রিঙ্কি বোস সেন | Some Random Thoughts & Some Confessions...

রিঙ্কি বোস সেন | Some Random Thoughts & Some Confessions...


ঘটনা ১-

কিছুদিন আগে একটি জেন্টস্ গারমেন্টেসে্র এয়ার কন্ডিশনড্ শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, কন্যাসহ। শোরুমের ভিতরে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। তাই মা আর বাবাকে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা বাইরেই থেকে যাই। গরম ছিল, ঘাম হচ্ছিল। তার মধ্যে কন্যার ভিতরে যাবার ছটফটানিও সামলাতে হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি তিরিশ ছুঁই ছুঁই দুই ভাই ( সম্ভবত যমজ) কাচের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কী একটা বলাবলি করল। তারপর তাদের মা'কে কিছু বলে দুজনেই একসাথে বেরিয়ে এসে আমায় বলল,

_"যান দিদি, ভিতরে যান"।

আমি যাবো তার আগেই কন্যা পোঁওও করে ঢুকে গেল। পিছু পিছু আমিও ঢুকলাম। ছেলেদুটির মা তখনও ভিতরে, আরও মিনিট পনেরো লাগলো তার জিনিস ফাইনাল করে, পেইমেন্ট করে বেরিয়ে যেতে। ততক্ষণ ছেলেদুটো বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল।


ঘটনা ২-

বৃহস্পতিবার বর্ধমানে মাছের আড়ৎ বন্ধ থাকে। এদিকে গেল বৃহস্পতিবার বাড়িতে মাছ শেষ। যে দুই দাদা বাড়িতে এসে মাছ দিয়ে যান তারাও সেইদিন আসবেন না, জানতাম। অগত্যা গেলাম বাজারে। সবজি বাজার গেলে আমি আবার ভীষণভাবে প্রলোভনে পড়ে যাই। নানারকম সবজির তরকারি খুব ভালোবাসি। ব্যাস মাছের সাথে 'টাছ' হয়ে গেল প্রচুর। থলে পুরো কানা পর্যন্ত ভর্তি। আসার পথে রিক্সও পেলাম না। বাড়ি যদিও বাজার থেকে হাঁটাপথ কিন্তু অত ভারি ব্যাগ নিয়ে হাঁটা সহজ ছিল না। থলে একবার এই হাতে, একবার ওইহাতে করে টুকুস টুকুস করে হাঁটছি। হঠাৎ পিছন থেকে এক মহিলা কন্ঠ।

_" ও দিদিভাই তুমি কতদূর যাবে, এই যে আমি নেমে যাচ্ছি, আমার বাড়ি এই যে সামনেই...ও ভাই তুমি এনাকে দিয়ে এসো।"

দেখি আমার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেক বড় এক মহিলা রিক্স থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে হনহন করে বাঁপাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

উপরের দুটি ঘটনারই সকল পাত্র/পাত্রী আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। এর আগে আমি কোনোদিন তাদের দেখিনি, হয়তো কোনোদিন দেখতেও পাবো না। তার চেয়েও বড় কথা দেখা যদি হয়েও যায় কেউই কারোকে চিনতে পারবো না। কিন্তু তবুও তাদের নিয়ে লিখছি। কেন লিখছি? কারণ তাদের ছোট্টো একটা আচরণ আর মস্ত বড় একটা বোধ আমাকে ভাবিয়েছে, আমাকে ছুঁয়ে গেছে। একটু যাতে আরাম পাই গরমের হাত থেকে বা একটু যাতে থলে ভর্তি জিনিসের ভার থেকে রেহাই পাই, সেই ভেবে ওই অপরিচিত মানুষগুলো তাদের নিজেদের সুবিধাটুকু, আরামটুকু ছেড়ে দিয়েছিলেন। সামান্য একটু বোধ আর সেখান থেকে সামান্য একটু ত্যাগ... কী ব্যপক তার প্রভাব।


এই গভীর বোধ, এই সূক্ষ্ম অনুভূতি আর এই সুন্দর অভিব্যক্তি...এ সবকিছুকে আমি যে ইংরাজি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করব তা হল sincerity, বাংলায় এর সঠিক শব্দ কী হবে জানি না। সচেতনতা? আন্তরিকতা? তবে যাইহোক না কেন এইটুকু বলা যায় যে এর জন্য আত্মিক সম্পর্কযুক্ত হতেই হবে তা নয়, ঘনিষ্ঠ হতেই হবে তাও নয়। বরং সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়েও এমন সুন্দর করে sincere যে হওয়া যায় তা তো উপরে উল্লিখিত ঘটনাগুলিই প্রমাণ করে দেয়।

কিন্তু আমরা সবাই সবসময় তা পারি না। কেন? আমি সবসময় তা পারি না। কেন? আসলে আমরা অনেকেই বড্ড উদাসীন, বড্ড অন্যমনস্ক। খুব তাড়াতাড়ি অনেককিছু ভুলে যাই, যা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়। আবার যা কিছু ভুলে যাওয়া উচিৎ সেইসব 'জঞ্জাল' সযত্নে মনের আনাচে-কানাচে লালন করি। কী অদ্ভুত না? আমাদের ছোটবেলায় শেখানো হয়, 'কেউ কিছু দিলে, বা কোনো হেল্প করলে থ্যাংক ইউ বলবে'। কিন্তু বড় হতে হতে আমরা সেই পাঠ ভুলে যাই, 'থ্যাংক ইউ' বলার অভ্যাস হারিয়ে ফেলি। অথচ মজার কথা হল, এই আমরাই আবার ছোটো ছেলেমেয়ে দেখলেই তাদের শেখাই, 'কেউ কিছু দিলে বা কোনো হেল্প করলে থ্যাংক ইউ বলবে'।

সুতরাং যা শিখি তা অভ্যাস করি না আর যা অভ্যাস করি তা তো শিখিনি। আমি নিজেও তো পারতাম ঠান্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে ছেলেদুটিকে 'থ্যাংক ইউ' বলতে। বলা হয়নি। ঐ মহিলাটিকেও তো বলা যেতো।বলা হয়নি। শুধু তাই নয় এমন কত মানুষ আছেন যাদের আমার 'থ্যাংক ইউ' বলা বাকি। ছোট্টো ছোট্ট থেকে বড় বড় স্বস্তি যাদের মাধ্যমে আমি পেয়েছি, তাদের কথা কই তেমন করে মনে পড়ে না তো! আসলে ঐ যে বললাম আমরা সেই সবকিছু ভুলে যাই যা ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়। আর যা কিছু ভুলে যাওয়া উচিৎ...।

এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার কথা বলি, এই সেইদিন একজন বয়সে আমার থেকে ছোটো এক সহকর্মী, সকালে আমায় ফোন করে জানালো যে তার ক্লাসগুলোকে যদি সামান্য এদিকওদিক করা যায় তাহলে খুব ভালো হয় কারণ তার বাচ্চা খুব কাঁদছে, তাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, ছাড়ছে না।' কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেরকমই একটা ব্যবস্থা করা হয়। পরে সেই দিদিমণি এসে আমায় বলে, ' থ্যাংক ইউ রিঙ্কিদি'।

চমকে উঠি। তেমন তো কিছুই করিনি যে 'থ্যাংক ইউ' শুনবো। কিন্তু তারপর মনে হল আমি যদি তার জায়গায় থাকতাম তাহলে কী করতাম? থ্যাংক ইউ বলতাম? বলতাম না? ঠিক এই জায়গাটায় গিয়েই বুঝলাম চমকে ওঠার প্রকৃত কারণ। অভ্যাসটাই যে হারিয়ে ফেলেছি আমরা, 'থ্যাংক ইউ' বলার। আর তাই তো কেউ বললে সেটা কানের কাছে কেমন যেন বেজে উঠছে। অথচ প্রতি নিয়ত কত এমন মুহুর্ত আসে চলার পথে, যখন আশেপাশের মানুষগুলোকে গিয়ে বলাই যায় 'তুই/তুমি/আপনি আমার বেশ উপকার করলি/করলে/করলেন'।

আসলে আমরা খুব দ্রুত ছুটছি মনে হয়। কখনো কখনো মনে হয় একটু চুপ করে, বেশিক্ষণ না, খুব অল্পক্ষণ হলেও একটু চুপ করে বসা দরকার... একা, একদম একা। বসে বসে এলোপাথাড়ি যাহোক কিছু ভাবা, মনে করা। এই প্রসঙ্গে বলি নিজের সাথে নিজে কথা বলা একটা দারুণ ব্যাপার। অনেকেরই এই অভ্যাস আছে। হয়তো প্রকাশ্যে বলতে চাইবেন না। কিন্তু এটা খুব ভালো একটা অভ্যাস বলে আমার বিশ্বাস।

কষ্ট হলে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে বলা যায়,

_'অনেক কেঁদেছিদ আর কাঁদিস না'।

রাগ হলে বোঝানো যায়,

_ 'ধুর অত রাগ করিস না তো, বাদ দে।'

এই অভ্যাসে নিজের ভুলগুলোও খুব স্পষ্ট করে দেখা যায়, আর তখন নিজেই নিজেকে বলা যায়,

_ 'ছি: এটা আমি কী করলাম!'। এই নিজের সাথে নিজে কথা বলা একধরনের থেরাপি৷ এতে অনেক বিষয় যেমন স্পষ্ট হয় তেমন অনেককিছু সহজও হয়ে যায়, বিশেষ করে সম্পর্কগুলো। কারণ সম্পর্ক, তা সে যে আকার,আকৃতি, বর্ণ,গন্ধের হোক না কেন প্রবাহিত হয় সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতি-অভিব্যক্তির শিরা-উপশিরা দিয়ে।

শেষ করব আরেকটি ঘটনা দিয়ে। ক্লাস ফাইভের একটি বাচ্চা একদিন বড়দিমণির কাছে অভিভাবকসহ এসে অভিযোগ করে যে তাকে তার ক্লাসের দুই সহপাঠী প্রতিদিন সুযোগ পেলেই মারছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা চমকে উঠি, রীতিমতো খোঁজ খবর নিই। তাতে জানতে পারি ঐ অভিযোগকারী বাচ্চাটির মধ্যে মনগড়া ঘটনা বলার একটা প্রবণতা আছে। বাচ্চাটির মা-বাবাকে ডেকে কথাবার্তা বলে জানতে পারা যায় বাচ্চাটি বাড়িতে তার নিজের ভাইয়ের কাছে মার খায় আর তা মা ভাইয়ের প্রতি অপ্রয়োজনীয় প্রশ্রয় দেখিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকেই শাস্তি দেয়। এই থেকেই ওর মধ্যে এক অসুস্থ মানসিকতা তৈরি হয়েছে যার দরুন সে ক্লাসের সবচেয়ে ভালো দুই সহপাঠীর নামে দোষ চাপিয়েছে, সবার মনোযোগ তথা সহানুভূতি পাবার উদ্দেশ্যে।

আমরা দিদিমণিরা নিজেদের মত করে বাচ্চাটিকে বোঝাই। একদিন ক্লাসে গিয়ে আমি ওকে ডেকে বলি,

_" দ্যাখ, সবাই বলছে সোনালি ( পরিবর্তিত নাম) খুব দুষ্টু মেয়ে, শুনতে ভালো লাগছে কি? তুই বরং প্রমিস কর এই দু সপ্তাহ কোনো দুষ্টুমি করবি না, যতটা পারবি ভালো মেয়ের মত থাকবি, যাতে যখন তোর বন্ধুদের জিগ্যেস করব তখন যেন গোটা ক্লাস বলে, সোনালি ভালো মেয়ে হয়ে গেছে,আর দুষ্টুমি করে না। পারবি? করে দেখিয়ে দে তো সবাইকে।"

এর মাঝে বলে রাখি, মেয়েটি যে দুই সহপাঠীর উপর দোষ চাপিয়েছিল তাদের মধ্যে একজনের মা বাকি বাচ্চাদের কাছ থেকে নিজের মেয়ের নামে অভিযোগ শুনেই, আদ্যপ্রান্ত না জেনেই মেয়েকে বাড়ি ফেরার পথে সকলের সামনে দিয়েছিল দুই ঘা।

তা যাইহোক, বেশ কিছুদিন বাদ আমি ক্লাসে জিগ্যেস করি,

_"সোনালি এখনও দুষ্টু আছে না ভালো মেয়ে হয়ে গেছে।"

আমাকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে সোনালির সেই সহপাঠী, যে তার মার কাছে মিথ্যে অভিযোগে সবার মাঝে মার খেয়েছিল, উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

_"মিস সোনালি আগের থেকে অনেকটা ভালো হয়েছে, আরও একটু হতে হবে।"

অবিশ্বাস্য! একটা ছোট্ট মেয়ের এত্ত বড় মন! যাকে সহপাঠীর মিথ্যে অভিযোগের কারণে সবার সামনে অসম্মানিত হতে হয়েছে সেই কিনা সহপাঠীর জন্য উঠে দাঁড়িয়ে তার সম্পর্কে সদর্থক খবর দিচ্ছে! বেশ কিচ্ছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, বললাম, 'তুই মস্ত বড় কাজ করলি, তুই একজন প্রকৃত বন্ধুর মত কাজ করলি'।

আমরা পারবো এমন? আমি পারবো? অথচ এমনটাই তো হওয়া উচিৎ। কারণ আমরা তো ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি এবং এখন ছোটদের শোনাই যে, 'সে অধম হইলে আমি উত্তম হইব না কেন?'

শুরু মোটামুটি sincerity দিয়ে করেছিলাম। শেষও তাই দিয়ে করব। এই sincerity সবার কাছ থেকে আশা করা যায় না, দাবী করা তো যায়ই না। এই বোধ যার থাকে তার থাকে। কিন্তু যার থাকে না তার কোনোদিনই থাকবে না তা বোধহয় নয়। কিন্তু তার জন্য তার ঐ নিজের সাথে নিজে একটু বসা খুব জরুরি। অনুভূতি, সহানুভূতি আছে আমাদের সকলেরই অন্তরে। শুধু সচেতন হতে ভুলে যাই কখনো সখনো। এটাও আসে অভ্যাস করলে।

তবে একটা কথা খুব বিশ্বাস করি প্রতিটি sincere act ঘুরে ঠিক আসে,বিফলে যায় না। হয়তো সেখান থেকে আসে না যেখান থেকে আসবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, বরং সেখান থেকে আসে যেখানে তাকিয়েও দেখিনি। কারণ হল প্রকৃতি, যাকে universe ও বলতে পারি, সে কিন্তু উদাসীন নয়, অন্যমনস্ক নয়। সে সব দেখে, নোটবুকে লিখে রাখে, সময় এলে রিপোর্ট কার্ড দেয়, খুশি হলে বোনাস পয়েন্টও দেয়।

So every sincere act is an act of worth, therefore never goes in vain, NEVER!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ