রফিক সতুর বউ ফোয়ারা আর কাপুরুষ / ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

রফিক সতুর বউ ফোয়ারা আর কাপুরুষ / ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য


নীলুদা বললো, দেখেছিস?

আমি বললাম, আমি তো অন্ধ হয়ে গেছি। আজ দেড় বছর আমি আমার চোখে দেখতে পাই না কিছু। চরম কাপুরুষতা থেকে এই অন্ধত্ব আমার। এখন কানে শুনি শুধু। শব্দ শুনে দেখতে পাই। কানের পর্দায় শব্দ এসে আছড়ে পড়ে আমার চেতনায় একটা ছবি ভেসে ওঠে। সেই ছবি দেখে সবটা বুঝতে পারি আমি।

--- থাম। বাজে কথা রাখ। আমাকে থামিয়ে দিল নীলুদা। থমকে গেলাম আমি। আজ প্রথম থমকালাম এমন নয়। আগেও আমি থমকে গেছি। ভুল বললাম। থমকে দিয়েছে। তারপর থেকে ভয় পেয়ে অন্ধ হয়ে গেছি। এখন বোধহীন চাউনি আছে আমার।

--- শোন, শুরু করেছে নীলুদা। শহরটা কেমন নতুন সাজে সেজে উঠছে দেখেছিস! রামচন্দ্রের ভাবনায় এ যেনো অন্য কোনো শহর।

নীলুদা রামচন্দ্রের ফ্যান। রামচন্দ্র একজন নেতা। ভুল বললাম। একজন সমাজসেবী। সামান্য সংযোজন। একজন উদারচেতা মহান সমাজসেবী। আমি ভয় পাই রামচন্দ্রকে। আমি কাপুরুষ। রফিক আগে গালাগালি দিত রামচন্দ্রকে। এখন আর দেয় না। এখন রফিকের চোখা চোখা খিস্তি আমিই খাই। ওর মনে হয়েছে আমিই এই জগতের শ্রেষ্ট অপদার্থ।

শুরু করেছে নীলুদা। বলে, দেখবি এইভাবেই দেশটাও নতুন সাজে নতুন হবে একদিন। সত্যি রামচন্দ্র ইস এ জিনিয়াস। বলে তাকিয়ে আমার দিকে। আমি তাকিয়ে নেই। আমি তো অন্ধ। অনুমান করে বলছি যে নীলুদা আমার দিকে তাকিয়ে। এবং এটা সঠিক। কারণ আমার অনুমান শক্তি প্রখর। কারণ আমি অন্ধ তাই। অন্ধের অনুমানই ভরসা।

নীলুদার কথার পিঠে আমি কিছু একটা বলবো বলে ভাবছিলাম। হঠাৎ করেই একটা শব্দ আমার মুখ বন্ধ করে দিল। আমার আশেপাশে কেউ দেশলাইয়ে কাঠি ঠুকে আগুন জ্বালালো। আমি বুঝে গেছি। আমার পাশে কে এসেছে। একটা ছবি ফুটে উঠছে সঙ্গে সঙ্গে। একটু আগেই বললাম শব্দ আমার মনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। এইবার একদলা বিড়ির ধোঁয়ায় মুখ বন্ধ হয়ে গেলো আমার। কাশি এলো। খক খক করে কাশলাম খানিক। নীলুদা বলে, শুধু শুধুই কেশে মরছিস। পেট গরম হলে কাশি হয়। ডাবের জল খেয়ে দেখতে পারিস। নয়তো কৃমির ওষুধ। পেটে পোকা হয়েছে। টিবি মানে টিউবারকিউলোসিসও হতে পারে। আরো অনেক উপদেশ দেবে এইবার। নীলুদা সব জানে। সব বোঝে। সব বিষয়ে স্বচ্ছ জ্ঞান। আমাকে উপদেশ দেয় প্রায়ই। আজ মন ভালো নেই আমার। অন্য দিন হলে শুনতাম হয়তো।নীলুদাকে থামাতে বললাম,' রফিক '।

শব্দটা নীলুদাকে থামিয়ে দিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। এটা আমি জানতাম ' রফিক 'শব্দ শুনলে থেমে যাবে নীলুদা। কারণ শব্দ ব্রহ্ম। নীলুদার সব কিছু গুলিয়ে দেবার ব্রহ্মাস্ত্র। নীলুদা চুপ। পাঞ্জাবিটা খুলছে গা থেকে। বাহারি পাঞ্জাবি, একরঙা। খস খস শব্দ শুনে বুঝেছি আমি।

পাশ থেকে গলা হাকারির শব্দ এলো কানে। আমার আঁধার ভুবনে রফিকের চেহারাটা ফুটে উঠেছে। খালি গা। চেক চেক লুঙ্গি। নতুন। একদম নতুন। কয়দিন আগে স্টেশন চত্বরে কারা যেনো বস্ত্র বিতরণ করলো। রফিক একটা লুঙ্গি পেয়েছে। একটা গেঞ্জিও পেয়েছে। গেঞ্জিটা পুরানো। শীত ছাড়া গেঞ্জি গায়ে তোলে না রফিক। শীত আসতে ঢের দেরি। বিড়ি ফুঁকছে রফিক। সেই ধোঁয়াই আমার মুখের দিকে ভাসিয়ে দিয়েছে। হতে পারে রফিকের বিদ্রুপ। বা করুণা। কোনটা ঠিক রফিক বলতে পারবে। আমাকে বলবে না। আমাকে হয়তো গালাগালি দেয় রফিক। হয়তো কেনো নিশ্চিত ভাবেই দেয়। কারণ আছে। আমি বলেছিলাম রফিক বিলটা তোদের। বিলের পাশের আবাদি জমি তোদের। সতু, চামু, মেধো আর ইয়াসিনকেও বলেছিলাম। আমি লড়াই দেবো। তোরা পিছনে থাকিস। ন্যায়ের সঙ্গে সবাই থাকবে। এতো বড় অন্যায় হতে পারে না। তোরা মাটি কামড়ে পড়ে থাক। এক ঠ্যাং নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতু। ওরা পড়ে ছিলো বিলটাকে বুকে জড়িয়ে। আমি ছিলাম না। বেইমানি করেছি। অথচ শহরের নানা প্রান্তে দাঁড়িয়ে বলেছি ওদের কথা। আগুনে ভাষায় লিখেছিলাম পত্রিকায়। রফিকরা ফকির হতে চলেছে জানলো দেশ দুনিয়ার লোক। রফিকরা জানে সে সব কথা। তারপর মানে তার বেশ কিছুদিন পর আমাকে থমকে দিল। কাপুরুষের মতো আমি রফিকদের সামনে থেকে সরে গেলাম। তারপর থেকে আমি অন্ধ। লেখালিখিও ছেড়ে দিলাম। মানে আগুনে লেখা ছেড়ে প্রেমের কাহিনী লিখছি শেষ দেড় বছর। আমি তুমি আকাশ গান চুম্বন উরু নির্জন..., আমার লেখার বিষয়বস্তু এখন। কলমের আগের ধার এখন ভোঁতা। মরচে পড়েছে মগজে। অবশ্য সেই নিয়ে অনুশোচনা নেই আমার। আমি তো কাপুরুষ। একদিন দিনদুপুরে রাস্তায় মার দাঙ্গার শব্দ শুনেছিলাম। রফিকরা মার খেলা। জমিও গেলো। ছিটেবেড়া গেলো। চালের টিন গেলো। সতু সর্দারও গেলো। সতু সর্দার পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলো। সে রাতে আমি দুটি গল্প লিখলাম। " অপর্ণাকে নিয়ে একটি রাত"। আর " রজনী - বাসরে আমি আর ঝিলিক"। গল্প দুটো ছাপা হয়েছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। নীলুদা বলেছিল দারুন লিখেছিস। রামচন্দ্র তোর প্রশংসা করেছে। আমাদের লোকজন তোর লেখা ভীষণ পছন্দ করে ইদানিং। খুবই প্রাকটিক্যাল এবং যুগোপযোগী লেখা। চালিয়ে যা। আমি হেসে ছিলাম সামান্য। আমি তো কাপুরুষ।


এই মুহূর্তে জোরে জোরে দম নিচ্ছে রফিক। হাঁপরের মত ওঠা নামা করছে ওর উনপাঁজুরে বুক। পেটটা চিতিয়ে গিয়ে পেটে মিশে গেছে। পেটে পিঠ ঠেকেছে রফিকের। আগে ছিলো না এমন। আগে মাছ ধরতো। ছোটো ডিঙ্গিতে চেপে। বিলের বুকে ডিঙি নিয়ে উড়ে উড়ে ঝপ করে জাল ফেলত। আর মাঝে মাঝে বিড়িতে টান দিত। মনের আনন্দে। তখন আনন্দ ছিলো রফিকের মনে। বিলের মাছ আর অতি সামান্য ফসলে অনটন ছিলো অন্য গ্রহের ভাবনা। সতুর একটা পা নেই। তবুও সতুর বউয়েরও আনন্দ ছিলো। এখন রফিকের মনে আনন্দ নেই। সতুর বউটাও নেই। আর শহরটা সুন্দর হচ্ছে। পরে দেশটাও সুন্দর হবে। রফিক এখন শুধুই বিড়ি টানে। ডিঙি টানে না। ডিঙিটা নেই। আর নেই। ডিঙির কাঠ পুড়িয়ে চুলো জ্বেলে চাল ফুটিয়ে ছিলো। টিনের চাল হারানোর পর বেশ কিছুটা চাল পেয়েছিল রফিক। পরে আরো অনেক কিছুই পাবে বলে শুনেছিল। সেই পাওয়া আর পাওয়া হয়নি। হবে কিনা নীলুদা বলতে পারবে। কারণ নীলুদা রামচন্দ্রকে চেনে, জানে, বোঝে। আর হাভাতেদের যন্ত্রণা বোঝে রামচন্দ্র নিজে।

--- বুঝলি, বিষয়টা হচ্ছে রামচন্দ্র। রামচন্দ্রের দূরদৃষ্টি অতুলনীয়। মানে এমন ভাবনা...। নীলুদা বলে চলেছে। আর একটা মাছরাঙা পাখি আমার কানের পাশে ডেকে উঠলো। শব্দের পিছন পিছন চিত্র এলো চেতনায়। কালো জলের বিলটা ভেসে উঠলো আমার সামনে। বিশাল বিল। চারপাশে গাছ। বড় বড় গাছ। গাছের নিচে ছিটে বেড়ার দেওয়ালের উপর টিনের চালের দারিদ্র। তবুও আনন্দ নিবাস। রফিক, সতু, ইয়াসিন, মেধো, পচুদের ঘর।

বিলটা আর নেই । বলাটা ঠিক হলো না। বিলটা আছে। আগের মত নেই। উঁচু পাঁচিলের ঘেরাটোপে ধরা দিয়েছে। তাতে বড় বড় হাঁস খেলা করে। ধপ ধপে সাদা হাঁস। হাঁস রামচন্দ্রের খুব পছন্দ পাখি। বিলের কাজল কালো জলে দুধ- সাদা হাঁস। দারুন লাগে দেখতে। দেশ বিদেশের লোক আসে সেই হাঁস দেখতে। না, আবার বলায় ভুল হলো। শুধু হাঁস দেখতে আসেনা। ইকোপার্কটা দেখতে আসে। বিলের বুকে পার্ক হয়েছে। চোখ টানার মতো ভাস্কর্য হাত বাড়িয়ে দর্শনার্থীদের দিকে। টিকিট কাটলে তবেই হাত ধরা দেয়। তারপর ভিতরে নিয়ে যায়। তারপর আনন্দ আর ফুর্তি। ফুর্তি আর আনন্দ। বড়ো খুব বড়ো একটা ফোয়ারা বসেছে। ফোয়ারার মুখে বাঘ। বাঘ রামচন্দ্রের প্রিয় প্রাণী। নির্ভীকতার প্রতীক। রামচন্দ্র নির্ভীক। আলোর কেরামতি আছে ফোয়ারাতে। রাতের বেলায় বোঝা যায় সেই কেরামতি। ফোয়ারার জলের ফিনকিতে মন্দির, মসজিদ, গির্জার অবয়ব ফুটে ওঠে। একই সঙ্গে। আবার আলাদা আলাদা ভাবেও। শহরের ধর্ম নিরপেক্ষতার অভূতপূর্ব নজির। দেশেরও। বলবার মত বিষয়। দেখবার মত ফোয়ারা। দেশের লোক শুনেছে সেই কথা। খবরের কাগজে ছেপে ছিলো। পাশে রামচন্দ্রের ছবি ছিলো। আমি দেখিনি। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। নীলুদা বলেছিল গতকাল। কোন রাজা না কোন কোন দেশের রাজা মন্ত্রী সবাই ছিলো ইকোপার্ক উদ্বোধনের পবিত্র সময়ে। রামচন্দ্র ছিলো। নীলুদাও ছিলো। চারপাশে গাছপালা ফুলে ফলে সাজানো পার্ক। শহরের গর্ব। দেশের গর্ব। রামচন্দ্র বলেছে। নীলুদাও বলে। আমি বলিনি। আমি পার্কটার নতুন চেহারা দেখিনি। নতুন করে পার্কটা তৈরি হবার আগেই আমি অন্ধ হয়ে গেছি। বিলের পুরানো চেহারাটা মনে আছে। সেই বড়ো বড়ো গাছ। ছিটেবেড়ার দেওয়াল। টিনের চাল। রফিক, সতু সর্দার, রামু কিস্কু, ইয়াসিনদের বাড়ি। আর জিওল গাছে মাছরাঙা পাখি। পাখিটার গলায় সাদা দাগ।

পাঞ্জাবিটা দেওয়ালের হুকে ঝুলিয়ে নীলুদা বললো বুঝলি শীতে এই পার্কটার চেহারাটাই বদলে যাবে। যাবেই। শীতকালে ভিনদেশী পাখিও আসবে বিলে। থেমেছে নীলুদা। পরিযায়ী পাখি আসবে। এখনও আসেনি। কারণ শীতকাল তো আসেনি এখনও। এইসবই রামচন্দ্রের ভাবনা। রামচন্দ্র সব ঠিক ভাবে। আগে আমি বলতাম না একথা। এখন বলি। এখন আমি কাপুরুষ। এখন আমি অন্ধ। আর রামচন্দ্র দুনিয়া চালায়। ভুল বললাম দুনিয়া চলে রামচন্দ্রের ভাবনায়।

নীলুদা বলে, কি যেনো বললি?

--- কই? কিছু বলিনি তো।

--- না না বললি। একটা নাম। কি যেনো।

--- হ্যাঁ, রফিক। বলি আমি।

--- সে কে? নীলুদার দুই ভ্রু কুঁচকে একে অপরকে ঠেসে ধরেছে।

--- আমার বন্ধু। আমি বললাম।

--- তাতে কি?

--- তাতে কিছুই নয়।

--- তাহলে বললি?

--- নামটাই তো বললাম। আর তো কিছু বলিনি।

--- বল। জানতে চাইছে নীলুদা।

বলতে যাচ্ছিলাম আমি। রফিকের কথা। শুধু রফিকের কথা বললে তো আর রফিককে চেনা যায় না। সতু আর সতুর বউয়ের কথাও বলতে হয়। কথা সাজিয়ে ফেলেছি আমি। এইবার বলবো। আবারও শব্দ কানে আসে। আবারও ভেসে এসে শব্দ - চিত্র। এইবার কেউ জোরে নাক টানলে যেমন শব্দ হয়। রফিক কাঁদছে। কান্নাহীন কান্না যেমন হয়। মানুষের পেট কাঁদলে যে কান্না শোনা যায় না, সেই কান্না। কারণ পার্ক হয়েছে। বিলের জলে মাছ আছে। বিলে এখন বোট চলে। ছেলে বুড়ো সবাই ফুর্তি করে বোট চালায়। আর রফিক লাট খেতে খেতে ঘুরে বেড়ায়। পথে, স্টেশনে বা বাস স্ট্যান্ডে। আর কাঁদে। রফিকের কান্নার আরো একটা কারণ আছে। সেটা সতুর বউ। সতুর বউকে ভালোবাসতো রফিক। ভুল বললাম। ভালো আজও বাসে। তবে...।

--- তুই তো সেদিন সন্ধ্যায় এলি না। বললাম বারবার করে। কতো বড় বড় মানুষ এসেছিল। ইকোপার্কের উদ্বোধনের কথা বলছে নীলুদা।

--- আহা, বিউটিফুল! বিস্ময়ে গলা কেঁপে উঠলো নীলুদার।

' বিউটিফুল ' আমার কানের পর্দায় আছড়ে পড়লো। স্নায়ুতন্তু গুলি বুঝিয়ে দিল বিউটিফুল আসলে কি। দৃষ্টিহীন চাউনি মেলে দেখতে চাইছি আমি অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্য। গগনচুম্বী ফোয়ারা। অনেকেই বোটিং করছে। সদ্য - প্রেম পোক্ত হওয়া প্রেমিক প্রেমিকারা একে অপরের সুদৃঢ আলিঙ্গনে নিরাপদে রয়েছে। নির্লজ্জ আলিঙ্গন। আরো কিছু দৃশ্য ভেসে ভেসে আসছে। হঠাৎ একটা হাসির শব্দ। মুহূর্তে বিউটিফুল শব্দের চিত্ররূপ কেঁপে কেঁপে উঠে হারিয়ে গেলো। আর সতু সর্দারের বউয়ের মুখটা সামনে এলো। নাকে গন্ধ এলো সঙ্গে সঙ্গে। আঁশটে গন্ধ। গায়ে ব্লাউজ নেই। একফালি কাপড়ে আঠাশ বছরের বাসি যৌবন চাপা দেওয়া। হাতে ধরে তালপাতা। বিলের জলে তালপাতা ডুবিয়ে গেঁড়ি গুগলি ধরতো সতুর বউ।

ডিঙি থেকে সতুর বউকে দেখে মাছ ধরা ভুলে সেদিকেই চেয়ে থাকতো রফিক। অসীম লালসায় কাতর। গল গল করে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে অপেক্ষায় থাকতো। কখন জল থেকে পারে উঠবে সতুর বউ। ভিজে কাপড় লেপ্টে থাকা শরীরটা দেখবে রফিক। জিওল গায়ের ডালে বসে থাকা মাছরাঙা পাখিটা ডেকে উঠতো। সতুর বউ তাকাতো সেই দিকে। রফিকের চোখ জড়িয়ে থাকতো সতুর বউকে। অপলকে। মনের মধ্যে উথাল পাতাল। ঘন ঘন শ্বাস। যা দেখেনি তার অস্পষ্ট ছবি কল্পনা করতো। ব্যাপারটা ভালোই লাগতো সতুর বউয়ের। উপভোগ করতো খুব। কারণ সতুর মুখে খিস্তি আছে, পা নেই। আরো কিছু থাকতেও নেই। রফিকের সব আছে। সব। তাই সব - এর কাছে সবটা সমর্পণ। তারপরই তো ...।

--- কি ভাবছিস বলতো? নীলুদার প্রশ্নে সতুর বউয়ের ছবিটা দুমড়ে মুচড়ে সরে যায়। বলি না না তেমন কিছু ভাবছি না। ওই সতু সর্দারের বউ...।

চমকে ওঠে নীলুদা। তোয়ালে দিয়ে মুখটা মোছে। বলে এই হলো টিপিক্যাল আঁতেল বাঙালী। সবেতেই একটা অন্য রকম ভাবনার রসদ খোঁজার অভ্যাস। ডিসগাসটিং!

আমি চুপ। আবার শুরু করেছে নীলুদা। বলে, আচ্ছা শহরের বুকে এই রকম একটা ইকোপার্ক, ভাবতে পারিস! এটা যে কত বড় গর্বের বিষয়...। কান্নার শব্দ পেলাম। সতুর বউকে দেখতে পাচ্ছি। কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে একটা ভিড়। ভিড়ের নখ রয়েছে। দাঁত রয়েছে। লালা ঝরছে ভিড়ের লকলকে জিভ বেয়ে। সতুকে মাড়িয়ে সতুর বউটাকে...।

--- দেখ একটা পরিষ্কার কথা বলি। আমরা ভাগ্যবান যে এমন একজন মানুষকে সামনে থেকে দেখছি। আমি বেখায়ালে জিজ্ঞাসা করি, কোন মানুষ? নীলুদা আমার দিকে তাকিয়ে। রাগত দৃষ্টি। অনুমান করতে পারি আমি। নীলুদা বলে, জিজ্ঞাসা করছিস কোন মানুষ! আরে আমাদের রাম...।

নীলুদার কথার মাঝেই কান্নার শব্দ কানে ঠেকলো। শব্দ মুহূর্তে চিত্র হয়ে ধরা দিল। রফিক ডিঙির কাঠ চুলোয় জ্বালিয়ে চাল ফুটাচ্ছে। দু চোখে জল। কাঠের ধোঁয়ায় হতে পারে। আবার সতুর বউয়ের জন্যও হতে পারে। আমাকে বলবে না রফিক। আমি অন্ধ। আমি কাপুরুষ।

--- সত্যি, তোরা যে কোন গ্রহের মানুষ কে জানে! বলে চলেছে নীলুদা। মাছরাঙা পাখির ডাক আবার শুনতে পেলাম। আর সেদিনের সেই বিলের ছবি ফুটে উঠেছে। ডিঙি নিয়ে মাছ ধরছে রফিক। সতুর বউ গুগলি জড়ো করছে। জিওল গাছে বসে মাছরাঙা পাখিটা লেজ নাড়াচ্ছে। সতুর বউ দেখছে মাছরাঙা পাখিটাকে। জাল ছেড়ে রফিক দেখছে সতু সর্দারের বউটাকে। সতুর বউয়ের মুখে হাসি। রফিকও হাসছে এইবার। রফিকের সব আছে। সতুর বউ নিজেকে রফিকের কাছে বিলিয়ে দিয়ে চায়। সব - এর কাছে সবটা সমর্পণ। তারপর ...।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ