কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে, রোগের সঠিক কারণগুলিকেই আইডেন্টিফাই করা? মূল প্রশ্ন সেটাই। আমরা যাঁরা সর্বদা যে যাঁর গোষ্ঠীকেন্দ্রিক মানসিকতায় অপর কোন এক বা একাধিক গোষ্ঠীকেই সকল খারাপ কিছুর জন্য দায়ী করি। তাঁদের পক্ষে রোগের সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভব!
আর মূল মুশকিলের বিষয়টা ঠিক সেখানেই। কোন বিষয়ে কেউই যদি নিজেদের ভুল এবং ভ্রান্তিগুলিকে দেখতে না পায়। তাহলে রোগের নিরাময় কোনদিনও সম্ভব নয়। আবার আরও একটু এগিয়ে গেলেই আমরা দেখতে পাবো, আমরা বোধহয় কেউই রাজ্যের বর্তমান পরিণতির পিছনে ঠিক কোন কোন অবস্থা বা কার্যকারণ দায়ী, সেই বিষয়গুলি জানার বিষয়ে আদৌ ততটা আগ্রহী নই। যতটা আগ্রহী যেনতেন ভাবে পরস্পরকে দোষারোপ করে একদলকে শাসন ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে আর এক দলের হাতে রাজ্যের শাসনভার তুলে দিতে। ২০১১ সালে ঠিক যে ভুলটি আমরা করেছিলাম। আমরা কিন্তু আসলেই আবারো ঠিক সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করার জন্যে ভোটার লাইনের দিকে এক পা এগিয়ে রেখেছি। এগিয়ে রেখেছি তার একটাই কারণ, এটাই আমাদের স্বভাব। এই সেই স্বভাব, যে স্বভাবটুকু গড়ে উঠেছে আমাদের আবহমানকালের বঙ্গ সংস্কৃতির হাত ধরেই। অর্থাৎ আবহমানকালের সংস্কৃতির পথেই আমরা আজ ঠিক এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি।
ফলে আমরা একদলকে ফেলে আরও এক দলের হাতে নিজেদের ভুত ভবিষ্যত বর্তমান তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত বোধ করি। কখন করি? না, যখন আমরা এক দলের কাছ থেকে বিশেষ কোন অনৈতিক সুবিধে বাগিয়ে নিতে পারার ব্যবস্থা করতে পারি না। কিংবা চোখের সামনে লাগাতার অনৈতিক কাজকর্ম চলতে দেখতে দেখতে একসময় বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠি। আবার সেই আমরাই যদি কোন ভাবে বরাৎ জোরে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির বিষয়গুলিকে অনৈতিক পথে দিব্বি হাসিল করে নিতে পারি, তাহলে মসনদে যত বড়ো দুঃশাসনই থাকুক না কেন, আমরা দুই হাত তুলে শাসকের জয়গানে নৃত্য করতে থাকি। এটাই বাঙালির স্বভাব। তার জন্য কাঁটাতারের কোন পারে কে থাকে, সেটা ম্যাটার করে না। তার জন্য কে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী মানে আর কে নিরাকার সর্বশক্তিমানের আরাধনা করে, সেটাও কোন তফাৎ সূচিত করে না। কে পুঁজিবাদী সুবিধের পৃষ্ঠপোষক আর কে সাম্যবাদের ব্যানারের তলায় নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত, সেটিও বিশেষ কোন তফাৎ গড়ে দেয় না। এটাই আবহমান কালের বাঙালি জাতির স্বরূপ।
মাত্র একটা ফোন কলে শাসকদলের কোন ছোট বড়ো সেজো মেজো চাঁইকে ধরে যেকোন অনৈতিক সুযোগ এবং সুবিধে বাগিয়ে নিতে পারলে বাঙালির মতো আহ্লাদে আটখানা হতে আর কোন জাতিকে দেখা যায় কিনা, জানি না। তবে এই বিষয়ে ডান বাম, আস্তিক নাস্তিক, ভদ্র অভদ্র, শিক্ষিত নিরক্ষর, সকলেই সমান। প্রত্যেকেই তখন দুঃশাসনের পুজারি। আর আমাদের বাগিয়ে নিতে থাকা অবৈধ অনৈতিক কাজকর্মগুলি যাঁদেরকে সর্বস্বান্ত করে পথে বসিয়ে দেয়। মুশকিল হয় তাঁদের। তাঁরা না পারে বিচারের বাণীকে নিভৃতে কাঁদা থেকে রক্ষা করতে। না পারে দুঃশাসনদেরকে মসনদ থেকে টেনে নামাতে। এই যেমন আর জি করের সেই নিহত লেডি ডাক্তারের পিতামাতা। হাহাকার ছাড়া যাঁদের আর কোন পুঁজি নেই আজ আর। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সেই নিঃস্ব পুঁজির মালিক যাঁরা, যদিও তাঁরাই সংখ্যাধিক। তবু তাঁরা কোনতন্ত্রেই কোনদিন জোট বাঁধতে পারে না। নাহলে হাল আমলে সেই সারদায় অর্থ লগ্নী করা সর্বাহারাদেরও একটা জোট গঠন হয়ে যেতে পারতো। জোট হতে পারতো শিক্ষকনিয়োগ দুর্নীতির শিকার হওয়া বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের। এখনো জোট হতে পারতো ন্যায্য পথে শিক্ষাদপ্তরে নিযুক্ত হয়েও চাকরিহারাদের। তাও হয়নি কিন্তু। তা হয় না। কারণ মাঝখানের জায়গাগুলি জুড়ে থাকে কিছু না কিছু প্রাপ্তিযোগের ভিখারিরা। তাদেরকে ঢাল করেই শাসকের ঢাক ও ঢোলের বাদ্যে চারিদিক অন্ধকার ঘুমে আচ্ছন্ন রয়ে যায়। সেখানেই শাসকের প্রাণভোমরা।
সেই প্রাণভোমরারও একদিন আয়ু শেষ হয়। রাজনীতির নিয়মেই। কিন্তু গোড়াতেই যেখানে গলদ। সেখানে অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে কি করে? কথায় বল যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। শাসকের মুখোশ পাল্টিয়ে যায়। মুখ পাল্টায় না। রাজনীতির ব্যানার পাল্টিয়ে যায়। ভাষ্য পাল্টায় না। নেতানেত্রীদের নাম বদলিয়ে যায়। চরিত্রের কোন বদল হয় না। ফলে রাজনীতির ণত্ব এবং ষত্ব সেই এক জায়গাতেই স্থিতিশীল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জনগণ যে তিমিরে ছিল। সেই তিমিরেই রয়ে যায়। শাসক আসে শাসক যায়। অবস্থা একই থাকে। হ্যাঁ রঙটুকুর বদল তো করতেই হয়। লালের বদলে এখন যা নীলসাদা। একদিন তাও বদলিয়ে যাবে। আমরা সেই বদলের দিকেই তাকিয়ে থাকি। কারণ আমরা কোনভাবেই নিজেদেরকে বদলাতে চাই না। সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো রোগ।
এই রোগেরই আরও একটি লক্ষ্মণ আমাদের ভিতরে দেখা যায়। বাঙালি একান্তই প্রভুভক্ত জাতি। আমরা সর্বদা কোন না কোন প্রভুর আশায় থাকি। আমাদের কামনা একটাই। এমন একজন প্রভু। যিনি শুধু আমাদেরই মঙ্গল সাধন করবেন। আমাদের কামনা বসনা চাহিদা মিটিয়ে যাবেন। আমাদের কষ্টের বোঝা লাঘব করবেন। এই প্রভুভক্তি বাঙালির ডিএনএর একেবারে গোড়ার কথা। বাঙালির ধর্মেও যা। বাঙালির রাজনীতিতেও তাই। সে সর্বদাই একজন প্রভুর আওতায় থাকতে চায়। যে প্রভু সর্বশক্তি দিয়ে শুধু তাঁর ভক্তকেই রক্ষা করবেন। তিনি ধর্মগুরুই হোন, আর ঈশ্বর। তিনি পাড়ার কাউন্সিলরই হোন আর শাসকদলের প্রধান। বাঙালি একবার প্রভুর পায়ে পড়ার সুযোগ পেলেই হলো। আর সহজে ছাড়তে রাজি নয়। একদিন যখন বর্গীর আক্রমণে দিশেহারা বাঙালি মারাঠা দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে সাগরপারের ব্রিটিশকেই প্রভুর আসনে বসিয়ে ছিল, তখনো সেই বাঙালি সহজে সেই প্রভুকে ছাড়তে চায়নি। দেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছে। দেশ ভাগও হয়ে গিয়েছে। বাঙালি নিজেও দ্বিখণ্ডিত। এখনো বাঙালি মাত্রেই দেখা যাবে বুকে লণ্ডন নিউইয়র্ক বহন করছে। এটাই বাঙালিত্ব। যে কারণে দুঃখ করে কবি বলেছিলেন। ‘রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি’। বাঙালির রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিসীমাও ঐ রকম প্রভুভক্তিতেই স্থাণু। সেই প্রভুভক্তিতেই একদিন বাঙালির নয়নমণি ছিল একদিকে নেহেরু, অন্যদিকে জিন্নাহ। যে প্রভুভক্তিতে বাঙালির টিকি বাঁধা একদিকে দিল্লীতে। অন্যদিকে ইসলামাবাদে। ইসলামাবদের থেকে যে টিকি একদিন মুক্ত করতে লক্ষলক্ষ বাঙালির প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছিল, আবারো সেই টিকি যথাস্থানে ফেরাতে বাঙালির একটা অংশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর বাকি অংশের তো কথাই নেই। টিকি এখন শুধুই দিল্লীতেও নয়। নাগপুরেও বাঁধার পর্ব চলছে। ফলে এই বাংলার রাজনীতির মানচিত্রে এখন সেইভাবেই রিডিজাইনের প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। মজার কথা সেই কাজে শাসকদল আর প্রধান বিরোধীদল হাতে হাতে পরস্পর সহযোগী।
বাঙালির প্রভুভক্তিজনিত এই রোগের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সবচেয়ে বড়ো ভুমিকা কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। নির্ধনদের ভুমিকা শুধু অন্ধের মতো লম্ফঝম্ফতেই সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ প্রভুর পতাকা বহনের মহান দায়িত্ব তাঁদেরই হাতে। তাতেই তাঁরা আহ্লাদে আটখানা। আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রভুভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে নির্ধনদের মগজধোলাই করে তাতে প্রভুভক্তির বীজ বপনে দিনে দিনে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠাকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সাফল্য বলে মনে করতেই অভ্যস্থ। আমরা তাঁদেরকেই সসম্মানে সমাজের বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য করে থাকি। যাঁরা আমাদের চোখে অন্ধত্বের রকমারি ঠুলি ঠেসে ঠেসে প্রভুভক্তির প্রমাণ দিতে থাকেন। বাঙালির এই প্রভুভক্তির সবটুকু ক্ষীর কিন্তু ঐ উচ্চবিত্তরাই মেরে দেয়। ওটাই ওদের কাজ। ফলে দেখা যাচ্ছে, বাঙালরি রাজনীতি এবং সামাজিক অবস্থান মূলত তিনটি শ্রেণীর বিন্যাসেই বিন্যস্ত। নির্ধন থেকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত। এই শ্রেণী বিন্যাসকে অস্বীকার করে আমাদের রাজনৈতিক পরিণতিগুলি অনুধাবন, এক কথায় অসম্ভব। আবহমানকালের যে সংস্কৃতির বিকাশের ধারায় আমাদের আজকের অবস্থান, বাঙালির এই শ্রেণী বিন্যাসের ধরণটিও সেই একই আবহমানকালের সংস্কৃতির বিকাশের ধারার মূল কেন্দ্র। বাংলার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির বিকাশের এই ধারার বাইরে কিন্তু কিছুই নয়। কোন দল নয়। কোন রাজনীতি নয়। ফলে আমাদের সংস্কৃতির এই বিকাশের ধারাকে সঠিক অর্থে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে না পারলে শুধুমাত্র শাসকদল পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে কোন সমস্যার সমাধানও যেমন সম্ভব নয়। সম্ভব নয় প্রকৃত পরিবর্তন সংঘটিত করাও। না, দুঃখের বিষয় এই সত্য আমরা ২০১১ তেও অনুধাবন করতে পারিনি। আজও পারছি না। ফলে কোলাহলই হচ্ছে। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়। কবির’ই কথায় আমরা বাঙালিই রয়ে গিয়েছি। মানুষ হয়ে উঠিনি।
©শ্রীশুভ্র
Reviewed by শব্দের মিছিল
on
আগস্ট ২১, ২০২৫
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন