জরীর কাজ করা কুর্তি পড়ে দাঁড়িয়ে ঋতমা। গলায় মাল্টি কালারড্ স্কার্ফ। আমাকে দেখে বলল চলুন কফি খাবো। আপনার অফিসের সামনেই কফি সপ। আমার কিছু বলার তোয়াক্কা না করে মুজরি মশমশিয়ে এগিয়ে গেল ও।ওহ্! মেয়েটা অদ্ভূত ছোঁয়াচে ।
আপনি কি নেবেন রক্তিম , চা না কফি ?
আমার একটা কোল্ড কফি আর ইন্ডালজেন্স।
আমি কি বলব বুঝে ওঠার আগেই আমাকে তাড়া দিয়ে বলল “কোই যান,অ্যাম হাঙরি”।
হুুম যাচ্ছি। বলে কাউণ্টারে গেলাম।
কফির অর্ডার দিয়ে এসে জিগ্যেশ করলাম। বলুন ঋতমা।
“আমাকে বিয়ে করবেন”? অগ্নিবাণটা যেন তৈরী রেখেছিল আমার জন্য! জাস্ট ছুড়ে দিল ঋতমা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম আমার ভেবলে যাওয়া অবস্থাটা কেউ দেখল নাকি। দেখলাম অনেক জোড়া চোখ ঋতমা কে মাপছে আর আমি একটুএকটু করে হারাচ্ছি।
ঋতমার মতো মেয়ে যেকোন পুরুষের হৃদয় তছনছ করে দিতে পারে সে আমার মতো একটা কুৎসিত ছেলেকে বিয়ে করতে চায়? কেন? এও কি সম্ভব? উফফ্ মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কফি সপ থেকে ফেরা ইস্তক মন অশান্ত । একটা সেরিডন খেয়ে সারাটা সন্ধে শুয়ে ছিলাম অন্ধকার ঘরে। প্রায় মাঝ রাত , ফ্রিজ থেকে বের করে রাতের খাবার গরম করছি হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। বুঝতে অসুবিধে হয়নি ফোনটা কার । ফোনটা ধরে বললাম “ বলুন ঋতমা”। ওপাশ থেকে ঋতমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল ....
শৈত্য ভেসে চলে। মাপা আদর কথা।
দুর্নিবার হোক আকর্ষণ
পথ হারাবার ব্যথা।
“রক্তিম তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
কাল দুপুরের ট্রেনে বেরোচ্ছি আমরা। করোমন্ডল এক্সপ্রেস দুপুর পৌনে তিনটেয় হাওড়া থেকে ছাড়বে, পরদিন ভোর চারটে ভাইজাগ পৌঁছবো। সেখান থেকে আরাকু। আর তিনটে দিন ঋ। তারপর আমি মুক্ত। তুমি ও। ক্ষমা কোরো ঋ, এছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার । ডিভোর্স দিতে পারতাম কিন্ত তোমার এমন নিঁখুত নগ্নতা। পারব না তোমাকে কোনদিন অন্য কারুর ভাবতে। তোমাকে মরতে হবে ঋ। জানো ! তোমার মৃত্যু দেখে খুব কষ্ট পাবো। বিশ্বাস করো । আমার একমাত্র ভালোবাসা তুমি ঋ। শেষ নারী ও তুমিই .! একমাত্র. তুমিই!
আরাকু তে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় বেলা বারোটা। ওক রিসর্ট বুক করাই ছিল আমাদের । হোটেল রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রুম সার্ভিসে ফোন করে চিলড্ বিয়র আনালাম। ঋ বলল ও ব্রিজার খাবে, ওর জন্য লেমন ফ্লেবর অর্ডার করলাম। ও ফ্রেশ হয়ে ডেনিম ব্লু হট প্যান্ট আর হোয়াইট লিনেন শার্ট ইন করে পড়ে নিয়েছে। ঋ কে দেখে আমার চোখ বদলে যাচ্ছে। মনের কানায় কানায় ভরে উঠেছে আবেগ ,আবেশ আর সমর্পণ। প্রকৃতির আলাদা নেশা আছে। সবকিছু মন্দ ও যেন ভালো লাগতে শুরু করে। মনের সমস্ত দৈন্যতা যেন মুছে দিচ্ছে কেউ। ঋ আমার শিরায় মিশে যাচ্ছে।
বিকেল পাঁচটায় কফি মিউসিয়াম ঘুরে মার্কেটের দিকে গেলাম আমরা। সকালেই গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম। কিছু টুকটাক কেনাকাটা সেরে ট্রাইবাল মিউসিয়াম ঘুরে হোটেলে ঢুকলাম পৌনে সাতটা। রুম সার্ভিসে ফোন করে নটায় ডিনার বললাম। আসার সময় টিফিন কিনেই এনেছিলাম। টিফিন খেয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে দুজনে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের অপরিসীম নির্জনতায় মন উদাস হয়ে যায়। ঋ ও দেখলাম চুপ করে দাঁড়িয়ে । খুব হাল্কা ভাবে ঋতমার হাত ধরে ওকে কাছে টানলাম। ও আমার বুকে মাথা দিল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মনে হল দু ফোঁটা গরম জল যেন গড়িয়ে পড়ছে বুকে। ওর মুখটা আলতো করে তুলে দেখি কাঁদছে। গভীর মমত্বে বুকে জড়িয়ে নিলাম ওকে। তারপর নির্জন পাহাড়ী রাত কে সাক্ষী রেখে ওকে চুমু খেলাম। দীর্ঘকাল ধরে তৃষ্ণার্ত যক্ষ এক অভিশাপ মুক্ত হল যেন। আদরে আদরে ঋর প্রতিটি অঙ্গে নতুন এক প্রেমকাব্য লিখছি সারারাত ধরে। রুমের বাইরে তখন লজ্জায় আরক্ত ‘ডু নট ডিসটার্ব ’ আলো।
'প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ'
আলাইকুন্ডা পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি দুজন । সকাল আটটা বাজে। আমরা ছাড়া আর কেউই নেই আজ এখানে। ড্রাইভার কিছুটা দূরে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে। আমি দেখছি ঋ কে মুগ্দ্ধ দৃষ্টিতে, অসামান্য লাগছে ওকে লং স্কার্টে। ওর চোখে গাঢ় লাইনার,পাতলা গোলাপী ঠোঁটে লিপ বামের জেল্লা। মায়াবী লাগছে খুব। ওকে দেখে কবিতার এই দুটো লাইন মাথায় এলো। চিৎকার করে বলে উঠলাম । মনের ভেতর তখন তোলপাড়। হঠাৎ নিজের কাছে নিজেকে ছোট লাগছিল। কি করতে যাচ্ছিলাম আমি। গত রাতে ওর চোখের জল আমার মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব দূর করে দিয়েছে। আরো একবার প্রেমে পড়লাম আজ।
ঋ আপনমনে খাদের দিকে তাকিয়ে। শান্তমনে গভীরভাবে যেন কিছু ভেবে চলেছে। ওর কাঁধে হাত রাখলাম। ডাকলাম ঋ, কি হয়েছে এতো চুপ কেন। ঋর নরম সুন্দর চুলগুলো ওর মুখে পড়ছে। সেগুলোকে একসাথে করে ক্লিপ লাগালো। তারপর থেমে থেমে বলল ! জানো রুকু আমার এই পঁচিশ বছর বয়সেই যে আমি কত পুরুষমানুষ দেখেছি। কত সুন্দর পুরুষেরা আমাকে চেয়েছে। কিন্ত তারা আমার থেকে বেশী অন্যকিছু চেয়েছে। তোমার সাথে দেখা হল সম্মান দিলে। অন্যরকম মানুষ দেখলাম একটা! বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। বিয়েও হল। আমি জানি রুকু তুমি আমাকে অসম্ভব ভালোবাসো। ঋর কথা শুনে আমি বাক্শক্তিহীন হয়ে পড়ছি যেন। এতো শান্ত ওকে আগে কখনও দেখিনি। এতো কথা মেয়েটা চেপে ছিল এতদিন। কেন?
হঠাৎ ঋ আমাকে জড়িয়ে ধরল। ও কাঁদছে। আমি অবাক! কত ভুল ভেবেছি ওকে। ওকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিলাম। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর মুখ তুলে পরিপূর্ণ চোখে তাকালো। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল ‘আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি রুকু। কথাটা শুনে আমি পাগল হয়ে গেছি পুরো। ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। ও নিজেকে মুক্ত করল আমার বাহুবন্ধন থেকে, তারপর অস্ফুটে বলল
কিছু মানুষ রেখে চলে যায় চিহ্ন
পুরনো স্মৃতি , বাক্সবন্দী দুঃস্বপ্ন
দোমড়ানো অতীতের আতর আর মুখবন্ধ না বলাদের!
সময়ের সাথে বদলাচ্ছি তুমি আর আমি!
আমি অমিতদা কে তোমার থেকে ও বেশী ভালবাসি রুকু । কেন আগে এলে না! তোমাকে যে যেতে হবে রুকু। নইলে যে.....ভালো থেকো যেখানেই থাকো। আমি কিছু বোঝবার আগে দেখলাম ছেঁড়া পৃষ্ঠার মত খাদে তলিয়ে যাচ্ছি। আহ। কি তীব্র আঁধার ঋতমা।
![]() |
| পরিচিতি |
রিংকু কর্মকার চৌধুরী
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন