বু তোমরা তো ম্যালাদিন পড়ে এপাকে আইস'নেন তা তোমার কতা কন ক্যানে?
উঠানে পুটির মা জবেদা বেগম তার দূর সম্পর্কের এক মামাতে বোনের সঙ্গে কথা বলছিল। জবেদার এই বোন শহরে থাকে, স্বামী ব্যবসা করে মোটামুটি ধনী পরিবার। ছেলে মেয়েরা বড় বড় স্কুলে পড়াশুনা করে। এদিকে কিছু জমি জমা কেনার জন্য মূলত তারা এখানে এসেছে।
উঠানে পুটির মা জবেদা বেগম তার দূর সম্পর্কের এক মামাতে বোনের সঙ্গে কথা বলছিল। জবেদার এই বোন শহরে থাকে, স্বামী ব্যবসা করে মোটামুটি ধনী পরিবার। ছেলে মেয়েরা বড় বড় স্কুলে পড়াশুনা করে। এদিকে কিছু জমি জমা কেনার জন্য মূলত তারা এখানে এসেছে।
- আমার আর কি কথা ভাই। এইতো তোমার দুলাভাই আর বাচ্চাদের নিয়ে ভালোই আছি। অনেক্ষণ কথা বললাম আজ থাকো ভাই আর একদিন আসবো, আমার মেয়েটার আবার টিচার আসবে।
- আর একনা বসলেন হয়, দুটা পিঠা বানে দিনু হয়, ধরি গেইলেন হয়।
- আরে না, পিঠা আর একদিন খাবো।
জবেদার স্বামী বছর খানেক হলো ঢাকায় কাজের জন্য গেছে। ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে তেমন একটা বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বৃদ্ধা শ্বাশুরীসহ বর্তমানে চার জনের সংসার। তার ছেলে রাজু এক হাজার টাকা মাইনে শহরের একটি গ্যারেজে কাজ করে। আর জোবেদা এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ কাম করে যা পায় তাই দিয়ে সংসার চলে। তাদের ভিটাবাড়িটা ছাড়া আর কোন জমি জমা নেই। শ্বাশুরীর বয়স হয়েছে কাজ কাম করতে পারেনা। মেয়েটা নিজ উৎসাহে হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ছে। জবেদা তার বোনকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে কলেরপাড়ে থালাবাসন মাজতে থাকে, এমন সময় লাঠিতে ভর করে জবেদার শাশুড়ী আসে। থালাবাসনগুলো ঘরে রেখে জোবেদা বলতে থাকে ...
- ক্যা মা তোমার এটা আক্কেল হইল! সাত সকালবেলা না কয়া কোটে গেইছেন।
জবেদার শ্বাশুরী লাঠিতে ভরদিয়ে মাটিতে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে - ক্যা তোর কি হইছে, মুই মরিগেইলে তো তুই বাচিস।
- এই হইলো তোমাক নিয়া জ্বালা, মুই ভাল কথাটা কনু আর তোমরা কি কবার নাগছেন?
- মুই তো ঠিকই কইছং। তুই ক্যা, মোর ব্যাটাও তো চায় মুই কোমব্যালা মরং। তা না হইলে মোর পেটের ছাওয়া মোর খবর নেয় না। আইতোত জারের ঠ্যালায় ঘুমবার পাং না, দুই ব্যালার খাবার এক ব্যালা খাওয়া খায়, এদোন করি আর কত চলে।
- থাক, তোমার সাতোত কতা কওয়া ফাও। মুই কনু তোমরা না কয়া কোনটে গেছেন, আর তোমরা হিস্টি শুরু কননে। মুই কি কখনো কইছোং তোমরা মরেন। বাড়িত বাপ মায়োক ফ্যালে এটে পড়ি আছোং, মুই মনে করং তোমরায় সগ, আর তোমরা...!
- আরে মন খারাপ করিস ক্যানে, মুইতো জানোং তুই মোক ক্যামন দেখিস। তুই না হয়া অন্য কোনো নাঙ্গের বেটি হইলে কুনদিন নাতথি দিয়া চলি গেইল হয়।
- তাও যে কন।
- আরে শোন মুই আক্কাছ মেম্বারের অটে গেছিনু।
- ক্যা আক্কাছ মেম্বারের অটে ক্যা।
- উয়াক কনু মোক একখান বয়স্কভাতার কাড করি দিবার।
- তোমরা আর কাম পাননাই, উয়ায় তোমাক কাড করি দিবে। যায় মজ্জিদের টাকা নিয়ে খায় তায় আবার মেম্বার।
- থো তো তোর কতা, মুই কবার কতা কইছোং দেখি দেয় কিনা। সেদিন কাশিয়াবাড়ির হাটোত মিটিং হইল না অটে চেয়ারম্যানেক কইছং। চেয়ারম্যান কয় এলা দুই বছরোত নাকি আর কাড হবার নয় কিন্তু মুই শুনলুং চুরি করি নাম নেকবার নাকছে অই জন্য তো গেছুং।
- তা মেম্বার কি কইল তোমাক।
- মেম্বারতো হামারগুলার সাগাই হয় মোর কতা কি ওয়ায় ফ্যালে দিবে। কইল, যা তোক চিন্তা করা খাবার নয়, কারো হয় হোক না হোক এইবার তোর একটা কাড করি দিম।
জবেদা চোখ আকাশে তুলে বলে - কন কি মা, তোমার কাড করি দিবে। উয়ার কতা মোর একদম বিশ্বাস হবার নাগছে না, হোক, যদি হয়তো ভাল।
■
পুটি স্কুল থেকে ফেরে। মেয়েটার জন্য জবেদা খুব মায়া হয়। মেয়েটা পড়া লেখায় খুব ভাল সে জন্য স্কুলের হেড মাস্টার ওর পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছে। যদিও মানুষে বলে কামলার বেটির ওতো পড়া লেখার কি দরকার কিন্তু জবেদা সে সব কথায় কান দেয় না। নিজে তো লেখাপড়া করতে পারেনি, তাই মেয়েটাকে যদি বেশি বেশি পড়াতে পারে সেই জন্য হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করলে তিনিই ওর মেয়ের পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়। ওর পড়ার খরচের ব্যাপারে চিন্তা করতে নিষেধ করেন। মেয়েটির উপবৃত্তিরও ব্যবস্থা করে দেন।
পুটি হাত মুখ ধুয়ে প্লেটে একটু ভাত নিয়ে ওর দাদির পাশে বসে খেতে থাকে। খেতে খেতে বলে
- দাদি, আমি শুনলাম পরশু দিন নাকি স্কুলের মাঠে কম্বল দিবে।
কথাটা শুনে পুটির দাদির চোখ দু’টো ছলাত করে ওঠে।
- কি কলু কম্বল দিবে, কায় দিবে।
- আমি তো তেমন কবার পাইনা। কায় যে এলা আইসে।
- তা কোমব্যালা দিবে! কিছু কবার পাইস।
- বিকাল বেলা দিবে।
- মোক ধরি যাইস তো ।
- হ আমি কাম পাইনাই তোমাক নিয়া যাই, আর আমার স্যার দেখলে খবর আছে।
- ও, তুই তো আবার শিক্ষিত হবার নাগছিস, তোর স্কুলত কম্বল আইনবার গেইলে মান সম্মান যাইবে।
- হ বুড়ি, তুমি বুঝনা আমি অফিসার হমু।
পুটির কথায় ওর মা হেসে উঠে। পুটির দাদি গোলেজান বেগম দুপুরের আগে এসেই স্কুলের পাশে তেঁতুল গাছটার নিচে বসে থাকে। তখনো কেউ আসেনি। দুপুর পার হতে না হতেই আস্তে আস্তে লোকজন আসতে শুরু করল। আসরের আজানের আগে দিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে শহর থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে স্কুল মাঠে থামতেই লোকজনের হুড়া হুড়ি শুরু হয়ে গেল। গাড়ি থেকে তিনজন মহিলা ও দুইজন পুরুষ নেমে আসতেই স্কুলের হেড মাস্টার, এই ওয়ার্ডের মেম্বার নতজানু হয়ে সালাম জানিয়ে স্কুলের হেড স্যারের রুমি নিয়ে বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পিয়ন আর আয়া মিলে প্লেট গ্লাস নিয়ে দৌঁড় ঝাপ শুরু করে দিল। এদিকে দুটো লোক এসে অপেক্ষমান লোকদের লাইন করে দাঁড়াতে বলল। এক লাইনে মহিলারা দাঁড়ালেন অন্যটা পুরুষদের জন্য। গোলেজান বেগম লাইনের প্রথমে ছিল, ধ্বাক্কা খেতে খেতে দশজনের পিছনে গিয়ে পড়েছে।
গোলেজান বেগম মনে মনে ভাবতে থাকে আজ রাতে কম্বলের ওমে একটু আরাম করে ঘুমাতে পারবে। কিছুক্ষণের মধ্যে শহরের অতিথিরা গাড়ি থেকে কম্বলগুলো সামনের টেবিলটাতে রেখে পেছনে একটা ব্যানার লাগিয়ে দাড়িয়ে পড়ল। মহিলাদের লাইনেই আগে কম্বল দেওয়া শুরু হলো, কম্বলগুলো অতিথিরা হাতে ধরে একজন মহিলার হাতে তুলে দিচ্ছেন আর দুজন সাংবাদিক ক্যাচ ক্যাচ করে ছবি তুলছে।
এক এক করে লাইনটা ছোট হচ্ছে গোলেজান বেগম এসে দাঁড়ালো, একজন মহিলা জিজ্ঞেস করল আপনার কার্ড দেন
- কি কন বাহে বোঝং না।
গোলজানের কথা শুনে মহিলারা হাসতে থাকে। ওর পেছন থেকে একজন মহিলা বলল- দাদি তোমারটে কোন কাগজ আছে।
- কিসের কাগজ মা।
একটা লোক ছুটে আসে- তোমরা যাও এ্যাইটে থেকে, তোমার তো কোন কাগজ নাই।
লোকটা গোলেজানকে টেনে নিয়ে যেতে চায়, গোলেজান ওখান থেকে নড়েনা। একসময় সে শহর থেকে আসা মহিলাদের পা ধরতে গেলে মহিলারা বাধা দিয়ে তার হাতে একটা লাল-কালো ডোরাকাটা কম্বল তুলে দেয়।
গোলজানের কথা শুনে মহিলারা হাসতে থাকে। ওর পেছন থেকে একজন মহিলা বলল- দাদি তোমারটে কোন কাগজ আছে।
- কিসের কাগজ মা।
একটা লোক ছুটে আসে- তোমরা যাও এ্যাইটে থেকে, তোমার তো কোন কাগজ নাই।
লোকটা গোলেজানকে টেনে নিয়ে যেতে চায়, গোলেজান ওখান থেকে নড়েনা। একসময় সে শহর থেকে আসা মহিলাদের পা ধরতে গেলে মহিলারা বাধা দিয়ে তার হাতে একটা লাল-কালো ডোরাকাটা কম্বল তুলে দেয়।
গোলেজানের চোখের পানি ঝড়তে থাকে। সে মহিলাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে মা
- তোমরা বাঁচি থাকেন মা! এই প্রথম একটা কম্বল পানু, বুড়া মানুষ কি করিম কন। জুয়ান মানুষগুলা সব পায় মুই কিছুই পাংনা। তোমরা কি আর একনা উপকার কইরবেন মাও।
- তোমরা বাঁচি থাকেন মা! এই প্রথম একটা কম্বল পানু, বুড়া মানুষ কি করিম কন। জুয়ান মানুষগুলা সব পায় মুই কিছুই পাংনা। তোমরা কি আর একনা উপকার কইরবেন মাও।
মহিলাটি বিরক্ত না হয়ে বলে- বলেন দেখি কি করতে হবে।
- মা, তোমরা একনা মেম্বারক কয়া মোর বয়স্কা ভাতার কাড করি দিবার পাইবেন! মুই খুব গরিব মানুষ মাও।
মহিলাটি মৃদু হেসে বলল- আপনি যদি বয়স্ক ভাতা না পান তো কে পাবে। বর্তমান সরকার আপনাদের দুঃখের কথা স্মরণ করে এই বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেছে। সে মেম্বারকে ডেকে বলে দিলেন যেন খুব দ্রুত এই বুড়িমার একটা বয়স্কভাতার কার্ড করে দিতে। মেম্বার জি জি বলে সব শুনলো।
গোলেজানের মনে আজ খুব আনন্দ। এতো কথা সে যে বলতে পারবে ভাবতেও পারেনি। মহিলাটা খুবই ভাল, এতো বড় মানুষ কোন রাগ অহংকার নেই। যদি সে এবার কার্ডটা পায় তা হলে পাঁচটা মসজিদে দিবে। কম্বলটা কয়েক বার নাকের কাছে চেপে শ্বাস ভরে গন্ধটা নিয়েছে। কতো নরম এটা, গায়ে দিলে ঠান্ডা আর কাছেই আসতে পারবে না এমনটা চিন্তা করতে করতে সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে পৌছল।
■
এদিকে গোলেজানের শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে। প্রতিদিন গোলেজান আশায় থাকে এই বুঝি বয়স্কভাতার একটা কার্ড পায় কিন্তু একটা সবুজ কার্ডের আর দেখা পায়না। সেদিন ঘটনাটা এমনভাবে ঘটবে কেউ বুঝতেই পারেনি। গোলেজান বিছানা থেকে তেমন একটা নড়া চড়া করতে পারেনা। পুটি স্কুল থেকে এসে খবর দিলো চেয়ারম্যান দাদিকে দেখা করতে বলেছে। গোলেজানের ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যাবার মতো আর ক্ষমতা নেই, তাই পরদিন জবেদা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে গেলে তাকে গোলেজানের নামের একটি বয়স্কভাতার কার্ড দেয়। জোবেদা মনে মনে ভাবে যাক শাশুড়ি তাহলে এবার মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা পাবে। এরকমটা ভাবতে ভাবতে জবেদা বাড়ি ফেরে। বাড়ির বাহির থেকে তার শাশুড়ি কে ডাকতে থাকে -
এদিকে গোলেজানের শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে। প্রতিদিন গোলেজান আশায় থাকে এই বুঝি বয়স্কভাতার একটা কার্ড পায় কিন্তু একটা সবুজ কার্ডের আর দেখা পায়না। সেদিন ঘটনাটা এমনভাবে ঘটবে কেউ বুঝতেই পারেনি। গোলেজান বিছানা থেকে তেমন একটা নড়া চড়া করতে পারেনা। পুটি স্কুল থেকে এসে খবর দিলো চেয়ারম্যান দাদিকে দেখা করতে বলেছে। গোলেজানের ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যাবার মতো আর ক্ষমতা নেই, তাই পরদিন জবেদা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে গেলে তাকে গোলেজানের নামের একটি বয়স্কভাতার কার্ড দেয়। জোবেদা মনে মনে ভাবে যাক শাশুড়ি তাহলে এবার মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা পাবে। এরকমটা ভাবতে ভাবতে জবেদা বাড়ি ফেরে। বাড়ির বাহির থেকে তার শাশুড়ি কে ডাকতে থাকে -
- মা, মা কোনটে তোমরা, এই দ্যাখি যাও তোমার নামের কার্ড আসছে।
গোলেজানের কোন সাড়া শব্দ পায় না। জবেদা ঘরে এসে দেখে শ্বাশুরী ঘুমিয়ে আছে। অনেক চিন্তাভাবনা করে, তাকে ডাকবে কি না। কিন্তু খুশির খবরটা তো চেপে রাখতে পারছে না।
-পুটি দেকতো মা তোর দাদি নিন্দাইল নাকি।
পুটি ঘরে এসে দাদিকে ডাকতে থাকে, কিন্তু সে কোন সাড়া দেয় না। পুটি গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে ডাকতে গেলে দেখে, সমস্ত শরির ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেছে। পুটি চিৎকার করে মাকে ডাকে। জমেলা কার্ডটা হাতে নিয়েই দৌড়ে আসে, সে শাশুড়ির বুকে আছড়ে পড়ে। হাত থেকে বয়স্ক ভাতার কার্ডটি মাটিতে পড়ে যায়। চিৎকারে এ বাড়ি ও বাড়ির লোকজন দৌড়ে আসে।
পুটি ঘরে এসে দাদিকে ডাকতে থাকে, কিন্তু সে কোন সাড়া দেয় না। পুটি গায়ে হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে ডাকতে গেলে দেখে, সমস্ত শরির ঠান্ডায় বরফ হয়ে গেছে। পুটি চিৎকার করে মাকে ডাকে। জমেলা কার্ডটা হাতে নিয়েই দৌড়ে আসে, সে শাশুড়ির বুকে আছড়ে পড়ে। হাত থেকে বয়স্ক ভাতার কার্ডটি মাটিতে পড়ে যায়। চিৎকারে এ বাড়ি ও বাড়ির লোকজন দৌড়ে আসে।
বয়স্কভাতার কার্ডটি মানুষের পায়ে দলিত হতে থাকে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন