এবারের আড্ডায় আমাদের মুখোমুখি কবি , গল্পকার , সম্পাদক , নাট্যাভিনেতা , প্রাবন্ধিক , শিক্ষাবিদ এবং সমাজসেবী শ্রী কমলেশ গোস্বামী । সর্বজনপ্রিয় , অদম্য প্রানশক্তি সম্পন্ন মানুষটির সাংগঠনিক
শক্তিও প্রশংসনীয় । উনি যেভাবে আমাদের প্রতিটি জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছেন তার ব্যস্ত
শিডিউল থেকে আমরা কৃতজ্ঞ । ওনার সৃষ্টিমুখর সুস্থ আগামী কামনা করি । আমাদের পক্ষ
থেকে অনাবিল শুভেচ্ছা এবং কৃতজ্ঞতা ...
আপনার জন্ম কর্ম বেড়েওঠা সবই কি
রায়গঞ্জ এ ? বন্দর এলাকার গোস্বামী
বাড়ি তো এখানকার বনেদি বাড়ি গুলির অন্যতম । ব্যাবসা বাণিজ্য , জমিজমার প্রতিই স্বাভাবিক আগ্রহ থাকার কথা ।
সেখান থেকে সাহিত্যের অঙ্গনে এলেন কিভাবে ?
বাড়িতে
কারুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এ বিষয়ে ?
ব্যাকগ্রাউনডটা
যদি একটু বলেন আমাদের ...
স্নেহের শর্মিষ্ঠা , আগে কেউ
আমাকে এভাবে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে নি । আমি আমার মত উত্তর দেবার চেষ্টা করলাম ।
জানি না এটা কাউকে আকর্ষণ করবে কিনা ,
তবে
উত্তর দেবার ক্ষেত্রে সৎ থাকব কথা দিচ্ছি । রাইগঞ্জ , অধুনা রায়গঞ্জ আমাদের সাত পুরুষের বাস । ১৭৭৩ সালে
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় এক সন্ন্যাসী সৈনিক রায়গঞ্জে আসেন । এখানে তার মঠের নাম
ছিল গিরি গোঁসাই এর মঠ । সন্ন্যাসীরা ত বিবাহ করতেন না । মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি
জানকী নামে এক শিশুকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন । তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নি ।
তিনি ইংরেজি ও ফার্সিতে পারদর্শী ছিলেন । রায়গঞ্জের প্রথম অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট , রেজিস্ট্রার ও জমিদার রূপে স্বীকৃতি পান ।
আমরা তাঁর উত্তর পুরুষ । আমার ঠাকুরদা ঈশ্বর যতীন্দ্র মোহন গোস্বামী নাটক , সঙ্গীতের সাথে যুক্ত ছিলেন । আমার বাবা কল্যাণ
কুমার গোস্বামী নাটক , সমাজসেবার সাথে
যুক্ত ছিলেন । সাহিত্যের অঙ্গনে এসেছি ২০০১ সালের গোড়ার দিকে । স্ত্রী সুনন্দা
লেখালেখি করে । মাঝে কিছুদিন সরে ছিল । পরে আবার আমরা একসঙ্গে সাহিত্য চর্চা শুরু
করি ।
আপনার গল্প সংকলন , ‘প্রান্তিক’, প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে । আর কোনও নতুন সংকলন আছে , বা আসছে ?অগুন্তি ম্যাগাজিনে গল্প লেখেন । সেগুলি উৎসাহী পাঠকের হাতে পৌঁছনোর বন্দোবস্ত
কি ?
আমার প্রথম লেখা ২০০৩ এ ‘আনন্দমেলা’ তে প্রকাশিত হয় ।
ঐ বছর ই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দফতরের ‘আলোর ফুলকি’ তে এবছি’ছোটদের কচিপাতা’
তে
প্রকাশিত হয় । তারপর অনেক গল্প জমে গেলেও গল্প সংকলন করা হয় নি । পরে উত্তরবঙ্গের
ওপর তিনটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । ‘রাইগঞ্জের ইতিহাস ‘, (নির্বাহী সম্পাদক ), ‘বিদ্রোহ ও আন্দোলনে উত্তরবঙ্গ ‘, (সম্পাদক) , ‘উত্তরবঙ্গের ইতিহাস- পরিবেশ ও পর্যটন ‘(সম্পাদক) , এছাড়া রায়গঞ্জ ইন্সটিটুটের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে
ইন্স্টিটিউটের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস ‘রাই ১৯৩৯-২০১৫’ নামে প্রকাশিত হয়েছে । এগুলো ছাড়াও কিছু লিটিল
ম্যগাজিন , নন্দন , কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান , আমার রুপসি বাংলা , দিবারাত্রির কাব্য , শৈব ভারতী , দৈনিক স্টেটসম্যান ,
উত্তরবঙ্গ
সংবাদ ইত্যাদিতে নিয়মিত লেখা প্রকাশ হয়েছে । বন্ধু , তোমাদের নবপ্রযুক্তিতে আমি নবাগত বৃদ্ধ , পাঠকের হাতে পৌঁছনোর রাস্তা আমার জানা নেই ।
বিদ্রোহী কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে –
‘আকাশেতো
আমি রাখিনাই মোর উড়িবার ইতিহাস / তবু উড়েছিনু সেই মোর উল্লাস ‘।
আকাশবাণী শিলিগুড়ির ‘প্রান্তিক’ অনুষ্ঠানে আপনাকে
গল্প পরতে শুনি । কতবছর ধরে পড়ছেন ?
রেকর্ডিং
নিয়ে মজার কোনও অভিজ্ঞতা আছে ? প্রথম রেকর্ডিং এর
অনুভুতি কেমন ছিল ?
আকাশবাণী শিলিগুড়িতে প্রায় দশ – বারো বছর হোল । প্রান্তিক অনুষ্ঠানে গল্প পাঠ
করি । রেকর্ডিং নিয়ে মজার গল্প নয় । তীব্র আত্মগ্লানি আছে । গল্পকার রূপে আমাকে
স্বীকৃতি দেন উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ সম্পাদক স্বর্গীয় অজিতেশ ভট্টাচার্য মহাশয় ।
রায়গঞ্জে এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে এসে আমার লেখা ‘বাণ’ গল্পটি শুনে মুগ্ধ
হয়েছিলেন । প্রথম রেকর্ডিং করতে গিয়ে দেখি অজিতেশবাবু রেকর্ডিং করতে এসেছেন । তখন
আমার গল্প অনেক পত্র পত্রিকায় বের হচ্ছে । হয়তো মনে মনে একটু অহংকারও জন্মেছে ।
ওনার সাথে কথা বলছিলাম । রেকর্ডিঙের জন্য ডাক পড়ল । আমি চলে গেলাম , বাড়ি ফেরার বাসে ওঠার পর আমার বিবেক যেন
চাবুকের ঘা খেয়ে জেগে উঠল , রেকর্ডিং এ যাবার
সময় আমি ওনাকে প্রণাম করতে ভুলে গেছিলাম ,
ওনাকে
গুরু মানি । পরে অনেকবার দেখা হয়েছে ,
প্রণামও
করেছি । সেদিনের না করার ভুলটা আজও বিবেককে রক্তাক্ত করে । সেটা কি নার্ভাসনেসের
জন্য নাকি আমার - । নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি ।
উত্তরবঙ্গের জনজীবন , প্রাকৃতিক প্রাচুর্য , ঐতিহ্য ,
সংগ্রামের
ইতিহাস এসব কিছু নিয়েই তো আপনি তিন তিনখানি প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছেন । কেবল
উত্তরবঙ্গে আটকে থাকাটা কি ইচ্ছাকৃত ?
আমি উত্তরবঙ্গের সন্তান । উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি
, মানুষের সাথে আমার নাড়ির
টান । উত্তরবঙ্গ চির অবহেলিত । এখানকার সন্তান হিসেবে আমি সমস্ত অবিচারের প্রতিকার
চাই , তাছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক
প্রাচুর্য , ঐতিহ্য , নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমি বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু
মানুষের কাছে তুলে ধরতে চাই । এটা উপ্ততরবঙ্গে আটকে থাকা নয় । কোন ভালো কাজ করতে
হোলে বাড়ি থেকেই তা শুরু করা ভালো । সেক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ আমার প্রথম পছন্দ । এক
জায়গায় বদ্ধ হয়ে থাকা আমার স্বভাব নয় । কবিগুরুর লেখা আমায় ভাবায় – ‘হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোন খানে ‘’। মানুষের জীবন অনন্ত খজ , এ খজ সারা জীবনের ।
আমার পরিচয় গল্পকার , প্রাবন্ধিক না সম্পাদক রূপে পাঠকের কাছে
গ্রাহ্য হবে তা কেবলমাত্র পাঠকই বলতে পারেন । তবে আমি নিজেকে সংস্কৃতি মনস্ক
অনুসন্ধিৎসু একজন সমাজকর্মী রূপে ভাবতে ভালোবাসি ।
কিছুদিন আগে আপনার বাগান
বাড়ি ‘সুহাসিনী’ তে ‘চৈতন্য’ পত্রিকার প্রকাশ , গুণীজন সম্বর্ধনা কে উপলক্ষ করে উত্তরবঙ্গ , দক্ষিণবঙ্গ এমনকি দিল্লী থেকেও কবি , সাহিত্যিক , সমাজতাত্ত্বিক সকলকে নিয়ে তিনদিনের বিশাল মিলনমেলা করলেন ।
এত বড় মাপে সবকিছু আয়োজনের শক্তি ও সাহস পান কোথা থেকে ? বিশাল আর্থিক দায় ও তো বইলেন । কিসের তাগিদে ?
প্রথমেই আপত্তি জানাচ্ছি বাগানবাড়ি শব্দটিতে ।
একজন প্রখ্যাত কবি অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায় এ বাড়িটার নাম দিয়েছেন ‘লেখাবাড়ি’। চৈতন্য পত্রিকার
অনুগল্প সংখ্যা ‘লুপ’ গল্পে এর উল্লেখ আছে । ছোটবেলা থেকেই
সংগঠনমূলক বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলাম । হরিজন বিদ্যালয় , উদয়চন্দ্র বিদ্যাপীঠ , টেন ক্লাস গার্লস , অজয় সঙ্ঘ প্রভৃতি নানা শিক্ষা ও জনহিতকর
কর্মকাণ্ডে উদ্যোক্তার ভূমিকা নিয়েছি । ফলে হরিজন সম্প্রদায়ের সীতারাম জমাদার যেমন
আমার বন্ধু তেমনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীও আমার কাছের মানুষ
। কোনকিছু আয়োজন করার ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে শক্তি যোগায় । আর সাহসটা
চিরকালই আমার আছে । আর্থিক দায় আমরা স্বামী –স্ত্রী বিলাসিতা
বাঁচিয়ে করেছি ।
আপনার বাড়ির পাশেই ‘সুহাসিনী’ পল্লী প্রতিষ্ঠা
করলেন । কে এই সুহাসিনী দেবি ? হঠাৎ এমন একটা
চিন্তা মাথায় এল কেন ?
সুহাসিনী দেবী একজন মহীয়সী নারী ।
যতীন্দ্রমোহন গোস্বামীর স্ত্রী । নয় বছর বয়সে রায়গঞ্জ এ বিয়ে হয়ে আসেন ।
যতীন্দ্রমোহন তখন পাশ্চাত্যই শিক্ষায় শিক্ষিত । ব্রাহ্মসমাজ সহ উচ্চ মহলের অনেকের
সাথে যোগাযোগ । বউ শিক্ষিতা হবেন এই তার ইচ্ছে । সুহাসিনী দেবীর দাদা বানেশ্বর
গোস্বামী এস্টেটের তহশিলদার ছিলেন । লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী এই ভদ্রলোক বোনকে
বাংলা এবং ইংরেজি শেখানোর দ্বায়িত্ব নিলেন । শাশুড়ি হৃদিভারতী দেবী ও সুহাসিনী
দেবী স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন । ছোটবেলায় মা মারা যাবার পর বেশির ভাগ
সময় ঠাকুমার সাথেই থাকতাম , শুতাম , গল্প শুনতাম । আমাদের পাড়ার নাম বন্দর , কুলিক নদীর বন্দর । কথিত আছে নাবিকদের বন্দরে
বন্দরে বউ থাকে । প্রাচীন কাল থেকেই বন্দরে পতিতা পল্লী ছিল । ঠাকুমা বলতেন , ‘দাদা,
এখানে
মেয়েদের চরম অপমান সহ্য করতে হয় , তুই বড় হয়ে পারলে
মেয়েদের জন্য কিছু করিস । ‘ আমার যুবক বয়সে
রায়গঞ্জ গার্লস স্কুলের মর্নিং সেকশানে দশম শ্রেণী বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি
মেয়েদের স্কুল ছিল । সকালে হওয়ায় তিন ঘণ্টার বেশি ক্লাস হতো না । আমার উদ্যোগে এবং
বন্দর বাসীর সহায়তায় প্রথমে পতিতা পল্লীতে বসবাসকারীদের সাথে সভা করে সিদ্ধান্ত
নেওয়া হল , পতিতা পল্লীর পাশের জমিতে
মেয়েদের স্কুল হবে । এই পল্লী এখানে থাকবে না। দুই একজন জারা ব্যবসায় থাকতে রাজী
তাদের বহরমপুর পতিতা পল্লীতে পুনর্বাসন দেওয়া হয় । তাদের জমি জমা উপযুক্ত দামে
প্রতিবেশীরা কিনে নেন । অন্যরা সংসারী হয়ে যান । যে জমিতে নিম্নবিত্ত মানুষেরা সুহাসিনী
পল্লী গড়ালেন সেই জমিটিও সুহাসিনী দেবীর সম্পত্তি ।
আপনার গল্পের উপজীব্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই
গাঁ মাটির গন্ধমাখা মেহনতি মানুষ । প্রচুর দেহাতি শব্দের ব্যবহার দেখি আপনার লেখায়
। এসব উপাদান ই কি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লব্ধ নাকি বিশেষ স্টাইল অনুশীলনে আয়ত্ত করা ?
বাড়িতে দেখেছি সুহাসিনী দেবী দরিদ্র , মেধাবী দশজন ছাত্রকে কাছেরেখে পড়াশোনা করাতেন
। একটু বড় হতেই আমাকে দিয়ে নিয়মিত তিনবার মহাভারত পড়াতেন । আমার উচ্চারণের ভুল
শুদ্ধ করতেন , কঠিন অর্থ বোঝাতেন
। এটি আমার প্রিয় গ্রন্থ হয়ে ওঠে । রামায়ণ ঠাকুমাকে আটবার পড়ে শুনিয়েছি । অনেক
জ্ঞানলব্ধ আলোচনা শুনেছি পণ্ডিত সীতাকান্ত আচার্যর কাছে । জমিদার বাড়ি ছিল বলে , বর্গাদাররাও আসতেন । এদের মধ্যে সাঁওতাল , মুসলমান , রাজবংশী , বিহারী , তুরী ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন ।
ঠাকুমা এদের খাওয়াতেন , অর্থ সাহায্য
করতেন , অসুখবিসুখে খোঁজ খবর নিতেন
, এদের কোলেপিঠে আমি মানুষ ।
ওদের ঘরে গিয়ে দেখেছি ওদের জীবন । ওদের ভালোবাসা কখনো ভুলবো না । যখন গল্প লিখবো
ভাবলাম , ভেবে দেখলাম , উচ্চবিত্ত , মধ্যবিত্ত বা ড্রয়িংরুমের গল্প লেখার অনেক শিক্ষিত মানুষ
আছেন , কিন্তু আমি প্রান্তিক
মানুষজনের কাছের লোক । কবিগুরুর কথায় ,’যে আছে মাটির
কাছাকাছি / সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি ‘। তাই গল্পগুলি
জীবন থেকেই নেওয়া , কোন তৈরি স্টাইল
নয় ।
ছোটবেলায় দিদির গানের জন্য প্রথমে তবলা বাঁয়া
কেনা হয় , আমাকেও ভর্তি করা হয়
স্বর্গীয় কৈলাস ছন্দ্র দাস মহাশয়ের কাছে । ৬৯ এ গুরু শ্রী বাব্লু মজুমদার । তিনি
বিভিন্ন যন্ত্র বাজানোয় দক্ষ ছিলেন । আমি সেখানে তবলা , খোল ,
ঢোলক
, নাল , কঙ্গ ,
চামড়ার
তৈরি বাদ্য যন্ত্রগুলো বাজাতে পারতাম । বাংলাদেশ , নেপাল , বিহার , উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠান করেছি
আমরা । এছাড়া সঙ্গীত শিল্পী শ্রী অচিন্ত্য সেন , শ্রী নারায়ণ কুণ্ডু এবং আরো অনেকের সাথে সঙ্গত করেছি ।
অভিনয় আমাদের বংশে । আমার প্রথম পছন্দ অভিনয় ।
বাবা কাকাকে নাটকে অভিনয় এবং পরিচালনা করতে দেখেছি । ছোট বেলায় মামাবাড়িতে
থাকাকালীন ‘অজয় সঙ্ঘে’ ‘কালোমাটির কান্না’ নামে এক্তি নাটক মঞ্চস্থ করি খনি শ্রমিকদের
নিয়ে , বাবা যখন রায়গঞ্জ পৌরসভার
পৌরপতি তখন ইন্স্টিটিউটে বাহান্ন সপ্তাহে বাহান্নটি একাঙ্ক নাটক অভিনীত হত , একটিতে আমি বাবার সাথে অভিনয় করার সুযোগ
পেয়েছিলাম । বন্দরের যুবনাট্য সম্প্রদায় যাত্রা করতো , পৌরাণিক পালা সব , উনিশ পয়সা টিকিত । আমি এখানে যোগ দিলাম , প্রথম যাত্রা ‘লালবাঈ’। নতুন আঙ্গিক আমদানি
করলাম । টিকিত হল দুটাকা , তিনটাকা । মানুষের
ঢল নামত । একে একে ,’নাচমহল’, ‘সবার দেবতা’, ‘বেগম আশমান তারা,
রাজা
যদুর জালাল্লুদ্দিন হবার কাহিনী , পটভূমি দিনাজপুর , মালদা । ইন্স্টিটিউটে শ্রী অচিন্ত্য সেনের
পরিচালনায় অনেক নাটক করেছি , এর মধ্যে মারীচ
সংবাদ’, ‘স্পারটাকাস’, ‘এই নারী এই তরবারি’ আরও অনেক । এখানথেকে আমরা কোলকাতায়
রবীন্দ্রসদনে গিয়েও নাটক করেছি । ১৯৮৬ তে,
রিভিউ
ছাপা হয়েছিল ‘যুগান্তর’, ‘দেশ’
এবন
আরও কিছু পত্রিকায় । আমার নিজের ‘কোরাস’ নামে একটি দল আছে , এর দুটি প্রডাকশান ‘বিনয় বাদল দীনেশ’,
‘সন্ন্যাসীর
তরবারি’। আমার স্ত্রী ও কন্যাও
আমার সাথে অভিনয় করেছে । আজ থেকে ১০০ বছর আগে আমাদের বাড়িতে ‘মেবার পতন ‘
মঞ্চস্থ
করেছিলেন ঠাকুরদা । রায়গঞ্জে নাট্য চর্চার শতবর্ষ উৎযাপন করা হচ্ছে ২০১৫ র
ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ র ডিসেম্বর পর্যন্ত । সকলকে আমন্ত্রণ জানাই ।
অনুমতি দিলে একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি
... আপনার সহধর্মিণী শ্রীমতী সুনন্দা গোস্বামীও প্রতিষ্ঠিত কবি এবং সম্পাদক ।
বাড়িতে তো চাঁদের হাট । সমমনস্ক দুটি প্রতিভাবান মানুষ যখন জীবন কাটান একসঙ্গে
তারা সহযোগী হবেন বলাই বাহুল্য , কিন্তু জানতে
ইচ্ছে করছে , কখনও কি
ইগোক্ল্যাস হয় না ? কখনও কি প্রতিযোগী
মনে হয় না একবারের জন্যও একে অপরকে ?
আমার ক্লাস এইট আর সুনন্দার ক্লাস সিক্স থেকে
আমাদের পরিচয় । আমি তখন মামাবাড়িতে । সুনন্দা আমাকে পোস্টকার্ডে চিঠি লিখত ।
খুবসুন্দর চিঠি লিখত ও । আমি রায়গঞ্জ থেকে নদীয়ায় গেছি , জেলার টান কথায় , লেখায় । ক্লাস ইলেভেনে খাদ্য আন্দোলনের সাথে
যুক্ত হই । আমার বন্ধু আনন্দ হাইত পুলিশের গুলিতে মারা যায় । আমার নামে পি ডি একটে
ওয়ারেন্ট বের হয় । আমি বাড়িতে পালিয়ে আসি । বাবা তখন এখানকার পৌরপতি । রাজনীতি
ছাড়তে হবে , বাড়িতে ঢুকতে হলে , বাবার শর্ত । ঘুরছি এখানে ওখানে । সুনন্দার
সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন । প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল পাশ করি । সুনন্দা বহরমপুর গারলস
কলেজে ফার্স্ট ইয়ার । বাবা মারা গেলেন। আমার একুশ । ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম ।
সেই ‘তিন ভুবনের পারে’র গল্পের মত সুনন্দা প্রভাবিত হয়ে থাকবে । আমার লেখালেখিতে
আসা ওর প্রেরণায় । আমি ওর কাছে ঋণী । সুতরাং ক্ল্যাস হয় নি ইগোর । রবীন্দ্রনাথের
ভাষায় ,’তোমারে যা দিয়েছিনু সে
তোমারই দান / গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’।
ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন , বাবাকেও । আপনার কথাসাহিত্যে বিশেষ কোন লেখা
আছে কি যেখানে এই বেদনার প্রতিফলন ঘটেছে ?
সংগঠক হিসেবে আপনি অসাধারণ । কখনো মনে হয়
নি রাজনীতিতে এই গুণটিকে কাজে লাগানোর কথা ?
ছাত্রজীবনে বাম আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম । আমাদের
বাড়ি জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল বলে উগ্র রাজনীতির সমর্থকরা বাড়ির পাশ দিয়ে
স্লোগান দিয়ে যেত ,’জোতদার জমিদার
নিপাত যাক , নিপাত যাক’। বাবা মারা গেছেন । আমার উনিশ । নাবালক ভাইবোন । পরিবারকে
বাঁচাতে তখনকার ছাত্র যুব নেতা শ্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসে
যোগ দি । উনি যতদিন সুস্থ ছিলেন আমি তার সমর্থক ছিলাম । তিনি অসুস্থ হবার পর
রাজনীতি আমাকে আর টানে না ।
আপনার সম্পাদিত ‘বিদ্রোহ ও আন্দোলনে উত্তরবঙ্গ’ ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে শুনেছি । কে করছেন ? হঠাৎ ইংরেজিতেই বা কেন ?
কবি প্রাণেশ সরকার । দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের
নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর রাজীব নন্দী জে এন ইউ র নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান
ডক্টর আর কে জৈন কে বইটি দেন । ওনার স্ত্রী বাঙালি । তিনি স্বামীকে পড়ে শোনান ।
উনি বলেন , উনি মুগ্ধ । এত তথ্য বহুল
বই ইংরেজিতে অনুদিত হলে বিশ্বে প্রচার হবে ।
আমি ‘চয়ন’ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীতে চার বছর ছিলাম ।
সেই সময় পত্রিকাটি লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি প্রদত্ত
সেরা লিটিল ম্যাগাজিন এর পুরস্কার পায় ।
আপনার পরবর্তী প্রোজেক্ট কি ?
বর্তমানে উত্তরবঙ্গের বাউল সম্প্রদায় নিয়ে
একটা কাজ করছি । ‘সুহাসিনী’ নামে একটি উপন্যাস লেখার ইচ্ছে আছে ।
আপনার সম্পাদিত ‘উত্তরবঙ্গের পরিবেশ ও পর্যটন’ কলকাতায় বাংলা একাডেমীতে অত্যন্ত সফল অনুষ্ঠানে হলভরা
দর্শকের উপস্থিতিতে মোড়ক উন্মোচিত হয়েছিল শ্রী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর হাতে ।
দক্ষিণবঙ্গের অনেক নামকরা ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে ।
উত্তরবঙ্গকে এভাবে দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতির মক্কায় উপস্থাপনের সাহস, দূরদর্শিতাকে শ্রদ্ধা করি । আপনি কি মনে করেন
উত্তরবঙ্গের লেখক সমাজ সত্যিই প্রান্তিক ?
উত্তরবঙ্গের সমস্ত অঞ্চলটাই প্রান্তিক ।
উত্তরবঙ্গ বহু ভালো লেখকের জন্ম দিয়েছে । তার মধ্যে দু একজন ছাড়া সবাই কোলকাতা
গিয়ে বিখ্যাত হয়েছেন । এক্ষেত্রে আমরা প্রান্তিক ।
শর্মিষ্ঠা জানিনা , তোমার প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক দিতে পারলাম কি না
। সব বন্ধুদের আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই । তোমরা ভালো থেকো , ভালো রেখো , ভালো লেখো ।
|
|
শ্রী কমলেশ গোস্বামী
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ১৫, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন