🇮🇳 সুমনা সাহা | ছাতা

মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এসে অটোটা দাঁড়িয়ে গেল। বাকি পথটুকু হেঁটে যেতে হবে। জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা এসেছেন গুণ্ডিচাবাড়ি। এখানে কয়েক দিন থেকে আবার উল্টোরথের দিন পুরীর মন্দিরে ফিরবেন। গুণ্ডিচাবাড়ি এসে জগন্নাথ দর্শন করলে ব্রজধামে কৃষ্ণ-দর্শনের ফল মেলে। সুপ্রিয়া আর অয়ন অটো থেকে নামলো। মোটা মোটা দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়েছে। চারমাথার এই মোড় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে জগন্নাথ দর্শন করতে হবে। ওরা সবেমাত্র নেমেছে, আর হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টি একেবারে মাটি কাটা বৃষ্টি। মোটা মোটা বৃষ্টির দানা যেন ঢিল পড়ার মত লাগছে। গত দুদিন আকাশে মেঘ থম মেরে ছিল। অসহ্য গুমোট গরমে হাঁসফাঁস করেছে মানুষ। আজ যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে জানাই ছিল। এখন বৃষ্টিতে ভিজলে ভেজা জামা কাপড়ে অতক্ষণ থাকতে হবে, তাই ওরা দুজনে ছুট লাগালো। সামনেই একটা দোকানের বড় শেড এর নিচে অনেক লোক বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে। ওরাও সেই দিকে ছুটলো। ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। দুটো গরু, চারটে কুকুরও রয়েছে। কেউ তাদের তাড়ায়নি। আহা অবোলা জীব! সুপ্রিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পশুর গায়ের ভেজা লোমের গন্ধ, বহু লোকের মিশ্র ঘামের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ সব মিলে একটা বিকট গন্ধে ওর বমি পাচ্ছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় সুপ্রিয়ার একেবারে ভালো লাগে না। ভিড়ের ভয়ে ও আজকাল কোন মেলায় যেতেও চায় না। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখতেও ভালো লাগে না। ভিড়ের মধ্যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে, আর দিন দিন এই ভিড় এলার্জিটা বেড়েই চলেছে।

উৎকট গন্ধে ক্রমে বোধ বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। একটানা বৃষ্টি থামারও নাম নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সুপ্রিয়ার মনে পড়ছিল অনেক ছোটবেলায় চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে যাওয়ার কথা। প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকতেই কাতারে কাতারে লোক ছুটছে ট্রেনে উঠবে বলে। কামরার পাদানি থেকে লোক ঝুলছে দেখে আতঙ্কে সুপ্রিয়া কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মা আর দাদা ওর হাত ধরে টানছিল সমানে, ‘চল ওঠার চেষ্টা করতে হবে তো! ভেতরে গেলে দেখবি ফাঁকা। বাইরে থেকেই অমন লাগছে।’ কিন্তু সুপ্রিয়া কিছুতেই ভিড় ঠেলে ট্রেনের ভেতর ঢুকতে পারেনি। পরপর দুটো ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর বাবা বকতে লাগলো, বলল, ‘এরপর আর গাড়ি পাবো না। পরেরটায় কিন্তু উঠতেই হবে।’ সুপ্রিয়ার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। তৃতীয় ট্রেন এলো। এটা আরও ভিড়। বাবা জোর করে শক্ত করে হাত ধরে গুঁতিয়ে সুপ্রিয়াকে তুলে দিল ট্রেনের ভিতরে। চারপাশে ভিড়ের মাঝখানে বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে ছোট্ট সুপ্রিয়া ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো, ‘আমাকে নামিয়ে দাও, আমি মরে যাব!’ সবাই সান্ত্বনা দিতে আরম্ভ করলো, ‘একটু সহ্য কর খুকি, টেশন এসে গেলেই তো সবাই নেমে যাবে। তুমি ঠাকুর দেখতে যাচ্ছ তো? দেখবে কত সুন্দর লাইটিং!’ সুপ্রিয়া তবু কাঁদতে থাকে, ‘বাবা আমাকে নামিয়ে দাও, আমি বাড়ি যাব। আমি ঠাকুর দেখব না।’ ওর কান্নাকাটি দেখে কিছু লোক বলল, ‘বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। আপনারা সামনের স্টেশনে নেমে যান।’ বাবা মা দাদা সবাই সেদিন সুপ্রিয়ার উপর রাগ করেছিল। স্টেশনে বসে ফুরফুরে হাওয়ায় ঝালমুড়ি আর চা খেয়ে সুপ্রিয়ার সুস্থ লাগছিল সেদিন। ওরা উল্টোদিকের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। দাদা বলেছিল, ‘তোর জন্য চন্দননগরের লাইটিং দেখা হলো না! দাঁড়া, কালকে আমি বন্ধুদের সঙ্গে একলাই চলে যাব।’

সুপ্রিয়ার মনে পড়ে গেল প্রিয় সাহিত্যিকের প্রিয় উপন্যাসের কথা। সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-র শেষটা। পড়লে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। কোন পক্ষই যখন পাশে থাকে না...!

“… অনেকগুলো চোখকে যেন আমি জ্বলতে দেখছি আমার দিকে, যেন আমাকে ছিঁড়ে খাবে। বড়দা মেজদা কোথায়। মিছিলের মধ্যে নাকি। ওরা প্রায় মুখোমুখি এসে গেছে, আর ঠিক তখনই, কোথা থেকে একটা আধলা ইট আমার মাথায় এসে পড়লো। কে যেন বললো, ‘মার ওকে।’ দেখতেই পেলাম না, কারা মারামারি করছে, কারণ আমার মাথা ফেটে চোখের ওপর দিয়ে রক্ত পড়ছিল, আমি দোকানের দরজায় হেলান দিলাম, বোধ হয় আবার সেলাই করতে হবে—কিন্তু আহ্, আমি খালি একটা আগুনের ঝিলিক দেখলাম চোখের সামনে, আর কান ফেটে যাওয়া একটা শব্দ। মনে হল, একটা ঝটকা লাগলো, আর ডানদিকের কী যেন একটা হালকা হয়ে গেল আমার শরীর থেকে, ডান চোখ দিয়ে একবার এক পলকেই দেখে বুঝলাম, আমার ঘড়ি-পরা ডান হাতটা নর্দমায় পড়ে গেল। কারা মারলো—আচ্ছা সেই প্রজাপতিটার কথা আমার মনে পড়লো... বাবার গলা শুনতে পাচ্ছি, ‘তুমি বলতে চাও তোমার দল মারেনি?’ ‘না। আপনি নিকুকে জিজ্ঞেস করুন, ওরাই টুকুকে বোমা ছুঁড়ে মেরেছে। তা নইলে আমি হাসপাতালে আসতাম না।’
মেজদার গলাও শোনা গেল, ‘হাসপাতালে তো আমিও এসেছি। টুকুকে তোরাই মেরেছিস।’ 

ওরা আমাকে এখনো ‘টুকু’ বলছে—মানে আমি তো সত্যি ওদের ভাই।” 

শব্দের মিছিল প্রতিদিন

ছাতার কাজ মাথা বাঁচানো। সে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোই হোক বা রাজনৈতিক সুরক্ষাই হোক, ছাতা মানে নিরাপদ আশ্রয়, নিরাপত্তার ঘেরাটোপ। ছাতা একটা দরকার, রোদে, বৃষ্টিতে ছাতার নিচে আসতে হয়। একটা ছাতার নিচে অনেক লোক। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অনেক লোক। বিড়ির গন্ধ, ঘামের গন্ধ, দম বন্ধ করে সহ্য করা। বাইরে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। লোক বাড়ছে। গরম আর অস্বস্তিও বাড়ছে। তবু ছাতার বাইরে যাওয়ার সাহস হয় না, বাইরে গেলে ভিজতে হবে। ধীরে ধীরে আরও কয়েকটা কুকুর ঢুকে পড়ল ছাতার নিচে। ওদের কেউ তাড়ালো না। আহা, কুকুর বলে কি... খ্যাট খ্যাট করে গা ঝাঁকুনি দিয়ে জল ঝাড়লো। তাতে ঘেয়ো কুকুরের লোমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। হেলেদুলে দুটো গরু এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ছাতার ঘেরে। আহা, অবোলা জীব। ভিজবে ক্যানো? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চড় চড় করে পেচ্ছাপ করে দিলো। একটু সরে সরে গেল সকলেই। তাতে আরও ঘেঁষাঘেঁষি। পাশে লাল চোখো এক ষণ্ডা। মদের গন্ধ আসছে গা থেকে। তবু তো ছাতার নিচে মাথা বাঁচছে? ছাতা মানেই সমবেত শক্তি। সেই শক্তি মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে উচ্চস্বরে জয়ধ্বনি দেওয়ায় আরও পোক্ত হয়, তা ‘জয় শ্রীরাম’ হতে পারে, ‘আল্লা হো’ হতে পারে, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ হতে পারে। মোট কথা যারা মাথা বাঁচানোর ছাতা পাচ্ছ, তারা একসাথে হাত তুলবে। রাজনীতির ময়দান থেকে আরম্ভ করে খেলার মাঠে, মন্দিরে, মসজিদে, সাহিত্যের আঙিনায় সর্বত্রই ছাতায় ছাতায় ছত্রাকার। মাথা গলিয়ে দিন ছাতার নিচে আর দলে ঢুকে পড়ুন। আপনার দল নেই? তাহলে আপনি একা। আপনি বোকা। আপনি ঠকা। বেশ, তাই হোক। তবুও এই ঘেঁষাঘেঁষির মধ্যে দমবন্ধ করে আর থাকা যাচ্ছে না। সুপ্রিয়া বললো, ‘অয়ন, আমি আর পারছি না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি বাইরে যাচ্ছি।’ অয়ন বললো, ‘কিন্তু বৃষ্টি তো এখনো থামেনি। ভিজে যাব যে!’ ‘ভিজলে ভিজব। আমি এগোলাম। তুমিও এসো।’ সুপ্রিয়া সত্যি সত্যিই হাঁটা দিল। এই তো একটুখানি পথ। না হয় ভিজবে। তা বলে অস্বস্তি নিয়ে থাকা? ওর দেখাদেখি অয়নও দোনোমোনো করে বেরিয়ে এল। ওদের দুজনকে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে হাঁটতে দেখে ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল, যার অর্থ এটাই, ‘একি! আপনি ছাতার আশ্রয় ছেড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছেন? আপনি বৃষ্টির মধ্যে পথে নামছেন?’ তারপর সকলেই সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের চলে যাওয়া দেখছিল। সত্যি বলতে কি, ওরা ভাবছিল, ‘খোলা আকাশের নিচে একলা আপনাকে বৃষ্টিতে নিশ্চিন্তে ভিজতে দেখে কী যে হিংসে হচ্ছে! মোদো মাতালের সঙ্গে বিরক্তিকর গা ঘেঁষাঘেঁষি, মিশ্র ঘামের ঝাঁঝালো গন্ধ, গরুর পেচ্ছাপ এসব কিছুই আপনাকে আর সহ্য করতে হবে না। আপনি ভিজতে ভয় পান না। 

বাইরে বেরিয়ে দু’পা হাঁটতে না হাঁটতেই দুজনেই ভিজে জাব্বুস হয়ে গেল। রাস্তার উপর অনেক হকার বসে আছে, ওদের মধ্যে কেউ কেউ জিনিসপত্রের উপর নীল-হলুদ নানা রঙের প্লাস্টিকের চাদর ঢাকা দিয়ে নিজেরা ছাতা মাথায় দিয়ে বসে আছে, কেউ কেউ একটু দূরে কোন বড় দোকানের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে নিজের দোকানের উপর লক্ষ্য রাখছে। ওদের দেখেই হাতে লাল-নীল রংবেরঙের ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হকাররা চেঁচিয়ে উঠলো, “আসো আসো ধাইকিরি কিরি আসো, শস্তায় মজবুত টেঁকসই ছাতা। ছাতা নাও, মাথা বাঁচাও।” সুপ্রিয়ার নাকের পাটা ফুলে উঠল, “একটা না একটা ছাতার তলায় আসতেই হবে, তাই না?...লাল হোক, নীল হোক, হলুদ হোক, ছাতা একটা নিতেই হবে?” অয়ন বললো, “বেকার বৃষ্টিতে ভিজবে কেন, ছাতা যখন শস্তায় পাওয়া যাচ্ছে?” সুপ্রিয়া বিড়বিড় করে, “নইলে তোমার গায়ে যে কোন পক্ষই বোমা ছুঁড়ে দিতে পারে, তুমি তো কোন পক্ষেরই নও!... মন্দিরে-মসজিদে, মাঠে-ময়দান, সাহিত্য-সভায় বা গানের আসরে... তোমার কোন ব্র্যান্ডের ছাতা? কোন ছাতাই ব্যবহার করো না? তাহলে তুমি মরো।” অয়ন বিরক্ত হয়ে বললো, “কী বিড়বিড় করছ? জেদ কোরো না, এসো, আরও কিছুক্ষণ দোকানের সামনে দাঁড়াই।” সুপ্রিয়ার কানে যেন কোন কথাই ঢুকলো না। অয়ন দেখলো, বৃষ্টির অঝোর ধারার মধ্যে সুপ্রিয়া ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল। বৃষ্টি এখনও থামেনি। অয়ন একটা ছাতা কিনেছে। কিন্তু তাতেও ভিজে যাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। তাই ছাতা দিয়ে নিজের শরীর খানিকটা আড়াল করে একটা বড় দোকানের শেডের নিচে আরও অনেকের সঙ্গে ঠেসাঠেসি করে  দাঁড়িয়ে আছে। সুরক্ষিত হয়ে অপেক্ষা করছে, কখন বৃষ্টি থামবে, কখন গন্তব্যে পৌঁছবে। সুপ্রিয়া বোধহয় ভিজতে ভিজতে এতক্ষণে যেখানে যাওয়ার, পৌঁছেই গেল!   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ