সুশান্ত কুমার রায় / বাংটু ঘটকের ঘটকালী

সুশান্ত কুমার রায়

সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। এক বন্ধুর নাম ডলি আর অন্য বন্ধুটির নাম শেফালী। তাঁদের দুজনের কেউ আজ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। দু’জনেই ছিলো খুবই অন্তরঙ্গ বন্ধু। কারণ তাঁদের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা বলা যায় একসাথে একই পরিবেশে একই গ্রামের পাশাপাশি বাড়িতেই। ডলি নামক এই ছাগলের বাচ্চাটি বিশেষ ভাবে ঋণী শেফালী নামের গরুর বাছুরটি ও তাঁর মায়ের কাছে। কারণ ছোটবেলায় মায়ের পেট থেকে প্রসবের সময় যখন ডলির মা মারা যায় তখন ডলিকে শেফালীর মায়ের দুধ খেয়ে বেঁচে থেকে বড় হতে হয়। এতে শেফালীর দুধের ভাগের পরিমাণটা একটু কমলেও তাঁদের দুজনের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন বা সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে পাকাপোক্ত হতে থাকে দিনের পর দিন। ডলির প্রতি বাড়ির সকলের মায়া মমতা বেড়ে যায় ডলি এতিম হয়ে যাওয়ার কারণে। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হলো গিট্টুর। কারণ সে ছোটবেলা থেকে ডলির মাকে কোলে পিঠে করে ঘাস—জল খাইয়ে বড় করেছে। আর তাই যেদিন ডলির মা মারা গেলো সেদিন গিট্টু খুবই চিন্তিত ও বিমূর্ষ হয়ে পড়লো। এমনকি খাওয়া দাওয়ার কথা পর্যন্ত গিট্টু বেমালুম ভুলে গেলো। এতো বড় ক্ষতি গিট্টু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।


একদিকে ডলির মায়ের সাথে ডলির দুই ভাই বোনের মৃত্যু অন্যদিকে ডলিকে বড় করার চিন্তার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির দিকটিও তাঁর মাথায় এসে ভর করলো। কারণ ডলির মায়ের কাছে তাঁর চাওয়া পাওয়ার পাল্লাটি একটু ভারি ছিলো। ফলে তা গিট্টু কোনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। গত আটটি বছরে ডলির মা ডলির মতো চব্বিশটি সুস্থ সবল ছাগলের বাচ্চা গিট্টুকে উপহার দিয়েছে যা অন্য কোনো ছাগলই গিট্টুকে উপহার দিতে পারেনি। গিট্টুর ছাগল লালন পালন একদিকে যেমন একটা নেশা তেমনি করে অনেকটা পেশা হয়ে দাড়িয়েছে বলা যায়। প্রতি বছরই ঈদের সময় গিট্টু তাঁর লালিত পালিত ছাগলের দুএকটা বিক্রি করে থাকে। ছাগল বিক্রি করে অভাব অনটনের সংসারে যদিও কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেনি। তবে দুপয়সা আয় ভালই হচ্ছিল ছাগল বিক্রি করে।

আর ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে তাঁর দুর্দিনের অভাব সংসারে কোনো রকম জীবিকা নিবার্হের একটা উপায় অন্তত খুঁজে পেয়েছেন। গিট্টুর ছাগলের মৃত্যুতে পাশের বাড়ির অনেকেই দেখতে এসেছেন। তাঁরাও গিট্টুর মা ছাগলটির মৃত্যুতে আফসোস করছেন এবং গিট্টুকে সান্তনা দিচ্ছেন। পাশের বাড়ির পরীর মার দিলটা অন্য আর দশ পাঁচটা মহিলার চেয়ে খুবই নরম। এই মহিলাও গিট্টুর ছাগলের মৃত্যুর কথা নরেশের কাছে শুনে তড়িঘড়ি করে এসেছেন।


এসে দেখেন পাড়ার আরও অনেক লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। মিয়াজী পাড়ার সোলায়মান কাজীও কি যেনো একটা কাজে এ পাড়ায় এসেছিলেন। তিনিও গিট্টুর বাড়ির কাছে লোকের ভীড় ও শোরগোল শুনে গিট্টুর বাড়ির দিকে রউনা দিলেন। মনে মনে ভাবতে থাকলেন হঠাৎ করে গিট্টুর বাড়িতে আবার কি ঘটলো ? তাঁর মেয়ের কি বিয়ের কথাবার্তার জন্য কোনো লোক এসেছে ? না ! তার মেয়ে তো এখনো অনেক ছোট। স্কুলে লেখাপড়া করছে। নাকি গিট্টুর বউয়ের কোনো অসুখ হয়েছে ? এই বলতে বলতে সোলায়মান কাজী গিট্টুর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন তেমন গুরুতর কিছু নয়। কিন্তু যাঁর সহায় সম্বল বলতে ভিটে মাটি ছাড়া কিছুই নেই তাঁর কাছে এটি অনেক বড় কষ্টের।


মৃণালিনী দেবী বৃদ্ধা। বয়স প্রায় নব্বই ছোঁ ছোঁ। বয়সের ভারে তাঁর গায়ের চামড়া জড়োসড়ো হয়ে এসেছে। চোঁখে তেমন একটা ভালো দেখে না। বাবা গিট্টু কি আর করবি ? কপালের লিখন না যায় খন্ডন এই বলে গিট্টুর গায়ে হাত বুলিয়ে পরীর মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো— ও পরীর মাও একনা করি তোমার গাইয়ের দুধ দেইস গো। বাকী বাচ্চাটাক খোয়া মানুষ কইরবে। ও জেঠাই তোমরা যখন কইলেন দেইম একনা করি দুধ। তাতে কি মুই মরিম ? মোর গাইয়ের তো দুই তিন সের করি দুধ হয়। উয়্যার থাকি দেইম মুই। জয়কালী নামের গিট্টুর এই পাড়াটি এক সময় হিন্দু প্রধান পাড়া হিসাবে পরিচিত ছিলো। নদীর পাড়ের মানুষ নদীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হিন্দুর পাশাপাশি অনেক মুসলমানও সহায় সম্পত্তি ভিটে মাটি নদীতে হারিয়ে কেউবা নদী গ্রাস করার আগেই বেচাবিক্রি করে এ হিন্দু পাড়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সহায় সম্বলহীন তাদেরই একজন গিট্টু। এ পাড়ায় তাঁর বসতি গড়ার দেড় যুগ হতে চলেছে। অনেকের দেখাদেখি অনেক মুসলমান এখন এ পাড়ায়। হিন্দু মুসলমান একসাথে তাঁরা মিলেমিশে বসবাস করছে। শীতের সকাল। মিষ্টি মিষ্টি রোদ। ডলি ও শেফালী সকাল বেলা গোয়াল ঘর থেকে তাদের মায়ের সাথে বের হয়েছে। তারা দুজন লাফালাফি ঝাপাঝাপিতে আপন খেলায় মেতে উঠেছে। কখনো এ বাড়ির উঠোন থেকে পাশের বাড়ির উঠোন আবার এ রাস্তার মাথা থেকে ও রাস্তার মাথা পর্যন্ত দৌঁড়াদৌড়ি ছুটাছুটি। দুজন যেন অলিম্পিক দৌড় প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছে। তা নাহলে ডলি আগে তিড়িং বিড়িং লাফ ও দৌড় আবার পরক্ষণেই শেফালীর ঘোড়াদৌড়। গিট্টু ঘরের পাশে উঠোনের রোদেলা জায়গায় বসে তাদের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করছে। কিন্তু মাথায় ঘুরঘুর করছে ডলির মায়ের মৃত্যু চিন্তা। কিন্তু কিছুটা শোক কাটিয়ে ওঠার কারণে সেই চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে ভর করলো অন্য আর এক চিন্তা। না ! বসে থাকলে চলবে না । কাজের সন্ধান করতে হবে তাঁকে। আর মনে মনে ভাবে আল্লাহ যে ক্যা এই জগৎ সংসার তৈয়্যার কইরছে। খালি খাই খাই। দিন ফুরালে রাত আর রাত পার হলেই ভোর।আর ভোর হলেই পেটের জ্বালা। আর পেটের ক্ষুধায় দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি। আল্লাহ যদি পেটোত ব্যাটারি নাগার ব্যবস্থা করি দিলে হয় মুই বাজারোত যায়া মোবাইলের মতো ব্যাটারি চার্জ করি আননুং হয়। একবার পেটের জ্বালা আর একবার বউ বাচ্চার জ্বালা। তেসটেন কোনটেয়। মোর মনে হয় ইয়্যার থাকি জঙ্গলোত যায়্যা যদি থাকপের পানুং হয় ? কিন্তু মায়ায় বান্ধা। এত্ত কাউ ক্যাচাল করি বউ গাইল পাড়ে তাও ক্যাবান মোক বাড়ি ছাড়ি যাবার মনায় না। এই কথা মাথা গুজে চিন্তা করতে করতে নিঃশব্দে ও পাড়ার হযরত এসে হাজির। 

কি রে গিট্টু কাজ করবু ? হঠাৎ চমকিয়ে ওঠে। দেওয়ানি ওই কতাটায় মুই ভাইবব্যার নারছং। আজ কায়ো তো কাজত ডাক দিলেনা। তা তোমরা যখন কইলেন তাড়াতাড়ি পন্তা খ্যায়া যাং। যাও তোমরা। হযরত দলনেতা। মালিকের সাথে কাজ ঠিক করার পর সে তাঁর তিন ছেলেসহ আরও কয়েক জনকে সাথে নিয়ে কাজের দল গঠন করেছে। যখন যেখানে কাজের ডাক পায় তখন সেখানে যায় মাঠে কাজ করতে। হযরতের মেয়ে নাই। তাই চিন্তাও কম। তিন ছেলে উপার্জনে সক্ষম হওয়ায় সে আজ মোটামুটি স্বচ্ছল। কিন্তু গিট্টুর তো চিন্তা অতি আসন্ন। একদিকে নদী ভাঙ্গা সংসার আর অন্যদিকে চার শতক ভিটেমাটি ছাড়া আবাদি জমি না থাকায় মেয়ে বড় হওয়ায় মেয়ের বিয়ের চিন্তা। আর কাজ প্রতিদিন চলুক বা না চলুক চুলা তো জ্বালাতেই হয়। গিট্টুর মেয়ে সুবর্ণা খুব সুন্দরী। এখন সে ক্লাস নাইনে। মেয়ে মানুষ অল্পেই বেড়ে ওঠে কলাগাছের মতো। সুবর্ণাও তাঁর ব্যাতিক্রম নয়। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলে যেতে হয়। চেয়ারম্যানের ছেলে হাবিলের কুনজর পড়েছে অল্প বয়সী সুন্দরী সুবর্ণার উপর। ছ—ছবার এসএসি ফেল করা হাবিল লেখাপড়া বাদ দিয়ে তার সঙ্গী সহচরদের নিয়ে মদ গাঁজা ভাং খেয়ে সারাদিন বাপ দাদার কটকটি মার্কা মটর সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নোংরামিতে সে তাঁর বাবা চেয়ারম্যান মবিলের চেয়ে তুখোড়। নারী ঘটিত অকাম—কুকামের কারণে এলাকায় মবিল চেয়ারম্যান পাঁঠা হিসেবে পরিচিত।


আগের দুবউয়ের একজন ডিভোর্স দিয়ে শ্বশুর বাড়িতে আর অন্যজন পরপারে। চেয়ারম্যান মবিলের নামকরণ করেছে অত্র এলাকার জনগণ। সরকারি রিলিফের গম খাওয়াতে ওস্তাদ হওয়ায় অনেকে প্যাটলা মবিল হিসাবেও ডাকেন। সরকারি মাল আত্মসাতের অভিযোগে বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন। রাত্রে খাওয়া দাওয়া শেষে পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত দেহ নিয়ে কেবল মাত্র গিট্টু বিছানায় সটান হয়েছে। আর ওই মুহুর্তেই বাংটু ঘটক তাঁর বাড়িতে গিয়ে গিট্টুর বউয়ের উদ্দেশ্যে বললো— ও ভাবী জান দেওয়ানী কি বাড়িতে আছে গো ? সুবর্ণার মা গিট্টু বউ সখিনা বাংটু ঘটককে উদ্দেশ্যে করে বলে কাঁয় ভাই জান ? ভাবী মুই বাংটু ঘটক। বুকটা ধুঁকপুঁক করে ওঠে সখিনার বাংটু ঘটককে দেখে। কারণ বাংটু ঘটক বিয়ের কথাবার্তা ছাড়া অন্য কোন কারণে সহজে কারো কাছে যায় না। আর দুর্মুখা ঘটক কতজনের বিয়ের ঘটকালি করে কত সংসার যে নষ্ট করে দিয়েছে তার ইয়ত্বা নেই।


তোষামোদিতেও সে সাকার্সের দোহারকেও হার মানায়। এইতো গেলো বছরের ঘটনা । কি কান্ডটাই না ঘটালো। বাংটু ঘটক গ্রামের ন্যাংলা মামার মেয়ের হ্যাংলা বর এনে দিয়ে কি বেইজ্জতিই না হলো। শেষ পর্যন্ত জুতার বারি খেতে হলো পাড়ার লোকজনের মাঝে। চৌধুরীর বেটার বউ এনে দিতে গিয়েও ছেলে ও মেয়ে উভয় পক্ষ থেকে ঘটকালির টাকা খেতে গিয়ে ধরা পড়লে চৌধুরী গ্রামের লোকজনকে ডেকে নিয়ে সালিস বসায়। শেষে পা ধরে মাফ নেওয়াতে রক্ষা পায় বাংটু ঘটক। তবে বাংটু ঘটক এতো কিছুর পরও বহাল তবিয়তে এখনো ঘটকালি করে যাচ্ছে মবিল চেয়ারম্যানের কারণে। মবিল চেয়ারম্যানের কম বয়সী সুন্দরী বউ আনার ক্ষেত্রে বড় অবদান এই বাংটু ঘটকের। তবে আর যাই হোক পূর্বের দুই বউয়ের কথা গোপন করে ফন্দি ফিকির করে বিয়ে করার কয়েক মাসের মধ্যে যখন নতুন বউ জানতে পারে চেয়ারম্যানের আরও এক বউ এখনও জীবিত আছে আর সেদিনই এ ঘটনা জানার পর মবিল চেয়ারম্যানকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন বউ বাপের বাড়ি চলে যায়। তবে অল্প বয়সী ললনা কামরুন্নাহারকে যে কদিন মবিল চেয়ারম্যান বিছানায় পেয়েছে তাতেই চেয়ারম্যান তাঁর খায়েস মিটিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করেছে। তাই বাংটুর আজ এতো স্পর্ধা। বাংটু এ পযর্ন্ত যত বিয়ের ঘটকালি করেছে তাঁর বেশির ভাগের সংসার টিকেছে বড় জোর বছর খানেক। নেহায়েত দুএকটা ছাড়া বেশির ভাগেরই দাম্পত্য জীবন হয়েছে জোড়াতালি নয় দুর্বিসহ বিষময়।


তাই বাংটু বাড়িতে আসাতে সখিনা নিজের মেয়ের ব্যাপারে সন্ধিহান হয়ে ভয়ে আতকে উঠলো। সখিনা গিট্টুকে ডাক দেয়ার আগেই বাংটুর কথা শুনে অনেকটা অস্বস্তি ভাব নিয়ে বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বের হলো গিট্টু। গিট্টু জানে শালা বাংটু ঘটক কি যে আগুন লাগাতে তাঁর বাড়িতে এসেছে। সখিনা অনেকটা তাঁর মনের অবাধ্যতার মধ্যেও একটা পিড়ে এনে বসতে দিলেন বাংটু ঘটককে। বাংটু ঘটক গিট্টুকে উদ্দেশ্যে করে বললো— দেওয়ানী কেমন আছেন ? বাংটু ঘটক গিট্টুর বউ সখিনাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো— ভাবীজান তোমার গুল্যাক একনা কতা কবার চাং— তোমার মাইয়্যা কোনার ব্যাপারে । দেওয়ানীও তো বাড়িত আছে। মেয়ে ছাওয়াল মানুষ। যতো তাড়াতাড়ি ব্যাচে খাওয়া যায় ততই ভালা। যুগ জামানা খারাপ হইয়্যা গেইছে— কখন কার নজর লাগে। এই কথা বললে— গিট্টু মনে মনে ভাবে শালা বাংটু এই জন্যে মোর বাড়িত আসছে। একবার চিন্তা করে বাংটুকে কিছু উচিত কথা বলবে কিনা পরক্ষণে ভাবে— না বাংটুকে উচিত কথা বললে সমস্যা হতে পারে। কারণ বাংটু এখন মবিল চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় আছে। কোনো কিছু বললে মবিল চেয়ারম্যানকে বলে দিবে। আর বাংটু তো মবিল চেয়ারম্যানের ছেলে হাবিলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। তখন গিট্টু নম্রতার সুরে বলে বাংটুকে বলে— ভাইজান তোমরা তো জানেন মোর মাইয়্যা কোনা কেবল নাইনোত পড়ে। দেওয়ানী তোর মাইয়্যা কোনার চেহারা সুরত ভালো দেখিয়া তো মুই তোমার কাছে আচছং। আজকাল মাইয়্যা মানুষকে নেকাপড়া শিখাইয়া কোনো লাভ নাই। ক্যা ভাবী— গান শোনেন নাই তোমরা— “কি আর হইবে কান্দিয়া / কবুল কইরা স্বামীর ঘরে যাইবে চলিয়া”...। তোমার মাইয়্যাক পরের বাড়িত যায়য়্যা ভাত আন্ধা নাইগবে। নেকাপড়া শিখিয়া তোমার মাইয়্যা কি তোমাক বিল্ডিং বানেয়া দিবে। বেটি ছাওয়া মানুষ ভাতারের বাড়ি গেইলেই সইগ শেষ। বেটা ছাওয়া মানুষ হলে না হয় একটা কতা আছিল। তা দেওয়ানী যদি মনে কিছু না করেন মুই একনা কতা কবার চাং । তখন সখিনা বলে ওঠে— মোর বেটিক এলায় বিয়ে দিবের নং ভাই ।


কারণ সখিনা ভালো করে বাংটুকে জানে। বাংটু কত মানইষের যে বেটির সংসার ভাইংছে আর ঘটনাকালী করিয়া বেইজ্জতিও হইছে। আর এই দুমুর্খা বাংটু আজ আইসছে মোর বেটির কপালোত আগুন নাগাইবার। ভাবী তোমার বেটি কোনা সুখোত থাইকপে। চেয়ারম্যানোক তো তোমরা চেনেন। আর চেয়ারম্যানের বেটা হাবিল এর বউ যদি সুবর্ণা হয় তাহলে দেওয়ানী তোমার গুল্যার কোনো অভাব থাকইপের নয়। মঙ্গা কি জিনিস তোমরা বুইজবের এ নন। এতো ধনী লোক হয়্যা যে তোমার বেটিক চেয়ারম্যান নিজের বেটার বউ করি নিবের চায়। এইগল্যা কি যারে তারে ভাগ্যোত হয়। দেওয়ানী চিন্তা করেন কি ? এতক্ষণ যদিও গিট্টু চেয়ারম্যানের ভয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো কিন্তু বাংটুর খারাপ মনোভাব ও প্রস্তাবে আর নিজেকে বেধে রাখতে না পেরে বাংটুর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো । বাংটু ভাই তোমার ও তো বাড়িত একটা বোইন আছে। তোমরা তো মাইনষের ঘটকালি অনেক কইরলেন আর নিজের বোইনটাক ওইভাবে বাড়িত রাখিয়া বুড়ি বানেয়া ফেলবার নাইগছেন। তা তোমরা একনা তোমার বোইনের জন্য ঘটকালি করিয়া দেখেন না ক্যা, চেয়ারম্যান কি কয় ? এই কতা বললে বাংটু থোতোমোতো খায়।


নিজের ঘটকালি ও বোনের বিয়ের লজ্জার কথা বাংটুর শরীরে সুইয়ের মতো বেধে যায়। বাংটুর মাথা খারাপ হইয়্যা যায়। এক পযার্য়ে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। সুবর্ণা ঘুমিয়ে থাকলেও উচ্চস্বরে কথা বলা এবং হই হট্টগোলের এক পযার্য়ে জেগে যায়। মুই যদি বাংটু ঘটক হং তাহলে দেখি ছাড়িম— তুই কোটেয় তোর বেটিক বিয়ে দেইস।

সখিনাও উত্তেজিত হয়ে বলাবলি শুরু করে তোমরা ভাগো মোর বাড়িত থাকি। নিজের গাবুর বোইনোক যায়্যা বিয়ে দেও। মোর এতো সেতরা বেটি হয় নাই যে যাকে তাকে ভাতার ধইরবে। বেটি আছে মোর ঘরোত থাইক। কোটেয় মোর
বেটির দিন গেইছে যে এল্যায় বিয়ে দেওয়া নাইগবে। ঝগড়া ঝাটি ও বাগবিতন্ডার এক পর্যায়ে আশে পাশের বাড়ির অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায় । তাঁরা গন্ডগোল শুনে অনেকে গিট্টুর বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। ততক্ষণে বাংটু নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতাকে পাশ কাটিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সটকে পড়ে। বাংটু জানে পাড়ার লোকজন আসলে আমার কোনো মান সম্মান থাকবে না। আর অনেকেই বাংটুর উপর চড়াও হয়ে আছে। একমাত্র মবিল চেয়ারম্যানের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তা নাহলে বাংটু কত যে ঝাটা ও জুতার বাড়ি খেতো তার ইয়ত্বা থাকতো না।


ইতোমধ্যে গিট্টুর বাড়িতে অনেকে উপস্থিত হয়েছেন। তখনো সখিনার বকবকানি চলছে। চেয়ারম্যান না হইলে উয়্যাক ঝাটা দিয়া পিটানুং হয়। চেয়ারম্যানের বেটার বউ নাগে তা তোর বোইনোক নিয়া যায়্যা আগি দে। তাক না পাইস তোর মাইয়েক নিয়া যায়্যা দে। তখন উপস্থিত সবার আর বুঝতে কোনো বাকি থাকে না। এককান দুইকান হতে হতে পরদিন সকাল হতে না হতেই গ্রামের সবাই জেনে যায় বাংটু চেয়ারম্যানের বেটার বিয়ের ব্যাপারে গিট্টুর বাড়িতে ঘটকালি করতে গিয়ে চরমভাবে অপমানিত হয়। এক পযার্য়ে ব্যাপারটি হাট বাজারে জানাজানি হলে বাংটু চেয়ারম্যানকে বলার আগেই মবিল চেয়ারম্যানের কানে পৌঁছায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ