পরকীয়া
সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রেমের সম্পর্ক খুব ঠুনকো কারণেই ভেঙে যায়,পরকিয়া হলে তো কথাই নাই। সামান্য অভিমান কিংবা ঈর্ষায় তা ভেঙে পড়ে। হয়তো ফেসবুকে একটি পারিবারিক ছবি, হাসিখুশী ভরা, কেউ একজন আপলোড দিল, তা দেখে অমনি মনের কোনে মেঘ জমে গেলো এবং সেই মেঘ ক্রমে জমাট বাঁধতে বাঁধতে এমন হলো যে সেখান থেকে বৃষ্টি নয়, থোকা থোকা রাগ ঝরতে থাকলো। যদিও রাগগুলি গভীরে অভিমান, কিন্তু ঠিক অভিমানও নয়, হয়তো ইগো। ব্যস, সম্পর্কে চিড় ধরে গেলো। এবং একটা সময় শীতল হয়ে গেলো।
অথচ পরকীয়া সম্পর্ক কিন্তু ঘটে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের আওতায়। উভয়ের কমন অবস্থা হলো একজনের স্বামী আছে, আর একজনের আছে স্ত্রী। এবং তারা দারুণভাবে সংসার করে। স্বামীর সংগে স্ত্রীর সম্পর্ক চমৎকার, এদিকে স্ত্রীর সংগের স্বামীর সম্পর্কও দুর্দান্ত।
তাহলে পরকীয়া ঘটে কেন?
কথায় বলে একটি চমৎকার সম্পর্ক নাকি আর একটি চমৎকার সম্পর্কের জন্ম দেয়। আসলে ব্যাপারটা তা নয় বলেই মনে হয়। একটি সম্পর্ক, যতই চমৎকার বলে বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, আসলে তা একঘেয়েমিতে ভরা। যে কোন সম্পর্কই তাই। কিন্তু বাইরে তা দেখানো যায় না, দেখাতে হয় সুখি সুখি ভাব। ভেতরে চলছে হাহাকার, ততদিনে সম্পর্কের মধুটি শেষ হয়ে গেছে, চাই নতুন মধু, নতুন মধুকর। তাছাড়া কেবলমাত্র একটি সম্পর্ক কি একজন মানুষের সব বাসনা পূর্ণ করতে পারে? পারে না। তাই চাই নতুন মানুষ। একসময় পেয়েও যায়, কারণ প্রতিটি সংসারে এমন মানুষ থইথই করছে। সংসারে থেকেও হতে চায় সংসারবিরাগী, পেতে চায় অন্য মানুষের ছোঁয়া।
সম্পর্ক হয়, কিন্তু তারা ভুলে যায় তারা সংসারী, তাদের একটি করে স্বামী আছে, একটি কিংবা দুটি করে সন্তান আছে। একক প্রেমের চেয়ে যেন এই প্রেম কোন অংশে কম নয়, বরং বেশি। চুন থেকে পান খসলেই একরাশ অভিযোগ এবং অভিমান। অথচ উভয়ে এই কড়াকড়ি থেকেই বেরিয়ে একটু স্বাধীনতা চেয়েছিল। পায় না এরা, এরা আরো কঠিন বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। সামান্য এদিকসেদিক হলেই রাগ এবং ক্ষোভ চলে আসে এবং যেহেতু এটি সমাজস্বীকৃত সম্পর্ক নয়, তাই ছেড়ে যেতে কোন কিছু করতে হয় না। ছেড়ে যায়, অন্য সম্পর্কে জড়ায়।
বিয়ে যে একগামি সম্পর্কে মানুষকে বাঁধে বলে মনে করে, আসলে তা ফস্কা গেরো। মানুষ এই গেরো থেকে বেরিয়ে পড়ে, তার প্রমাণ এই পরকীয়া। এখান থেকে আর একটি বিষয় সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে প্রেম সামাজিক নয়, প্রাকৃতিক। আর প্রকৃতিতে একগামিতা বলে কিছু নাই, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া। তাই আমরা এই ধরণের প্রেমকে বাঁকাচোখে পরকীয়া বলি কিন্তু পরকীয়া বলে কোন প্রেম নাই, সকলই প্রেম। এবং সেজন্য এইসব প্রেমেও থাকে অভিমান, অভিযোগ, রাগ এবং বিচ্ছেদ। মানুষ অন্য প্রেমে যেমন কাঁদে, এই প্রেমেও কাঁদে এমনকি আত্মহত্যাও করে। শুধু তাই নয়, সংসার ভাঙে, নতুন সংসার গড়ে।
মানুষ স্বাধীনতা চায়, কিন্তু পরক্ষণেই সে নিজেকে বন্ধনে বাঁধে। এ এক আশ্চর্য মানব কূটাভাস!
তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রেমের মত একটি অনির্বচনীয় মানবসম্পর্ককে বিয়ে নামক একটি প্রতিষ্ঠান হত্যা করে ফেলেছে। বিয়ে হচ্ছে সেই কালপ্রিট যা প্রেমকে পরকীয়া নামক একটি প্রেমের জন্ম দিয়েছে এবং একে নেতিবাচক বানিয়ে ফেলেছে। আসলে নেতিবাচক নয়, আসল প্রেম। আইনী, সামাজিক বানিয়ে একটি মধুরতম সম্পর্ককে হেয় করা হয়েছে।
সমাজের ভয়ে তাই এই প্রেমগুলিকে বলা যায় ভীরুপ্রেম। কারণ এখানে প্রেমিকপ্রেমিকাগণ সদা ভয়ে থাকে। এই ভয় থেকেই জন্ম অজস্র উপসর্গ যা এইসব প্রেমকে রাখে সদা তটস্থশীল।
আগেই বলেছি, নানাকারণে পরকীয়াও ভেঙে যায়, যেমন করে অন্য প্রেম, যাকে আমরা প্রকৃত প্রেম বলি, ভেঙে যায়।
সম্পর্ক ভেঙে গেলে ভেঙে যেতে দিন। আবার নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুন। মনে রাখবেন জীবন সম্পর্কের মালা, বিশেষত।
পরিশেষে বলি, বিবাহবহির্ভূত প্রেমকে পরকীয়া ডাকবেন না, বলবেন প্রেম। কারণ পরকীয়া বলে কোন প্রেম হয় না, এটা পুঁজিবাদ এবং ধর্মের চাপানো আধিপত্যবাদী মনেভাব যা মুনাফা এবং শোষণের ফাঁদ।
প্রেম নয়, চলুন এই ফাঁদ ভেঙে ফেলি...
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন