ঘাড় নাড়া পুতুল
পুতুল নেবে গো...... পুতুল!!! টুং টুং টুং.....আমি এক ঘাড় নাড়া বুড়া। আমার কথা কাহারো মনে পড়ে কি? সেই কবে উত্তর চব্বিশ পরগনার কোন এক মৃৎশিল্পীর দাক্ষিণ্যে আমার সৃষ্টি। আমি জন্মিয়াছিলাম বুড়া মানুষ হইয়া, আজীবন আমি বুড়াই রহিয়া গেলাম। এক সময় এই বাংলার ঘরে ঘরে আমার বিচরণ ছিল। আমার না ছিল শৈশব, না ছিল কৈশোর, না হইতে পারলাম জোয়ান কেবল বুড়া ই রহিলাম। তাতে অবশ্য আমার কোন আক্ষেপ নাই। একমাথা পাকা চুল আর দাড়ি লইয়া দন্ত বিকশিত করিয়া হাসিয়া মরিলাম জীবনভর। পূর্বে যখন বিশেষ করিয়া রথের মেলা বসিতো, তখন কত শিল্পী মাটির তাল লইয়া থরে থরে গড়ন দিয়া, আগুনে পুড়াইয়া, রঙ করিয়া সাজাইয়া তুলিতো আমারে। কখনো সাদা ধুতি পরাইয়া, হাতে হুঁকা দিয়া বানাইতো গ্রামের বুড়া, তো কখনো লাল কোট পরাইয়া হাতে চুরুট ধরাইয়া সাজাইতো আধুনিক বৃদ্ধ। আমি আপত্তি করিনাই কেবল মাথাই নাড়িয়াছি। যে আমায় গড়ন দিয়াছে, তাহার বানানো পুতুলের সাজিতে চড়িয়া মেলায় মেলায় পাড়ি দিয়াছি। আমার সহিত ডালায় চাপিয়াছেন বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, সারদা মা, রবি ঠাকুর, তারামা, বাউল সন্ন্যাসী, গোপাল, ল্যাংটা খোকা, লক্ষীর ভাঁড়। শিশুরা আমায় বড়ই পছন্দ করিতো। কেহ একখানি গোপাল কিনিলেও আমায় সাথে করিয়া নিতে ভোলেনাই। আমি মেলায় আসিয়া এই ভব সংসারের রঙ্গ-তামাশা দেখিয়াছি, হাসিয়াছি আবার হাসি চাপিয়াছি। হাসি চাপিয়া পেট ফুলাইয়াছি। তাই আমার মুন্ডের তুলনায় উদরের পরিধি বহু স্ফীত হইলো। যে যেরকম চাহিয়াছে আমার মস্তক হেলাইয়াছে, আমি তেমনি মাথা নাড়িয়াছি... টুং টুং টুং। তবু আজ আর মেলায় আমায় কেহ চাহে না। সেকালে বুড়া মানুষের সংসারে কদর ছিলো, আজ কমিয়াছে অনেকাংশে। বাজারে এখন কল চালিতো প্লাস্টিকের খেলনার চলন ঘটিয়াছে। শিশুরা যবে হইতে মাটির পুতুলের সঙ্গ ছাড়িয়াছে তাহাদের কল্পনা শক্তিও ক্রমেই হ্রাস পাইয়াছে। মানুষ যন্ত্রে পরিণত হইতে উদগ্রীব। একদিন সকলই চলিবে নাকি রোবটের দ্বারা। এই এতো বাংলার কুটির শিল্প, এতো সাহিত্য, গান, রস সবই হারাইবে। আমি মরিলে ক্ষতি নাই, সকলি যে মরিতে বসিলো, তাহা কি মানুষ ভাবে?
টমটম গাড়ি
টম টম টম....... আমি টমটম গাড়ি। গাড়ি হইলেও আপন শক্তিতে চলার ক্ষমতা আমার নাই। কেহ যখন আমার নাসিকায় দড়ি বাঁধিয়া টানিতে থাকে, আমি চলিতে থাকি তাহার পিছে পিছে....মহা আনন্দে। আমি চলি কাহারো পিছে, আমার পিছে ছোটে আরও বেশ কিছু ছোট খোকা খুকুর দল, হাসিয়া ওঠে, হাতে তালি দেয়। কেন? আমার পৃষ্ঠে বাজনা আছে যে!! আমি ছুটিলেই বাজনা বাজিয়া ওঠে টম টম টম।
আমার দেহখানি তৈরি হইয়াছে এক পোড়া মাটির সরা দিয়া। সরার মুখখানি (যাহা আমার পৃষ্ঠদেশ) এক মজবুত কাগজ দিয়া শক্ত করিয়া আঁটা। আমার পশ্চাতে দুইটি পোড়া মাটির চাকা আছে যাহার উপর ভর দিয়া আমি গড়াইয়া চলি গড় গড়। এই চাকা আমার গোটা অঙ্গের সহিত কয়খানি বাঁশের কাঠির দিয়া শক্ত করিয়া আঁটা। চাকার সহিত সরু দুইখানি সরু কাঠি এইরূপে যুক্ত থাকে যে আমার চলনের সময় পৃষ্ঠদেশে ক্রমাগত আঘাত করিয়া বোধকরি উহার পূর্ব জন্মের শোধ তুলিয়া লয়। আঘাতের ধ্বনিতে মুখোরিত হইয়া ওঠে বিস্তীর্ণ এলাকা....টম টম টম। কাঠি যত বিক্রম ফলায়, ধ্বনিত শব্দ তত তীব্রতর হইয়া উঠে, আর সেই ধ্বনিতে আন্দোলিত হয় বহু শিশু আর কিশোর মন। তাহাদের কাছে আমি এক অতি জনপ্রিয় খেলনা। তথাপি তাহাদের মনের হিসাব কেই বা রাখে। বাংলার কত কুটির শিল্পী খেলনার দো-তারা, বাঁশি, ভেঁপু, ঢোল প্রভৃতি হরেক রকম বাদ্যের সহিত আমায় বানাইয়া থাকেন, ঝাঁপি ভরিয়া ফেরি করেন এক মেলায় থেকে অপর মেলায়। আজ অবিশ্যি প্লাস্টিকের বাদ্যির রমরমা, তাই দিনে দিনে আমরা হারাইতে বসিলাম আমাদের অস্তিত্ব। আমায় আজ মানুষ ঘরে লইতে চাহেনা, বোধকরি আমার উগ্র বাদন আধুনিক সভ্য সমাজের মানুষদের বিব্রত করে। তথাপি পথে প্রান্তরে যখন কেহ আমারে টানিয়া লইয়া চলে কত খোকা মিষ্টি হাসি লইয়া আমার পিছে ছুটিয়া আসে, তাকাইয়া দেখে, আমার তখন নিজেকে হামিল্টনের বাঁশি মনে হয়।
লক্ষ্মীর ভাঁড়
ছম্ ছম্ ছম্ ..আমি লক্ষীর ভাঁড়। স্বয়ং মা লক্ষ্মীর পদতলে আমার অধিষ্ঠান। একদা বাংলার গৃহিণীরা কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় আমায় ঘরে আনিতেন, সকল বৎসর যাবৎ আমার দেহ প্রোকষ্ঠে দিনান্তে জমা করিতেন অল্প অল্প সঞ্চয়। এইরূপ এক বৎসর ব্যাপী সঞ্চিত ধন লইয়া পরবর্তী লক্ষী পূজায় ব্যয় করিতেন। শুধু গৃহিণী নয়, এক সময় আমি দেশ বিদেশের বহু মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় সঙ্গী হইয়াছি। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে আমার কদর করিয়াছে, সুখ-দুঃখের ভাগীদার করিয়াছে, সুযোগে সঞ্চয় করিয়াছে, দুর্যোগে ব্যয় করিয়াছে, অপব্যয় ও করিয়াছে কেহ। কত মৃৎশিল্পী নানান রকম আকারে আমারে গড়িয়াছেন, কভু জীব-জন্তুর আকার দিয়াছেন, তো কভু নিটোল গোলাকৃতি মুখআঁটা ঘটের ন্যায়। গড়ন আমার যেমনই হউক না কেন, ভিতরের প্রোকষ্ঠ সম্পূর্ণ ফাঁপা। প্রথমাবস্থায় কেবলি শূণ্য থাকে উহাতে, আর থাকে আশা আর স্বপ্ন পূরণের ক্ষুধা। যে দুঃখী আমার ভিতর গহবরে অসময়ের কথা চিন্তা করিয়া সঞ্চিত করেন তাঁর কষ্টের সম্বল, আমি তাঁহাকে সাময়িক অভাব পূরণের আস্থা দিই। যে ধনী আমাতে ধন সঞ্চয় করিয়াছেন তাহাকে আমি সাময়িক স্বপ্ন পূরণের আভাস দিয়াছি। যে শিশু আমাতে গচ্ছিত রাখিয়াছে তাহার ক্ষুদ্র সম্পদ আমি তাহাকে হঠাৎ পাওয়া আনন্দের স্বাদ দিয়া আহ্লাদিত হইয়াছি। প্রতিদিন সঞ্চয়ের একটি আধুলি যেমনি ছনাৎ করিয়া অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াছে, ঠিক তেমনি আমার সুখ কিনিবার রসদ নূতন প্রত্যাশায় নবীন প্রত্যয়ে অল্প অল্প স্ফীত হইয়াছে। মানুষ কিছুকাল অন্তর আমায় দুইহস্তে লইয়া আন্দোলিত করিয়াছেন এবং আমার অভ্যন্তরীণ গচ্ছিত আশারা ছম ছম শব্দে ধ্বনিত হইয়া ইশারা করিয়াছে। কাহারো চিন্তনে উহা আধা খালি, কেহ অনুধাবন করেন.....ভরিয়াছে বেশ!! আর ক্ষণকালের প্রতিক্ষা।
শিশু আর কিশোরদের দীর্ঘস্থায়ী অপেক্ষা বড়ই অপছন্দের, তাহারা আমার অভ্যন্তরে অঙ্গুলী প্রবেশ করাইয়া টানিয়া বাহির করে আধুলি যাহা উহাদের সাময়িক অন্তরের ছোট্ট বাসনাকে পূর্ণ করে তৎক্ষণাৎ। এইরূপে আমি একদা সকলের ভরসার পাত্র ছিলাম, বেশ লাগিত!! এই সমাজে আমার সমাদরের ঘাটতি হইবে না ভাবিয়া আমি আত্মতুষ্টিতে ভরিয়াছিলাম।
আজ দিনে দিনে বাজারে খুচরা পয়সা অচল হইয়াছে, পুরাতন সব কিছুর ন্যায় পুরাতন পয়সাও বাতিল হইয়াছে। আজ তাই আমিও যে বড় অচল। কতই যে নির্বোধ ছিলাম আমি, কেবলি পয়সা না চাহিয়া যদি কিছু বিশ্বাস আর শুভ বুদ্ধি সঞ্চয় করিতে পারিতাম বোধকরি কদর থাকিতো আরো কিছুকাল। আজকাল মেলায় আমি কেবলি চাহিয়া থাকি, যাহারা আমার সমাদর করিত তাহারা আজ ফিরিয়াও চাহে না। সকলকে আমি দুই হাত ভরিয়া আশা দিয়াছি, আজ আমার নিজের ভাগ্যেই শুধুই হতাশা।
2 মন্তব্যসমূহ
ছেলেবেলার স্মৃতি, সভ্যতার অগ্রগতির সহিত আমরা বহুবিধ সুবিধা ও আনন্দ অর্জনে লিপ্ত হইয়াছি তাহা যেমন সত্য, পাশাপাশি পুরাতন অনেক সুখ যাহা ছিল প্রাকৃতিক ঝর্ণার মত চঞ্চল-উজ্জ্বল স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্ভেজাল - তাহা যেন সব কোথায় নিরুদ্দেশে ভাসিয়া চলিয়া গিয়াছে। একালের শৈশব, বাল্য বা কৈশোর তাহার র ঠিকানাও খুঁজিয়া পাইবেনা।
উত্তরমুছুনসুন্দর একটি লেখা, মনের মধ্যে পুরাতন বাজনার ঝনঝনানি শুনছি যেন!
এমন মন্তব্য নতুন করে কিছু ভাবার অথবা লেখার অনুপ্রেরণা যোগায়। আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
মুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন