দ্বিতীয় মহাবিশ্ব যুদ্ধে যখন সারা পৃথিবী বিদ্ধস্ত, অখন্ড
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের কবলে লক্ষ লক্ষ শিশু নারী পুরুষ অনাহারে মৃত্যুর
মুখে, ঐ ১৯৪১ সালে ডিসেম্বরের এক শীতার্থ রাতে হত দরিদ্র ব্রাহ্মণ সোমনাথ
ভট্টাচার্য -এর কুঁড়ে ঘরে আমার, এই অমল -এর জন্ম। আশ্চর্য, এত অভাবেও আমি
বেঁচে রইলাম। পুজো বিবাহ শ্রাদ্ধ যজমানের কৃপায়, গাঁয়ে রাধা গোবিন্দের
মন্দিরে ও 'দু চার যজমানের বাড়িতে দুবেলা পুজো আরতি করে আর চার বিঘে জমিতে
চাষ আবাদ করে কোন ক্রমে সংসারের জোয়াল সোমনাথ বাবু টেনে হিঁচড়ে চলছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধের দামামা বাজতেই অশনী সংকেত দেখা দিলো, ইংরেজ
সরকার আর মজুতদারের সর্বনাশা ষড়যন্ত্রে জনগন প্রাণ ধারণেই ব্যতিব্যস্ত,
পুজো পাঠ ও তাঁর সাধের পাঠশালা প্রায় উঠে গেলো। দিন আসে, রাত নামে, মানুষ
মৃত্যু ও প্রলোভনের শিকার - ক্ষুধার জ্বালায় যৌবনা নারী আজ পতিতা -
দরিদ্রতা কী ভয়ংকর - বন্যার জলে বানভাসী ভেসে যায় - সততা, সম্ভ্রম,
সম্মান, শালীনতা, মানবতা খুইয়ে - মরার 'পরে খাঁড়ার ঘায়ে দেশ ভাগের
ভয়াবহ পরিনামে একটা জাত, এই বাঙালী জাত, কাঙালের পর্যায় আর আমাদের ঘরের
মা ও বোনেরা বেশ্যায় পরিনত হয়ে গেলো। সোমনাথ বাবু জন্মভূমির অমোঘ শিকড়ের
টানে, ময়মনসিংহ এর মুকতা গাছা গ্রামের মায়া ছেড়ে সর্বস্ব হারিয়ে ভিখিরীর মতো কোলকাতার রাস্তায় ভিক্ষে করে দিন যাপনে রাজী ছিলেন না।
গাঁয়ের অনেক হিন্দু পরিবার অনেক কিছু হারিয়ে শেষে
পালিয়েছেন। চাষা মরে আশায়। স্ত্রী জয়া আধ পেটা খেয়েও দাঁতে দাঁত চেপে
অনেক কঠিন কালের আঘাতেও ভেঙ্গে না পড়েও ধুক ধুক করে টিঁকে আছেন। দুটো
কিশোরী মেয়ে, বড় উমা ষোল বছর, ছোট বীনা চোদ্দ, আর আমি তখন ছয় বছর।
গাঁয়ের মোড়ল প্রধান ও অন্যান্য পড়শী, তাঁরা অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ১৯৪৭
শে ১৪ই আগষ্ট রাত থাকতেই কাক ভোরে ধুতি খুলে, বাল্য বন্ধু বসীর মিঞার
দেওয়া ভালেবাসার দান - লুঙ্গি ফতুয়া ফেজ টুপি 'পরে, দীর্ঘ দিন না কামানো
দাড়ি গোঁপের জঙ্গলে হারিয়ে সোমনাথ ভট্টাচার্য হলেন সোলেমান মিঞা।
বসীর মিঞার বিবি আয়েশা জয়াকে কাপড় কানের পাশ দিয়ে ঘোমটা
টেনে বোরখা পড়িয়ে দেয়। আফজল মিঞার দাদার তদবীরে ডিস্ট্রিক্ট র্বোডের
প্রেসিডেন্টের রেকমেন্টেড পরিচয় পত্রে লেখা আছে ফুলেশ্বরী গ্রামের সোলেমান
শেখ, তার বিবি আমিনা ও বাচ্ছাদের নিয়ে কোলকাতায় যাচ্ছে হাসপাতালে
দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য। শেষ বারের মত গৃহ মন্দিরে ও গাঁয়ের
মাটিতে মাথা নুইয়ে প্রণাম করে গৃহ দেবতা রঘুবীর আর শালগ্রাম শিলা জপের
মালার ঝুলিতে বুকের আড়ালে ঝুলিয়ে, হাউ মাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠে আছড়ে
পড়লেন।
গোফুর, বসীর, আফজল, মোক্তার, হোসেন মিঞা হাত ধরে তুলে বুকে
জড়িয়ে চোখের পানী মুছিয়ে সান্তনা দিয়ে মেহেরবানের কাছে দোয়া জানালেন।
বৃদ্ধ হোসেন মিঞা বিড় বিড় করে সূরা আওড়াচ্ছেন। লন্ঠন হাতে গাঁয়ের সবাই
দল বেঁধে ভীষণ ভালো মানুষ, ইমানদার, সবার খুব প্রিয়, যেন আত্মার আত্মীয়
-সোমনাথ বাবুর হাত ধরে পার ঘাটায় আনলেন - চোখের অশ্রু আজ অঝরে ঝরছে। বসীর
মিঞা নৌকোর মাঝি আবদুলকে সতর্ক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন।সবাই
সোমনাথবাবুকে বুকে নিয়ে গভীর আলিঙ্গনে কাঁদছেন। ছোটরা কেউ কেউ পদম বুসি
প্রণাম করছেন। অনেকেরই অক্ষর জ্ঞান হয়েছিল সোমনাথ বাবুর পাঠশালায়।
অন্য দিকে আয়েশাবিবি, মর্জিনা, ফতেমা, জয়ার চোখের পানী
মোছাচ্ছে, উমা তার সই নূরজাহাকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে সই-এর বুকেই জ্ঞান
হারালো। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আর এক সই সাহিদা - ওদের সাথে পানী দেবার
জন্য কলস ভরে এনে ছিলো, সে তাড়াতাড়ি উমার চোখে মুখে পানী দিয়ে অল্প
পানী খাওয়াল, আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিল পরম মমতায়, তাই দেখে অনেকেরই চোখ ছল
ছল করে উঠলো। বসীরের আম্মী, বৃদ্ধা সুলতানা বিবি বিশাল এক ঝোলায় পথে
খাওয়ার জন্য পুলি-পিঠা, নানা রকম খাবার, নিজের হাতে কোটা চিড়া নাড়ু
জয়ার হাতে তুলে দিলেন। জয়া তাঁকে প্রণাম করলে তিনি জয়াকে জড়িয়ে কেঁদে
ফেললেন।
অন্যেরা বয়ে আনছিল সোমনাথ বাবুর কিছু প্রয়োজনীয় কাপড়
জামা, একটি শাল, উমার সাধের খাঁচায় ময়না পাখী, বাড়ির তুলসী মঞ্চের মাটি
সমেত তুলসী গাছের ছোট চারা। সামান্য সোনার গয়না জয়া পেট কাপড়ে আগেই
ভালোভাবে বেঁধে নিয়েছে। বসীর আর হোসেন মিঞা সোমনাথ বাবুকে গাছের আড়ালে
ডেকে নিয়ে গিয়ে হাজার খানেক টাকা ছোটো থলিতে হাতে তুলে দেন। সোমনাথ বাবু
ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকেন, দুচোখ বেয়ে গড়ায় অশ্রুধারা।
গাছের তলায় নামাজ পাটি বিছিয়ে নদীর পানীতে হাত মুখ ধুয়ে
ফজর নামাজ পড়ছেন। আবদুল মাঝি 'বদর বদর' বলে নৌকো ভাসিয়ে দিলো আড়িয়াল
খাঁর পানীতে। সোমনাথ বাবু ঈশ্বর ও দেশের মাটিকে প্রণাম করছেন। সূর্যের
প্রথম আলোয় রাঙা হয়ে উঠছে আকাশ। আলোয় উদ্ভাসিত অশ্রু সজল চোখে অনেক
ভালোবাসার মানুষ তারা কেউই চাইনি দেশভাগ। তারা জানতো দেশভাগের এই ক্ষত থেকে
চিরকাল রক্ত ঝরবে।
সোমনাথ আবৃতি করছে --জবা কুসুম---!
পূর্ব আকাশে সূর্য উঠছে। সুনীল আকাশে এক ঝাঁক পাখী উড়ে গেল
এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায়। এই জন্যই কবি লিখেছিলেন - "আবার আসিব ফিরে
হয়তো মানুষ নয় শঙ্খচিল শালিখের বেশে।"
শ্যামল সোম
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন