জয়া চৌধুরী


জীবন যেন পদ্মপাতায় জল। এই আছে এই নেই। এই সব অকিঞ্চিৎকর দীর্ঘ সময়যাপনে আমরা কতই না ভাব ভাষায় নিজেদের ব্যক্ত করি। মূক হয়ে যারা জন্মাই তাদের জন্য আমাদের কারো আছে সমবেদনা আর কারো আছে করুণা। আমরা ভুলেই যাই যে আমাদের স্বীকৃতির বাইরেই তাঁরা তাদের ইচ্ছাখুশিতে জীবন চাকা ঘুরিয়ে যান। আমরা যারা পশু রূপে থাকি, তারা তাদের মত ডাক বা স্বরে মনের কথা কই সই। আর আমরা যারা মানুষ তকমা ধারী তাদের জন্য এই জগতে বলবার কত কিছুই না থাকে। আমাদের সেই ভাষা বড় সার্বজনীন। তার না আছে কোন নাম না আছে কোন অক্ষর। সেগুলো ব র ক ধ ঝ/ য জ য় স ঘ ...না আ বে সে দে এ... নাকি লাতিন না দেবনাগরী না এস্পারান্তো সেসব নিয়ে মাথা ঠুকে লাভ নেই তাই। প্রাণের তাগিদে উৎসারিত সেই ভাষাই আমাদের চালিত করে আজন্মকাল। তার জন্য কোন বাহ্য বিপ্লব করতে হয় না। প্রাণের ভাষা প্রাণেই লেপ্টে থাকে। গোপাল ভাঁড়ের সেই “সড়া অন্ধা অছি” ...র কথা মনে আছে তো? সেই যে চাপে পড়ে উড়ের মুখে মাতৃভাষা বের হয়ে পড়েছিল। এক অর্থে মাতৃভাষাকে প্রাণভাষা বললেও ক্ষতি হয় কি? জন্মে ইস্তক যে ভঙ্গীতে আমরা নিজেদের প্রকাশ করি তার বাহক হিসেবে ইংরিজি উর্দু স্প্যানিশ-এর সাহায্য নেওয়া বই আর তো কিছু নয়। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা জন্তু জানোয়ারদের ল্যাঙ্গুয়েজ ও আর নানারকম ল্যাঙ্গুয়েজের বখেড়ায় গিয়ে মাথা ভার করে লাভ নেই।  ওসব তাত্ত্বিকেরা ভাবুন। আমরা বরং ভাষাতত্ত্বের কচকচিতে না ঢুকে বরং নিজ নিজ জীবনের খাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিই। 
                            
 অবাকবেলা
-আ লেলেলে... গুল্লুমুল্লু কুচিমুচি সন্টুমন্টু... কি ছুন্দর দেখাচ্ছে আমার ছোট্ট ছোনাকে
- অ ...আ...উমমম বাবাবাবাবা...দদদদদ
-ওলে বাবা...ছোনা টা আবার কথা বলছে...হুম...কি বলছো ? অ্যাঁ ? কি বলছো তুমি মাম্মাকে?...
- আবাবামামাদাদাদা...এতাতা...মমমমম..
- দেখেছো আমার সোনা মা বলেছে ...
- মমমম...কাকাকাকাকা...অঅ অঅঅ
- অ...অ... আমার ছোনামণি টা আমার বুট্টুছোনাটা... 
- তাতাতাতা ...মমমম...
                         
নতুন নতুন বেলা
-হেডস ডাউন...চিল্ড্রেন...কিপ কোয়ায়েট...
- আন্টি...উমম...আন্টি
- অ্যাই অ্যাই কি হয়েছে তোমার মাথা তুলছো কেন? জানোনা এখন স্লিপিং টাইম
- আন্টি... টয়লেট...
- অ্যাঁ? টয়লেট পেয়েছে? আগে বলবে তো। জানো না টয়লেট পেলে বলতে হয় – মে আই গো টু দ্য টয়লেট?  মুখটা এরকম করেছো কেন? প্যান্টে করে দাও নি তো? আয়া? আয়া? দেখো তো ওকে নিয়ে যাও বাথরুমে। যাও ...গো গো কুইক...
                           
আশা খুশী স্বপ্ন বেলা
-অ্যাটেনশন...স্ট্যান্ড অ্যাট ইজ ...বিশ্রাম। রোল নম্বর ওয়ান টু থ্রি... প্রেয়ার...
- অসতো মা সদগময়...ওম সহ না ববতু...
- নাউ থট ফর দ্য ডে... কিসি কি সহায়তা করকে উস সহায়তা কো ভুল জানি চাহিয়ে... নাউ গেট রেডি ফর দ্য ন্যাশনাল অ্যান্থেম
- জনগণমন অধিনায়ক...
- ডিসপার্স...
- জয়হিন্দ
- কদম কদম বঢ়ায়ে যা...
- অ্যাই রোহন তোর কাছে গ্লু স্টিক আছে?
- কেন?
- আরে এস উ পি ডব্লু কপিটায় পিকচার পেস্ট করা হয় নি। আমার কাছে পিকচার গুলো আছে।একটু দিবি রে
- ঠিক আছে , নিস। শোন প্রেয়ার লাইনে অমিত একটা কথা বলল- জানিস করনজিত কাল শাল্মলীকে আই লাভ ইউ বলেছে।
- আরে জিও...এটা তো দারুণ খবর। যাক শেষ পর্যন্ত ঝেড়ে কাশল ব্যাটা
- আমি বুঝি না ও আর মেয়ে পেল না? শাল্মলীটা তো এক নাম্বারের নেকু। 
- তোর কি জেলাসি হচ্ছে সঞ্জুষা? 
- জেলাসি? মাই ফুট... ফালতু কথা বলিস না তো। শোন তোর কাছে এনরিকের পোস্টার আছে?...
                      
ডেটিং মেটিং প্রেমবেলা
ইস আজ সারাদিনে ও একটা মেসেজেরও আনসার দেয় নি। এত কি বিজি
বাবা বলতে না বলতেই ফোন।হ্যালো
কুটুস একটা নিউজ আছে
সারাদিন কোনো মেসেজের জবাব দাও নি। একটা ফোন তোলো নি। ফোন করা তো দূরে থাক। আর এত ঘন্টা পরে ফোন তুলেই শুধু নিজের কথা?
যা ব্বাবা এত রাগ করলে কেন? আমার তো আজ ইন্টার ভিউ ছিল সেক্টর ফাইভে। ভুলে গেলে?
এ মা। ঠিকই তো । একদম ভুলে গেছিলাম। আসলে এত চাপে আছি আমিও। জানো রায়দা আমায় সোমবার রেকর্ডিং কোম্পানীর অফিসে যেতে বলল। এই জাস্ট একটু আগে আমায় কনফার্ম করল নিউজ টা। তুমি তো জানো কত্তদিন ধরে অপেক্ষা করছি এই ব্রেকটার।
 আরে এত দারুণ খবর। কনগ্র্যাটস ডিয়ার। ...এবার আমার পুরো কথাটা শুনবে?
এ মা ছি ছি ছি। প্লিজ রাগ কোরো না। বলো না কি হলো ইন্টারভিউতে? 
আই গট দ্য জব।
মাই গুডনেস। ... ঋক ঋক ঋক আমি জানতাম আমি জানতাম তুমি পারবে।
ও তুমি জানতে আমি চাকরিটা পাবো?
হুঁ চোখ বুজেই আমি বলে দিতে পারি তোমার সব মনের কথা।
তাহলে চোখ বোজো
ফোনে ফোনে দেখবে কি করে চোখ বুজলাম কি না
তবে গালটা ঠেকাও স্ক্রিনে, আমি ঠিক টের পাবো তোমার ছোঁয়া। তারপর ফিসফিসিয়ে বলব... কুটুস...আই লাভ ইউ...উইল ইউ ম্যারি মি?
ঋক...লাভ ইউ...লাভ ইউ টু...ইয়েস আই ডু
                              
প্রণয়বেলা
ঘং ঘং করে কেশেই মরবে তুমি। কত্তদিন ধরে বলেছি এভাবে সিগারেট খেয়ো না। একটা কথা যদি কানে তোলে ...
তোমার তাতে কি? বেশ করবো। আমি নিজের পয়সায় সিগারেট খাই তোমার ছেলের পয়সায় না।
ওঃ। আমার ছেলে? আমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম তাই না? 
ছেলে ছেলে ছেলে...সারাজীবন শুনে এলাম আমি নাকি বাপ হয়ে ছেলের দিকে কোন নজরই দিই না। এখন... এখন তোমার গুণধরের টিকি নেই কেন?
খবরদার তুমি ওকে গালমন্দ করবে না। এতদূর লেখাপড়া শিখে এদেশে ওকে তো কেউ কাজেই লাগাতে পারে নি। ওর কি দোষ? এখানে যদি যেমন তেমন একটা কাজ জুটিয়ে থেকে যেত, তখন তো তুমিই আমাকে দোষ চাপাতে মার আঁচল ধরা ছেলে বানিয়েছি। 
এখন যেন কম আঁচল ধরে! হুঃ! যখনই ফোন আসে রাত বিরেতে সব কথা মার সঙ্গে। বাপ বুঝি কেউ না! আরে বাপ না থাকলে এলি কোথা থেকে? খেতি কি? পড়তি কি? সব ব্যাটা বেইমান। সাধে কি শাস্ত্রে বলে ...কা তব কান্তা কস্তে পুত্রাঃ/ সংসার হ্যয় অতীব বিচিত্রা। 
শুরু হলো শাস্ত্রপাঠ...সারাজীবন এই ওপর চালাকি দেখলাম। কাজের নামে টিকি নেই কথা বললেই বুকনি ঝাড়া... একটা কথা বলতে গেলেই আমায় দোষ চাপায়। দিনরাত শুধু অর্ডার...চা দাও... খবরের কাগজটা কই...চশমাটা পাচ্ছি না কেন...আমার কালো শার্টটার বোতাম ছিঁড়ে গেছে... চোয়া ঢেঁকুর উঠছে বিয়েবাড়ি খেয়ে, একটা টোটকা কিছু দাও না... দিনরাত ওনার খিদমত খাটতে খাটতেই আমার প্রাণ গেল। 
ওঃ আমি শুধু তোমায় জ্বালাই তাই না? এখন তো তুমি বলবেই ...একদিন এই শর্মাই শুধু তোমার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা চার্চ গেটে অপেক্ষা করেছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তোমার টিউশন স্যারের বাড়ির সামনে থেকেছে শুধু তোমাকে বারী নিয়ে যাবে বলে একদিন...
থাক আর বোলো না... সত্যি ই কি আমি বলি যে তুমি আমায় জ্বালাও? তুমি বোঝো না এইসব জ্বালানো না পেলেই আমি হাঁপিয়ে উঠি? এইসব চাওয়া গুলোই আমায় টেনে রাখে সংসারে, আমায় জুড়ে রাখে ...জানো না তুমি? বোঝো না তুমি? সত্যিই বোঝো না? 
                                    
চিরশান্তিবেলা
দেখুন এই অবস্থায় আর কিছু করার নেই। আপনারা যদি ওনাকে শান্তিতে চলে দিতে যেতে চান তাহলে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। এই অবস্থায় আর কোন কিছু করানো মানে ওনাকে আরো খোঁচাখুঁচি করে কষ্ট দেওয়া। আমার এত বছরের ডাক্তারি অভিজ্ঞতায় এইধরণের পেশেন্ট কে এই মুহূর্তে চিকিৎসা না করাটাই সেরা চিকিৎসা
সঞ্চিতা শুনছো ডাক্তারবাবু কি বলছেন।
উনি ঠিকই তো বলছেন... তুমি অস্থির হয়ে আছ, তাই তোমার মাথায় ঢুকছে না কোন কথা। 
ডাক্তারবাবু। আর কোন উপায় নেই?
দেখুন ডাক্তার বলে কি আমরা মানুষ নই? আমরা কি বুঝি না মা কে নিজের চোখে এভাবে কষ্ট পেতে দেখা কি ভয়ানক কষ্টের? কিন্তু বিশ্বাস করুন আমিও কারো সন্তান... আমি বলছি ওনাকে শেষ টুকু শান্তি পেতে দিন।
শৌর্য ওনার কথা শোনো , চলো মাকে আমরা বাড়ি নিয়ে যাই। 
মা মাগো তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? মা তাকিয়ে দেখো সঞ্চিতা আর সমও এসেছে এখানে।। তুমি কতদিন সম কে কোলে নাও নি মা। দেখো বাবা কাঁদছে। একবারটি তাকাও না মা। মা মাগো  মা... তুমি বলেছিলে অনেকদিন থাকবে। এত তাড়াতাড়ি যেও না মা। প্লিজ... একবার চোখ খোলো...একবার তাকিয়ে বুবুন বলে ডাকো...মা প্লিজ একবার কথা শোনো...মা 

বলহরি হরি বোল বলহরি হরি বোল বলহরি হরি বোল বলহরি হরি বোল

পরিচিতি 
জয়া চৌধুরী জয়া চৌধুরী Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.