রমাকান্ত বাবুর নেশা ছল। না,মদের না--অন্য ম'কারেরও না। নেশা তো কত কিছুরই হতে পারে--সকাল বিকেলে ঘুরতে যাওয়া, প্রতিদিন জানলা দিয়ে তাকিয়ে লোকজনের আনাগোনা দেখা ইত্যাদি ইত্যাদি। বিয়ের আগে এক সময় ছিল তাঁর এ ধরনের নেশা--রাস্তার লোক গোনা, ফুড়ুত উড়ে যাওয়া পাখি দেখা, কিম্বা রঙচঙে কাউকে হেঁটে যেতে দেখা ! বিয়ে করার পর ও সব নেশা ছুটে গেছে--তারপর আবারও জানলায় উঁকি মারার ইচ্ছে থাকলেও বাগড়া বাধিয়ে ছিল ওই ধর্মপত্নী, তার একে বারে মোদ্দা কথা ছিল, ও সব ছাড়, বিয়ের পর আর সেয়ানা মেয়ে বউদের দেখে বেড়াতে হবে না...
ওসব নেশা অনেকদিন আগেই কেটে গেছে। এখন রমাকান্তর নেশা অন্য রকম--লেখালেখির নেশা, গল্প, কবিতা লেখা,আর শুধু লিখেই তো ক্ষান্ত দিলে চলে না--তাকে টাইপ করে লোক সম্মুখে তুলে না ধরতে পারলে হবে কেন !
রমাকান্ত সে দিন রাতেও মনোযোগ দিয়ে একটা গল্প লিখছিলেন।
--কি হল তোমার সময় হল না--আর কত বসে থাকবে ওই ল্যাপটপ—কম্পিউটার নিয়ে? এই রাত দুপুরেও কি তোমার লেখালেখি শেষ হবে না ? স্ত্রীর দ্বিতীয় বারের ঝাঁজদার কণ্ঠ বেজে উঠলো। রমাকান্তর এই হল এক যন্ত্রণা, স্ত্রী শুয়ে গেলে তাকে পাশে গিয়ে শুতেই হবে--তার জন্যে নানান বাহানা, আলো জ্বললে আমি ঘুমাতে পারি না--চোখের সামনে তোমার ঠায় মুখ গুঁজে পড়ে থাকা আর কাঁহা তক দেখা যায় !
ব্যাস আর বসা চলবে না—না হলে তৃতীয় বারেই গাজ্বালা বচসা শুরু হয়ে যাবে। অবশ্য স্ত্রী তাঁর ইচ্ছে করেই ওই জ্বালা ধরা কথাগুলি বলে, তা না হলে নাকি বুড়োটার গায়ে গিয়ে লাগবে না ! বসে থেকে থেকে ওই সব ছাইপাশ লেখা !
সারা দিন খাটাখাটনির পর রাতের বেলায় ওই ঘুমের সময়টায় এমনিতেই স্ত্রীর মেজাজ তেলে বেগুনে জ্বলার মতই থাকে। কাজেই রমাকান্ত আর তৃতীয় বার বলার অপেক্ষা না করে উঠে পড়লেন।
এবার শুতে হবে। অথচ এদিকে নানান জট পাকানো চিন্তা তাঁকে ধরে আছে। আধ লেখা গল্প বড় ভাবাতে থাকে। মাঝে মাঝে এভাবেই ঘুমের ব্যাঘাত হয়। কখনো সখনো মনের মধ্যে ভাবের উদয় হয়--সেগুলিকে কাগজে নোট করে রাখতে না পারলে সকালে তা আর মন হাতড়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। শোবার বালিশের তলে স্ত্রীর অজান্তে কাগজ কলম রেখে দেন তিনি। তা সত্ত্বেও স্ত্রীর নিদ্রা ভঙ্গের দায় থেকে বাঁচার জন্যে অনেক সময় সে সব সূক্ষ্ম সুন্দর ভাবগুলি আর কলমে ধরে রাখা হয়ে ওঠে না।
এক সময় রমাকান্তর এই লেখালেখির ব্যাপারটা শুধু মাত্র সময় কাটানোর জন্যে ছিল--কিন্তু ধীরে ধীরে এটা এক ধরনের নেশায় পরিণত হল। অবশ্য রেগে গেলে বউ বলে, ভুতের বেগার ! ভাবতে গেলে কথাটা একদিকে সত্যি বটে--যার মধ্যে পয়সার নাম গন্ধ নেই--বরং উল্টো লেখকের খরচ। কালি, কলম, কাগজ ছাড়া আছে ল্যাপটপ-কম্পিউটার, প্রিন্টারের মেনটেনেন্স। এ সব অনাবাদী ফসল, জঙ্গলে আপনি আপনি গজিয়ে ওঠার মত। কোন পত্রপত্রিকা তার দাম দেওয়া তো দুরের কথা, বরং সম্পাদকের খুঁতখুঁতানি শোন--বানান ভুল, প্যারাগ্রাফ ঠিক নেই। আর ভালো হল তো একেবারে নির্বাক হয়ে থাকবে, ভুলেও বলবে না, খুব ভালো হয়েছে লেখা।...এর পরেও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের গলা শুকানো আছে--জানাবে, আমাদের পত্রিকার পাঁচ কপি কিনলে লেখক কপি এক্সট্রা পাওয়া যাবে ! কিম্বা জানান দেওয়া হবে--নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশের জন্যে মুক্ত হস্তে দান করুন !
ইত্যাকার প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও রমাকান্ত তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সংসার ধর্ম চালাবার ব্যাপারে তিনি বড় আনকোরা। নতুবা উঠতে বসতে স্ত্রীর এত গলাবাজি শুনতে হবে কেন ? এক সময় তিনি নিজে এসে স্ত্রীকে যথাসাধ্য কাজে সাহায্য করতে চেষ্টা করতেন। ইদানীং তিনি অনেকটা সংসারত্যাগীর মতই। আর কত ধরে রাখা যায়--দেখতে দেখতে তাঁর বয়স ৬২ পার হতে চলল যে!
বিয়ের পরে পরে তো তিনি চড়চড়িয়ে সংসার ধর্মে চড়ে বসে ছিলেন। শরীরে তখন প্রেমের ধারণ ছিল, যখন-তখন বসন্তের হাওয়া চলত, মনে পলাশের নেশা ছিল। এমনটা তো সব সালারই থাকে ! পরপর তিন তিনটে বাচ্চা কাচ্চা হবার পর কোথায় যে গেল সে সব জোয়ারের দিনগুলি ! খাটতে খাটতে বউয়ের খাকড়ি মারা গলাটা সময় অসময় সংসারের নীরবতা ভাঙ্গতে লাগলো। সংসারের পাঁচ ছজন সদস্যের মাঝে ফেঁসে গিয়ে রমাকান্তর ঘরকে যেন কেমন খোঁয়াড় খোঁয়াড় বলে মনে হত !
অন্য দিকে অফিসের চাপ ছিল। তবে টুর পড়লে মনটা একটু চাঙ্গা হয়ে উঠত। শরীরকে হালকা ছেড়ে দিয়ে কেবল অফিসের চাপটুকু মাথায় রেখে ঘুরে বেড়ানো--ওরই ফাঁকে নীলাকাশ, ফুল বাগান, আর রঙিন পাখি দেখে বেড়ানো !
স্ত্রী কাজের চাপে ধেবড়ে যাচ্ছিল। আকর্ষণ বিকর্ষণ জাতীয় ভাবগুলি কেমন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। মুখে খ্যামটা ভাব জেগে উঠছিল। ওই সংসার চাপে যেমনটা হয় আরকি ! চাপে ভাপে শরীর পেলব গলে ঢলে একাকার...
--এই আমায় ঘুমাতে দেবে ? একটু সময় স্থির হয়ে থাকতে পার না--বিছানায় শুয়েই এত মোড়ামুড়ি এপাশ ও পাশ কেন শুনি !
কথা সত্য--রমাকান্তর কিছু উত্তর দেবার নেই। লেখালেখির ভাবনাগুলি বড় নাছোড়বান্দা, মন ছেড়ে যেতেই চায় না—মনের মাঝে সব সময় পিলপিল করতে থাকে। আরে বাবা, এত সুড়সুড়ি দেবার আছে টা কি ? এখন ঘুম চাই, ঘুম--আজকাল আর এক ব্যামো হয়ে গেছে অঘুমে যেমন এপাশ ওপাশ উসখুস করেন তেমনি তিনি ঘুমের মাঝেও কথা বলেন। স্বপ্নের সংলাপ যাকে বলে ! একদিন তিনি বলে উঠেছিলেন, ভালবাসার তুমি কি জানো !
ব্যাস আর যায় কোথায়--পাতলা ঘুম ভেঙে স্ত্রী চমকে উঠলেন, রমাকান্তর পিঠে খোঁচা মেরে বলে উঠলেন, আচ্ছা--স্বপ্নেও ভালবাসা ! তাও অন্য কারো সঙ্গে হবে !
--এই, কি হচ্ছে কি ? আচমকা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল রমাকান্তর। কথা বলার আগে খোঁচা খেয়ে একটু ক্যাঁৎ, করেও উঠেছিলেন। এমনিতেই বিছানায় থাকা কালীন স্ত্রীর নির্বিঘ্ন ঘুমের দিকে নজর রাখতে হয় তাঁকে। তারপর এমন সিচুয়েশন ঘটে গেলে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে বই কি !
--স্বপ্নে আবার কাকে নিয়ে ভালবাসার ফুল ফোটাচ্ছিলে তুমি ! স্ত্রীর বেশ কর্কশ গলার চিল চিৎকার ছিল।
--না,না--মানে--রমাকান্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলেন না--না, না বলে তোতলাছিলেন।
--থাক থাক--সব বুঝেছি—
স্বপ্নের ঘটনাকে মেক আপ দিতে গিয়ে গলায় সামান্য রস ভরার চেষ্টা করে নিয়ে রমাকান্ত বলেছিলেন, জানো--তোমায় দেখলাম--সেই সে দিনের--
--আ:, চুপ ! চুপ !! গোঁজামিল না দিয়ে দয়া করে আমায় একটু ঘুমাতে দিন--
তুমি, থেকে আপনিতে এলে বুঝতে হবে মেজাজটা এখনও মধ্যমে আছে। আর বাড়তে দেওয়া মঙ্গলজনক নয়। ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলেন রমাকান্ত। শোয়া তো নিজের হাতে কিন্তু ঘুম ? সেটা ? প্রাত্যহিক ব্যাপার হলেও এই বয়সকালে ওটা ভগবানের হাতেই ছাড়া থাকে বলে মনে হয়।
মাঝে মাঝে এমনি হয়--স্বপ্ন বড় তেঁদড় হয়--ওই আধ-খাবরা গল্পের নায়িকা রানু স্বপ্নে দেখা দিয়ে ছিল। অদ্ভুত সে স্বপ্ন । গল্পের নায়িকা, রানু বনের মধ্যে লতায় পাতায় বাঁধা পড়ে আছে। যেন সে বাঁধন ছিঁড়ে সে আর কোন দিন বের হতে পারবে না। এদিকে নায়ক হাওয়া। নায়িকার সে কি বিরহ দশা। হঠাৎ রমাকান্ত যেন নায়িকার সামনে এসে দাঁড়ালেন। নায়িকা করুণ হয়ে বলে উঠলো--এ বিরহ থেকে আমায় বাঁচাও রাম দা ! আমায় উদ্ধার করো!
স্বপ্নেও,রাম দা,কথাটা কানে একটু বাধলেও রমাকান্তর দেহ ক্রমশ: সবুজ হয়ে যাচ্ছিল--কচি-কান্ত একটা ভাব চেহারায় লেগে যাচ্ছিল। ও দিকে মদন তার শরশয্যা বিছিয়ে ছিল হবে। রানু লতাপাতায় জাবড়ে থেকে বলে চলেছে, ও গো আমায় বাঁচাও--তোমার প্রেমিকাকে উদ্ধার করো।
রমাকান্ত ঘুমে রেশ নিয়েই একটু নড়ে উঠে বলে উঠেছিলেন, ভালবাসার তুমি কি জানো সখী ! ব্যাস ডায়লগ শেষ হতে না হতেই পিঠে এসে পড়ে ছিল স্ত্রীর ধারাল নখের খোঁচা !
না, ঘুম কিছুতেই আর আসবে না--তিনি মশারি তুলে ধীরে হাত বাড়ালেন, জলের গ্লাসের দিকে। অমন স্বপ্নের কথা মনে পড়ে রাতের নরম বিছানায় থেকেও গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। যত সাবধানই হও--বয়সের ধর্ম যাবে কোথায় ? গ্লাসের সঠিক জাগায় হাতটাও রাখা গেল না--ধপ--ধড়াস--ভাংচুর শব্দ ওরে বাবা, এবার রক্ষে নেই, ভাববার আগেই স্ত্রী তড়াক করে উঠে বসলো। ঘুমের মধ্যে ব্যাপারটা অনুধাবন করতে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলো । রমাকান্ত চোখ বুজে পড়ে আছেন। একেবারে নট নড়ন চড়ন।
--কি ব্যাপার ? কিছুর শব্দ হল না ?
রমাকান্ত মিটমিটিয়ে দেখলেন, স্ত্রীর মুখ তাঁর একেবারে মুখের ওপর ঝুলে আছে। রমাকান্তর ঘুম নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে হবে ! দু চোখ আরও এঁটে নিলেন রমাকান্ত। মনে হল চশমা বিহীন স্ত্রীর চোখ দুটো তাঁর উন্মীলিত চোখের খোঁজ পেল না--রমাকান্ত ভাবলেন, একটা সময় ছিল, যখন এই চার চক্ষুর উন্মীলনে কত না আনন্দের ঢেউ মনের মাঝে তোলপাড় করে যেত !
তাপসকিরণ রায়
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২১, ২০১৪
Rating:



কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন