শর্মিষ্ঠা ঘোষ / হারানোর লিস্ট

হারানোর লিস্ট / শর্মিষ্ঠা ঘোষ

পশ্চিমবঙ্গ কি শুধুই হারাবে ? তার অতীত ঐতিহ্য গৌরব? ভারতের বুকে নবজাগরণ আনা বঙ্গদেশ ভরে যাবে শুধু হেরে যাবার হাহাকারে ? জোব চার্নকের সময় থেকে বঙ্গদেশের যে ইতিহাস সেখানে উজ্জ্বল হয়ে আছে ভারতের বুকে অনেক কিছুই প্রথমবার করে দেখানোর নিদর্শনে। শিল্প বাণিজ্য সংস্কৃতি শিক্ষা চিকিৎসা গবেষণা কি নয়! এই গৌরব আমাদের অপদার্থতায় আর অবিমৃষ‍্যকারিতায় হারিয়ে যাচ্ছে রোজ। বাঙালি কি ভবিষ্যতে শুধু বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে জেগে থাকবে? যেভাবে হয়ে চলেছে ব্রেন ড্রেন যেভাবে একে একে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার ট্রাম দোতলা বাস হারিয়ে যেতে বসেছে বেঙ্গল কেমিক্যাল মাদার ডেয়ারি। ঠিক সে রকমই নিঃশব্দে চলে গেল কোলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে ভারতের প্রথম বিস্কুট কারখানাটি। আজকের ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ নামধারী সংস্থাটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ আমলে কলকাতায় ১৮৯২ সালে। তখন কিন্তু মোটেই এই নাম ছিল না। পরবর্তীতে নলিনচন্দ্র গুপ্ত এই কোম্পানি কিনে নেন। তখন নাম ছিল ভি এস ব্রাদার্স। ১৯১৮ তে একজন ইংরেজ সি এইচ হোমস কোম্পানির অংশীদার হওয়ার পর কোম্পানির নামকরণ হয় ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি। অর্থাৎ ব্রিটানিয়া বিস্কুটের প্রথম কারখানাটি এই কলকাতার কারখানা। সময়ের সাথে সাথে বিবর্তন ঘটেছে। দ্বিতীয় কারখানা হয়েছে মুম্বাইয়ে ১৯২৪ সালে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটানিয়া মিত্রশক্তির সৈন্যদের বিস্কুট সরবরাহ করতো। মোটামুটি সেই সময় থেকেই দেশে-বিদেশে ব্রিটানিয়ার নাম ছড়িয়ে পড়ে। গোটা বিশ্বে ব্রিটানিয়া বিস্কুট রপ্তানি করা হতে থাকে। ব্রিটানিয়া বিস্কুট কোম্পানি থেকে ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামকরণ হয় ১৯৭৯ সালে। এর ঠিক দশ বছর পর ব্রিটানিয়ার হেড অফিসটি সরে যায় কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে। 

বিশ্বের আশিটি দেশে ছড়িয়ে আছে ব্রিটানিয়ার কারখানা। গ্রেট ব্রিটেনের কোম্পানি এই ব্রিটানিয়া বিস্কিট কেক ডেয়ারি প্রোডাক্ট এর জন্য বিখ্যাত। ২০২৩ শে এর নেট প্রফিট হয়েছিল ভারতীয় টাকায় ২১ বিলিয়ন। কিন্তু প্রথম বিস্কুট উৎপাদন কারখানাটি যথেষ্ট সচল অবস্থায় থাকাকালীন ব্যাঙ্গালোরে স্থানান্তরিত যখন করা হলো 2024 সালে তখন স্বভাবতই ইতিহাস মোদী এবং সাধারণ বাঙালির মন খারাপ হয়েছে কারণ বাঙালির জনজীবনের সাথে বিস্কুট বলতেই ব্রিটানিয়া নামটি জড়িত। নতুন নতুন বহু কোম্পানির উত্থান হয়েছে বিগত ৫০ বছরে কিন্তু প্রায় দেড়শ বছর ছুঁই ছুঁই এই সংস্থাটির নাম গরিমা এবং বিস্কুটের কোয়ালিটি অক্ষুন্ন রয়ে গেছে।এসেছে নতুন নতুন প্রোডাক্ট। বিস্কিটের পাশাপাশি এসেছে চিজ কেক ডেয়ারি প্রোডাক্টস এসবও। সব বয়সের সব হেলথ কন্ডিশানের কথা মাথায় রেখে। শহরতলীর নিম্নমধ‍্যবিত্ত থেকে শুরু করে পাতি সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত তো বটেই শ্রেণী বর্ণ নির্বিশেষে ব্রিটানিয়ার বিস্কুট একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। এই ব্রান্ড বঙ্গ জীবনের ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়ে আসছে তার বাপ ঠাকুরদারও আগের আমল থেকে।

সুতরাং ব্রিটানিয়া বঙ্গ জীবনের একটি অঙ্গ বলা যেতে পারে। ঠিক যেমন বোরোলিন। যতই আশ্বাস দেওয়া হোক না কেন কোলকাতা থেকে গেল তো কি হয়েছে ব্রিটানিয়া তো আর ভারতবর্ষ থেকে চলে যাচ্ছে না! কিন্তু প্রথম যা কিছু ঐতিহ্য তা হারানোর বিমর্ষতাও তো বাঙালির পিছু ছাড়ছে না! গিনেস বুকের পাতাতেই শুধু তাহলে লেখা হয়ে থাক সেই ইতিহাস! মোহাম্মদ আলী জিন্নার পৌত্র এবং প্রপৌত্রের হাত ধরে ব্রিটানিয়া কোন অভিমানে কলকাতা পরিত্যাগ করল বাঙালির কাছে এ একটি অনুচ্চারিত প্রশ্ন হয়ে থাক! "বাপ বন গয়ে " র মিষ্টি কুকুর ছানা বা দীপিকা পাড়ুকোন এর সেই বিখ্যাত অ্যাড মনে করুন গুড ডের "এক সাথ মুসকুরা" বা গব্বর সিং এর সেই অ্যাড " পসন্দ আয়া" বা মাছ ধরতে গিয়ে ছিপে জুতো গাঁথার পর" হ্যাভ এ গুড ডে" "টিং টি টি টিং টিং " এসবের সাথে বড় হয়েছে বাঙালির বাচ্চা। ব্রিটানিয়া মেরি, থিন এরারুট, স্ন‍্যাক্স, অরেঞ্জ ক্রিম, ক্রিম ক্রাকার, ৫০-৫০, জিম জ্যাম, মিল্ক বিকিস, নাইস এই সবকিছুর অ্যাড এর সাথে বাঙালির বাচ্চা নেচে ওঠেনি এমন কখনো হয়নি। আমার বাচ্চাও গুনগুনায় ব্রিটানিয়া জিঙ্গল। ওকে বলতে খুব খারাপ লাগবে আমরা কি হারিয়ে ফেলছি রোজ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ