ঋতুপর্ণ ঘোষ চলে গেলেন। খুব অল্প বয়সে, অসময়ে বিদায় নিলেন তিনি। এমন একটি সময় যখন বাংলা চলচ্চিত্র জগত খুঁজে নিচ্ছে একটি নিজস্ব আঙ্গিক। পুরনো গতে বাঁধা চালচিত্র থেকে বেড়িয়ে আসার যে একরোখা একটি প্রয়াস শুরু হয়েছে, তিনি ছিলেন এর হোতা। এবং অবশ্যই তিনি ছিলেন এই নতুন ঠিকানা খুঁজে নেওয়ার প্রয়াসের প্রধান নাবিক। তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই দিকনির্দেশের প্রক্রিয়া একটু স্তব্ধ হল বইকি। তাঁকে নিয়ে দু-চার লাইন লিখি এ আমার সাধ্য কি!
তবুও যে কারণে আজ এই মেঘলা বিকেলে কলম ধরা তার পেছনে রয়েছে এই মানুষটিকে নিয়ে আমার একটি পুরনো স্মৃতি। বছর দুয়েক আগে সপরিবার কলকাতা ভ্রমণকালে ভ্রমণসূচিতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নামটি জুড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার পরে, ঠাকুরবাড়ির দুর্গা দালানটিকে ক্যামেরার লেন্সে বিভিন্ন কোণে ধরে রাখার প্রচেষ্টায় রত ছিলাম। তখন দেখেছিলাম বেশ কিছু মানুষ নানান আসবাব পত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত, কেউবা রঙের কাজে। আশেপাশে থেকে যা কথা কানে এল বুঝলাম কোন শুটিং এর সেট তৈরি হচ্ছে। তবে এখানে যে এত চমক অপেক্ষারত ছিল তা কল্পনাতেও আসেনি। হঠাৎ বাইরে একটি অ্যামবাসডর এসেদাঁড়াল। দরজা খুলে জনা চারেক লোককে সঙ্গে নিয়ে যে মানুষটি প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেন,তাঁকে আজ সকাল ৭.৩০ মিনিটে আমরা হারিয়ে ফেলেছি – ঋতুপর্ণ ঘোষ। অপ্রত্যাশিত এই দর্শনে হতবাক হয়ে ক্যামেরার লেন্সটিকে ঘুরিয়ে দিই তাঁর দিকে। ওনার অজান্তে বন্দী করি ওনার সেই ক্ষনিকের সফরের কিছু মুহূর্ত। সে বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতজন্মবর্ষ উপলক্ষে একটি তথ্যচিত্র বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন তিনি। সেই কাজের সেট পরিদর্শনেই সেই দিন তাঁর আসা। অসম্পূর্ণ থেকে গেল সেই কাজ। সেদিন খুব কাছে থেকে দেখেছিলাম তাঁকে, শুনেছিলাম তাঁর কথা।
দূরদর্শনের পর্দায় যাকে দেখে অভ্যস্থ,চর্মচক্ষে অপ্রত্যাশিত ভাবে তাঁকে দেখে হয়েছিলাম হতবাক! ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে সপার্ষদ তিনি যেভাবে ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করলেন তাতে পরিচালক হিসেবে তাঁর কর্ম তৎপরতার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। দুর্ভাগ্য আমার, সেদিনের তোলা সেই ছবিগুলো আমি সংরক্ষণ করে উঠতে পারিনি। আমার কম্পিউটারের যান্ত্রিক গোলযোগে বাড়ি ফেরার কিছু দিন পরেই সেই ছবিগুলো সহ কলকাতায় তোলা সব ছবি কম্পিউটারের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। এই ক্ষতিও পূরণ হওয়ার নয়! কিন্তু তাঁর কাজগুলো মত এই স্মৃতিগুলো চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বর্তমান কালের পরিচালকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে সঠিক প্রয়োগ একমাত্র তিনিই করতে পেরেছিলেন। আজকে বাংলা সিনেমাকে দক্ষিণ ও পশ্চিমের সংস্কৃতি যেভাবে গ্রাস করতে উদ্যত, এই খারাপ সময়ে তাঁর অভাব অবশ্যই অনুভূত হবে। বাংলা চলচ্চিত্র তাঁর কাজগুলির মধ্য দিয়ে পেয়েছিল একটি বিশেষ আঙ্গিক। তাঁর আলোছায়ার ব্যবহার, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, আবহ, চিত্রনাট্য- কোথায় যেন উসকে দিত সত্যজিতের নস্ট্যালজিয়া। আজকের মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি ভেজা হাওয়া সেই কথাগুলোকে বড্ড মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনের মণিকোঠায় তিনি চিরকাল থেকে যাবেন, তবুও পরের বার কলকাতা গেলে তাঁর সাথে ঠাকুরবাড়ির দালানে তো আর দেখা হবে না...।।
![]() |
| লেখক পরিচিতি |
কুন্তল কুণ্ডু
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
অক্টোবর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন