‘শব্দের মিছিল’ কিছু কৌতূহল , কিছু সম্ভ্রম মেশানো দূর আর অনেক ভালোলাগা নিয়ে গিয়েছিল , আজকের বাংলা সাহিত্য জগতে পরিচিত মুখ, কবি , গল্পকার , অনুবাদক , শ্রীমতী নন্দিতা ভট্টাচার্য র কাছে ... এক খোলামেলা আড্ডায় আমরা যেভাবে দেখলাম তাঁকে , যেভাবে জানলাম তাঁর ভাবনার গতিপথ , একসাথে পরিক্রমা করলাম সমাজ , সাহিত্য , সাহিত্যের অলিগলি , আমাদের পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি সেই অনুভব ... তাঁর সাহিত্যজীবন পুষ্পে পত্রে বিকশিত হোক , আমরা মধুলোভী সাহিত্য মধুকররা সেই আশায় থাকলাম ... নন্দিতা দি , তোমার চলার পথে বিছিয়ে দিলাম আমাদের শুভেচ্ছা গালিচা , তুমি বিজয়িনী সগর্বে রাজহংসীর মত মাথা উঁচু করে হেঁটে যাও তাতে , আমরা মন্ত্রমুগ্ধ দেখি ...
শব্দের মিছিলঃ- নন্দিতা দি , তোমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তো আসামে ... একটু বলনা , তোমার সেই মেয়েবেলা , উন্মোচনের দিনগুলি সম্পর্কে ...
নন্দিতাঃ- ধন্যবাদ শর্মিষ্ঠা আমার মত সামান্য মানুষকে এতো সম্মান জানানোর জন্যে । আমি এবং ইন্টার্ভিউ ! ভাবতেই কেমন কেমন !
আসামের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তার প্রকৃতির কথা। সত্যি আসামে বড় হওয়া মানে ভীষণ এক প্রকৃতির মধ্যে,এক সারল্যের মধ্যে বড় হওয়া । ষোল খানা পাহাড় গুয়াহাটি শহরে ও একটি ব্রহ্মপুত্র যা মানুষকে নাড়া দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট । তুমিও তো উত্তরবঙ্গে মানুষ বুঝতে পারবে আমি কি বলছি। আর জন্মেছি একান্নবর্তী পরিবারে । মূল্যবোধ যেখানে প্রধান সম্বল । সিম্পল লিভিং হাই থিঙ্কিঙ্গের সত্যিকারের চর্চা দেখেছি নিয়ত । অর্থ ও ভোগ যে হাত ধরাধরি করে চলে না তা ওখান থেকেই শিখেছি। বাবা দেশভাগের পর এপারে নির্মাণ করলেন আবার একটি সম্পূর্ণ গৃহ । শেখালেন সবাইকে নিয়ে চলা ।এমন উদার , সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ খুব কম দেখেছি। তাঁর প্রভাব আমাদের সবার ওপরে ছিল অসীম । সাহিত্য সঙ্গীত , সম্পূর্ণভাবে কলা বিদ্যাকে ভালবাসা তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। ঐতিহ্য মানতেন নিপুণভাবে কিন্তু গোঁড়ামি দেখিনি। সবরকমের জাত ধর্মের মানুষের আমাদের বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত। অথচ আমাদের গোঁড়া বৈদিক ব্রাহ্মন পরিবার । বলা যায় কিছুটা ক্লোজড এথনিক কমুনিটি আমরা । বাড়িতে কড়া শাসন ছিল কিন্তু পরাধীন ছিলাম না আমরা ভাইবোনেরা ।
শব্দের মিছিলঃ- তুমি পড়াশুনো করেছ কটন কলেজে , যথাক্রমে গৌহাটি এবং কোলকাতা বিস্ববিদ্যালয়ে ... তোমার বিষয় এবং সেই নির্বাচনের পেছনে কারুর কোন ভূমিকা ছিল কি ?
নন্দিতাঃ- সে এক মহা মজার কথা । আমি কটন কলেজ ও হ্যান্ডিক কলেজে পড়েছি । আমার পছন্দের বিষয় ছিল ইকনমিক্স । কটন ছেড়ে যে কলেজে ভরতি হলাম সেখানে ইকনমিক্স ছিল না । তাহলে কোন বিষয় নেয়া যায় । সাহিত্য তো সর্বকালের পছন্দ । সাহিত্যে স্কুলে সব কটাতেই হাইয়েস্ট বাঁধা ছিল । বাংলা ইংরেজি হিন্দি সংস্কৃত অসমীয়া । না কেউ উদ্দীপনা যোগায় নি । কে যোগাবে । নিজেই তো তখন মহা ওস্তাদ । বিশ্ব জয় করতে পারি এমন ভাব আর কি ! ধরাকে সরা জ্ঞান ।
শব্দের মিছিলঃ- নীল পাহাড় , সবুজ বন আর ব্রহ্মপুত্র ছেড়ে কবে এবং কিভাবে প্রথম কোলকাতার ইট কাঠ কংক্রিট ইস্পাতের জঙ্গলে এসে পড়লে ?এলেই যদি থেকে গ্যালে কি এই শহর ভালোবেসে নাকি অন্য গল্প আছে কিছু ?
নন্দিতাঃ- এসেছিলাম বিবাহসূত্রে। নেহাতই জীবনের গন্তব্যে। বিবাহ টা ছেড়ে গেল আমি রয়ে গেলাম । তবে ভালবাসা থেকেও চাকরির তাগিদে বেশী। কারণ ওটা বেশ তাড়াতাড়ি জুটে গিয়েছিল । চাকরি ছাড়া চলবেও না তখন । তাই থেকে যাওয়া । তারপরে শহরকে ভালবেসে ফেলা। তবে মনটা ব্রহ্মপুত্র ও নীলাচলের কোলেই থাকে । লুকোই কেমন করে ? তাই বছর বছর ছুটে যাওয়া।
শব্দের মিছিলঃ- পেশা সূত্রে শিক্ষকতাকে কেন বাছলে তুমি ?কখনো ফুল টাইমার সাহিত্যিক হতে ইচ্ছে করে নি ?
নন্দিতাঃ- পেশা বেছেছি জীবনের কঠিন তাগিতে । তখন কোন চয়েস ছিল না । আর সাহিত্য আমার নিত্য সঙ্গী । সেটা যে পেশা হিসেবে নেয়া যায় সে বোধই ছিল না । মধ্য জীবনের পঁচিশটা বছর কিছু ভাববার সময় ছিল না । কোথা দিয়ে কেটে গেছে জানিনা । সময় যখন হল তখন আবার নিত্যসঙ্গীর দিকে ফিরে চাইলাম ।
শব্দের মিছিলঃ- সংসার সামলে , মেয়ে কে যথার্থই মানুষ করে , চাকরি সামলে লেখা চালিয়েছ ভালোবাসো বলে , তোমার কি কখনো আক্ষেপ হয় , মহিলা বলে কিছু বেশী দায় নিতে হয়েছে ? না হলে আরও সফল হতে পারতে সাহিত্যিক হিসেবে ?
নন্দিতাঃ- আক্ষেপ হয় না তেমন । জীবন যেমন চেয়েছে চলেছি । চলার পথ আমাকে সমৃদ্ধ করেছে তাই ভাবি । নিজেকে সাহিত্যিক ভাবি না । সে যোগ্যতাও নেই । হ্যা , সময় অনেকটা চলে গেছে সেটা আক্ষেপ । তবে এ হতভাগা জীবন আমার ফ্রেন্ড , ফিলসফার ও গাইড । কলকাতা আমাকে শিখিয়েছে। পড়িয়েছে । বোধ তৈরি করেছে । বাংলা ভাষার চর্চা তো আমাদের সময় আসামে তেমন ছিল না ।
শব্দের মিছিলঃ- সাহিত্যে মহিলাদের আর পুরুষদের লেখার কি আলাদা ভাষা , ফর্ম , ভাবনা , টেকনিক হয় ? কতটা সত্যি ?
নন্দিতাঃ- কিছুটা তো হয় ই। দুটো তো আলাদা প্রজাতি । ফর্ম বা টেকনিক সমকালীন , ভাবনা আলাদা হতেই পারে । হওয়াটা দরকার ও। দুজনেই সম্পূর্ণ মানুষ । কিন্তু দুরকম বেড়ে , ওঠা , হাঁটা বসা চলা । তার একটা ছাপ থাকবে না ! তাই বা কি করে হয় । আর তাতে লজ্জিত হওয়ারই বা কি আছে ? কোন লেখাটা কেমন হবে , সেটা একটা মানুষের বেড়ে ওঠা , জিন , পারিপার্শ্বিক সব কিছুর ওপর নির্ভরশীল । আসলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যা হবে সেটাই গ্রহণযোগ্য । জোর করে কিছু করলে তো বরঞ্চ কৃত্রিম হয়ে যাবে। আর মেয়েরা সব ব্যাপারেই ছেলেদের ফলোয়ার হতে হবে কেন ? সে আপন গতিতে চলুক , নিজের মত করে ভাবুক। এক নতুন জগতের সন্ধান দিক । যা হবে একবারেই আনকোরা।
শব্দের মিছিলঃ- সাহিত্যে এই যে যুগ বিভাগ , শূন্য , নয় , হাবিজাবি ... তোমার কি মত ? কতটা তফাত মৌলিকতার একের সাথে অন্যের ?তুমি নিজেকে কোন দলে ফেলবে ?
নন্দিতাঃ- সাহিত্যে যুগ বিভাগ তো ইংরেজদের কাছ থেকে শেখা । সেটার মুল্য সাহিত্য থেকেও ইতিহাসের বেশী । এটা হচ্ছে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা। আচ্ছা ধর নব্বই –শূন্যয় জন্মায়নি কিন্তু যে যুগে বসে লিখছে, সে যুগের কোন প্রভাব তার মধ্যে থাকবে না এ হয় ? আবার একেবারেই যে তফাত হবে না তাও নয় । কারণ যে সময়ের মধ্যে দিয়ে লেখক এসেছেন সেটা থেকে তার পরিত্রাণ নেই । অর্থাৎ পিন পয়েন্ট করব তাও নয় আবার একেবারেই উড়িয়ে দেব তাও নয় ।
শব্দের মিছিলঃ- রাজ্যে তিনবছর , দেশে তিন মাস হল পালাবদলের । সাহিত্যের কি এল গ্যাল তাতে ?
নন্দিতাঃ- একেবারেই এল গেল না বলা যাবে না ......সাহিত্যিকরা সময়কে ধরবেনই । নন্দীগ্রাম নিয়ে কি লেখা হয় নি ! ...... বা সেই সময়কে নিয়ে !!
শব্দের মিছিলঃ- রাজনীতি কিভাবে প্রভাবিত করে একজন লেখক কে ? আদৌ করে কি ?
নন্দিতাঃ- সেটা নির্ভর করে সেই মানুষটির ওপর । তাঁর সেন্সিটিভিটির ওপর । কোন কিছুই সবাই করে না ...... সব কিছুই কেউ কেউ করে ।
শব্দের মিছিলঃ- অনেক সাহিত্যিক ই বিশেষ ধর্ম এবং দর্শন এ প্রভাবিত হয়ে লেখার ধারা বদলে ফেলেন । কিভাবে দ্যাখ তুমি এ ব্যাপার টা ?
নন্দিতাঃ- একজন লেখক কিভেবে লিখবেন সেটা তাঁর ব্যাপার ... সেটা যদি একেবারে জলে ফেলে দেই তাহলে সুকান্তের কবিতা কি আমরা জলে ফেলে দেব ......!! আর কোনটা কবিতা কোনটা কবিতা নয় সেটা সময়ই বলবে ।
শব্দের মিছিলঃ- পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়া কতটা জরুরী সফল সাহিত্যিক হতে গ্যালে ?
নন্দিতাঃ- মনে করি না ...... খুব জরুরি।
শব্দের মিছিলঃ- তুমি তো আঞ্চলিক ভাষায় গল্পের অনুবাদ নিয়ে কাজ করেছ , তোমার ‘অর্ধেক আকাশ’ যেমন অসমীয়া ছোট গল্পের অনুবাদ । এর পরের ভাবনা কি এই অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে ?
নন্দিতাঃ- প্রকাশিত হবে এবার একটি উপন্যাস ... প্রেসে আছে ...... রূপলেখা দেবীর ...... অল্প বয়েসি ... লেখে ভাল ... ‘অন্যত্র বিরলা দেবী’ ... কামাখ্যা পাহাড়ের পাণ্ডাদের সমাজ জীবন নিয়ে লেখা ... কামাখ্যা পাহাড়ের পাণ্ডারা নবদ্বীপ থেকে গেছিলেন ...তাই সেখানকার জীবনযাত্রার মধ্যে বাংলা ও আসামের সংস্কৃতির অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় ... যা আমাকে ভীষণ ভাবে টেনে ছিল বইটি পড়ার সময় ...রূপলেখা চেয়েছিল আমি অনুবাদ করি ।
শব্দের মিছিলঃ- ঘুরতে ভালোবাসো ? ভ্রমণের কোন প্রভাব লেখায় পড়ে তোমার ?
নন্দিতাঃ- সচেতন ভাবে তো নয় ... তবে সেরকম মনে দাগ কাটলে লিখব ...ইচ্ছে আছে ...
শব্দের মিছিলঃ- তোমাকে যদি নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় , পাঁচটি বই দিয়ে ,কি কি নেবে তুমি ?
নন্দিতাঃ- পাঁচটি বই দিলে হবে না ...পাঁচশ লাগবে আর সব নতুন ... তাঁর মধ্যে ইতিহাস থাকতে হবে ...প্রাচীন ভারত অবশ্যই......
শব্দের মিছিলঃ- এখনকার বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কেমন বুঝছ তুমি ? এখন যারা লিখছে তাদের মধ্যে তোমার প্রিয় কবি কে ?
নন্দিতাঃ- ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ বলবে ... অনেক লেখা হচ্ছে ... ওয়েব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে... অনেক লেখা সবার সামনে আসছে... প্রিয় অনেকে ।
শব্দের মিছিলঃ- তোমার একটি বই আছে ‘নাকছাবির কথকতা ‘... বাংলাদেশের দুজন ও ভারতের তিন মহিলা কবির একক যাত্রা ...এই অসাধারণ কাজটির কথা তুমি ভাবলে কি করে ? বাংলাদেশ গেছ ?কোন ফারাক বোঝো দুই দেশের কাব্য চর্চার মধ্যে ?
নন্দিতাঃ- ‘নকছাবির কথকতা’ অনেকটা আমার স্বপ্নের মত। খুব কিছু ভেবে যে করেছি তা নয় । মনের মধ্যে ইচ্ছে এসেছিল , তার রূপ পেয়েছে , পরিশ্রম করেছি খুব। স্বপ্নের পেছনে ছোটার মত। দুই বাংলাকে তো মেলাতে পারব না । বইয়ে মিললাম । এ ছাড়া কচি রেজা রত্নদীপা মেঘ অদিতি শর্মিষ্ঠা খুব অন্যরকম লেখেন । সবাই মিলে পাঠক দের কাছে একসাথে গেলাম । সমবায় পদ্ধতিতে আমরা পাঠকদের কাছে পৌঁছতে পারি । এই আর কি ।
ওপার বাংলা এপার বাংলায় লেখার তফাত তো আছেই । আমরা একটু পাশ্চাত্য মুখি ওরা অনেকটা ওরিয়েন্টাল ... অনেক মাটির কাছাকাছি ...
শব্দের মিছিলঃ- তোমার এযাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ক’টি ও কি কি ?
নন্দিতাঃ- তিনটি । চতুর্থটি প্রেসে । একটি অসমীয়া ছোট গল্পের অনুবাদ । একটি একক কবিতার , একটি যৌথ কবিতার –দুই বাংলার । এবার একটি অসমীয়া উপন্যাসের অনুবাদ বেরোবার অপেক্ষায় । ছোটগল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশ আসামে বেরিয়েছে ।
শব্দের মিছিলঃ- তুমি যেভাবে আমাদের তোমার মূল্যবান সময় দিলে , আমরা আপ্লুত , মঙ্গলময়ের কাছে তোমার সুস্থ সুন্দর দীর্ঘ জীবন কামনা করি, আবার অদূর ভবিষ্যতে হয়তো কোনদিন মুখোমুখি বসবো আমরা , তোমার উজ্জ্বল দীপ্ত চোখে আমাদের শ্রদ্ধা মেশানো দৃষ্টি মিলিয়ে পড়ে নেব তোমাকে , এই আশা রাখি ...
নন্দিতাঃ- ধন্যবাদ আবারো। শব্দের মিছিল কে ......
![]() |
| ~ লেখিকা পরিচিতি ~ |
নন্দিতা ভট্টাচার্য
Reviewed by Pd
on
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন