আজকের ‘এক মুঠো প্রলাপে’ আমরা মুখোমুখি হয়েছি প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী প্রযুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের । অন্যধারার কাজে ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছেন তিনি । আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি আবৃত্তি ছাড়া ভাবাই যায় না । আবার আমরা এই শিল্পীদের সম্পর্কে খুব কম জানি । আজ আমরা কিছু প্রশ্নের ডালি নিয়ে ওনার কাছে এসেছি , জানতে চাই এধরণের কাজের বাঁক , চ্যালেঞ্জ সবকিছুই …
আবৃত্তির ক্ষেত্রে ছকভাঙ্গার একটা তাগিদ চোখে পড়েছিল বৈকি! এই শতাব্দীর শুরু থেকেই অন্যান্য সকল শিল্পমাধ্যমে বেশ বড়সড় বিপ্লব ঘটে গেছে,যেমন সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, বাংলা আধুনিক গান ইত্যাদি। শুধুমাত্র আবৃত্তির জগতে এখনো অনেকটাই গতানুগতিক চলন। কবিতার নির্বাচন, বাচনভঙ্গি, আবহসঙ্গীত,এমনকি অ্যালবামের প্রচ্ছদ - সব দিক দিয়ে বহমান প্রথার বাইরে বেরোতে চেয়েছি।
আমি ছোট থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছি। মা,বাবা,কাকা,পিসি,মামা,মাসি,মেশো সকলেই কোনও না কোনওভাবে নাচ,গান,নাটক,লেখালেখির সাথে যুক্ত। হয়ত সেখান থেকেই ইনহেরিট করেছি। ছোটবেলায় মা শিখিয়ে দিতেন আবৃত্তি। মাধ্যমিকের পর বাবা নিয়ে গেলেন শ্রদ্ধেয় জগন্নাথ বসুর কাছে, প্রায় দশ বছর তাঁর কাছে শিক্ষানবিশি ক'রে বর্তমানে ঊর্মিদি,আরেক শ্রদ্ধেয় মানুষ ঊর্মিমালা বসুর শিক্ষণসংস্থা 'কথানদী'র সাথে যুক্ত। কিন্ত অ্যালবামের বা রেকর্ডের জগতে আমায় হাত ধরে টেনে নিয়ে আসেন আবৃত্তিশিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা যায় তিনিই তাঁর একটি অ্যালবামে আমায় প্রথম সুযোগ দেন, আশা অডিও থেকে বেরোনো 'নাশ'(২০১২), পরে আমার কাজ ভাললাগায় একটি গোটা রেকর্ড প্রযোজনা করার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নেন, যা তিনি আগেও করেছেন অলক রায় ঘটক, মানসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। আমার এই একক অ্যালবামটির নাম 'অথ না লক্ষ্মী কথা', কসমিক হারমনি থেকে ২০১৩ তে রিলিজ করে।
এই প্রশ্ন টা বেশ মজার,কেন তা পরে বলছি, তার আগে বলি, অনেকে মনে করেন, একই পেশায় থাকলে মন মালিন্য ঘটে,সম্পর্ক নষ্ট হয়। আমার মনে হয়, আমি যদি এয়ারহোস্টেজ হতাম, কিম্বা তিনি যদি ডাক্তার হতেন, তাহলে ব্যাপারটা মোটেও জমত না। বরং এই যে একে অন্যের অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারি, কেরিয়ার সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারি, এটা কিন্তু সম্ভব হত না। এবারে পরের অংশে আসি, আমায় কিন্তু বেশ ভাবাল এই অংশটা। প্রতিযোগিতায় কতটা এগিয়ে রেখেছে বলতে পারব না, তবে বাচিকশিল্পের একজন চর্চাকারী রূপে সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরণী হিসেবে নিজেকে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী বলে মনে করি। বাকশিল্প নিয়ে তাঁর চর্চা,ভাবনা এবং প্রয়োগ অনেক বেশি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। সেক্ষেত্রে অনেকদূর উপকৃত তো আমি বটেই। তবে কতটা গ্রহণ করতে পারছি, তার উপরেই সবটা নির্ভর করে।
তবে দেখো, গুরু তিনিই হবেন যিনি দিকদর্শন করাবেন, কখনো স্নেহ, কখনো শাসনের দ্বারা তিনি অনুজকে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আমি আমার ক্ষেত্রে গুরু হিসাবে স্থান দেবো অবশ্যই সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
আকাশবাণীর সাথে যুক্ত আছি প্রায় এগারো বছর। প্রথমে যুববাণী, পরে ২০০৭ থেকে আকাশবাণীর দুটি এফ এম রেডিও স্টেশন এফ এম রেইনবো আর এফ এম গোল্ড এ আছি, রেডিও জকি হিসাবে। ২০০৪ এ নাটক নিয়ে রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্স করার পর পরই রেডিও তে কাজ করা শুরু। তাই প্রথমে তত বুঝিনি, পরবর্তীতে কাজটার প্রতি অসম্ভব ভাললাগা তৈরি হল। আমি এমনিতে বেশ শাই। পর্দার এপাশে থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে এই যে প্রাণের যোগাযোগ, অথচ কেউ আমায় দেখতে পাচ্ছেন না; আমি রোগা, না মোটা, লম্বা না খাটো; কিছু না জেনেই বন্ধুত্ব হয়ে যাচ্ছে- এই ব্যাপারটায় ধীরে ধীরে কেমন মোহগ্রস্ত হয়ে গেলাম। আজও সেই মোহ থেকে বেরোতে পারিনি। সেক্ষেত্রে একথা বলাই যায় রেডিও প্রেজেন্টেশন আমার নেশা এবং পেশা।
bangla abrritti subroto projuktii ( https://m.facebook.com/banglaabrittsubrotoprojuktii ) নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এখানে মূলত আমাদের আবৃত্তির trackগুলিই পাওয়া যাবে। এছাড়াawaakakha voice trainer subroto bondyopadhyay যেটি রয়েছে সেটি হল abrriticharchar ( https://m.facebook.com/Aabritti Charchasubrotobondyopadhyay ) এই পেজটি সম্পর্কে কিছু বলার আছে, আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগে আবৃত্তি শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় এটা উপলব্ধি করেছিলেন, বহু আগ্রহী মানুষ এই আবৃত্তির সাথে যুক্ত হতে চান, কিন্তু অনেক সময়ই মূল স্রোতের বাইরে বা শহরের মূলকেন্দ্র থেকে দূরে থাকার ফলে সঠিকভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয়না। অথচ তাঁরা আবৃত্তি নিয়ে চর্চা চালিয়ে যেতে চান,ভাবতে চান; এই দূরত্ব ঘোচানোর জন্যই তিনি 'আবৃত্তিচর্চার অ আ ক খ' নামে তিনটি অ্যালবাম (শিক্ষণপ্রযোজনা) প্রকাশ করেন। খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে বহু শিক্ষার্থী অ্যালবামটি না পেয়ে বারবার আবেদন জানান ইন্টারনেট এর মাধ্যমে কিভাবে সেগুলি পাওয়া যেতে পারে। তখন উনি ভাবেন, you tube এর সাহায্য নেওয়ার কথা এবং পেজের মাধ্যমে আগ্রহী চর্চাকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা। এই দুটি পেজের সাথেই জড়িয়ে রয়েছি আমি।
অন্যান্য কলা শিল্প মাধ্যমগুলির মত আবৃত্তিও মূলত নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম,যা অনেক মানুষের নান্দনিক তৃপ্তির কারণ হয়। সে সূত্র মেনে এমন কোনও লেখা, যার সঙ্গে আমি নিজেকে সংযুক্ত করতে পারিনা, তা গ্রহন করতে পারিনি। বলতে পারো এক্ষেত্রেও ছক ভেঙ্গেছি। আমার মনে হয়, আমার পরিবেশনার তিনটি মূল স্তর। কবিতা নির্বাচন, বাচনভঙ্গি এবং আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার। প্রথমেই আসে কবিতা নির্বাচন বা টেক্সট সিলেকশন এর কথা। দেখো, বর্তমানে মেয়েরা অনেকটাই স্বাধীন, এবং তার সাথে সাথে তারা নিজেদের ভালোলাগা, না-লাগা, ভালবাসা, প্রেম, শরীর নিয়ে সব অনুভূতির কথাই স্পষ্টভাবে বলতে শিখে গেছে। ফলে নারীর অধিকার, অত্যাচার, নির্যাতনের পাশাপাশি বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে অসম প্রেম, শরীরী প্রেম, দুষ্টুমিষ্টি পরকীয়ার মত তথাকথিত নিষিদ্ধ প্রসঙ্গগুলিও। যখন বাংলা সিনেমা, নাটক,উপন্যাস এতটা প্রাপ্তমস্কতার পরিচয় দিচ্ছে প্রতিমুহূর্তে, তখন আবৃত্তির ক্ষেত্রে এই ছুৎমার্গ কেন?
তুমি ‘নিষিদ্ধ’ নামে একটি কবিতা ইউ টিউবে দিয়েছ গত বছর ।তোমার অ্যালবামেও আছে কবিতাটি । খুব পপুলার হয়েছে । আমার আড়াই বছরের মেয়ে কি বোঝে জানি না , খুব পছন্দ করে শুনতে এটি । তুমি যেমন অসাধারণ আবৃত্তি করেছ তেমনি মিঊজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট কেও কি এর সাফল্যের জন্য অনেকটাই বাহবা দেবে না ? কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে মিঊজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট কতটা গুরুত্বপুর্ণ বলে তুমি মনে কর ?
তোমার লেখা 'নিষিদ্ধ' কবিতাটি রয়েছে আমার অ্যালবাম 'নহি সামান্যা'(দুই মেরুর গপপো/আশা অডিও/২০১৪) তে। এই আবৃত্তির ক্ষেত্রে ইউনিক মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের কারণেই বোধহয় তোমার মেয়ে মজা পায়। তবে বড় হয়ে কবিতাটি বুঝতে শিখলে সে কি বলবে জানি না। আবৃত্তির ক্ষেত্রে আবহ সঙ্গীত একটা বড় ভূমিকা গ্রহন করে। আমার এবং নিজের ক্ষেত্রেও সব কাজেরই মিউজিক কনসেপ্ট সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের। এ ব্যপারে এখন তাঁকে সাহায্য করছেন অ্যারেঞ্জার, প্রোগ্রামার শমীক কুণ্ডু।
আবৃত্তি করতে গিয়ে একটা লেখার ওপর কতটা স্বাধীনতা নাও ? সেটা কিভাবে রস এবং আবেদন বাড়ায় একটু উদাহরণ দিয়ে যদি বল …
আবৃত্তিকার যখন কোন কবিতা কন্ঠে ধারণ করেন, তখন সেটি তাঁর হয়ে যায়। তিনি লেখ্য ভাষা কে কন্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। শুধু শব্দ উচ্চারণ করেন না, বরং স্বরের মাধ্যমে প্রতিটি বর্ণের ধ্বনি আদায় করতে করতে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেন। অন্যদিকে নাটকের ক্ষেত্রে আমরা জানি 'অ্যাকটিং বিটুইন দ্য লাইনস'এর কথা। আমার বাচনভঙ্গির এটাই বৈশিষ্ট্য, যেহেতু নাটক নিয়ে পড়াশোনা, পরিবেশনায় নাটকের প্রভাব এড়াইনি। ফলত, কখনো শ্বাস, কখনো অনুভূতিপ্রকাশক ধ্বনি, কখনো বা একটা কি দুটো শব্দ উচ্চারণ করেছি এস্থেটিক্স বা নান্দনিকতার স্বার্থে। আর উদাহরণ হিসাবে তো আবারো তোমার লেখা 'নিষিদ্ধ' কবিতার কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে। আবৃত্তির ক্ষেত্রে একদম শেষে যে 'ডোন্ট মাইন্ড' শব্দদুটি উচ্চারণ করেছি, সেটা কিন্তু তুমি লেখনি।
হ্যাঁ, আমি আবৃত্তি শেখাই। প্রতিটি শিল্প মাধ্যমেরই একটা বেসিক ব্যাকরণ আছে। আর সঠিক প্রশিক্ষকই তার শিক্ষা দিতে পারেন। প্রশিক্ষণ ছাড়া শিখতে গেলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও ঋষিপ্রতিম জীবনযাত্রা প্রয়োজন। ব্যতিক্রম হলেও কেউ কেউ এমন আছেন কিন্তু।
প্রথম অ্যালবাম 'নাশ', আশা অডিও,২০১২ তে প্রকাশিত। দ্বিতীয় 'অথ না লক্ষ্মী কথা', কসমিক হারমনি থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত, এটি আমার প্রথম একক। তৃতীয় অ্যালবাম 'নহি সামান্যা', আশা অডিও,২০১৪। আমার ও সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি সিডি একই মলাটে, 'দুই মেরুর গপপো' নামে। কোলকাতার প্রায় সমস্ত রেকর্ডের দোকানেই পাওয়া যাবে। তবে আমার ওয়েবসাইট (www.projuktii.com) ও ইউটিউবেও কিছু আবৃত্তি পাওয়া যাবে। ইউটিউবের ক্ষেত্রে টাইপ করতে হবে projuktii/bengali recitation.
প্রতিদ্বন্দ্বী কাউকেই মনে করি না। আসলে এই ধরণের মানসিকতা কাজ ক'রে যাওয়ার গতি কে রুদ্ধ করে, দৃষ্টি মোহাচ্ছন্ন করে। নিজেকে মূল্যায়ন করার মত জায়গায় এখনো পৌঁছাইনি। এখনো অনেক পথ চলার বাকি।
দেখো লবিবাজি বা সংকীর্ণ গোষ্ঠীবদ্ধ মানসিকতা সেই গুহাজীবন থেকে মানুষ বহন করে আসছে। ওটা তো থাকবেই। প্রত্যেক মানুষের একটা কমফোর্ট জোন থাকে। তার ভিতরেই থাকতে তারা ভালবাসে, নিরাপদ মনে করে। ফলে পরিচিত গণ্ডির বাইরে যেতে চায় না। তবে শিল্পের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি নৈর্ব্যক্তিক হলেই বোধহয় ভাল।
না, সরকারী বা বেসরকারিভাবে কোন স্বীকৃতি পাইনি। তবে আমি যে ধারায় চলেছি, চলতে চাইছি, সেটা আমার শ্রোতাদের ভাল লাগছে, মানুষের ভাল লাগছে, এটা একটা বড় প্রাপ্তি।
অনেক ধন্যবাদ প্রযুক্তি , তোমার খোলামেলা আলোচনার জন্য । আমরা কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে যতটা মাতামাতি করি , অনেক সময় ই ততটা গুরুত্ব দিয়ে তাদের কথা ভাবি না , যারা আমদরবারে কাব্য সাহিত্যকে উপস্থাপণ করেন, পপুলারাইজ করেন , প্রসারিত করেন আমাদের কাব্যচেতনা । বাচিক শিল্প সাধারণ মানুষের প্রাণের অনেক কাছাকাছি এনে দেন বিখ্যাত , কম খ্যাত , অখ্যাত কবিদের সৃষ্টিকে । তাই তাদের ভূমিকা আরো অনেক গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি । ‘আত্মার সান্নিধ্যের’ পক্ষ থেকে তোমাকে অনেক কৃতজ্ঞতা । তোমার আগামীর আরো অনেক সাফল্য , যশ কামনায় আজকের মত টা টা , ফির মিলেঙ্গে …
|
|
প্রযুক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ০৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন