প্রিয়দীপ



বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের উপকণ্ঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যে কুঠি বাড়ি আদতে এই বাড়িটি পূর্বে ছিল ইংরেজদের নীল কুঠি। শত শত বছরের শাসক ও শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের পতন ঘটেছে বহু আগেই। তবে তাদের শোষণের নানা স্মৃতিচিহ্ন অস্তিত্ব আজও বহন করে চলেছে অত্র এলাকা। এসব এলাকার মধ্যে শাহজাদপুর নীলকুঠি ( রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি ) অন্যতম। ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা গেছে শাহজাদপুর নদী তীরবর্তী কৃষিমাঠ জুড়ে  নীল চাষের জন্য তৎকালীন সময়ে উপযুক্ত এলাকা হিসেবে ইংরেজদের কাছে বিবেচিত হওয়ায়  এখানে প্রত্যক্ষভাবে আগমন ঘটে ইংরেজদের। পর্যবেক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে  গড়ে ওঠে এই নীলকুঠি।

নীল চাষে অত্র অঞ্চলের খেঁটে খাওয়া মজুর , কৃষকদের এক প্রকার বাধ্যতামূলক ভাবেই নিয়োগ করতেন ব্রিটিশ সরকারের তাবেদার এবং রক্তে নীল দোসরেরা। এক সময় অসহনীয় এবং কস্ট পীড়নের এই নীল চাষে মজুর – কৃষকেরা অনীহা প্রকাশ করে বিদ্রোহ শুরু করে । এক সময় দানা বেঁধে এই বিদ্রোহ আক্রমন হানে নীল কুঠিতে। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মজুর কৃষকদের  আন্দোলনের মুখে ছোট লাট গ্রান্ট এক সময় নীল চাষ বন্ধের ঘোষণা করেন । পর্যায়ক্রমে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর ইংরেজদের থেকে রানী ভবানীর কাছে নীল কুঠি’ টি  হস্তান্তর হয়।  ১৮৪০ সালে তিন তৌজির অন্তর্গত  শাহজাদপুরের এই অংশ নিলামে উঠলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর তেরো  টাকা দশ আনায় এই অংশ কিনে নেন। সেই থেকেই মূলত এই জায়গাটি  রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জমিদারির অংশ।

১৮৯০ সালে লন্ডন থেকে ঘুরে আসার পর রবীন্দনাথ ঠাকুরের ওপর কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ী ও নওগাঁর পতিসর কাচারিবাড়ী এলাকার জমিদারি তদারকির ভার ন্যাস্ত হয়। সে সময় কোনও স্থলযান চলাচলের রাস্তা ছিল না। জমিদারি দেখাশোনার কাজে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ কুঠিবাড়ী থেকে নদী পথে তার প্রিয় পদ্মা ও চিত্রা বোটে ( সজ্জিত নৌকা ) চেপে শাহজাদপুরে আসতেন । কখনো নদীতে জল কম থাকলে সোনাই নদীতে নৌকা রেখে রাউতারা থেকে পালকি করে আসতেন। ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দনাথ শাহজাদপুরে জমিদারি দেখাশোনা করেছেন।

ইতিহাস প্রসিদ্ধ এর নাম সেই থেকেই কুঠিবাড়ি।  প্রকৃতির সবুজের মাঝে হলুদ রঙের দ্বিতল ভবন। ভবনের দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার, উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। প্রতি তলায় সাতটি করে ঘর। উত্তর ও দক্ষিণে প্রশস্থ বারান্দা। ভবনের পাশেই কাছারি বাড়ি, মালখানা ও কর্মচারীদের বাসগৃহ।

এই কুঠি বাড়ির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তার মানস গঠনেও এ অঞ্চল , প্রকৃতির প্রভাব অনস্বীকার্য। শাহজাদপুরে চোখে দেখা বাস্তব চরিত্রগুলো তার সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। এখানেই যেন ধরণীর সঙ্গে কবিগুরুর প্রণয় ঘটে। কাচারি বাড়ির তার শোবার ঘরের দক্ষিণের বারান্দা এবং তার প্রিয় বকুল তলার বেদীতে বসে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে  থেকেই রচনা করেছেন অসংখ্য মূল্যবান কবিতা, গান ও ছোট গল্প। লিখেছেন তার প্রিয়জনদের কাছে অসংখ্য চিঠি।  তার সৃষ্টি-সম্ভারের উল্লেখযোগ্য অংশ শাহজাদপুরে বসে রচিত হয়েছে। বৈষ্ণব কবিতা, দুই পাখি, আকাশের চাঁদ, পুরষ্কার, হৃদয় যমুনা, ব্যর্থ যৌবন, প্রত্যাখ্যান, লজ্জা, চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীতে, নদীমাত্রা, মৃত্যু মাধুরী, স্মৃতি, বিলয়, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, যাত্রী, তৃণ, মানস লোক, কাব্য, প্রার্থনা, ইছামতি নদী, আশিষ গ্রহণ, বিদায়, নব বিরহ, লজ্জিতা, বিদায়, হতভাগ্যের গান, কাল্পনিক, যাচনা, সংকোচ মানস, প্রতিভা ইত্যাদি কবিতা এখানে লিখিত।

পোস্টমাস্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারা প্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি গল্প গুলোও এখানেই লিখেছেন। ছিন্নপত্রের ৩৮টি পত্র, পঞ্চভূতের অংশবিশেষ এবং বিসর্জন নাটক শাহজাদপুরে লেখা। এর মধ্যে, গোপাল সাহার মেয়ে সমাপ্তি গল্পের নায়িকা, হারান চক্রবর্তী ছুটি গল্পের ফটিক, তার কাছারির বাবুর্চি কলিমুদ্দি চিরকুমার সভার কলিমুদ্দি মিঞা, পোস্টমাস্টার মহেন্দ লাল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পোস্টমাস্টার গল্পের নায়ক।

ছিন্নপত্রে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাচারি বাড়ি সম্পর্কে লিখেছেন, “ আমি চারটি বড় বড় ঘরের মালিক।”  পূর্বে রবীন্দ্র কাচারি বাড়ি সংলগ্ন উত্তরে ও দক্ষিনে দুটি বড় বাগান ছিল। পাশেই ছিল একটি কৃত্তিম হ্রদ। রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যায় এই হ্রদের মধ্যে বারোমাস পদ্ম ফুল ফুটে থাকতো। একসময় এই কাচারি বাড়ি ঘিরে ছিল বড় বড় ঝাউ, লিচু, আম, দারুচিনি, কামিনী ফুলের গাছসহ আরো দুস্প্রাপ্য গাছ-পালা।  কবি এই বাগানের কথাই ছিন্ন পত্রে লিখে গেছেন, “ দক্ষিনের বারান্দায় কেবল মাত্র কামিনী ফুলের গন্ধে মস্তিষ্কের রন্ধ্র পূর্ণ হয়ে উঠে।”

কাচারি বাড়ির নিচের তলায় ছিল একটি ডাকঘর। পোস্টমাস্টার চিঠিতে স্ট্যাম্প দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কবির সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। তিনিই ‘পোস্টমাস্টার ’ গল্পের মধ্যে অমর হয়ে রয়েছেন। কুঠি বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদী দেখে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “ – আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।” এই কুঠি বাড়িতে তিনি যে সুখানুভূতি পেতেন তা লিখে গেছেন ছিন্নপত্রে। একটা যেন নতুন স্বাধীনতা পাওয়া যায়। যতটা খুশি নড়বার চড়বার আবার শরীর প্রসারণ করবার জায়গা পাওয়া মানুষের মানসিক সুখের যে একটা প্রধান অঙ্গ সেটা আবিষ্কার করা যায়। ” (ছিন্নপত্র ১৮৯৩, শাহজাদপুর)। কবির এই কথাতেই বুঝে নেওয়া যায় কি ছিলো এই কুঠি বাড়িতে।



এখন  এ বাড়িতে আসার জন্য নদী পথ নেই। তবে, প্রবেশের পথ মোটামুটি একই আছে। কবিগুরু বা তার পরিবারের সদস্যরা নৌকা বা পালকি করে যে পথ দিয়ে আসতেন, সেই পথেই এখন বাস বা রিকশা চলাচল করে। শাহজাদপুরে  বাসস্ট্যান্ড থেকে পূর্ব দিকের রাস্তা চলে গেছে কুঠিবাড়ির দিকে। রাস্তার শেষ মাথায় উত্তর-দক্ষিণ দুদিকে দুটি রাস্তা গেছে। উত্তর দিকের রাস্তায় গেলেই ‘রবীন্দ -কাছারি বাড়ি। মূল বাড়ির পেছনের দরজা এখানেই। বর্তমানে এই দরজা দিয়েই ভবনের ভেতরে  প্রবেশ করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

প্রবেশ পথ সংলগ্ন সবুজ উঠোনের এক প্রান্ত জুড়ে'ই  ফুল বাগান। নানান ফুলের সমাহার । একটু পিছিয়েই ঐতিহাসিক হলুদ রঙের দোতলা কুঠি। নিচের তলা জুড়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিভিন্ন ছবির মাঝে তার আঁকা বিভিন্ন ছবি এবং তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির পাতার অংশ বাধাই করে দেয়ালে টানানো রয়েছে।  উত্তর দিকের বারান্দার একেবারে পশ্চিমে সিঁড়িঘর। গোল-প্যাঁচানো সিঁড়িটি যেন সবাইকেই উপরে উঠতে আহ্বান করে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। ইতিহাসের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে দেই রবীন্দ্রনাথে ...




সিঁড়ির মুখেই দুটি দরজা। যার একটি দরজা দিয়ে প্রবেশকালেই চোখে পড়বে একটি পালকি। ঠাকুর বাড়ির পালকি।  যা  বংশ পরম্পরায় ব্যবহার হয়েছে।  আছে , পড়ার টেবিল, চিঠি লেখার ডেস্ক, আলনা, গোল টি-টেবিল। এরপর এক ঘর থেকে আর এক ঘরে সুন্দর ভাবে সুরক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের  ব্যবহত নানারকম আসবাবপত্র : বেতের চেয়ার, বড় ড্রেসিং টেবিল, চিনা মাটির ছাকুনি, টেবিল বেসিন, আলনা, দেবতার আসন, বড় টেবিল, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, আরাম কেদারা, পিয়ানো, কাঠের দোলনা চেয়ার, সোফা সেট, হাতলযুক্ত চেয়ার, স্ট্যান্ডে সংযুক্ত দুটি ড্রয়ার, হাতলওয়ালা গদিযুক্ত চেয়ার, আলনা স্ট্যান্ড, ৫টি আলমারি, আলমারির ভেতরে কেতলি, সসপ্যান, ফ্রাইপ্যান, লন টেনিস খেলার র্যােকেট, কাটা চামচ, চিনা মাটির ফুলদানি, ডিস, টব, জগ, জমিদারি মনোগ্রাম ৭টি, বালতি, কেরোসিনের বাতি, ঘণ্টা ট্রে, বাতির চিমনি ইত্যাদি। আরও রয়েছে দুটি খাট। এছাড়া আরও বহু কিছু একসময় এখানে ছিল। যেগুলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা’র জাদুঘরে স্থানান্তরিত হয়েছে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্থান গুলোর মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের এই কাছারি বাড়ি অন্যতম। ১৮৯৬ সালে তিনি শেষ বারের মতো শাহজাদপুর থেকে চলে যান। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত বাড়িটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত’র পাশাপাশি রবিন্দ্রভাবনার সাথে সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলছেন ,  বাংলাদেশ গনপ্রজাতন্ত্র সরকার এবং সন্মিলিত রবীন্দ্র প্রেমীরা।

কিভাবে  আসবেন -
ঢাকা থেকে সরাসরি আপনাকে আসতে হবে সিরাজগঞ্জ রোডে। সৃষ্টি এবং দৃষ্টি নন্দিত এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু ( যমুনা সেতু ) অতিক্রম করে একটু এগিয়ে গেলেই সিরাজগঞ্জ রোড নামক স্থান। ঢাকার গাবতলী ও মহাখালী থেকে  অনেক বাস (উল্লেখযোগ্য হল হানিফ, শ্যামলী, এস আর  ইত্যাদি ) সিরাজগঞ্জ রোডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।  ঢাকা থেকে পৌঁছেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টা। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার বাসে করেও আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে নামতে হবে সিরাজগঞ্জ রোডে’ ই। সিরাজগঞ্জ রোড থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে কাছারি বাড়ি’র অভিমুখে রউনা হতে হবে। পৌছাতে সময় লাগবে এক ঘন্টা। ট্রেনে আসতে চাইলে আপনাকে নামতে হবে উল্লাপাড়া স্টেশনে। ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেন পদ্মা, ঢাকা থেকে খুলনা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন ও চিত্রা, ঢাকা থেকে রাজশাহী রুটে চলাচলকারী আন্ত:নগর সিল্কসিটি ও ধুমকেতু, ইত্যাদি ট্রেন উল্লাপাড়া স্টেশন হয়ে যায় ।

কোথায় থাকবেন - 
শাহজাদপুর বাস স্ট্যান্ডে একটি ভাল মানের হোটেল আছে। এখানে ডিলাক্স, সেমি ডিলাক্স,স্পেশাল এবং সাধারণ মানের এসি ও ননএসির বিভিন্ন ধরনের রুম আছে।  এছাড়াও শাহজাদপুর শহরে আছে বিভিন্ন রেস্ট হাউস, এবং আবাসিক হোটেল।  এছাড়াও চাইলে ইতিহাস নন্দিত সাংস্কৃতিক শহর সিরাজগঞ্জ শহরেও থাকতে পারেন।



সহযোগী সুত্র - পাবনার ইতিহাস ও ঐতিহ্য



প্রিয়দীপ প্রিয়দীপ Reviewed by Pd on মে ০৯, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.