স্বাধীনতা সংগ্রামে বহু বরেন্য মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। আবার কত শত জন নীরবে লোক চক্ষুর আড়ালে স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। তারা কোনদিন পাদপ্রদীপের আলোয় আসেননি। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা কেউ জানেও না। তেমনই এক মহীয়সী আমার অভি ঠাম্মা। যার আসল নাম অভয়া সুন্দরী।
অভি ঠাম্মা আমার ঠাম্মা নয়, বাবার ঠাম্মা। বাবার জ্ঞাতি দাদুর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী। তখনকার সমাজ ব্যবস্থার নিয়ম মেনেই বারো বছরের অভিঠাম্মা পঞ্চাশোর্ধ স্বামীকে মেনে নিয়েছিলেন। পাঁচ বছর না পেরুতেই দাদু মারা গেলেন। সতের বছরের ভরা যুবতীর থান পরে স্থান হলো বাড়ীর এক কোণে। সৎ ছেলে বউদের অনুগ্রহে একবেলা আতপ চালের দুটি সেদ্ধ ভাত জুটতো। বিনিময়ে বিনে পয়সার আয়াগিরি । অভি ঠাম্মা কিছু পড়াশোনা শিখেছিলেন বাপের বাড়িতেই। বই পত্তর পড়ে তার বাকি সময় কাটতো। কোন অভিযোগ ছিল না।
সেটা ত্রিশের দশক। অভিঠাম্মার বয়সও ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। এমনই এক গ্রীষ্মের ভরা দুপুরে অভি ঠাকরুন সদর দরজা বন্ধ করতে যাবেন হঠাৎ এক পঁচিশ ত্রিশের যুবক উদ্দত পিস্তল হাতে হুড়মুড় করে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। ছিন্ন ভিন্ন পোষাক, দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত। প্রথমে চমকে উঠেছিলেন অভি ঠাকরুন, কিন্তু নিজেকে সংযত করেন মুহুর্তে। নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। গান্ধীবাদের পাশাপাশি দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা তাঁর অজানা ছিল না। হয়তো মনে প্রাণে সমর্থনও করতেন। তাই শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন,
- তুমি কি বেপ্লবী ?
- ... হ্যাঁ, কিন্তু পিছনে পুলিশ! এখানেও আসবে। ওরা আমাকে দেখেছে।
- দেশের কাজ করতে নেমেছ মরতে ভয় পাও কেন ?
- মররতে ভয় পাই না কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি। আপনি বাঁচান আমাকে। আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়তে চাই না।
তখন বহরমপুর শহর ফাঁকা ফাঁকাই ছিল। সারা শহর জুড়ে গোরা পুলিশ ঘুরে বেড়ায় অভি ঠাকরুন দেখেছেন। শুনেছেন তাদের নৃসংশতার কাহিনী। মনস্থির করে ফেলেন তিনি। ছেলেটিকে সোজা নিজের শোওয়ার ঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের খাটে শুইয়ে দেন। ঠাকুর ঘর থেকে চন্দন এনে গোটা মুখে লেপে দিয়ে মশারী ফেলে দেন। নিজেও থান বদলে একটি রঙীন শাড়ী পরে নেন। ততক্ষণে সদর দরজায় পুলিশের বুটের লাথি। দরজা খোলো, নয়তো ভেঙ্গে ফেলবো। ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্নদের দিবা নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। বাড়ির কচিকাচারা পুলিশ দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। পুলিশ সংক্ষেপে আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করে ঘরের তল্লাশি শুরু করল। কোথাও কিছু না পেয়ে তারা প্রায় ফিরেই যাচ্ছিল হঠাৎ নজর পড়ল ঠাকুর দালানের পাশে ছোট্ট একটা ঘরের উপর। বাড়ির বড়রা হাঁ হাঁ করে উঠল ওদিকে ঠাকুর ঘর ! গোরা পুলিশ এক ধমকে ওদের চুপ করিয়ে এগিয়ে গেল। ঠাকুর ঘর দেখেই নক করল অভি ঠাম্মার ঘরে। অভি ঠাম্মা প্রস্তুত ছিলেন। খানিকটা সিঁদুর মাথায় দিতে গিয়ে একটু থামলেন। বিধবার সিঁথিতে সিঁদুর! সংস্কারে বাধছে। কিন্তু একজন মানুষের চেয়ে কি সংস্কার বড় ? না সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর লাগিয়ে দরজাটা খুললেন। ঘরে ধূপের ধোঁয়ার গন্ধ। অভি ঠাম্মা দরজা অল্প খুলেই বললেন ....
- ওমা পুলিশ নাকি গো । ও বাবা, কি হবে গো ....
পুলিশের একজন বললো আপনার ঘর সার্চ করা হবে। একজন স্বদেশী এসে এ বাড়ীতে ঢুকেছে আমরা দেখেছি। অভি ঠাম্মা নাকি কান্নার সুরে বলতে শুরু করে ..
- কেমন মানুষ গো তোমরা ! আমি এ বাড়ীর কাজের মেয়ে। দেখছো না আমার সোয়ামীর বসন্ত রোগ হয়েছে তারই সেবা করছি। অতই যদি সন্দ তবে দেখে যাও কেনে বাপু ! দেখছ না পাড়ায় রোজ কত মরছে এই রোগে ? এসো দ্যাখো ....
গোরারা এদেশের ম্যালেরিয়া আর স্মল পক্সকে ভীষন ভয় পেতো। তাই পক্স শুনেই ওরা তড়িঘড়ি সদর দরজার দিকে এগোলো। বাড়ির কর্তা অভি ঠাম্মার বড় সৎ ছেলে ও তাদের কাকা বোধ হয় কিছু বলতে চেয়েছিলেন । কিন্তু চিরদিনের শান্ত অভি ঠাম্মা এত কঠোরভাবে তাকিয়েছিলেন যে ওরা আর কিছু বলতে পারেনি।সেই রাত্রেই বাড়ীর গাড়োয়ানকে দিয়ে ছেলেটিকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন অভি ঠাম্মা সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে। কিন্তু এই কাজের জন্য দিতে হলো চরম মূল্য।
বিধবার সিঁদুর পরা, অচেনা অজানা পুরুষকে নিজের শোবার খাটে শোয়ানো ... তাকে স্বামী বলে পরিচয় দেওয়ার অপরাধ ও তাদের ভাষায় পাপ করার শাস্তি স্বরূপ সমাজপতিদের হুকুমে অভি ঠাম্মাকে ন্যাড়া করে ঘোল ঢালা হল। গোবর খাওয়ানো হল। সম্পত্তি থেকে বেদখল করা হল।
অভি ঠাকরুন ওরফে অভয়া সুন্দরী এ অপমান সহ্য করতে পারেন নি। বললেন, আমি বিধবা কিন্তু অসহায় নই। তোমরা আমার সঙ্গে যা করলে তার মূল্য একদিন না একদিন চুকাতেই হবে। তিনি তাঁর গচ্ছিত শেষ সম্বল গয়নার বাক্সটি ও নগদ কিছু টাকা নিয়ে কাশী পাড়ি দিলেন। যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন নীরবে দেশের কাজ করেছেন বিশেষ করে স্ত্রী শিক্ষা । পড়াশোনা থেকে হাতের কাজ করা শিখিয়ে স্বাবলম্বী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন। ‘গুরুমার পাঠশালা’ নামে তার স্কুল ছিল।
আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। বহু শহীদের আত্মত্যাগে পতপত করে উড়ছে স্বাধীন পতাকা। কিন্তু নীরবে কত প্রাণ যে উজাড় করে দিয়ে দেশের স্বাধীনতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে সব খবর আজও অজানা ইতিহাস হয়েই রয়ে গেল। আমার অভি ঠাম্মা সেই বীরাঙ্গনা। তাঁকে আমার প্রণাম। জয় হিন্দ।
![]() |
| পরিচিতি |
শুক্লা সান্যাল
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন