৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যেকটি মাসই বেশ গুরুত্বপূর্ণ । মার্চ থেকে ডিসেম্বর প্রতিটি মাসই অগ্নিঝরা যুদ্ধের টুকরো টুকরো ইতিহাস যা রচনা করা হয়েছে অজস্র খুনের ভেতর দিয়ে । যারা করেছিলেন তারা ইতিহাসের এক কলঙ্কিত জাতি; নাম তার ‘পাকিস্তান’ । তবে ডিসেম্বর সেই সব টুকরো টুকরো ইতিহাসের সম্মিলিত পরিসমাপ্তি । ডিসেম্বর বাঙালীর বহু কাঙ্ক্ষিত এক মাসের নাম যদিও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক ডিসেম্বরই শেষ হতে চলেছে ইতিহাসের জঘন্যতম এই যুদ্ধ । বাঙলার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা বাঙলার স্বাধীনতা বা মুক্তি আর পাকিস্তানের বিনা শর্তের আত্মসমর্পণ । ইতিহাসের এক যুদ্ধের নাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ । স্বাধীনতা আমাদের এক স্বপ্ন পূরণের নাম ।
যদি পেছনে ফিরে তাকাই ৪৩ বছরের পুরনো দিনগুলোর দিকে তবে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে আমার । দেখি এক অন্ধকার কুণ্ডলী পাকিয়ে বাঙলার আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে । দেখি আমাদের বাংলাদেশ জ্বলছে দাউদাউ আগুনের লেলিহান রূপের মাঝে । ছুটে চলছে আমার ভাইটি; ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমার মা, আমার বোন । চোখের সামনে কুকুরের দল ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার প্রিয় প্রেমিকাটিকে । দেখি আমার পিতার মুখ যে উদ্বিগ্ন চিত্তে তাকিয়ে আছে পুবের আকাশে কখন উঠবে এই বাঙলায় একটি আপন সূর্য যার আলোতে বাঙলা পাবে নববধুর রূপ । দেখি হাজার হাজার উদ্বাস্তু প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে ! আমি বেশি সময় ধরে পেছনে ফিরে তাকাতে পারিনা । আমার চোখ যন্ত্রণা ক’রে । আমার চোখ বিদ্রোহ ক’রে, আমার চোখ ঘৃণায় ভরে ওঠে ।
কে এনে দেবে মুক্তি, কে দেখাবে আলোর পথ এই বাঙলায় ? অপেক্ষা ক’রতে হয়েছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস; তবে অপেক্ষা ক’রতে হয়নি আমাদের বছরের পর বছর । আর তা সম্ভব হয়েছিল আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে; একটি স্বাধীন বাঙলার চেতনা বুকে ধারণ ক’রে । দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে, ফিরে পেতে হবে আমাদের অধিকার এমনই কথা ছিল । স্বপ্নতো তখন চোখে মুখে কৃষকের, রিক্সা চালকের, শ্রমিকের, মুক্তিবাহিনীর, বালকের, ছাত্র ছাত্রীর মোটকথা রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের । এক গভীর অন্তর্বেদনা এক ক’রে দিয়েছিল বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধের পুরো ন’টি মাস জুড়ে । এমন দিন, এমন বছর বাঙালীর জীবনে আর আসেনি আসবেওনা কোনোদিন । স্বাধীনতা উত্তর বাঙলা এখন স্বাধীনতা পূর্ব বাঙলার চায়তে অনেক বেশি অধঃপতিত এক জাতি । নৈতিকতার দিক দিয়ে ।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা জানিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে যে বাঙালীরা অধিকার চায়, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে নিজেরাই লালন করতে চায়; মুক্ত হতে চায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে । ইতিহাসে এমন যুদ্ধ নজিরবিহীন । মুক্তির পথ দেখিয়েছিল আমাদের মুক্তিবাহিনীরা যারা অতিসাধারণ মানুষ; বলতে গেলে কৃষক,শ্রমিক ! ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় কিছু খাঁটি বাঙালী সেনা কর্মকর্তার অধীনে তাঁরা গড়ে তুলেছিল প্রতিরোধ সেদিন । ৭১’র প্রতিটি দিন বাঙালীর জীবন মরণের দিন । কিন্তু মরণকে উপেক্ষা ক’রে তাঁরা পেরিয়ে গিয়েছিল আঁধারের পথ; খুঁজেছে প্রতিক্ষণে, প্রতিমুহূর্তে আলো; যে আলোয় দেখা যাবে বাঙলার আকাশে উড়ছে আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকা । ৭১’র সামগ্রিক মুক্তির মিছিলে প্রয়োজন ছিল নেতৃত্বের । দরকার ছিল সঠিক পথ দেখাবার একজন সাহসী বাঙালীর । দেখিয়েও ছিলেন একজন দিয়েছিলেন আলো ঘোরতর অন্ধকারের মাঝেও । যদি স্বীকার না করি একজন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির কথা তবে ইতিহাস কখনোই ক্ষমা করবেনা আমাদের । যদি না বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারের কথা তাহলে অস্বীকার করা হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেই ।
কেউ অস্বীকার করেনি, কারো অস্বীকার করবার সাহস ছিলো না এতদিন অন্তত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত । কিন্তু তারপর বদলে গেছে পরিস্থিতি । বদলে গেছে মানুষের রূপ যারা একদিন সপ্ন দেখত স্বাধীন বাংলাদেশের । যারা একদিন তাঁর উদাত্ত আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে বিনা প্রশ্নে । কিন্তু ক্ষমতা আর অর্থ যখন পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছিল, তাঁরা অস্বীকার ক’রে বসে তাঁর অবদান তাঁর সমগ্র প্রচেষ্টাকে । বাঙালী নষ্ট হতে থাকে প্রথমে ধীরে ধীরে আরও পরে দ্রুত । আজ সে প্রসঙ্গ নয় । এ এক অন্য ইতিহাস যা সত্য নয় যা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত ক’রে তোলে জানা মাত্রই । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা স্বাধীনতার পর স্বাধীন বাংলাদেশে অধিক চর্চিত । মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে অনেকের নানা সত্য মিথ্যার মিশেলে । তবে কিছু বই মহৎ, স্বীকৃত। ইতিহাসের দলিল হিসেবে বিশেষ ভাবে আখ্যায়িত । বিশেষ করে যারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন কেউ কেউ লিখেছেন সত্য ইতিহাস । অনেকে যুদ্ধ না করেও লিখেছেন সত্যনিষ্ঠ বই । তবে শুধু মাত্র বইয়ের সংখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে,স্বাধীনতাকে বিচার করা যাবেনা । মূলত হৃদয়ে যদি ধারণ না করি এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় গুলো । যদি ভালো না বাসি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে, বাংলাদেশকে ।
আমাদের সমস্ত আবেগের নাম মুক্তিযুদ্ধ; আমাদের সামগ্রিক চেতনার নাম মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা । একাত্তর আমাদের শক্তি যেমন; তেমনি আমাদের তীব্র অহংকার । একাত্তরের ডিসেম্বর মাস আমাদের মুক্তির পথে শেষ বাধার মাস যা কেটে যায় মধ্য ডিসেম্বরই । এই বাধা পেরিয়ে এসেছি আমরা বিভীষিকার ভেতর দিয়ে ন’টি মাস জুড়ে । সেদিনের বাঙলা ছিল রক্তের স্রোত ধারায় প্রবাহিত এক মহা সাগরের নাম । আজ ৪৩ বছর পরও চোখ বন্ধ করলে আমি সে’দিনটি দেখতে পাই; পেয়ে শিউরে উঠি । আমার অস্তিত্বে খেলে যায় ঠাণ্ডা শীতল প্রবাহিত ঝর্ণাধারা । আমি জমে যাই সেই শীতলতায় । ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যায় আমার প্রতিটি রক্তকণিকা । ভয়ে কুঁকড়ে যাই আমি এই স্বাধীন বাঙলায় বসবাস ক’রে অজস্র আলোর মাঝে থেকেও! মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের শেষ এবং শ্রেষ্ঠ দলিল ইতিহাসের যা সংরক্ষিত আছে নানা ভাবে যদিও বিকৃতির চেষ্টাও কম করা হয়নি ! তবে ইতিহাস ইতিহাসই । সে ধারণ করে সত্যের চরম রূপ । পেরিয়ে যায় সীমা থেকে অন্য সীমায় কারো বাধা না মেনে । রচনা ক’রে আরও ইতিহাস অন্য ইতিহাস । আর আমরা সেই ইতিহাসকে ধারণ করি, ক’রে এগিয়ে যাই সামনের দিকে ।
যদিও মিথ্যা ইতিহাস আজকাল প্রচুর লেখা হচ্ছে । লিখে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে মানুষকে । বিশেষ ক’রে যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মকে । করছে তাঁরাই, যারা এই বাঙলার পক্ষে নয় যারা বাঙলাকে ভালবাসেনা । যাদের রয়েছে আজো পাকিস্তান প্রীতি । যদি আজও আমরা পাকিস্তানের পদতলে থাকতাম তাহলে সেসব মানুষেরাই খুশি হত বেশি; যেমন কিছু বাঙালী খুশি ছিল ৭১’র স্বাধীনতার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানের দাসত্ব ক’রে । বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই এসে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা । তাকে আসতেই হয়, আসতে হবেই । কোন পথ নেই এ পথ ছাড়া । কিন্তু তারও আগে কিছু পথ ছিল যে পথে হেঁটেছি আমরা । হেঁটেছে বাঙালীর প্রতিটি মানুষ । সে পথের কথা শুধুমাত্র দিবস আসলেই উচ্চারিত হয় বেশি, যেমন উচ্চারিত হয় বিজয় দিবস আসলে । কিন্তু সে পথে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোই পথ দেখিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের স্বাধীনতার । তাদেরকে বাদ দিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে অথবা এড়িয়ে গিয়ে এ পথে আসা যাবেনা কোনমতেই । একাত্তর যদি হয় আমাদের মুক্তির স্বীকৃত সনদ তাহলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের অস্বীকৃত স্বাধীনতার অলিখিত প্রথম দলিল । যা আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল উনিশ বছর পর সেদিনের ৭১’র রণাঙ্গনে । আমরা সেজেছিলাম এক একজন গ্রীক যোদ্ধা । না ভুল বলা হলো, হয়েছিলাম তার থেকেও বেশি কিছু ।
আজকের দিনটি অর্থাৎ বিজয় দিবস তথা স্বাধীন বাংলাদেশের তাৎপর্য উপলব্ধি করবার জন্য আমাদেরকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে পেছনের দিকে । চোখ রাখতে হবে তার কাঠামোগত যে বিন্যাস তার স্তরটিতে । তা না হলে এই বিজয়কে মনে হবে কেবলই প্রাপ্তি বিনা প্রতিরোধে; অন্তত নতুন প্রজন্মের কাছে । এই প্রাপ্তি স্বীকার করতে যেয়ে আমাদেরকে যে ত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি করতে হয়েছে তা অজানা অনেকের কাছে, বিশেষ ক’রে যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে । ১৬ই ডিসেম্বর শুধু একটি বিজয় নয়; আমাদের চেতনা বিকাশের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, এক ঐতিহাসিক সংযোগ যা চির অম্লান । ১৬ই ডিসেম্বর, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আয়না, তথা আমাদের পরিচয় ।
বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের পথে ১৬ই ডিসেম্বর যদি শেষ ঠিকানা হয় তাহলে ৫২’র ভাষা আন্দোলন আমাদের পথের খোঁজ । তাই ভাষা আন্দোলন যদিও ভাষার জন্যে লড়াই কিন্তু লড়াইতো আসলে সামগ্রিক মুক্তির পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন থেকে । যা এনে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং অবশ্যই ১৬ই ডিসেম্বরের সোনালী বিকেল । উর্দুর ভাষা স্থায়ীকরণে যেদিন জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন ‘‘ উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা অন্য কোন ভাষা নয়’’ এবং ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবেশে একই কথা পুনরাবৃত্তি করেন তখন উপস্থিত ছাত্র জনতা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন । পরে খাজা নাজিমুদ্দিনও ১৯৫২’র ২৭শে জানুয়ারি পল্টনের এক জনসভায় জিন্নাহ’র কথাই পুনরুক্তি করেন ।
১৯৪৭’র দেশ ভাগের পর থেকে বাঙলা সংস্কৃতি ও ভাষা সঙ্গী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি ও উর্দু ভাষার, কষ্ট ক’রে এবং অনেকটা ধর্মীয় চাপে পড়ে ; কিন্তু তার পেছনে ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য । ৪৭’র পূর্বে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর কাছে ভাষার চায়তে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঙলা ভাগ এবং ধর্ম; তথা হিন্দু মুসলিম বিভক্তির প্রশ্ন । তাঁরা চেয়েছিল ধর্মীও পরিচয় । ভাষা আর সাংস্কৃতিক পরিচয় এক পাশে রেখে হিন্দু মুসলিম ভাগাভাগি । হয়েও ছিল তাই । ৪৭’র পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের তথা পূর্ব বাঙলার বাঙলা ভাষার উপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা কর্তৃত্ব চালাতে চেয়েছিল,। চাপ প্রয়োগের নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল তারা । তবে বাঙালীর ভাষা আর সংস্কৃতি এমন চাপ বেশিদিন সহ্য করতে পারেনি । তারা পারেনা । কারণ ভাষা ও সংস্কৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে । কোন বাধা সহ্য করতে পারেনা । গতিও তাই । সেই গতি পথটি বদলে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকেরা । বাঙালীর ঘাড়ে জোর ক’রে চাপিয়ে দেবার অপচেষ্টা খোদ ভাষা-ই সহ্য করেনি । সে বাঙালীর হৃদয়ে বিলাপ করেছে, কেঁদেছে গোপনে । সেই বিলাপ, সেই কান্না সইতে পারেনি বাঙালীরা । বিদ্রোহ ক’রে বসে তাঁরা । প্রথম বিদ্রোহটি ৫২’র ভাষা আন্দোলন । শুরুতে ৫২’র ভাষা আন্দোলন ছিল শুধু মাত্র ভাষার অধিকার স্থাপন । ভাষাই মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে অধিকার আদায়ের প্রশ্ন প্রথম; ভাষা শিখিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব রক্ষার আপন কলাকৌশল নানা ভাবে নানান আন্দোলনের ভেতর দিয়ে । যখন থেকে বাঙলা ভাষাকে ধ্বংসের অপচেষ্টায় লিপ্ত হলেন পাকিস্তানি শাসকেরা বলা যায় সেদিন থেকেই দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রশ্নটি সামনে এসে যায় । তবে তৎকালীন মুসলিম লীগের ক্ষমতায় যে সব বাঙালীরা ছিলেন তাঁরাও প্রকাশ্যে এ কথা কোনোদিন বলেননি । যিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির স্বপ্নে বিভোর ছিলেন শেষের দিকে এসে তিনি আমাদের স্বাধীন বাঙলার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান । গোপনে লালন করতেন হয়তো কেউ কেউ । এই দ্বিজাতি তত্ত্বের রূপকার আর কেউ নন তিনি শেখ মুজিবুর রহমান । রূপকার তিনি ৬৬’র ছয় দফারও ।
স্বাধীন হতে হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, হয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, নিজস্ব সংস্কৃতি হাতের মুঠোয় নিতে হবে; এমন ভাবনা বেশির ভাগ লোকেরই ছিলোনা ।কারণ তখন কারোর মাথায় নেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রর কথা । দাবী ছিল ভাষার । ভাষাই তখন রাষ্ট্রের কাজ করেছে গোপনে কখনো কখনো প্রকাশ্যে ।
ভাষা আন্দোলনে মিছিলে গুলি হলো । মারা গেলেন, প্রাণ দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আরও নাম না জানা অনেকেই । তাঁরা রাষ্ট্র ভাষার প্রথম শহীদ । পরে শহীদ হয়েছে আরও অনেকেই নানামুখী আন্দোলনে । ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান হয়েছে । শহীদ হয়েছে আসাদ, মতিউর । কিন্তু ইতিহাসের জঘন্যতম যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে পুরো ন’মাস ধরে আর শহীদ হয়েছে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ । ধর্ষণ, গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন অগণিত নারী তা পৃথিবীর যে কোন যুদ্ধকেও হার মানায় । এই যুদ্ধ আমাদের মূল অস্তিত্ব রক্ষার, চূড়ান্ত স্বাধীনতার । এই ত্রিশ লক্ষ মানুষ বিজয়ের লক্ষ্যে আত্মত্যাগকারী শেষ শহীদের দল । পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী ৭০’র সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের হাতে তথা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ।পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের কোন দল ক্ষমতায় ব’সবে এবং শাসন ক’রবে উভয় পাকিস্তান একজন বাঙালী,এটা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি । তারা নির্বাচনের ফলাফলকে সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করে বেছে নেয় ষড়যন্ত্রের পথ ।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা কোনদিনই গণতন্ত্র বোঝেনি তারা গণতন্ত্র বলতে বুঝতো হত্যা, রক্তপাত । বোঝে আজো তা ! পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন নাগরিক ও মানবিক সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এবং যখন জনগণ দ্বারা নির্বাচিত একটি দলের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় তখন শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১’র ৭ মার্চ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ) সমগ্র বাঙালী জাতিকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান করেন । মূলত তাঁর এই ডাকই স্বাধীনতার মূল মন্ত্র । যে মন্ত্রে ভেতরে ভেতরে দীক্ষিত হয়ে বাঙালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে । মুজিবের ভাষণটি ছিল অলিখিত এবং ইতিহাসের যে কয়টি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ আছে তার মধ্যে অন্যতম । একটি ভাষণ কেমন ক’রে বদলে দিতে পারে মানুষের ভেতরের রূপটি; রূপণ করতে পারে চেতনার বীজ । স্বপ্ন দেখাতে পারে স্বাধীনতার; তা মুজিবের ভাষণটি না শুনলে উপলব্ধি করা কঠিন । কোথায় পেয়েছিলেন এমন বুক ভরা সাহস তিনি ? কি ছিল তাঁর ভেতর ? যাতে ক’রে নিমিষেই একটি জাতি এক হয়ে গিয়েছিল । ভুলে গিয়েছিল ব্যক্তি পরিচয় ? বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় পরিচয় ? উঁচু হয়ে দেখা দিয়েছিল বাঙালীর নিজস্বতা ? তিনি কোন সামরিক শাসক ছিলেন না । ছিলেন তিনি জনগণের যাকে বলে অতি সাধারণের । অসাধারণ কিছু অর্জনের পথে সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে চলবার এক অনন্য সাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর । বিশেষ ক’রে তা যদি হয় বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার মতো কঠিন কাজ । আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে তাঁর ছিল একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও তার স্বরধ্বনি । যে কণ্ঠ একজন বাঙালীর, একজন দেশপ্রেমিকের । তাঁর কণ্ঠে তিনি মাতিয়ে দিয়েছিলেন, ভাসিয়ে দিয়েছিলেন বাঙলা ও বাঙালীর মন প্রাণ । তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালী । বাঙালীর বন্ধু । আর তাইতো তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বঙ্গবন্ধু’ ।
পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা ক্ষমতার পালাবদলের পরিবর্তে বেছে নেয় হত্যার পথ । ২৫ শে মার্চ মধ্য রাত থেকেই তাদের সেনাবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে নিরস্ত্র বাঙালীর উপর । তারা লেলিয়ে দেয় তাদের সৈন্যবাহিনী । এরপর থেকে চলে হত্যা, ধর্ষণের মতো অমানবিক কাজ । কিন্তু বাঙালী লড়তে জানে অস্তিত্বের প্রশ্নে । একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সপ্ন পূরণে যে যেমন ক’রে পারে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে রুখে দাঁড়ায় সেদিন । আশার কথা ছিল এই যে, সেদিন ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল । তাঁরা আমাদেরকে যুদ্ধে যাবতীয় সহায়তা প্রদান করেছিল । প্রায় এক কোটি মানুষকে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দিয়েছিল । আমরা ভারতের কাছে সে জন্য চির ঋণী, চির কৃতজ্ঞ । এই ঋণ শোধাবার নয় আজীবন । তাঁরাদের সহযোগিতা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে লড়াইয়ে জেতা ছিল প্রায় অসম্ভব । দিশেহারা পাকিস্তানিরা যেদিন বাধ্য হলেন আত্মসমর্পণ করতে সেদিন বাঙালীর ইতিহাস নতুন করে লিখা হলো ইতিহাসের পাতায় । এই অধ্যায়টি ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা । সেই অধ্যায়টিই ১৬ই ডিসেম্বর । অনেক হারানোর ব্যথায় কাতর, শোকে মুহ্যমান বাঙালীর জন্য খুশির দিন এই বিজয় দিবস । আমরা পেলাম একটি নিজস্ব নতুন লাল সবুজের পতাকা । আমরা ফিরে পেলাম আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি । বাঙালী মুক্ত হলো, দেশ স্বাধীন হলো এই বিজয়ে ।
কিন্তু আজ পেরিয়ে এলাম যে বিজয় । কেটে গেছে যে ৪৩ টি বছর বিজয়ের; সে বিজয় কি আমরা ধরে রাখতে পারছি ? বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে আমাদের বিজয়কে নস্যাৎ করার অপচেষ্টা করা হয়েছে খোদ স্বাধীন বাংলাদেশেই । অপমান করা হয়েছে বিজয়ের চেতনাকে । ৭১’র চিহ্নিত রাজাকাররা কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিত্ব পেয়েছে । তাদের গাড়িতে লাল সবুজের পতাকার উড়েছে স্বাধীন দেশে ! কেউ কেউ অস্বীকার করেছে এই বাঙলা এই বাংলাদেশ । স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে । যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে আমরা যথাযথ আর্থিক সহযোগিতা করতে পারিনি আজো ! পারিনি যুদ্ধ করতে যেয়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়া গরিব মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করতে ! যে নারীরা আজ বিরঙ্গনা হিসেবে পরিচিত তাঁদেরকে সরকারি ভাবে সঠিক মূল্যায়ন করতে ! দিতে পারিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি । এ লজ্জা আমাদের ।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি দীর্ঘ ৪২ বছর ! এই সব কিছুই আমাদের বিজয়ের অপমান । তবে আশার কথা এই, খুব দেরিতে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে । ইতিমধ্যে একজন অপরাধীর ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে । জাতির কলঙ্ক কিছুটা হলেও মোচন হলো । ৭১’র বিজয় সম্মান লাভ করল দেরিতে হলেও ।
যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম । যে বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীনতার জন্যে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল বীর বাঙালীরা সে স্বপ্ন সে বিশ্বাস আজ ভেঙে গেছে । তারা এখন টুকরো টুকরো আয়না; পড়ে আছে পথে ঘাটে ! সেই আয়নায় মুখ দেখলে মনে পড়ে যায় আত্মত্যাগকারী মানুষদের কথা ! লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে । ক্ষোভে ঘৃণায় কেঁপে উঠি যখন তখন ! স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ এখন নষ্ট ভ্রষ্টের লীলা ভূমি । স্বাধীনতার উত্তর প্রতিটি দশক ক্ষমতা ভোগ আর ক্ষমতা ভাগাভাগির দশক । জনগণ দেখেছে কয়েকটি সেনা অভ্যুত্থান । দেখেছে স্বৈরশাসন । লুট হয়েছে ব্যাংক, শিল্প কারখানা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা গুলো । শিক্ষার নামে হয়েছে সন্ত্রাস । এই গুলো থেমে যায়নি; আজো হচ্ছে, প্রতিনিয়তই । কিন্তু কথা হচ্ছে এসবের জন্যই কি আমরা যুদ্ধ ক’রেছিলাম একাত্তরে ? এসব করার জন্যই কি স্বাধীনতার জন্যে চিৎকার করতো তাঁরা যারা আজ দূষিত ? তখনতো মনে হয়েছিল বাঙলাকে ভালোবেসেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কেরেছিল তাঁরা ! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদেরকে এক ক’রে দিয়েছিল কিন্তু ‘বিজয়’ আমাদেরকে বিভক্ত করে দিয়েছে নানা ভাবে নানা কারণেই নিজেদের ভেতরে । আমি নিশ্চিত আজ যদি ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ ফিরে আসে বা বলতে পারি যদি যুদ্ধটি সংঘটিত হয় এখনকার সময়ে তাহলে একত্রের বাংলাদেশ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । সেও নানা কারণেই । এমন বাংলাদেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী । সময় বদলে দেয় অনেক কিছু, বদলে যায় কাঠামো; অস্বাভাবিক নয় এমনটি ঘটা । কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তার বুকে ছুরি বসিয়ে তাকে রক্তাক্ত, বিপন্ন ক’রে তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না । বিজয়ের চেতনা আমাদেরকে সে অনুমোদন দেয় না । কখনোই না ।
ভরসার জন্য,প্রাণ শক্তির জন্য, সচেতনতার জন্য, আত্ম উপলব্ধি জাগাবার জন্য এমনকি নানাবিধ প্রয়োজনেও আমাদেরকে বারবার যেতে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছে । এখানেও দেখছি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভাবেই দেখা দিচ্ছেন তিনি । তাঁর শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি এক জায়গায় বলছেন-‘‘মানব মহিমার শোচনীয় পতন ইতিহাসের পর্বে পর্বে। কিন্তূ এই সকল সভ্যতা যেখানে মহামূল্য সত্যকে কোনো দিন কোনো আকারে প্রকাশ করেছে, সেইখান থেকেই সে মানুষের মনকে চিরদিনের মত জয় করেছে । আজ আমাদের অভিযান নিজের অন্তর্নিহিত শক্তির আত্মশত্রুতার বিরুদ্ধে, প্রাণপনে আঘাত হানতে হবে বহু শতাব্দীনির্মিত মূঢ়তার দূর্গভিত্তি-মূলে" ।
কোটি অশ্রু জলের আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের যে স্বাধীনতা তার চেতনাকে বুকে লালন করা; তাকে যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান করা আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব এবং কর্তব্য । দায়িত্ব এটাও যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও স্বচ্ছ ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদেরকে সে পথে ধাবিত করা ।
![]() |
| পরিচিতি |
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন