শ্রীশুভ্র / ধর্ষণের লাইসেন্স

শ্রীশুভ্র / ধর্ষণের লাইসেন্স



এটা আমরা সকলেই জানি মানুষ জঙ্গলে নিরাপদ নয়। আর আমাদের দেশে মেয়েরা রাতবিরেতে বাড়ির বাইরে নিরাপদ নয়। একমাত্র মেয়েরাই জানেন তাঁরা দিনের বেলাতেও বাড়ির বাইরে নিরাপদ নন। দিনের বেলায় বাড়ির বাইরেও মেয়েদের নিরাপত্তা থাকলে সেই কামদুনি কাণ্ডের কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি আজও বেঁচে থাকতেন। তাঁর উপরে যে অমানুষিক অত্যাচার হয়েছিল, সেটা তাঁর রাতবিরেতে একা একা বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য নয়। শহরের কলেজ থেকে প্রতিদিনের মতো গ্রামের বাড়িতে ফেরার পথেই তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছিল। এমন ভাবেই বিঘ্নিত হয়েছিল যে আবহমান কালের বাংলার ইতিহাসে জাতি হিসাবে বাঙালির খুব বড়ো রকম ভাবেই মুখ পুড়েছিল। কিংবা হাতরসের সেই দলিত কন্যাটি। ভর দুপুরে মায়ের সাথে মাঠে কাজ করার সময়েই তো তাঁকে উত্তরপ্রদেশের একদল অমানুষের অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল। ফলে এটা নিশ্চিত, রাতবিরেতই হোক আর দিনের বেলা হোক। আমাদের দেশে মেয়েরা কোন সময়েই বাড়ির বাইরে নিরাপদ নন। বাড়ির ভিতরেও যে প্রতিটি মেয়ে জীবনের প্রতিটি দিন নিরাপদে থাকবেন। এমন উদ্ভট কষ্টকল্পনাও কেউ করেন না। রাজনীতির কেষ্ট এবং বিষ্টু ছাড়া অন্য কেউ তেমন দাবি করেও লোক হাসান না। সে যাই হোক, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে মেয়েরা বাড়ির বাইরে কি দিন কি রাত কোন সময়েই নিরাপদ নন।

বনজঙ্গলে যেমন নিরস্ত্র মানুষের কোন নিরাপত্তা থাকে না। সব কালেই থাকে না। সব দেশেই থাকে না। তেমনই আমাদের দেশেও পথেঘাটে মেয়েদেরও কোন নিরাপত্তা থাকে না। দিনেও নন। রাতেও নন। অথচ আশ্চর্যজনক ভাবে হলেও সত্য, আমরা প্রায় সকলেই একসুরে গলা মিলিয়ে ফেলছি। না, রাতবিরেতে মেয়েদের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। অনেকটা যেন, এমন কোন বেঠিক কাজ করলে তার ফল তো একজন মেয়েকে ভুগতে হতেই পারে। সেই যেমন সমাজের একদল জ্যাঠামশাইরা হামেশাই মেয়েদের পোশাকের দোষ দেখতে থাকেন। পথে ঘাটে মেয়েদের ধর্ষিত হওয়ার পিছনে যাঁদের চোখে মেয়েদের পোশাকই দায়ী হয়ে ওঠে। মেয়েরা কেন ছোট পোশাক পরবে? না, আমাদের দেশে নিরানব্বই শতাংশ মেয়েরাই ঘরের বাইরে কোথাও ছোট পোশাক পরে চলাফেরা করেন না। এমনকি ঘরের ভিতরেও অধিকাংশ মেয়েই ছোট পোশাক পরিধানের সাহস পান না। কিন্তু তারপরেও মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য কি দিন কি রাত পথঘাট আদৌ নিরাপদ নয়। কিছু হলেই প্রথমেই দুটি কারণ উঠে আসে। হয় রাত। নয় ছোট পোশাক। এবং তাও যদি না মেলে, তাহলে তো নিশ্চিত ভাবেই মেয়েটির চরিত্রের কোন দোষ ছিল। না হলে তাঁকে ধর্ষিত হতে হবে কেন? কই ঘরে ঘরে আর মেয়েরা নেই? কারুর তো এমনটা হচ্ছে না। এটাই আমাদের ভাবনার ধরন। আমাদের চরিত্র।

রাতবিরেতে পথে যাওয়া। ছোট পোশাক পরা। চরিত্রের দোষ। অর্থাৎ একজন মহিলার উপরে অমানুষিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিতে এইগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এবং বিশেষ করে কেউ যদি একবার শাসনক্ষমতায় গিয়ে পৌঁছান। কেউ যদি শাসকদলের তল্পি বহন করতে থাকেন। তাহলে তো কথাই নেই। আর যাঁরা শাসনক্ষমতায় গিয়ে পৌঁছাতে চাইছেন, তাঁদের কাছে লাশ আর ধর্ষণ একটা মস্তবড়ো হাতিয়ার। একমাত্র তাঁরাই যতদিন শাসনক্ষমতার বাইরে পড়ে থাকেন, ততদিন এইগুলির কোনটিকেই ধর্ষণের কারণ বলে স্বীকার করেন না। কিন্তু মুশকিল হয়, সাধারণ মানুষও যখন এই কারণগুলিকেই প্রাধান্য দিতে থাকেন। ধর্ষককাম চরিত্রগুলির তখনই পৌষমাস। একবার যখন আমরা ধরেই নেব, একা একা পথে গেলে যে কোন মেয়ের যে’কোন সময়ে কপাল পুড়তে পারে। তখনই আসলে আমরা ধর্ষণের একটা সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে ফেলবো। ফেলছি তো বটেই। সমস্ত দায়টাই আমারা চাপিয়ে দিচ্ছি কিন্তু মেয়েদের উপরেই। তারা যেন একা একা বাইরে না যান। রাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। তাঁরা যেন ছোট ছোট পোশাক না পরেন। এবং অবশ্যই তাঁরা যেন চরিত্র দোষ থেকে মুক্ত থাকেন।

এদিকে যে ধরনের অমানুষদের হাতে মেয়েদের সম্মান নষ্ট হয়। নির্যাতিত অত্যাচারিত হতে হয়। সেই সকল অমানুষরা নিরাপদে ঘরে বাইরে দিনে রাতে মনের সুখে চলাফেরা করবে। আর হায়নার মতো ওঁৎ পেতে থাকবে। যাঁদের আবার বেশিরভাগই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নাটবল্টু হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে থাকবে আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে। এবং আমরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাদের থেকে ঘরের মেয়েদের নিরাপদে রাখার জন্য যতরকম ভাবে সম্ভব মেয়েদের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করতে থাকবো। মেয়েদেরই কল্যাণ কামনায়। 

পরিস্কার বাংলায় বললে, এটা একটি দ্বিচারিতা। এবং নপুংসকতা। এদিকে আজকে শাসনক্ষমতায় থেকে যাঁরা বিধান দিচ্ছেন, রাতবিরেতে মেয়েরা যেন পথে না থাকেন, তাঁরা কি তাহলে এটা স্বীকার করেই নিতে চাইছেন যে তাঁদের শাসনে আমাদের দেশের পথঘাট ধর্ষকদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে? নিশ্চয় তাই। না হলে দেশে একটা সংবিধান থাকতে, গণ্ডায় গণ্ডায় কড়া কড়া আইন থাকতে, শত শত আদালত থাকতে হাজার হাজার জেল থাকতে, দেশে কোটি কোটি পুলিশ থেকে মিলিটারিসহ অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষীরা থাকতেও কোন ফর্মুলায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশের রাতগুলি ধর্ষকদের জন্য এমন নিরাপদ এবং আনন্দের হয়ে ওঠে? শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকারের প্রাথমিক কাজ কি? জনসাধারণের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সব ধরনের নিরাপত্তা। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সহ জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এবং নিরাপত্তার এই প্রশ্নে অতি আবশ্যই নারী এবং শিশুর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাই সকলের আগে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে শাসকদলের নেতামন্ত্রীরাই যদি রাতে মেয়েদের জন্য পথঘাট নিরাপদ নয় বলে স্বীকার করেই নেন, তাহলে ধর্ষকদের আর দোষ কোথায়? এতো এক কথায় ধর্ষকদের ধর্ষণ কামনাকেই মেনে নেওয়া। যে, রাত হলে ধর্ষকরা তাদের কাজ করবে না তো‌ কে করবে?


শ্রীশুভ্র / ধর্ষণের লাইসেন্স শ্রীশুভ্র / ধর্ষণের লাইসেন্স  Reviewed by শব্দের মিছিল on অক্টোবর ১৩, ২০২৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.