জীবনে কোনদিন মাটির লেভেলের ওপরেই উঠতে পারল না সনাতন। হুড়মুড় করে দোতলা বাড়ি তেতলা, তেতলা চারতলা হয়ে গেল। পাশের বারোঘর-একউঠোন দত্তবাড়ি প্রোমোটার স্পর্শে আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। ওয়ার্ডের কমিশনার বিলেদা চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যান রোহিতদা এম এল এ আর এম এল এ রাধারমণবাবু এম পি হয়ে গেলেন। রাস্তার ওপারের জলাজমি বুজিয়ে হল শপিং মল। যাদের দু চাকা ছিল, তাদের চার, যাদের চারচাকা ছিল তাদের আর একটু বেটার মডেল, নিদেনপক্ষে একটু হায়ার ভ্যারিয়ান্ট। কিন্তু সনাতন যে কে সেই। মাটি মেখে। মাটির কাছাকাছি। নজর ওই মাটিরই দিকে। অনেকটা ম্যামনের মত।তবে ও সোনা খোঁজে না। মাটিই ওর সোনা। মাঝে মাঝে মুখ তুলে যখন আকাশ দেখে, তখনও ওই মাটিরই জন্য। সমাচ্ছন্ন মেঘ কতটা ধারাপাত ঘটাবে বা খর রোদ কতটা পোড়াবে, তা দিয়েই নির্ধারিত মাটির রস। আর এই রসের টানেই প্রোথিত উদ্ভিদের শিকড়। মাটির গভীরে। আরও গভীরে।
মাটি ভেদ করে যা ওঠে তাই উদ্ভিদ। উদাহরণ, কেঁচো। লিখেছিল ওর ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সনাতনকে মুখে সবাই মাটির মানুষ বলে। যদিও মনে মনে ওর বউয়ের ভারশানটাই সবাই মানে – কেঁচো। অবশ্য মাটি ভেদ করে ওঠার ক্ষমতা ওর নেই। তাই মাটির মমতা গায়ে মেখে সনাতনের পথচলা। সনাতন জানে যে মাটিই খাঁটি। এবং তা জানা ও মানার জন্য তার জীবনটাই মাটি – একথা সে কখনই মনে করে না। এই মাটি প্রীতি বা মাটির টান বংশগত কিনা বলা যাবে না। তবে এই মাটি প্রীতি তার বাপের ছিল। গ্রামের জোতদার তথা স্কুলের করণিক জনার্দনবাবুর জীবনের আপ্তবাক্য ছিল – টাকা মাটি, মাটি টাকা। চাকরী জীবনে জমি কিনেছেন প্রচুর এবং অবসরকালে সেই মাটিকে টাকায় কনভার্ট করে নিকটবর্তী গঞ্জে এসে আস্তানা গেড়েছেন। সেখানেও এই “টাকা মাটি, মাটি টাকা” কারবার শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটা বড় ধাক্কা খেয়ে গেলেন যখন তাঁর প্রায় লাখ দশেকের একটি জমি ল্যান্ড মাফিয়াদের পাল্লায় পড়ে “টাকা মাটি, মাটি হাওয়া” হয়ে গেল। সেই থেকে মাটি প্রীতি ঘুচে গেছে বাপের।ছেলের কর্মক্ষেত্রের কাছে সদ্য করা বাড়ির চিলতে ছাদের ছোট্ট ফুল বাগান দেখে বাবা মন্তব্য করেছিলেন – ভালোই হয়েছে। তবে সব্জিবাগান করতে পারতি। খাওয়া যেত।
শারদত্তোর এক সকালে শীতের হিম ও সূর্যের ওম মেখে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করছিল সনাতন। পরণে হাফপ্যান্ট, মাঙ্কিক্যাপ আর বগলফুটো হাতাওয়ালা গেঞ্জী। গোলাপের ছাঁটা ডালে কুশি বেরিয়ে ডালপালা লম্বা হয়ে গেছে। কয়েকটিতে কুঁড়ি। ফুটতে দেরী। কাজ অনেক। সময় অল্প। মরাপাতা ঝরাতে হবে।গাছেরা গোড়ার ঘাস নিড়াতে হবে। শুকনো ফুল ডাঁটি থেকে ভাঙাও বাকী। গাছে জল দিতে হবে। চায়ের জন্য ফ্লাস্কের দিকে হাত বাড়ায় সনাতন। কিন্তু হাত গুটোয়। সময় কম। আর চা নয়। বাগানের সাথে ওর সম্পর্ক অনেকটা বাগান ও মালীর মত। মালিকের নয়। গাছেদের পেছনে খাটতে খাটতে সময় যায় ওর। ফুলের রূপ-রস-গন্ধ নেবার সময় কই? ওর বউয়ের মাটিতে অ্যালার্জি। খুব ভালো ফুল-টুল ফুটলে ছাদে ডাকে। এসেই স্মার্ট ফোনে ফোটো তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে। সাথে ক্যাপশান- আমাদের বাগানের ফুল। খানিক বাদে এসে রিপোর্ট দেয় কতগুলো লাইক পড়ল। বড় মেয়ে কে জি ওয়ান কি টু-তে পড়তে আসতো মাঝে মাঝে। ছাদে। মিস-এর জন্য ফুল নিতে। এই সুযোগে কিছু ফুলের নাম শিখিয়েছে ওকে। এখনো কিছু কিছু মনে আছে। ফুলের নাম বলতে বললে গোলাপ, জবা, বেলির সাথে সাথে জারবেরা, অ্যাজেলিয়া, অ্যাডেনিয়াম ও বলে। ছোট মেয়ে আধো আধো কথা বলতে শেখার পর সনাতন ওকে শিখিয়েছে। এখন বছর দুয়েক বয়েসে আঙুল দিয়ে পয়েন্ট করলে ঠিকঠাক বলে দেয়। বলে – এতা পুল, ওতা তাতা। তাতেই তৃপ্তি সনাতনের। বেশি কিছু চাওয়া নেই উত্তর প্রজন্মের কাছে। কিছুই না। শুধু এটুকুই, যেন বাবা বলে পরিচয় দিতে কুন্ঠা না বোধ করে। বাবার হুইম বা শখ – যাই বল, তা নিয়ে যেন লজ্জা না পায়। তাই এত তোড়জোড়। নিজের শখকে ভালো লাগানোর বা স্বীকৃতি পাওয়ানোর। অন্ততঃ নিজের উত্তরসূরীর কাছে।
অবশ্য অ্যাপ্রিশিয়েট করার লোকের অভাব নেই। ওদের একটা গ্রুপই হয়ে গেছে। নেতাজী পল্লীর শুভ, করোনেশান স্কুলের জানা–দা, তুলসিপাড়ার জ্যোতি, রিটায়ার্ড দুই চিরসবুজ বন্ধু সুদীপবাবু ও নাড়ুবাবু। এরকম আরও গুটিকয় গাছপাগল। পালা করে একে অপরের বাড়ি যায়। দু-এক কাপ চা খায়। উৎসাহ দেয়। কেউ বেড়াতে গেলে পালা করে তার গাছে জল দেয়। চাপা রেষারেষি যে নেই তা নয়। কার ফুলের সংখ্যা বেশি, কার পাতা বেশি চিক্কণ। তবে প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতাই বেশি। গাছে অ্যাফিড, কী পেস্টিসাইড দেব- নাড়ুদাকে জিগ্যেস কর। কারো গোলাপে ডাই ব্যাক। “ওষুধ আমার কাছে আছে। কিনতে হবে না।“ হয়ত শুভই বলল। একবার ফ্লাওয়ার শো- তে গোলাপের জন্য মোক্ষম দাওয়াই বাতলেছিলেন প্রদীপদা – মালা–ডি দাও গুঁড়ো করে। ফনফনিয়ে বাড়বে গাছ। ফুলও ফুটবে সেই। কিনেওছিল সনাতন পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে। তাকিয়েছিল ছোকরা কর্মচারী। চোখে সপ্রশংস দৃষ্টি। চল্লিশোর্ধ্ব সনাতনের জোশ দেখে। কিন্তু দেওয়া হয় নি। তবে ওই টোটকা যে পরীক্ষিত সত্য তাতে সন্দেহ নেই। শিলিগুড়ি শো–এর গোলাপ চ্যাম্পিয়ান পুলকদাও ওই টোটকার কথা বলেছিলেন একবার। বলে বললেন – এই কাউকে আবার বোল না।
একদিকের হাতের কাজ সেরে ছাদের ছায়াঘেরা কোণটিতে হাত লাগায় সনাতন। আট-বাই-আট এই জায়গাটি বড় প্রিয় তার। লোহার ফ্রেমের ওপর অ্যাগ্রোনেট দিয়ে ঘেরা জায়গাটিতে তার অর্কিডদের বসতি। বেশিদিনের শখ নয়। দুবছরের মধ্যে তার বাহারি অর্কিডেরা তরতর করে বেড়ে ফুলে ফুলে ছাদের এই কোণটি আলো করে রেখেছে। প্রথমে সে ফো্লিয়ার স্প্রে করে। তারপর শুরু হয় তার সন্তর্পণ আনাগোনা। চৌহুদ্দি এই আট-বাই-আট। একটু বেশি হাত-পা ছড়ালেই ফুলের স্টিক পটকাবে বা অর্কিডের পট উল্টোবে। পাতায় ফাংগাল অ্যাটাক হল কিনা, শিকড়ে পচন ধরল কিনা, ডগার পাতা শুকোচ্ছে কিনা – সব দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পাতার গোড়ায় খাঁজ থেকে কোন স্টিকের আগমনের সম্ভাবনা দেখা দিলেই পুলকিত হয়ে ওঠে। ওই আট-বাই-আট – এই অষ্টবক্র অবস্থাতেই চলে ফোনাফোনি। যেন নতুন বাবা তার সন্তানের ভূমিষ্ঠ হবার খবর দিচ্ছে বন্ধুদের। স্টিক বেরিয়ে দানা বেরোয় স্টিকের গায়। কুঁড়ি বড় হয়। প্রকৃতি সময় নেয়। সনাতন ধৈর্য হারায়। আধফোঁটা কুঁড়ির ডগায় চাপ দিয়ে ফুল ফোটায় সে। অনেক সময় কুঁড়ি ভাঙে, পাপড়ি ছেঁড়ে। সনাতন হাত কামড়ায় তার অপরিণামদর্শিতায়। কিন্তু এই অভ্যেস ছাড়তে পারে না।
বন্ধু সৌমেনের পাল্লায় পড়ে একবার সনাতন গিয়েছিল চন্ডীতলায়। এক ভদ্রলোক নাকি তাঁর গাছপালা বিক্রি করে দিচ্ছেন কেনা দামে। অর্কিডও আছে। বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল। পক্ক শশ্রুগুম্ফশোভিত এক সুঠাম বৃদ্ধ। ঘোলাটে চোখে তার খ্যাপামি।এ দৃষ্টি সনাতনের চিরপরিচিত। গলায় হতাশা বাজছে। বিশাল বাগানওয়ালা বাড়িতে ভদ্রলোক একা। ছেলে মেয়ে বাইরে থাকে। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে বছর কয়েক। বললেন – বেশ ক’দিন হসপিটালে ছিলাম। গাছপালা সব শেষ। যা কিছু আছে বেঁচে দেব। এভাবে চোখের সামনে তো শেষ হয়ে যেতে দিতে পারিনা। অর্কিড পাওয়া গেল কিছু। বাকি সব শুকনো, শ্রীহীন। গোড়ায় বাসা বেধেছে লালপিঁপড়ের দঙ্গল। পাতায় পাশের বাড়ির রঙের ছিটে। সিমেন্টের দাগ। নামমাত্র মূল্যে হাতবদল হল গুটিকয়েক বেঁচেবর্তে যাওয়া অর্কিডের। সৌমেন বাগান দেখব বলাতে ভদ্রলোক নিয়ে গেলেন তার বাগানে। শ্মশান বললে কম বলা হয়। অ্যাডেনিয়াম পচে গিয়েছে। জবার বাগান পোকা লেগে শেষ। গোলাপ ঝাড়গুলি পুড়ে কঙ্কাল। গায়ে তাদের ঝুলছে নাম বংশপরিচয় নামাংকিত বাহারি ট্যাগ। শুকনো মুডমুডে পাতায় পরম মমতায় ভদ্রলোক হাত ছোঁয়াতেই, তার পাতা খসে খসে পড়ল। ট্যাগযুক্ত মৃত গোলাপগুলোকে যেন মর্গে শয়ান শবের মত। যেন কোন হলোকাস্টে গোটা বাগান জ্বলে পুড়ে খাক।
সনাতন ভাবে আর শিহরিত হয়। হয়তো এটাই ভবিতব্য। তবুও যখন ছোট্ট চারাগাছ ডালপালা মেলে, মাটিতে শিকড় ছাড়ে রসের সুলুক সন্ধানে, কচিডালের ডগায় কুঁড়ি আসে, ফুল ফোটে, ভোরের রোদ্দুর পড়ে সবুজ পাতায় শিশির হাসে – সনাতন আরও একটু বেশি ভালবাসে। আরও একটু জড়িয়ে যায়। গাছের টান, মাটির টান – এ বড় মায়া। উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা তার কই! এই কংক্রিট জীবনে এতটুকু সবুজ ছাড়া সে বাঁচেই বা কি করে! তবুও যে কদিন আছি, যতদিন না মাটিতে মিলাচ্ছি, আর একটু জড়িয়ে যাই, আরও একটু জুড়িয়ে যাই – ভাবে সনাতন। ভাবে আর ওর হাত ছুঁয়ে যায় অর্কিডের ফুল, জবার কচি সবুজ পাতা, গোলাপের কাঁটা – পরম মমতায়।
![]() |
| পরিচিতি |
অনির্বাণ ঘোষ
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন