ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য / সোশ্যাল মিডিয়া ও ভগীরথদা

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য / সোশ্যাল মিডিয়া ও ভগীরথদা


--- জ্বলে গেলো। মরে গেলাম।

চম্পার আর্তনাদ ডাউন কৃষ্ণনগর লোকালে চেপে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গেলো।

দেশ দুনিয়ার মানুষ চম্পার ছবি দেখে অবাক। রাশি রাশি কমেন্টস। কেউ লিখলো, "দেখলে কে বলবে!"

"এদের চরম সাজা হওয়া উচিত।" এমন কথাও কেউ কেউ লিখলো।

"প্রশাসনের মদত ছাড়া এমন কাজ হতে পারে না," লিখলো নীল শার্ট।

" প্লাটফর্মে এদের দলের আরো লোকজন আছে। যাত্রীদের সচেতন হওয়া উচিত।" লিখলো খয়েরী সালোয়ার।

ভগীরথদা লিখলো অন্য কথা। " এদের মাথাকে ধরা মুস্কিল। কলকাতায় কালিতলা লেনের সঙ্গে এদের যোগাযোগ।"

ভগীরথদা সোশ্যাল মিডিয়ার নোন অ্যান্ড এক্টিভ পার্সোনালিটি। মাঝে মধ্যেই টেলিভিশনে বিতর্ক সভায় সমাজকর্মী পরিচয় নিয়ে উপস্থিত থাকে ভগীরথদা।

ভগীরথদার পোস্ট আর কমেন্ট সেকেন্ডে লাইক পেলো সহস্র। "ঠিক কথা বলেছেন ভগীরথ বাবু " সঙ্গে উপরের দিকে বুড়ো আঙুল তোলা ইমোজী। দেখে খুশি ভগীরথদা। সাত সকালে সমাজের জন্য কিছু করতে পেরে তৃপ্তি পেয়েছে বেশ।

তবে বিরুদ্ধ মতামতও লিখলো দু চার জন।

" সব বিষয়েই কালিতলা লেন! ভূত দেখেন নাকি ভগীরথ বাবু ? কই কান্দিগ্রাম নিয়ে তো কিছু বলেন না।"

একজন লিখেছে " যাদের দেখতে নারি তাদের চলন বাঁকা। এইসব চোর চক্রের সঙ্গে সুখেন্দুবাবুর কোনো যোগাযোগ নেই নিশ্চিত আপনি?"

ভগীরথদা শাণিত ভাষায় থামিয়ে দিল তাদের কন্ঠ, লিখে দিল " নিজের চোখে না দেখে এমন ননসেন্স রিমার্ক করবেন না দাদা। আগে সমস্যা গুলো কাছ থেকে দেখুন। আমি নিজে দাঁড়িয়ে এই সমস্যা দেখেছি।"


ঘটনাটা আজকের।

সকাল বেলা। অফিস টাইম। স্টেশন চত্বরে লক্ষ যাত্রীর ভিড়। নিত্যযাত্রীই বেশি। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপী, সাদা বিভিন্ন রঙের শার্ট গুলো গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে। রামধনু গ্রুপ। একই কামরায় উঠবে সবাই।

হঠাৎ করেই স্টেশনের কোলাহলকে ছাপিয়ে মাথা তোলে আর্তনাদ। মহিলা কণ্ঠ। আশেপাশের লোকজনের শব্দভেদী নজর ক্ষণিকের জন্য শব্দ উৎস্য সন্ধানের চেষ্টা করে। ওইটুকুই। এর বেশি কৌতূহল দেখানোর সময় নেই, অফিস টাইম। অল্প সময় পরেই ডাউন কৃষ্ণনগর লোকাল হামা দিয়ে প্লাটফর্মে এসে হাঁফ নেবে কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তার মধ্যেই কামরায় সেঁদিয়ে দিতে হবে নিজেদের।

লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা, গোলাপি রঙের শার্ট গুলো একজোট। একযাত্রা। এক ট্রেন। এক কামরা। একই ভাবে রোজ রোজ। ভগীরথদার কামরায় উঠবে সবাই। ভগীরথদা কৃষ্ণনগর থেকে এই ট্রেন নিয়ে আসে। রোজ। সামনের দিক থেকে লেডিসের পরের কামরার দ্বিতীয় গেটে উঠবে বিভিন্ন বর্ণের শার্ট গুলো। সারা বছর এই একই কামরায় শিয়ালদা যাওয়া। সঙ্গে ভগীরথদা। আলপিন টু এলিফ্যান্ট, সব বিষয়ের উপর দগ্ধ আলোচনার দিশারী ভগীরথদা।

--- মরে গেলাম। মা গো।

আবারও মাথা তোলে আর্তনাদ। তবে শব্দ আগের মত তীক্ষ্ণ নয়। সামান্য ভোঁতা। ঘাড় ঘোরায় অনেকেই।

--- কে মরে যাচ্ছে? বাতাসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় লাল শার্ট।

--- কি করে বলবো দাদা? এখন ওই সব বলার সময় নেই। সামনে তাকান। ভিড় থেকে কেউ একজন বলে।

ইতিমধ্যে স্টেশন মাইকে ঘোষণা হয়, ট্রেন প্লাটফর্মে আসছে।

যাত্রীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। পার্স, মোবাইল নিরাপদ আস্তানায় রেখে পজিশন নিয়েছে সবাই। রেডি, স্টেডি, গো। ঠিক জায়গায় ঠিক ভাবে না দাঁড়ালে ঠিকা নেওয়া কামরায় ওঠা যাবে না।

প্ল্যাটফর্মের কিনারা ঘেঁষে একটা ত্রিস্তরীয় মানব প্রাচীর তৈরি হয়েছে। একেবারে নিটোল নিখুঁত নির্মাণ। লাল, নীল, হলুদ, সবুজরাই প্রথম স্তরের প্রাচীরে। স্বাভাবিক। এরই মধ্যে হলুদ শার্টের ফোন বেজে ওঠে। এখন কথা বলতে ফোন হাতে নেবার প্রয়োজন নেই। কানে যন্ত্র। টাচ করলেই কথা বলাই যায়।

" সুপ্রভাত ভগীরথদা, বলুন। কি? রেলগেটে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে! ধুর শালা। আজও দেরি হবে..."

মুখ থেকে স্বতস্ফূর্ত ভাবে কয়েকটি খেউড় বাইরে আসে।

লাল শার্টের কথা শুনে নীল শার্ট হেসে ওঠে গা দুলিয়ে। পাশের খয়েরী সালোয়ার মুখ টিপে হেসে মুখ ঘোরায় অন্যদিকে। স্টেশন মাইকে ঘোষণা হয় " সামনের লেবেল ক্রসিংয়ে সমস্যা থাকায়...।"

"ওহ" সহস্র যাত্রীর চরম বিরক্তির প্রতীক হয়ে আছড়ে পড়লো শব্দটা।

--- জ্বলে গেলো, মরে গেলাম, মরে ... ।

এইবার যন্ত্রণার প্রকাশ একটানা হয়ে চলেছে। পল্টুর চায়ের দোকানের সামনে প্লাটফর্মে শুয়ে ছটপট করছে চম্পা। দোকানের ভিতরে পল্টু হাত ছুঁড়ে তর্জন গর্জন করছে। "পুড়িয়ে মেরে ফেলবো এইবার। রোজ বারণ করি, তারপরেও তোকে এইখানেই বসতে হবে!"

প্ল্যাটফর্মের সুচাগ্র জায়গার মূল্য আছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য ফুট পাঁচেক জায়গা ছেড়ে দিয়ে বাকিটা বাণিজ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। চা, চপ, পরোটা থেকে ভাতের হোটেল। কাঁচা সবজি, ছাতা, জুতো থেকে কসমেটিক, সব আছে। এবং সবাই আছে। যাত্রীরা আছে। পকেটমার আছে। মোবাইল হাতে সিভিক পুলিশ আছে। জুতো পালিশ আছে। ভিখারী আছে। তবে মোবাইল ভিখারীই বেশি। কারণ প্ল্যাটফর্মের কোনো দোকানের সামনেই ভিখারীদের বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর নিয়ম নেই। ব্যবসায় ক্ষতি হয়।

চম্পা স্টেশনারি ভিখারী। শারীরিক অসুস্থতা। সকাল থেকে যেকোন একটা দোকানের সামনে বসে যায়। সারাদিন দোকানদারদের গালিগালাজ খেয়ে ও খাইয়ে কারবার সামলায় চম্পা।

আজ বসেছিল পল্টুর দোকানের সামনে। চম্পার গায়ের দুর্গন্ধে খরিদ্দার কাটবে। আজ আর মুখে কিছু বলেনি পল্টু। অ্যাকশন নিয়েছে। গরম জল ছুঁড়ে দিয়েছে চম্পার গায়ে। একমাত্র কালুই দেখেছে সেই ঘটনা। পল্টুর দেখানের পাশেই কালুর লটারি কাউন্টার।

--- মরে গেলাম। বাবা গো...। ফুটন্ত জল পুড়িয়ে দিচ্ছে চম্পাকে।

ট্রেন আসতে দেরি আছে। হাতে সময় পাওয়া গেছে। যাত্রীদের একটা কৌতূহলী বলয় তৈরি হয়েছে চম্পাকে ঘিরে। যন্ত্রণার গর্ভগৃহে চম্পা, ছটপট করছে।

লাল শার্ট দুপা পিছিয়ে আসে। " মরে গেলাম " এর খবর নেওয়া উচিত। ভিড় ঠেলে ভিতরে পৌঁছে যাবার চেষ্টা করে। এবং ব্যর্থ হয়। মানব বলয়ের গায়ে নিজেকে গুঁজে দিয়ে মাথা তুলে ভিতরের খবর নেবার চেষ্টা করে।

হলুদ, নীল, সবুজ, গোলাপী শার্ট সবাই সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে। প্রতিনিধি পাঠিয়ে " কে? " , " কি?" , " কেনো?" জেনে নেবার চেষ্টায় সচেষ্ট।

হলুদ শার্ট: কি অবস্থা?

লাল শার্ট: দেখতে পাচ্ছি না। ভীষণ ভিড়। তবে চিৎকার করছে।

সাদা শার্ট: কেনো? চিৎকার করছে কেনো?

লাল শার্ট: বোঝা যাচ্ছে না।

গোলাপী শার্ট: কি হয়েছে?

লাল শার্ট: বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে কষ্ট পাচ্ছে।

নীল শার্ট: বাঁচবে?

লাল শার্ট: বোঝা যাচ্ছে না।

গোলাপি শার্ট: হয়েছেটা কি?

ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন চিৎকার করে বলে, নিজের নিজের মোবাইল মানি ব্যাগ সামলে দাদা। চোর...।

--- চোর, চোর। কালু চিৎকার করে ওঠে।

সাদা শার্ট: চোর?

মোবাইল এর পার্স সাবধানে রাখুন। দোকান থেকে চিৎকার করে বলে পল্টু।

নীল শার্ট: মার, মার। শালা, তিন মাসের মধ্যে দু বার ফোন কিনেছি। চূড়ান্ত ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

--- প্ল্যাটফর্মটাই শালা চোরের রাজত্ব। দোকান থেকে পল্টু বলে।

খয়েরী সালোয়ার: গতকালই আমারটা গেছে।

নীল শার্ট বলে ভ্যাগিস কম টাকা ছিল। আমার পার্সটা ...।

স্টেশন মাইকে ঘোষণা হয় প্লাটফর্মে ট্রেন আসছে।

ভিড় ঠেলে বাইরে আসে লাল শার্ট। " হ্যাঁ ভগীরথদা এইমাত্র ট্রেন আসছে বলে ঘোষণা হলো।"

ট্রেন আসছে, ট্রেন আসছে, ট্রেন...।

চুরমার হয়ে যায় কৌতূহলী বলয়। আবার প্লাটফর্মের কিনারা ঘেঁসে জমাট বাঁধে মানব প্রাচীর। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপী শার্ট পজিশন নিয়েছে। রেডি, স্টেডি, গো। কালু আর পল্টু দৃষ্টি বিনিময় করে।

ওদিকে ফাঁকা হয়েছে চম্পার চারপাশ। দেখা যাচ্ছে চম্পাকে, ছটপট করছে জ্বালা যন্ত্রণায়। এই প্রথম চম্পাকে দেখতে পেয়েছে লাল শার্ট। ট্রেনে পা রাখার আগে ঝট করে চম্পাকে ধরে নেয় মোবাইলে। শেয়ার করে রামধনু ডেইলি প্যাসেঞ্জারস গ্রুপে। বাকিটা ভগীরথ দা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ