গ্লাসহাউস ও বৃষ্টিদিন
রাহুল ঘোষ
এই যে একটু অসতর্ক হলেই সমস্ত অক্ষর জুড়ে কমলিনী নেমে আসে, এর মধ্যে নির্ঘাত লুকোচুরি ছিঁড়ে ফেলার দমিত বাসনা আছে। অথচ তার অদম্য হয়ে ওঠা ঈপ্সিত ছিল। অতএব অক্ষরের কৃষিকাজ শুরু হলেই সে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং কোথাও স্বাধীনভাবে কিছুটা আন্দোলিত হওয়ার পরে ফিরে আসে নতমুখে। যাপনের আবেগ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবেই ভাসতে থাকে হাওয়ায়, কাটা ঘুড়ির মতো। অথবা জমতে থাকে বুকের ভিতর, একদিন পাথর হবে বলে। তখন মনে থাকে না, যে-পাথর বুকের ভিতর বসত করে, অশক্ত হওয়াই তার নিয়তি। কারণ, হৃদয় ছোঁয়া যদি কোনো ভুল হয়, সেই প্রগাঢ় ভুল করেছে সে। অতএব আবার একদিন বিস্ফোরিত হয়ে ওঠার অপেক্ষা। মাঝেমাঝে আবেগের লাভাস্রোত এইভাবে গড়িয়ে না-এলে, আকাঙ্ক্ষার ডাকনাম ধরে আর কীভাবে ডাকবে বলো!
এমনিতে স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপে বহুবার উঠে এসেছে আমাদের একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখার অভিলাষ। উঠে এসেছে আপাত-আড়ালের অনিবার্যতাও। এই 'আপাত' শব্দটির সঙ্গে 'আপাতত' মিলেজুলে গেলে, যাবতীয় অত্যুৎসাহী বিভ্রান্তির জন্ম হয়। এই যে প্রাপ্তি, বিচ্ছেদ এবং ফিরে পাওয়ার জীবনরেখা; তাকে নিয়ে যাবতীয় উচ্ছ্বাস চেপে রাখা ভালো তাই। তবুও রঙিন আলো থেকে ছায়ার দিকে যাওয়ার মুহূর্তরা যেভাবে সজীব হয়ে ওঠে শ্বাসের বিনিময়ে, তাদের কীভাবে উপেক্ষা করা যায়! কমলিনীর মধ্যে ডুব দেওয়ার প্রতিটি মাহেন্দ্রক্ষণও অনিবার্যভাবেই লিপিবদ্ধ হতে চায়! কেন-না, এরপরেই তো এসে জমা হবে এক-আকাশ মেঘলা ও মনকেমন। মেনে নিতে হবে ভূগোলের দূরত্ব ও প্রাসঙ্গিক বিরহের দিনযাপন। সুখ-দুঃখের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই দিনেরও তাই নিজস্ব রক্তক্ষরণ আছে। সময়ের এগিয়ে চলার গল্পে অজান্তেই সে জীবনসন্ধ্যার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
যদিও শ্রাবণ মানেই বৃষ্টিদিন নয়, তবুও প্রতিটি শ্রাবণ ভাসিয়ে দিল সব, এমন ভাবতে অনেকসময় ভালো লাগে। এতে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। ঠিক যেমন, জৈষ্ঠ্যের দাবদাহ আঁকা জন্মদাগ বুকে নিয়ে আমি হেমন্তকন্যার শিশির-স্নিগ্ধতায় ভিজে যেতে চাই বারবার। অথচ এই 'বারবার' যে দুরূহ একটি ব্যাপার, তা কি একেবারেই জানি না? তেমনই, শ্রাবণ নির্বিচারে ভাসালে কোথাও যে নেমে আসতে পারে শ্মশানের স্তব্ধতা, সে-কথা ভেসে যাওয়ার উপক্রম হলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের বাইরে থেকে যাওয়া বিষয়সমূহের ওজন যে চোখের বাইরে থেকে গেলেই কমে যায় না, এইসব বুঝে ফেলার দক্ষতা রপ্ত করতে-করতে অনেকটা বেলা বয়ে যায়। মাথার মধ্যে আরও-আরও বাড়তে থাকে রুপোলি ঝিলিক।
নিজের সঙ্গে তাই খুব ভঙ্গুর একটা বোঝাপড়া করে রাখতে হচ্ছে প্রতিদিন। ভঙ্গুর, কেন-না, আবেগের গ্লাসহাউস মাঝেমাঝেই সেই বোঝাপড়াকে বোকা বানিয়ে মজা পায়। চুরচুর করে ভেঙে পড়ার সেইসব কাচ-শব্দ নিয়ে অনেক শব্দময় অথবা নিঃশব্দ কবিতা লেখা যেতে পারে। কাগজে-কলমে অথবা কিপ্যাডে-আঙুলে আর তেমন লিখি না মানেই তো এই নয় যে, তাদের আমি মনের পাতাতেও লিখে রাখছি না! আপাতত মনের ভিতরে প্রতিটি মেঘের বুকে বৃষ্টি জমছে অনেক। ছবির মতো দিগন্তরেখার দিকে যে-পথ মিশে গিয়েছে, তার কিনারায় বসে কমলিনীকে বারবার নদী হয়ে এসে ডেকে নিতে বলা, আরও বেশি জরুরি হচ্ছে রোজ। সেই আগমনী আবার নিকটবর্তী হলেই, যাবতীয় বৃষ্টিফোঁটা নিয়ে আবারও প্রোথিত হয়ে যাবো তার গভীরে।
রাহুল ঘোষ / গ্লাসহাউস ও বৃষ্টিদিন
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
আগস্ট ০৭, ২০২৫
Rating:
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
আগস্ট ০৭, ২০২৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন