কেমন ছিল মার্চ থেকে ডিসেম্বর একাত্তরের ? কেমন ছিল সোনার বাঙলা আমার ? কেমন ছিল তার ভোর, দুপুর, সন্ধ্যা রাত ? আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আমি হাহাকার শুনিনি আমি মনের গভীরে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ব্যথা অনুভব করিনি । দেখার কথা নয়, করার কথা নয় কারণ-আমি জন্মেছিলাম অন্য সময়ে, অন্য এক দেশের সিগ্ধ ভোরে । আমার জন্মে উৎসব হয়েছিলো নিশ্চয়ই, আমার জন্মে আমার মায়ের চোখ বেয়ে আনন্দ অশ্রু পড়েছিল নিশ্চয়ই ।
ছোট বেলায় মুগ্ধ হয়েছি বাঙলার রূপে; শুনেছি ময়না, কোকিলের ডাক । দেখেছি ধব-ধবে শাদা বকেরা, বালি হাঁসেরা উড়ে যাচ্ছে আমার মাথার উপর দিয়ে মুক্ত আকাশে । দেখেছি রাজহাঁস কেমন ক’রে বুক উঁচিয়ে পেরিয়ে যেত সাপের মতো ছোট্ট খালটি । দেখেছি জল সেঁচের পর কাদা মাখা শরীর নিয়ে ছেলেমেয়েরা কেমন ক’রে পুকুরের কিংবা খালের কাদায় লুকিয়ে থাকা শিঙ,পুঁটি, কাতল,রুই,মাগুর অথবা অন্যান্য মাছ নরম হাতে ছোবল দিয়ে উঠিয়ে আনতো; আমিও ছোটবেলায় দু’একবার আমার নরম হাতে উঠিয়ে এনেছি রুপালী ঝকঝকে মাছ !
বলতে পারি বেশ আরাম আর আনন্দে কেটেছে আমার, আমাদের শৈশব কৈশোর । আমার, আমাদের শৈশব কৈশোর এই সোনার বাঙলায় তার মেঠো পথে, শিশির ভেজা ঘাসে, দূর থেকে বহুদূরে ফসলের ক্ষেতে দৌড়ঝাঁপ ক’রে; আশ্বিনের ঝড়ের সাথে সখ্যতা ক’রে, চৈত্রের খরতাপে দগ্ধ হয়ে কিংবা আষাঢ় আর শ্রাবণের বৃষ্টি কোলাহলে পেরিয়ে গেছে ।
কিন্তু, যখন থেকে বুঝতে শিখেছি আর জানতে পেরেছি আমি, যেভাবে যেদেশের বুকের উপর দিয়ে পেরিয়ে এসেছি আমার শৈশব, কৈশোর আর অজস্র সুন্দরের ভেতর দিয়ে তাঁর রয়েছে এক গভীর ক্ষত; তাঁর বুকে জমাট বাঁধা রয়েছে একরাশ কষ্ট । তখন ভীষণ কষ্ট পেয়েছি আজো পাই । ক্ষণে ক্ষণে সে বিলাপ করে ওঠে, ক্ষণে ক্ষণে সে প্রকাশ করে উষ্মা; পেরে না ওঠে হাহাকার করে ওঠে ! ক্ষণে ক্ষণেই তাঁর বুক দিয়ে বেদনা গুমরে ওঠে তাঁর অগণিত, অপরিচিত সন্তানের জন্য । কে তাঁর সন্তান ? কারা তাঁর সন্তান ? কী-ইবা তাঁদের পরিচয় ? ওখানেতো অনেকেই ছিলেন; হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যারা অকাতরে বাঙলা মায়ের জন্য বিলিয়ে দিয়েছিলো প্রাণটুকু নির্দ্বিধায় ! মা’কে শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর অগণিত, অপরিচিত ধর্মহীন সন্তানেরা; যার নাম মুক্তিযোদ্ধা । কিন্তু বিনিময়ে কী পেয়েছে তাঁরা ? নিঃস্বার্থ ভাবে জীবন বিলিয়ে একদিন যে সোনার বাঙলা মুক্ত করেছিল বর্বর পাকিস্তানীদের কাছ থেকে, ম’রে গিয়ে সুনীল আকাশের উপর থেকে কী দেখছে তাঁরা ? তাঁদের পরিবার গুলো আজ না খেয়ে, না পড়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, তাই কী দেখছে ? তাঁদের পরিবার একজন মুক্তিযোদ্ধার একটি সনদের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাই কী দেখছে ? দেখছেন কী একজন মা, একজন বাবা পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন যার সন্তান কিনা ৭১’এ কোনোদিন ভিক্ষা করবেনা বলে মৃত্যু দিয়ে কথা রেখে গিয়েছিলেন ? আর কোনোদিন অপমান সইতে হবেনা বলে সম্মুখ যুদ্ধে মানচিত্র রক্ষায় অবলীলায় লাশ হয়ে গিয়েছিলেন ! তাঁরা কী দেখছেন এসব ? দেখছেন কী তাঁর মা তাঁর বাবা আজ একজন স্বীকৃত ভিখিরির নাম ?
দেখছেন কী আপনারা, প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা- এই বাংলাদেশে এখন বড়ো বড়ো পুকুর চুরি হয়,ডাকাতি হয় নারীর সম্ভ্রম পথে ঘাটে, দিনে দুপুরে ? দেখছেন কী, যে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন বন্দুক হাতে-সে দেশেই এখন হিন্দু বলে তাঁর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ? দেখছেন কী মন্দির, গির্জা ভাঙা হয় ? এমনকি এই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পবিত্র গ্রন্থ পুড়ে ফেলা হয় । দেখছেন কী মানুষ পুড়িয়ে মেরে, মানুষকে দিনেদুপুরে খুন করে কি বুনো উল্লাসে মেতে ওঠে শয়তানের দল ?
আপনারা নিশ্চয়ই দেখছেন এই স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক নেতা, কর্মীরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটে কেমন করে ? নেতারা কেমন করে গরীবের টাকা মেরে গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়, কেমন করে একটি রাস্তাকে বছরের পর বছর খনন করে সরকারী টাকা মেরে খায় সরকারী লোকেরাই; তা-ও নিশ্চয়ই দেখছেন আপনারা ?
অথচ আপনার সন্তানটি, ভাইটি, আপনার বোনটি যথেষ্ট শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও একটি চাকরি পায়না । অথচ মূর্খ অযোগ্য নেতার সন্তানটি চাকরিটি পেয়ে যায় অনায়াসে । নিশ্চয়ই দেখেছেন রাজাকারের গাড়িতে কেমন করে ওড়ে জাতীয় পতাকা ! আপনার প্রিয় সহধর্মিণী, প্রিয় সন্তান কিংবা আপনার মা-বাবা আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু পথযাত্রী ! কী দেখছেনতো? নিশ্চয়ই দেখছেন আপনাদের, আমাদের সোনার বাঙলা ছেড়ে অনেকেই আজ বিদেশকে করেছে আপন । এর সবকিছুর সম্মিলিত ফলাফল এখন জঞ্জাল যা ফেলেছি আমরাই, যা করেছি আমরাই গত চুয়াল্লিশ বছর ধ’রে আপনাদের রেখে যাওয়া বাঙলা মায়ের বুকে ! কিন্তু আপনারাতো মায়ের বুক থেকে জঞ্জাল পরিস্কার করেই আমাদের উপহার দিয়েছিলেন একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ নাম যার ‘বাংলাদেশ’ ! অগণিত,অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের ক্ষমা ক’রে দেবেন, আপনাদের রেখে যাওয়া দেশ আজ নষ্ট ভ্রষ্ট । মানুষ গুলো ঠিক মানুষ নয় ।
![]() |
| পরিচিতি |
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মার্চ ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন