সুমি বিছানার এক কোণে চুপচাপ বসে আছে , .চোখের নীচে কালি পড়েছে , বারো বছরের একটা সদ্যফোটা ফুলের মত মেয়ে যেন কালের টানে গত একমাসে অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে । উড়ন্ত প্রজাপতির মত সারা বাড়ি উড়ে বেড়ানো ছটফটে সুমি আজ শিখে গেছে জীবনের মানে ।শিখে গেছে নিজের আত্মরক্ষায় ,পরিবারের সন্মান রক্ষায় কেমন করে সত্যি আড়াল করতে হয় । বুঝে গেছে কেমন করে গিলে খায় মিথ্যা সত্যর সমস্ত সম্ভাবনা । কেমন করে মিথ্যের উপর মিথ্যে চাপিয়ে তাকে বলতে হয় ক্যাটবেরি চকলেট এসবের থেকে বহুদূরে তার জীবন ...আর হাসি মুখ ঝুলিয়ে মায়ের মত করে কিভাবে সবাইকে বোঝাতে হয় ভাল থাকার বোঝানোর জন্য মুখে হাসি ছড়িয়ে থাকতে হয় ।
গতবারের জন্মদিনের পার্টিতে বাবা নিজে হাতে কেক বানিয়েছিল , ভ্যানিলা এসেন্স বেশি হওয়াতে স্বাদের তীব্রতায় সুমির বন্ধুরা এমন মুখ বেঁকিয়ে ছিল যেন নাকের সামনে বর্জ্য গন্ধ ,এমন কি স্কুলে গিয়ে বলেছিল সুমির বাবা ব্যাড কুক তাদের বাবার থেকে । সুমি কোমর বেঁধে ঝগড়া করে বাবাকে জিতিয়ে দিয়েছিল , সুমির কাছে বাবা ছিল বিজয়ী সম্রাট , বাবাকে কখনও হারতে দেওয়া চলে না । আজও সুমি তার বাবাকে হারতে দেয় না কোনো খানেই । রিমা যখন ক্লাসের, টিউশনের বন্ধুদের ফিসফিস করে বলে জানিস শর্মিষ্ঠার বাবা না আমাদের পাড়ার প্রীতি আন্টির ফ্ল্যাটে থাকে.......শর্মিষ্ঠাদের সাথে থাকে না -- ইত্যাদি ইত্যাদি এসমস্ত কথা যখন কানে সে সুমির বুকফেটে কান্না নেমে আসে ,চোখ জ্বলে যায় সুমির । কেন এমন করলে বাবা! কেন এমন করলে!! কেনর উত্তর খুঁজে পায় না বারোবছরের সুমি ।
তবুও সুমি সত্যি গোপন করতে শিখে নিয়েছে ঠিক তার মায়েরই মত। রোজদিন চুলের ব্যান্ড , নাহয় গল্পের বই , কিংবা নেল পলিশ তার বন্ধুদের দেখিয়ে বলে তার বাবা তার জন্য অনেক দোকান ঘুরে কিনে এনে দিয়েছে ।
সেবার খুব জ্বরে বাবাকে সারারাত জেগে সুমি জলপট্টি দিয়েছিল, সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি, খুব ব্যাকুল হৃদয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিল, ভগবান বাবার জ্বর সারিয়ে দাও । সকালের খোলা জানলা দিয়ে রোদ যখন বাবার মুখে পড়েছিল ঠিক যেন স্বর্গের দেবদূতের মত মনে হয়েছিল বাবাকে, যেন সমস্ত পাপের ঊর্ধ্বে বাবার এই লালচে আভায় ভেসে থাকা মুখ । অথচ সেই মুখ আজকে ভীষণ অচেনা , মনে হয় অবরুদ্ধ জলাশয়ে আটকে পড়া কোন মাগুর মাছের মত মুখচ্ছবি বাবার ।
সেবার বাবা ওয়ালিংটন ট্রিপে গেলে অন্তু মামা ওদের বাড়ি থাকতে এসেছিল । মায়ের কেমন যেন দূরসম্পর্কের দাদা । মা খুব হেসে হেসে কথা বলত অন্তু মামার সাথে , বাবার সাথে কোনদিন এমন হেসে হেসে কথা বলতে দেখেনি সুমি । দিনদিন অন্তু মামা কেমন যেন বাবা হয়ে উঠছিল । বাবার ঘড়ি ,বাবার টাই,বাবার আসট্রেতে সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে, মায়ের প্রতি যেন বাবার চেয়েও এই মামার অধিকার অনেক বেশি জন্মাচ্ছে সুমি বুঝতে পেরেছিল । আর মায়ের সাথে অন্তু মামার মান অভিমান সুমি লক্ষ্য করে দেখেছিল বেড়েই যাচ্ছে , মা যখন তখন সেজেগুজে মামার সাথে বেড়িয়ে যাওয়া সুমি মানতে পারছিল না । কখনও কখনও রাত করে ফিরে সুমির জন্য গুচ্ছে খানিক কমিক্স বুকস কিংবা এনিমেশন ডিভিডি নিয়ে । সুমি এসব পেয়ে সাময়িক খুশিতে হত ডুবে যেত কিন্তু মনের কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না এসব ছেলে ভোলানো বস্তুর । সেদিন স্কুল থেকে ফিরে বেল টিপতেই শোভা মাসি দরজা খুলে দিয়েছিল । সুমি পিঠের ব্যাগ সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে ফরমান জারি করেছিল মাসি খুব খিদে পেয়েছে , এখুনি লুচি চাই.... বলেই পা বাড়িয়েছিল মায়ের বেডরুমের দিকে ।কিন্তু, কিন্তু, ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল একজোড়া নারীপুরুষ পৃথিবীর আদিম এক অদ্ভুত খেলায় মগ্ন.... .এমন খেলা সে ছোট বেলায় ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছিল বাবার সাথে মাকে খেলতে। সুমি ১২ বছরের কিশোরী,তার শরীরে নারীত্বের লক্ষণ স্পষ্ট , সুমি বুঝতে শিখেছে শরীর আসলে শরীরই । টিউশন স্যার ভালোবাসার নাম করে মাঝেমধ্যে যখন সুমির শরীর ছুঁয়ে দিয়েছে দু'একবার এক অজানা শিহরণে কেঁপে উঠেছে সুমি ,সেই সহজাত বোধ থেকেই লজ্জায় চোখ বুজে নিজের ঘরের দিকে ছুটে বিছানায় আছড়ে পড়েছিল একবুক ভরা কান্নায় ।
শোভা মাসি গরম লুচি এনে সুমির সামনে ধরলে....... তুমি নিয়ে যাও শোভা মাসি, আমার খিদে নেই আর।
শোভা মাসি গরম লুচি এনে সুমির সামনে ধরলে....... তুমি নিয়ে যাও শোভা মাসি, আমার খিদে নেই আর।
সুমির বরফের মত ঠাণ্ডা গলা শুনে সেদিন কাজের মেয়ে শোভা চমকে গিয়েছিল ।সেদিন থেকে মায়ের দিকে তাকাতে ঘৃণা হয়েছিল।ঘৃণা হয়েছিল সে নিজেও মেয়ে এটা মনে করে ।ঠিক করেছিল বাবা ফিরে এলে সে বাবা কে বলে দেবে মায়ের অনাচারের গজিয়ে ওঠা পাপ এর কথা ।যে পাপের ভারে সে দিন দিন মনে ক্ষয়ে যাচ্ছিল।হায়!!!!! নিয়তি , সুমি জানত না আরো কত চমক বাকি তার জীবনের অনুক্ষণে।
বাবা ট্রিপ থেকে ফিরে এসেছে সুমির জন্য কত্ত কি গিফট কিনে নিয়ে । বাবার ব্যাগে হামলে পড়ে একটা ট্যাব আবিষ্কার করল সুমি।
-একি এটা তোমার হাতে কেন ? কেন নিয়েছ তুমি?
অকস্মাৎ বাবার এই ক্রুদ্ধ রূপ দেখে দারুণ ভাবে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাববার অবকাশ ছিল না ।বাবা যেন হঠাৎ মিলিয়ন ড্রাগন..... হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়েছিল দামি স্ক্রিনে ভেসে থাকা প্রীতি নামের ট্যাবটি ।
সেদিন রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল মায়ের -বাবার কদর্য ভাষার বাক্যালাপ শুনে ।কে বলবে মা হসপিটালের নামকরা ডাক্তার , আর বাবা ম্যাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানির হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট । মনে হচ্ছিল দুটো উন্মাদ ষাঁড় এওর জমি দখলের লড়াই করছে ।
মায়ের চিৎকার ভেসে আসছিল দু খানা দরজা আর এসি ও ফ্যানের তীক্ষ্ণতা ভেদ করে......
-আমি ডিভোর্স চাই অনুপম ,তোমার মত মিথ্যেবাদী কদর্য একটা মানুষের সাথে আমার মত স্বাধীনচেতা মেয়ের পক্ষে এডজাস্ট সম্ভব নয়।সম্ভব নয় দিনের পর দিন তোমার নোংরামি মেনে নেওয়া।
-আমিও ফেডাফ তোমার মত র্যাবিশ একটা বীচ এর সাথে এক পজিশন শেয়ার করে থাকা , আই হেল টু উ। অন্তু কে বাড়িতে ডেকে এনেছ এত বড় স্পর্ধা তোমার?
-অনুপম এ সব শুরু আমি করি নি।তুমি করেছ। প্রীতি কে নিয়ে দিনের পর দিন........... অসহ্য, অসহ্য আমার কাছে।
সেদিন সুমির পায়ের নীচের মাটি কেঁপে গিয়েছিল।বাবা.............বাবা!!!!!!!!!!!বাবা ও!!!!!!!!!!!!!!!!
মা বাবার তো লভ ম্যারেজ।দাদি মায়ের মুখে শুনেছিল।বাবা কেমন ফ্লিমের হিরোর মত মা কে ভাগিয়ে এনেছিল তার কোটিপতি বাবার ডেরা থেকে এগল্প শুনে বাবাকে সিনেমার হিরো কল্পনা করে নিয়েছিল সুমি । মা শানের মেঝেতে শুয়ে, লবণ ভাত খেয়ে তখন যুদ্ধ করেছিল বাবার হাতে হাত রেখে দারিদ্র্যর সঙ্গে । মা পড়াশুনায় খুব ভাল ছিল , জয়েন্ট দিয়েছিল , চান্স পেলে বাবা কত কষ্ট করে মা কে ডাক্তারি পড়িয়েছিল ।একদিন মা বড় হাসপাতালে চাকরী পেল, বাবা উচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত হল। তারপর নাকি সুমি এসেছিল ওদের মাঝে।আর সুমিকে পেয়ে ওদের বৃত্ত নাকি পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। এসব কথা দাদি মায়ের মুখে কতবার যে সুমি শুনেছে তার ইয়াত্তা নেই । এরপরে বিছানা বড় হয়েছিল তার সাথে ঘর ও বড় হল।একদিন মাঝ রাত্রে সুমি আবিষ্কার করল বাবা আর মায়ের রুমে শোয় না।বাড়ি বড় হওয়ার সাথে সাথে মানুষ গুলোও যেন দূরগ্রহের প্রাণী হয়ে উঠেছিল।কিন্তু ওরা তো একে অপরকে ভালবাসত..........
এ সবই কি তবে কথার কথা ? মা -বাবা তোমারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত!!তোমাদের পৃথিবী ক্রমেই সুমির থেকে অনেক অনেক যোজন দূরে সরে যাচ্ছে।তোমরা কি টের পাচ্ছ ? সুমি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলত , বাবা - মাকে কোনদিন বলতে পারত না , ঝগড়া ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করেছিল , সারারাত সুমি ঘুমতে পারেনি , খুব কেঁদেছিল , পরদিন সকালে থম থমে মুখে বাবা সুমি কে ডেকে বলেছিলেন--
-আমি চলে যাচ্ছি মা ,তুমি মাম্মার সাথে থেক।মন দিয়ে পড়বে। তোমাদের সাথে থাকা আর আমার সম্ভব নয়।
সুমি বাবার চোখের দিকে লজ্জায় অপমানে তাকাতে পারে নি ।ভেঙে টুকরো হতে দেখেছিল তাদের হলে বাঁধানো ফ্যামিলি ক্যানভাস টাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে দেখতে দেখতে সুমি পাথরের মত নিশ্চল হয়ে উঠেছিল ।
মা পাথরের মত কঠিন.........
ড্রইংরুমে সুমির সামনেই অন্তু মামা একদিন মা কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলল , কিন্তু মা কঠোর ভাষায় অন্ত মামাকে বলেছিল তোমার টাইম শেষ হয়েছে অন্তু দা। আমি বিয়ে করতে পারব না। সুমিকে কে মানুষ করার দায়িত্ব আমার জীবনে সবচেয়ে বড় , বিয়ে আমি করব না অন্তু দা ।
মায়ের প্রতি কেন জানি না একটা প্রচণ্ড কষ্ট বেদনা ছুঁয়ে গিয়েছিল সে দিন। যেন নিজেকে মা মনে হয়েছিল সুমির । কিন্তু গত একমাসে চিত্রপট দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে । মা ধীরে ধীরে রাজি হয়েছে অন্তু মামার প্রস্তাবে। এক সপ্তাহ আগেই নির্দেশ হয়েছে সুমি তোমার দার্জিলিং এ বোর্ডিং স্কুল ঠিক করা হয়েছে। যা যা নেবার গুছিয়ে নিও। সুমি বুঝতে পারছিল চক্ষুলজ্জা বিষম বস্তু একটা ।
সে দিন সুমির ঘৃণা হয়েছিল। আচ্ছা কামের কাছে ,নিজস্ব চাহিদার কাছে ,দুরন্ত আবেগের কাছে সন্তান স্নেহ ও কি এভাবেই বার বার হেরে যায়? সুমি মনে মনে জোর হাসল-----বাবা যদি করতে পারে তবে দায় কেন শুধু মায়েরই! মা করলেই বা দোষ কোথায়! শুধু সন্তানের চোখে দু'জোড়া নারী পুরুষের জন্য জমে থাকা পাপে বেঁচে রইল একদলা ঘৃণার অভিশাপ।
আজ সুমীর দার্জিলিং এ বোর্ডিং স্কুল যাবার দিন শোভা মাসি ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। সুমির এই বাড়ি থেকে কিচ্ছু নেবার নেই , সব কিছুই হারিয়ে গেছে তার , টেবিলের উপর ড্রইং খাতায় শেষ যে ছবিটা এঁকেছিল -মা,বাবা আর মধ্যখানে সুমি........সেই ছবি আজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিল। খুব ঝড় উঠেছে আজ........হাওয়ার তোড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সুমির বাবা.....সুমির মা....... ওদের আহিরিটোলার এককামরার ঘর,স্কুলের স্টাডি বুকস.....সেই সাথে সুমি নিজেও।
মিলিয়ে যাচ্ছে মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতি টি বিন্দু নিজস্ব খরস্রোতায়,অচেনা সাইক্লোনে।
সোনালী মিত্র
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:

ভাষাহীন করে দেওয়া
উত্তরমুছুন