-- আমি অমল।
তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিল সবিতা। অমল চট করে ঘরে ঢুকেই দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। ...আজ রাতে একটু থাকতে দেবে মাসি?
-- অমল! এতো রাতে তুই কোথা থেকে এলি? কেন এলি এখানে? জানিস না ওরা তোকে খুঁজছে?
... খুঁজলে কি ঘরে আসবো না মাসি? মায়ের শরীর খারাপ। খবর পেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এলাম। কিন্তু রাতে বাড়িতে থাকা যাবে না। ওরা বাড়ির দিকে কড়া নজর রেখেছে।
অজানা আতঙ্কে সর্ব শরীর কেঁপে উঠলো সবিতার। ... এখন কী করবি?
-- রাত হয়েছে। এখন পালাতে পারবো না। দিনের আলো ফোটার আগে বেরিয়ে যাবো। ও তুমি চিন্তা কোরো না মাসি। আগে একটু জল খাওয়াবে?
সবিতা তাড়াতাড়ি ঠান্ডা জলের বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল-- কিন্তু তুই এখানে এলি, কেউ দেখে নি তো?
--আমি এসেছি বলে তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
-- হ্যাঁ পাচ্ছি, আমার জন্য নয়। তোর জন্য। তোর মায়ের জন্য। সে অসুস্থ। তোর কিছু হলে তোর মায়ের কী হবে?
-- আমার কিছু হবে না মাসি। এলাকায় কত লোক আমায় ভালোবাসে জানো? রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে ওরা আমায় মারতে পারে,দিনের বেলায় সাহস পাবে না। আমি সকাল বেলা হলেই পালিয়ে যাবো, ওরা টিকিও পাবে না।
সবিতার অস্বস্তি যেন কাটছে না। হাত পা কাঁপছে। একটা একটা করে জানালা বন্ধ করতে লাগলো। সদরের দরজার ওপাশে কোলাবসেবল গেটে তালা দিলো। ছাদের শিকল টেনে তাতে আরো একটা শক্তপোক্ত তালা ঝুলিয়ে দিলো। তারপর নিচে এসে বলল... বুঝিনা, কিসের আদর্শ তোদের? এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াস, কোন কাজের কথা এসব? সবাই তো চুরি করছে, ওপরতলায় যে যার ফায়দা বুঝে নিয়ে পা ফেলে। তোরা সাধারণ ঘরের ছেলে। বাবা মায়ের কত আশা তোদের নিয়ে। এসব তুই ছেড়ে দিতে পারিস না? তুই তো কত ভালো পড়াশুনায় ছিলি।
অমল হাসলো... সবাই যদি ভালো ছেলে হয়, রাজনীতি কে করবে মাসি? এই যে গ্রাম, উপর থেকে দেখে যা মনে হয় ভেতরে ঢুকলে বুঝবে ওদের দেখার কেউ নেই। ওদের শিক্ষা নেই, চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই, ওদের খাবার সংস্থান নেই, একটা টালমাটাল পরিস্থিতি দেশের। ওদের ঘরের মেয়েরা রাতে ঘুমোতে পারে না ভয়ে, কত মানুষ রাতের পর রাত বাড়ি ফেরে না। এই অবস্থায় আমরা ঘরে বসে থাকলে ওদের উপর বিপর্যয় কে ঠেকাবে?
#
দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল, আওয়াজটা বেশ জোরেই। ... কে আছেন? দরজাটা খুলুন।
কেঁপে উঠলো দুজনে। অমল বলল ... মাসি তুমি একদম শান্ত থাকো। ওরা যেন বুঝতে না পারে।
-- আচ্ছা, তুই ঘরের বাঙ্কের উপরে উঠে যা। আমি না বললে নামবি না।
সবিতা একটু তুতলিয়ে বলল... এতো রাতে কে? কী চাই।
-- আগে খুলুন, বলছি।
গ্রীলে তালা পড়ে গেছে তাই বাইরে থেকে কেউ হুট করে ঘরে ঢুকতে পারবে না। সন্তর্পনে দরজা খুলে সবিতা বলল --কী চাই আপনাদের?
-- ও মাসিমা, আমাকে চেনো? আমি পাড়ার নুটু। অমল এসেছে মাসিমা? এদিকেই এসেছে শুনেছি। পুলিশ খুঁজছে ওকে। ওর নামে অনেকগুলো কেস ঝুলছে জানো তো?একটুখানি দরজাটা খুলে দাও আমরা খুঁজে দেখি।
সবিতা রাগি রাগি মুখ করে বলল... এসব জেনে আমি কী করব? রাতের বেলায় একি উৎপাত! আমি একা মানুষ। আমার ঘরে কে আসবে? আমায় বিরক্ত কোর না।
কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি চলার পর ওরা ফিরে যাচ্ছিলো। নুটু বলল... মাসিমা ওইতো টেবিলের কাছে কার চপ্পল খোলা দেখছি। দেখে তো পুরুষ মানুষেরই জুতো মনে হচ্ছে। কার ওটা? দেখি দাও তো এদিকে।
--- ওমা! এতো তোদের মেসোমশাইয়ের চটি। বাজার যাবার সময় দেখি আমার চটিখানা একেবারে ছিঁড়ে গেছে। তাই বের করেছিলাম আরকি!
নুটু দাঁতে দাঁত চেপে কেমন একটা গা জ্বালানি হাসি দিয়ে বলল... দরজা ভালো করে বন্ধ করে দাও মাসি।
সবিতা তাড়াতাড়ি দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরে এলো। বলল... কী হবে? ওরা তো সন্দেহ করেছে বোধহয়। তোর চটিটা লুকানোর কথা কেন যে ভাবলাম না।
-- যা হয় হোক মাসি। এটা ওই নুটু, ছোটবেলায় একসাথে ফুটবল খেলতাম। আজ রাজনীতির দুকলম বুলি শিখে কে বা বন্ধু, কে বা পরমাত্মীয়। আমার জানর পেছনে হাত ধুয়ে পড়ে আছে। যেন ওটা চলে গেলে ওর শান্তি।
-- আমিও তাই ভাবছি, হ্যাঁ রে, দলই সব তোদের কাছে? মানুষের জীবনের কানাকড়ি মূল্য নেই, এ কোন আদর্শ তোদের? যদি বন্ধু নাও হোস, অপরিচিত হলেই এটা করা যায়? এই দিয়ে বুঝি দেশ সেবা হয়?
অমল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল... এমনটা ভাবতাম না মাসি। কিন্তু এখন তো সবাই বাধ্য, আমি ওকে না মারলে ও আমায় মেরে দেবে। যাই হোক, এখন লুকিয়ে থাকি। কাল দেখা যাক, ভোর হবার আগে কায়দা করে ঠিক বেরিয়ে যাবো।
সবিতা বলল-- কিছু খাবি? ঘরে তো তেমন কিছু নেই। তবু অল্প কিছু দিতে পারি।
-- না মাসি, প্রাণের ভয় থাকলে গলা দিয়ে খাবার নামে না। তুমি বরং অল্প মুড়ি থাকলে দাও।
সবিতা বলল-- ওকি! নিচে নামিস না বাপ। মুড়িটা খেয়ে, ওখানেই বালিশ দিচ্ছি শুয়ে পড়। কখন কি হয়, কখন জানলায় ধাক্কা দিয়ে খুলে দেয়। তুই বাঙ্কে শুলে ভয় থাকে না।
সারারাত দুচোখের পাতা এক হয়নি। অজানা আতঙ্কে হাত পা যেন পেটের মধ্যে গুটিয়ে আসছিলো। ভোরের দিকে চোখটা লেগেছে। আজ অবেলা পর্যন্ত ঘুমটা চোখ জড়িয়ে রেখেছে। আচমকা খুব কাছাকাছি কোথাও প্রচণ্ড বোমার আওয়াজে বাড়িঘর নড়ে উঠল। ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সবিতা। নির্বাচন এলেই হরদম অশান্তি যেন নাকে দম ধরিয়ে রাখে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভয়াবহ। কে জানে আবার কী হল? ঘুমের চোখে হঠাৎ যেন কিছুই ঠিক করতে পারল না। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই সবিতা ছুটে এঘরে এলো। বাঙ্ক খালি, সদর দরজাটাও একটু ফাঁকা করা রয়েছে। তাহলে অমল?
--হায় হায়! কেন বের হল এমন করে ও? আমি তো ওকে চলে যেতে বলিনি?
ঘরে বসে কত রকম কী ভাবনা আসছে, হঠাৎ পাশের বাড়ির মেয়েটা এসে ডাকাডাকি শুরু করল। ... ও মাসি, ওঠো ওঠো। খবর আছে।
সবিতা বসে বসেই বলল... কী হয়েছে রে?
-- বারে! পাড়ায় তো হৈচৈ পড়ে গিয়েছে মাসি। খুব খারাপ খবর। ওই যে গো নুটু! ওই মাঠের উপর কারা যেন মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। মার্ডার মার্ডার!
সবিতা কেঁপে উঠে বলল... নুটু? না না! এমন তো হবার ছিলো না? মনে মনে ভাবতে থাকল সবিতা। কে মারল ওকে? অমল কোথায় গেল? পালালো?
সবিতা ঢকঢক করে জল খেল একগ্লাস।কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল... হ্যাঁ রে, ওটা নুটু? তুই ঠিক দেখেছিস?
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন