---- দাদুন, তোমার ড্যাড আই মিন বড়দাদুনের রিভলবার ছিল?
---- রিভলবার? না তো দিদিভাই!
---- সোর্ড?
---- উঁ হুঁ!
---- এনি নাইফ!
---- না! কেন বলো তো?
---- বম্বও ছিল না?
---- না, ওসব কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন এসব তুমি জানতে চাইছো দিদিভাই?
---- তাহলে ফাইট কী করে করতো? কোন ওয়েপনস দিয়ে মারতো এনিমিকে?
---- হো হো হো......!
---- হাসছো কেন? তুমি তো বললে, তোমার ড্যাড ফাইটার ছিল?
---- ফাইটার নয়, ফ্রিডম ফাইটার। এঁরা যত না অস্ত্র ধরে যুদ্ধ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে লড়াই করেছেন। ইংরেজদের নাস্তানাবুদ করে ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছেন। তুমি তোমার হিস্ট্রি বইতে পড়ো নি, সেসব ফ্রিডম ফাইটারদের কথা?
---- না তো?
---- সে কি দিদিভাই! তোমার না এবার ক্লাস সিক্স?
---- ইয়েস দাদুন। বাট......
---- আচ্ছা বেশ, আমি তোমাকে সে সব দিনের কথা বলবো। শুনবে, কী করে আমাদের বাপ ঠাকুর্দারা নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে দেশটাকে স্বাধীন করে আমাদের হাতে দিয়ে গেছেন।
---- ইয়েস, কী মজা! আমার স্টোরি শুনতে খুব ভালো লাগে।
---- স্টোরি নয় দিদি, হিস্ট্রি। সত্যি ঘটনা।
ফোনটা রেখে মলয়বাবু একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নাতনিটার সঙ্গে কথা বললে মনটা যে কী ফুরফুরে হয়ে যায়। মাঝে মাঝে যদি নিজের কাছে এনে রাখতে পারতেন! কিন্তু এই বয়সে একার এই হালভাঙা সংসারে তরতরে কৈশোরকে টেনে আনার সাহস হয় কৈ!
(২)
দুধসাদা অডিটা গেট পেরিয়ে গ্যারেজে ঢোকার আগে বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো । ড্রাইভার নেমে গাড়ির ডালা খুলে দিলো , তারপর ডোরবেল টিপলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এলো বছর পঁয়ত্রিশের এক কাজের মহিলা । রাহী গাড়ি থেকে নামতে নামতেই বললো ,
---- বলাই , তুমি আর সীমা ডিকি থেকে প্যাকেটগুলো বের করে নিয়ে এসো । দেখবে মোট বাইশটা প্যাকেট আছে । মাটিতে পড়ে না যেন একটাও ।
কথা শেষ করে পরনের ব্লু টি-শার্টটার নিচের দিকটা একটু টেনে সোজা করে , একহাতে চুল ঠিক করতে করতে অন্য হাতে সুদৃশ্য চামড়ার পার্শটা গাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে হাঁটা দিলো ।
বলাই মানে ড্রাইভার এক এক করে প্যাকেট গুলো বার করে সীমার হাতে ধরাতে লাগলো । সীমা দুহাত বেড় দিয়ে প্যাকেটগুলো বুকের কাছে আগলাতে আগলাতে বললো ,
---- বৌদি এতো কী কিনেছে রে বলাই ?
---- আমি কী করে জানবো ? দোকানে তো বৌদি একাই ঢুকেছিলো । তবে রিলায়েন্স ট্রেন্ড , বিগবাজার আর মিয় আমরিতে ঢুকেছিলো আমি জানি ।
---- বাপরে গোটা বাজারটাই তুলে এনেছে মনে হচ্ছে !
----- মনে হয় টুংটাং এর স্কুলের জিনিস । দাদাকে ফোন করে বলছিলো বৌদি ,যে জিনিসগুলো খুব কালারফুল হয়েছে , টুংটাং এর বন্ধুরা নাকি ওগুলো হাতে পেয়ে খুব খুশি হবে ।
কথা বলতে বলতে দুজনে দুহাত বোঝাই করে প্যাকেট গুলো নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায় ।
রাহী সীমাকে দেখতে পেয়ে বলে ,
---- সীমা , তুমি প্যাকেটগুলো টুংটাং এর বেডরুম এর ডিভানে রেখে কড়া করে এক কাপ লিকার চা করে দাও । আর বলাই , তুমি লাঞ্চ সেরে গাড়ি নিয়ে সোজা মিয় আমরিতে চলে যাবে। অর্ডার মিলিয়ে সংখ্যা গুনে নিয়ে আসবে । দুপুর দুটো নাগাদ ডেলিভারি দেওয়ার কথা । ওগুলো নিয়েই টুংটাং এর স্কুল যাবে , ওর আজ তিনটের সময় ছুটি, যেন দাঁড়িয়ে না থাকে ।
--- আচ্ছা বৌদি --- বলাই উত্তর দেয় ।
---- দেখে নেবে , পুরো এগারোশো কেক থাকবে।সবকটাই চকোলেট ফ্লেভার। দেখবে অন্য কিছু যেন ঢুকিয়ে না দেয় ।
বলাই সবটা বুঝে নিয়ে নিচে নেমে যায় ।
ওদের কথার ফাঁকে সীমা প্যাকেট রেখে রান্নাঘরে ঢোকার মুখে জিজ্ঞেস করলো ,
---- টুংটাং এর বুঝি জন্মদিন বৌদি ?
---- না তো, ওর জন্ম ফেব্রুয়ারিতে, রাহী উত্তর দিলো।
---- ও ! এতো কেক আনা হচ্ছে , তাই ভাবলাম ---
---- কাল স্বাধীনতা দিবস না ? এবারে টুংটাং এর স্কুলের সেভেন্টি ফাইভ ইয়ারস ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে খুব বড়ো করে সেলিব্রেট করছে। তারই একটা পার্ট আমরা বেয়ার করছি । স্কুলের সব স্টুডেন্টকেই একটা করে গিফট আর কেক-ক্যাডবেরি দেওয়া হবে ।
---- বাবা ! সে তো একগাদা টাকার গচ্চা গো ?
---- হুঁ , টাকা তো লাগবেই , তবে আমরা ইচ্ছে করেই দায়িত্বটা নিয়েছি । এতো নামী স্কুল , হাইফাই ফ্যামিলির ছেলেমেয়েরা পড়ে ! প্রোগ্রামও হবে খুব কালারফুল। অ্যাস আ গার্ডিয়ান এই হেল্পটা করা আমাদের ডিউটি। তাছাড়া প্রিন্সিপল নিজে বড়োমুখ করে রিকোয়েস্ট করলেন আমাদের কন্ট্রিবিউট করার জন্য , না করলে চলে ? আমাদের টুংটাং এর স্কুলে একটা প্রেস্টিজ আছে না ? তোমার দাদার তো আবার মেয়ে অন্ত: প্রাণ ! তার মুখভার হলে আমারও রক্ষে নেই ।
---- তাই তো ! আমার মান্তুটাও কাল সকালে যাবে স্কুলে, পতাকা তুলতে । ও হ্যাঁ, বৌদি, আমাকে শ' - পাঁচেক টাকা দেবে ? ঘরে কটা জিনিস একদম ফুরিয়ে গেছে, না কিনলেই নয় ।
---- সীমা, আমি তোমাকে কতবার বলেছি , তুমি এভাবে আমার কাছে টাকা চাইবে না ! মানুষের এই ভিখিরিপনা একেবারে সহ্য করতে পারি না ।
---- আসলে মেয়েটার ইস্কুলের জামাটা না কাচলেই নয় । কালকে ওদের পরিষ্কার জামা পরে ইস্কুল যেতে বলেছে ।
---- তো ? ইস্কুলের জামা তো আর একটা নয় । অন্যটা পরিয়ে পাঠিও ।
---- না গো বৌদি , তুমি ---
---- দেখ সীমা ,অজুহাতের অভাব হয় না আমি জানি , কিন্তু আমারও তো একটা প্রিন্সিপাল আছে । আমি অ্যাডভান্স দিই না ।
---- আগাম তো নয় , দেড়হাজার টাকা মাইনে । দশদিন কাজ করলেই তো পাঁচশো টাকা হয়ে যায় বৌদি । আজ মাসের চোদ্দ তারিখ হলো ।
---- তুমি আমাকে কাজের হিসেব দেখাচ্ছো সোমা! আমি যে তোমাকে এক্সট্রা অ্যাডভাণ্টেজ দিই, তার হিসেব করেছো কখনো? বছরে অন্তত দুবার তুমি দশ পনেরো দিন করে এক্সট্রা ছুটি পাও --
---- সে তো তোমরা বেড়াতে যাও বলে।
---- তো! সেটা ছুটি না? দেখো, পাঁচশো টাকাটা অ্যাডভান্স দেওয়া বড়ো কথা নয়। কথা হচ্ছে এথিক্সের । আমি কি কাজে রাখার সময় তোমাকে বলেছিলাম, যে মাসে তিন চার দফায় মাইনে দেবো ? তাছাড়া সীমা, আমার বলা উচিত নয়, তবু বলছি, সরকার তো আমাদের মেরে তোমাদের হাত উপুড় করে দিয়ে যাচ্ছে, এরপরও এতো ভিখিরিপনা করো কেন? মাস শেষ হোক, মাইনে দেবো । যাও কাজগুলো শেষ করো ।
----- কাল কিন্তু আমি আসতে পারব না বৌদি ।
----- মানে ! কাল না এলে কী করে হবে ?
----- মান্তুটা সকালে ইস্কুলে পতাকা তুলে বাড়ি আসবে । দুপুরে ঘরে খাবে , ইস্কুলে মিড ডে মিল হবে না তো ! আমাকে রান্না করতে হবে ।
---- কিন্তু আমি তো তোমাকে ছুটি দিতে পারব না । কাল টুংটাং স্কুলে স্পীচ দেবে । আমরা ওর স্কুলে যাবো । তুমি না এলে ডিংডং কে দেখবে কে ? তুমি তো জান ,ও মানুষ ছাড়া থাকতে পারে না , মাত্র তিনমাসের পাপ্পি , খাইয়ে না দিলে খেতেও পারবে না। ওকে তো আর একা রাখা যাবে না ! তুমি বরং মান্তুকে কাল দুপুরে মুড়িটুড়ি খেয়ে নিতে বলো ।
----- কালকের দিনটা একটু ব্যবস্থা করে নিন না বৌদি ! এমনিতে তো ছুটি নিই না !
----- ও , তুমি ছুটি নাও না ! আর আমরা বুঝি ছুটি ভোগ করি । আমাদের ঘরে বাইরে হাজারটা কাজ সামাল দিতে হয় । তোমাদের এই ফাঁকি দেয়ার টেনডেনসি থাকে বলেই জীবনে উন্নতি হয় না ।
(৩)
পায়ে পায়ে হেঁটে খেলার মাঠটা পেরোতে গিয়ে আজ আবার মলয়বাবুর মনটা গুমসে গেল। না, 'মাস্টারমশাই' বলে আগের মতো কেউ সম্ভ্রম দেখায় না বলে নয়। আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে। জানেন, ভাবার কোনো মানে নেই, তাঁর মতো একটা গণ্ডগ্রামের হাইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টারের ভাবনা নিয়ে কার কী মাথাব্যথা? তবু ভাবেন। ভাবনা আসে। এই যে উঠতি বয়সের একদল ছেলেমেয়ে, খেলাধুলা না করে এই ভরবিকেলে মাঠের এক কোণে দলা পাকিয়ে এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে বসে মোবাইলের স্ক্রীনে বুঁদ হয়ে আছে। কী এক উত্তেজনায় সব ক'টার মুখে টসটসে ঘাম আর আকথা কুকথার খৈ। এদের বাজিয়ে দেখেছেন এক আধবার, সব ফাঁকা ক্যানস্টার, শুধুই উৎকট শব্দ তোলে — শিক্ষার 'শ'- এও পৌঁছনোর চেষ্টা নেই। মাঠের মধ্যিখানে কয়েকটা নিতান্ত বাচ্চা ছেলেমেয়ে ক্যারাটে শিখছে। ভীত হরিণ শিশুর মতো তাদের চোখ একবার ট্রেনার আর একবার পাশেই বসে থাকা মায়ের ওপর পড়ে ছটফট করছে। ওদের মা বাবারাও তথৈবচ। যে যার নিজের তালে ঘুরছে। শহর বা গ্রাম বলে নয়, ওপরতলার মানুষ - নীচেতলার মানুষ বলে নয়, সর্বত্রই, সব কাজেকর্মে মানুষের দায়বদ্ধতা তলানিতে ঠেকেছে। শুধুই এ ওকে টেক্কা দেওয়ার সস্তা খেলায় বিভোর হয়ে আছে সব। অমেধায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। শুধুই উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার, শুধুই আত্মরতি আর নিজের বাইরেটুকু দেখানোর তীব্রতা। কী অন্তঃসারশূন্য আস্ফালনে মেতে রয়েছে চতুর্দিক।আবারও ভাবলেন, এবার বৈকালিক ভ্রমণটা ছেড়েই দেবেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই পলাশগাঁয়ের মানুষজন এই প্রাক্তন হেডমাস্টারকে একটু আধটু মান্যিগন্যি করতো। অথচ —! বুঝতে পারছেন, খুব দ্রুত তাঁদের মতো মানুষগুলোর বোধের ছায়া গা থেকে ঝেড়ে ফেলে এই সমাজ অন্যতর ছায়ার চাদরে নিজেকে মুড়ে নিচ্ছে। তাঁর নিজের সন্তানদেরও এই ছায়া থেকে সরাতে অক্ষম তিনি। শুধু চিন্তা হয় নাতনিটার জন্য। ওই একরত্তিটা এখনো বড়ো নিষ্কলুষ। দূর থেকে পারবেন কি ওর ভেতরের সত্যিকার মানুষটাকে জাগিয়ে দিতে! নাতনির মুখটা বুকে করে তিনি দ্রুত পা চালিয়ে মাঠটা পেরিয়ে এলেন।
(৪)
রাহী গত দুদিন ধরে টুংটাং কে স্কুলের ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে-র স্পীচটা মুখস্থ করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু এখনো হোঁচট খাচ্ছে মেয়ে । কাজের মেয়ে সীমার ওপর সব কাজ ফেলে সকাল থেকে রাহী আজ টুংটাং কে নিয়ে পড়েছে ,
---- টুংটাং , তুমি বুঝতে পারছ , একটু পরেই স্কুলে স্পীচটা তোমাকে বলতে হবে এবং ইংলিশেই বলতে হবে? তুমি জান না , তোমাদের স্কুলে আজ কত ভি আই পি আসবেন ? তাঁরা তোমার স্পীচ শুনবেন কিন্তু ! তারপর তোমার টীচাররা আছেন , প্রিন্সিপাল আছেন ! তোমাকে তাঁদের সম্মান রাখতে হবে । ভাল বলতে না পারলে কী হবে বুঝতে পারছো ? স্টুডেন্টস তো হাসাহাসি করবেই , এতো গার্ডিয়ান এর সামনে আমাদের প্রেস্টিজটা কোথায় যাবে । আর একবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলো। এবার ভুল করবে না । ওই ইকুয়াল রাইটস এর পয়েন্টটা আর ফ্রীডম অফ চাইল্ডমাইন্ড এর পয়েন্টটা বলার সময় ঠিকঠিক ইমোশন চাই কিন্তু , মোডিউলিসনটা যেন ঠিকঠাক হয়। বলো দেখি ----
---- আমার শরীর খারাপ লাগছে !
---- বাজে না বকে যা বলছি তাই করো ।
---- সত্যি বলছি মামমাম, আমার খুব মাথাব্যথা করছে । আমি যাবো না ।
---- কী বলছো বোকার মত, তুমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল । তার ওপর কত জনকে টপকে তোমাকে এই স্পেসটা দেয়া হয়েছে ,এই চান্স কেউ হারায় ? চলো রেডি হও ।
---- আমি যাবো না । আমি স্পীচ দেবো না ।
---- দিতে তোমাকে হবেই । নাহলে পানিশমেন্ট তো জানো , সারাদিন ঘরে বন্ধ করে রেখে দেবো । আর যদি খুব ভাল স্পীচ দিতে পারো , তাহলে বাবাইকে বলবো , তোমার জন্য দারুণ গিফট আনতে । তোমার বন্ধুদের জন্য যে সব গিফট কিনেছি , তার থেকেও ভাল গিফট । ওকে ?
---- আমি গিফট নেবো না । আমি যাবো না স্পীচ দিতে ।
---- একদম তর্ক করবে না । যা বলবো তাই শুনবে ।
(৫)
টুংটাং কে নিয়ে রাহী আর সৌজন্য বিকেল চারটে নাগাদ যখন বাড়ি এসে গাড়ি থেকে নামলো , তখন ওদের দেখে মনে হলো উত্তাল সুনামিতে এলোমেলো হয়ে গেছে সব । থমথমে মুখে সৌজন্য প্রায় ছুটে দরজা দিয়ে ঢুকেই নিজের ঘরে লুকিয়ে পড়ল । রাহীর মুখচোখ যেন জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস , টুংটাং এর দিকে কিছুটা উত্তপ্ত লাভা ছুঁড়ে দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো ,
---- এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভেতরে ঢুকবে?
টুংটাং আশ্চর্য রকমের শীতল এখন। গাড়ি থেকে নেমে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো । মায়ের কথা শুনে মাথাটা বুকের সঙ্গে গুঁজে নিয়ে ভেতরে এলো ।
রাহী এসে ড্রয়িংরুমের সোফাটায় ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে , দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়লো । টুংটাং মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পায়ের নখ দিয়ে মেঝেটা খুঁটে একসময় মিনমিনে গলায় বলে উঠলো,
---- সরি মামমাম !
রাহী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না । ঠাস করে মেয়েটার গালে থাপ্পড় কষিয়ে চিৎকার করে উঠলো ,
---- সরি ? কীসের সরি ? তুমি যা করেছো আজ , সরি বললে তার মাফ হয় না । স্রেফ তুমি স্পীচ দেওয়ার স্কোপটা পাবে বলে তোমার বাবাই এককাঁড়ি টাকা খরচ করে এতো এতো স্টুডেন্টস এর জন্য গিফট আর টিফিন কিনেছে ! আমি সব কাজ ফেলে নেট ঘেঁটে, বই ঘেঁটে তোমার জন্য স্পীচ রেডি করেছি । দিনরাত এক করে তোমাকে প্র্যাক্টিস করিয়েছি ! ডিংডংটাকে পর্যন্ত দেখি নি ! আর তুমি?
এতক্ষণে সৌজন্যও ঘরের ভেতর থেকে প্রায় গর্জন করে উঠলো ,
---- তোমার মেয়ে কে জিজ্ঞেস করো , ওকে কে বলেছে যে ওর বাবা মা ইকুয়াল রাইটস মানে না ? ওর নাকি কোনো ফ্রীডম নেই ? আমরা ওকে কোন কষ্ট দিয়েছি ? হুঁ : ! একমাত্র সন্তানের জন্য এ টু জেড স্যাক্রিফাইস করার রেজাল্ট কী ? না, এত জনের সামনে ..... জাস্ট ইনটলারেবল্ ! ওকে সরাও আমার চোখের সামনে থেকে।
রাহী প্রচণ্ড রাগে আরেকটা থাপ্পড় মারতেই রান্নাঘর থেকে সীমা ছুটে এসে টুংটাংকে ধরে ফেলে ,
---- কী করছ বৌদি ! এই একরত্তি মেয়েকেও কেউ এভাবে মারে ?
---- সীমা, আমাদের মধ্যে ঢুকবে না । কেন ওকে শাসন করছি, এটা তোমার বুদ্ধিতে বোঝা সম্ভব নয়।
---- তা তো বটেই ! কিন্তু এমন নিষ্ঠুরের মতো মার কি আর চোখে দেখা যায় ?
---- তুমি এখন বাড়ি যাও তো । কথা বাড়িও না । আমাদের মন মেজাজ ভাল নেই ।
সীমা কিছু না বলে বেরিয়ে গেল । যেতে যেতে টুংটাং এর দিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । সীমা বেরিয়ে যেতেই রাহী আবার শুরু করলো ,
---- ইস ! ওই মোমেন্টটার কথা ভাবলেই মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে । মিসেস ইরফান, মিসেস ব্যানার্জি, মিসেস দত্ত, মিসেস প্যাটেল এর মুখগুলো যদি দেখতে না সৌজন্য! মিসেস প্যাটেল তো বললেনই, "মিসেস সেন, এতো টাকা খরচ করে সুহৃতার স্পীচের ব্যবস্থা করলেন, আর কী বলবে, কী বলবে না, সেটা শেখালেন না!"
সৌজন্য আবার ফুঁসে উঠলো ,
---- তুমি তো ওইটুকু শুনেছ, আমাকে ওই ভড়ংবাজ চৌধুরীটা বলে কিনা, "সেনবাবু, শুধু টাকা কামালেই হবে ? মেয়েকে আপগ্রেড করার দিকেও তো চোখটা রাখতে হয় নাকি!" — ভাব একবার!
মা বাবার ভয়ংকর রাগের সামনে দাঁড়িয়ে টুংটাং গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গেলো ।
(৬)
ক্লাস সিক্স এর ফার্স্ট গার্ল টুংটাং গভীর রাতে বাবা মায়ের ঘরে আলো নেভার পর দাদুনকে ফোন করলো।
---- দাদুন, আমি আজ যে স্পীচটা দিয়েছি, তুমি শুনবে?
---- নিশ্চয় দিদিভাই। আমি তো এইজন্যই না ঘুমিয়ে জেগে আছি। বলো দেখি, কী বলেছো আজ?
---- আজ আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স হলো পঁচাত্তর। আমাদের বইয়ের প্রথমে লেখা সংবিধানে বলা আছে , প্রত্যেক ভারতীয় সমানাধিকার পাবে । সমানাধিকার মানে নিজের ভাবনা, নিজের কথা, নিজের শিক্ষা, নিজের কাজ, নিজের জীবনের স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের থাকবে। প্রত্যেকের শরীর এবং মন থাকবে নিজের অধীনে। কিন্তু কোথায় সেই সমানাধিকার ? মান্তু কি স্বাধীন ? যে আমাদের কুকুরের কারণে দুপুরে মায়ের রান্না করা ভাত পায় না? সীমা পিসি কি স্বাধীন, যে সন্তানের জন্য খাবার না বানিয়ে আমাদের ঘর এবং কুকুর পাহারা দিতে বাধ্য হয় মাইনে কেটে নেওয়ার ভয়ে ? বলাই আঙ্কেল কি স্বাধীন, যে শরীর খারাপ নিয়েও গাড়ি চালাতে বাধ্য হয় ? আমার দেখা এই মানুষগুলো কেউ স্বাধীন নয়! আমি বা আমার মতো বাচ্চারাই কি স্বাধীন? তাহলে কেন দেশের স্বাধীনতা দিবসে কতকগুলো সাজানো মিথ্যা কথা আমাকে আমার মা বাবা জোর করে শিখিয়েছেন? কেন আমার দাদুনের ফ্রিডম ফাইটার বাবার কথা কিংবা দাদুনের কথা উঠলেই মা বাবা বলেন, "ওসব বস্তা পচা ধারনা?"
---- দিদিভাই, তুমি এসব সত্যিই বলেছো?
---- তুমিও কি শাস্তি দেবে বাবা মায়ের মতো?
---- শাস্তি! ওরা তোমাকে....
---- খুব মেরেছে আজ। আমার রাতের খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই সত্যিকথা গুলো বলেছি বলে। দাদুন, তুমি বলেছিলে, শিশুমনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের নামই স্বাধীনতা! মা-ও তো ইকুয়াল রাইটস-এর কথা আমাকে মুখস্থ করিয়েছে। তাহলে বলো, আমি তো সেটাই নিজের মতো করে ভেবে বলেছি, "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় " এই কবিতাটা স্পীচের মাঝে বাংলায় আবৃত্তি করেছি বলে, বাবা মায়ের মুখ রাগে থমথম করছিল কেন? অন্য আঙ্কেল আন্টিরাও মুখ টিপে টিপে হাসছিলো কেন ? কবিতাটা শেখানোর সময় তুমি বলেছিলে না, "টুংটাং , এ কবিতা আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কবিতা । যে যেমন অবস্থায় থাকি না কেন , মন আর শরীর যেন কারো কাছে বাঁধা না পড়ে?"
---- দিদিভাই, তুই তো বিপ্লব করেছিস! ওরে, আমার এই ঝাপসা চোখদুটো আজ এই রাতের অন্ধকারেও কী আলো দেখতে পাচ্ছে, তোকে কী করে বোঝাই! মনে হচ্ছে তোকে বুকে করে নাচি, গাই, পলাশগাঁয়ের মাঠটায় পাক দিয়ে বেড়াই! আমার সোনা রে, মানিক রে।
---- দাদুন তুমি একসাইটেড হচ্ছো! কিন্তু বাবা মা তো....
---- ওদের ওপর অভিমান কোরো না দিদিভাই। ওরা বোকা। ওদের মানুষ করতে পারি নি আমরা। তাই হীরের বদলে কাচ আগলাতেই ওরা ব্যস্ত। তোমার বুকে হীরে আছে দিদিভাই। তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্যই এ দেশ অপেক্ষা করছে। কখনো নিজেকে বদলে ফেলো না। কখনো না। আজ মনে হচ্ছে বাপ দাদাদের লড়াই, আমাদের লড়াই বৃথা যাবে না। আজ আমি নিশ্চিন্তে ঘুমবো দিদিভাই।
ফোন বন্ধ করে টুংটাং পা টিপে টিপে উঠে যায় ছাদে । মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশে তখন ঝিকমিক করছে চাঁদ আর অসংখ্য তারা । প্রত্যেকটি তারা আলাদা অথচ প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের কি মিল! কেউ কাউকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে না, কেউ কারো গায়ের ওপর চেপে বসছে না, আবার কেউ কাউকে ছেড়েও যাচ্ছে না ! তার হঠাৎ মনে হলো, মানুষের স্বাধীনতাও কি এমনটা হতে পারে না কখনো? কেউ কারো দখলে থাকবে না আবার কেউ কাউকে ছেড়েও থাকবে না ? নাঃ ! টুংটাং হেরে যাবে না । তাকে শেষ পর্যন্ত এমনই একটা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে হবে । পঁচাত্তর বছরের পরে নাহয় আরও পঁচাত্তর বছর যাবে , কিন্তু টুংটাং এর দল একদিন এমন একটা স্বাধীনতার মুখ দেখবেই । মা বাবার ওপর টুংটাং এর অভিমানটা কমতে থাকে , দাদুন তো বললো, ওরাও যে পরিস্থিতির কাছে পরাধীন ! সে ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে আসে। ঘুমোতে হবে। কাল অনেক কাজ।
পায়ে পায়ে হেঁটে খেলার মাঠটা পেরোতে গিয়ে আজ আবার মলয়বাবুর মনটা গুমসে গেল। না, 'মাস্টারমশাই' বলে আগের মতো কেউ সম্ভ্রম দেখায় না বলে নয়। আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে। জানেন, ভাবার কোনো মানে নেই, তাঁর মতো একটা গণ্ডগ্রামের হাইস্কুলের প্রাক্তন হেডমাস্টারের ভাবনা নিয়ে কার কী মাথাব্যথা? তবু ভাবেন। ভাবনা আসে। এই যে উঠতি বয়সের একদল ছেলেমেয়ে, খেলাধুলা না করে এই ভরবিকেলে মাঠের এক কোণে দলা পাকিয়ে এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে বসে মোবাইলের স্ক্রীনে বুঁদ হয়ে আছে। কী এক উত্তেজনায় সব ক'টার মুখে টসটসে ঘাম আর আকথা কুকথার খৈ। এদের বাজিয়ে দেখেছেন এক আধবার, সব ফাঁকা ক্যানস্টার, শুধুই উৎকট শব্দ তোলে — শিক্ষার 'শ'- এও পৌঁছনোর চেষ্টা নেই। মাঠের মধ্যিখানে কয়েকটা নিতান্ত বাচ্চা ছেলেমেয়ে ক্যারাটে শিখছে। ভীত হরিণ শিশুর মতো তাদের চোখ একবার ট্রেনার আর একবার পাশেই বসে থাকা মায়ের ওপর পড়ে ছটফট করছে। ওদের মা বাবারাও তথৈবচ। যে যার নিজের তালে ঘুরছে। শহর বা গ্রাম বলে নয়, ওপরতলার মানুষ - নীচেতলার মানুষ বলে নয়, সর্বত্রই, সব কাজেকর্মে মানুষের দায়বদ্ধতা তলানিতে ঠেকেছে। শুধুই এ ওকে টেক্কা দেওয়ার সস্তা খেলায় বিভোর হয়ে আছে সব। অমেধায় ভরে যাচ্ছে চারপাশ। শুধুই উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার, শুধুই আত্মরতি আর নিজের বাইরেটুকু দেখানোর তীব্রতা। কী অন্তঃসারশূন্য আস্ফালনে মেতে রয়েছে চতুর্দিক।আবারও ভাবলেন, এবার বৈকালিক ভ্রমণটা ছেড়েই দেবেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত এই পলাশগাঁয়ের মানুষজন এই প্রাক্তন হেডমাস্টারকে একটু আধটু মান্যিগন্যি করতো। অথচ —! বুঝতে পারছেন, খুব দ্রুত তাঁদের মতো মানুষগুলোর বোধের ছায়া গা থেকে ঝেড়ে ফেলে এই সমাজ অন্যতর ছায়ার চাদরে নিজেকে মুড়ে নিচ্ছে। তাঁর নিজের সন্তানদেরও এই ছায়া থেকে সরাতে অক্ষম তিনি। শুধু চিন্তা হয় নাতনিটার জন্য। ওই একরত্তিটা এখনো বড়ো নিষ্কলুষ। দূর থেকে পারবেন কি ওর ভেতরের সত্যিকার মানুষটাকে জাগিয়ে দিতে! নাতনির মুখটা বুকে করে তিনি দ্রুত পা চালিয়ে মাঠটা পেরিয়ে এলেন।
(৪)
রাহী গত দুদিন ধরে টুংটাং কে স্কুলের ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে-র স্পীচটা মুখস্থ করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে । কিন্তু এখনো হোঁচট খাচ্ছে মেয়ে । কাজের মেয়ে সীমার ওপর সব কাজ ফেলে সকাল থেকে রাহী আজ টুংটাং কে নিয়ে পড়েছে ,
---- টুংটাং , তুমি বুঝতে পারছ , একটু পরেই স্কুলে স্পীচটা তোমাকে বলতে হবে এবং ইংলিশেই বলতে হবে? তুমি জান না , তোমাদের স্কুলে আজ কত ভি আই পি আসবেন ? তাঁরা তোমার স্পীচ শুনবেন কিন্তু ! তারপর তোমার টীচাররা আছেন , প্রিন্সিপাল আছেন ! তোমাকে তাঁদের সম্মান রাখতে হবে । ভাল বলতে না পারলে কী হবে বুঝতে পারছো ? স্টুডেন্টস তো হাসাহাসি করবেই , এতো গার্ডিয়ান এর সামনে আমাদের প্রেস্টিজটা কোথায় যাবে । আর একবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলো। এবার ভুল করবে না । ওই ইকুয়াল রাইটস এর পয়েন্টটা আর ফ্রীডম অফ চাইল্ডমাইন্ড এর পয়েন্টটা বলার সময় ঠিকঠিক ইমোশন চাই কিন্তু , মোডিউলিসনটা যেন ঠিকঠাক হয়। বলো দেখি ----
---- আমার শরীর খারাপ লাগছে !
---- বাজে না বকে যা বলছি তাই করো ।
---- সত্যি বলছি মামমাম, আমার খুব মাথাব্যথা করছে । আমি যাবো না ।
---- কী বলছো বোকার মত, তুমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল । তার ওপর কত জনকে টপকে তোমাকে এই স্পেসটা দেয়া হয়েছে ,এই চান্স কেউ হারায় ? চলো রেডি হও ।
---- আমি যাবো না । আমি স্পীচ দেবো না ।
---- দিতে তোমাকে হবেই । নাহলে পানিশমেন্ট তো জানো , সারাদিন ঘরে বন্ধ করে রেখে দেবো । আর যদি খুব ভাল স্পীচ দিতে পারো , তাহলে বাবাইকে বলবো , তোমার জন্য দারুণ গিফট আনতে । তোমার বন্ধুদের জন্য যে সব গিফট কিনেছি , তার থেকেও ভাল গিফট । ওকে ?
---- আমি গিফট নেবো না । আমি যাবো না স্পীচ দিতে ।
---- একদম তর্ক করবে না । যা বলবো তাই শুনবে ।
(৫)
টুংটাং কে নিয়ে রাহী আর সৌজন্য বিকেল চারটে নাগাদ যখন বাড়ি এসে গাড়ি থেকে নামলো , তখন ওদের দেখে মনে হলো উত্তাল সুনামিতে এলোমেলো হয়ে গেছে সব । থমথমে মুখে সৌজন্য প্রায় ছুটে দরজা দিয়ে ঢুকেই নিজের ঘরে লুকিয়ে পড়ল । রাহীর মুখচোখ যেন জ্বলন্ত ভিসুভিয়াস , টুংটাং এর দিকে কিছুটা উত্তপ্ত লাভা ছুঁড়ে দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো ,
---- এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি ভেতরে ঢুকবে?
টুংটাং আশ্চর্য রকমের শীতল এখন। গাড়ি থেকে নেমে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো । মায়ের কথা শুনে মাথাটা বুকের সঙ্গে গুঁজে নিয়ে ভেতরে এলো ।
রাহী এসে ড্রয়িংরুমের সোফাটায় ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে , দুহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়লো । টুংটাং মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পায়ের নখ দিয়ে মেঝেটা খুঁটে একসময় মিনমিনে গলায় বলে উঠলো,
---- সরি মামমাম !
রাহী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না । ঠাস করে মেয়েটার গালে থাপ্পড় কষিয়ে চিৎকার করে উঠলো ,
---- সরি ? কীসের সরি ? তুমি যা করেছো আজ , সরি বললে তার মাফ হয় না । স্রেফ তুমি স্পীচ দেওয়ার স্কোপটা পাবে বলে তোমার বাবাই এককাঁড়ি টাকা খরচ করে এতো এতো স্টুডেন্টস এর জন্য গিফট আর টিফিন কিনেছে ! আমি সব কাজ ফেলে নেট ঘেঁটে, বই ঘেঁটে তোমার জন্য স্পীচ রেডি করেছি । দিনরাত এক করে তোমাকে প্র্যাক্টিস করিয়েছি ! ডিংডংটাকে পর্যন্ত দেখি নি ! আর তুমি?
এতক্ষণে সৌজন্যও ঘরের ভেতর থেকে প্রায় গর্জন করে উঠলো ,
---- তোমার মেয়ে কে জিজ্ঞেস করো , ওকে কে বলেছে যে ওর বাবা মা ইকুয়াল রাইটস মানে না ? ওর নাকি কোনো ফ্রীডম নেই ? আমরা ওকে কোন কষ্ট দিয়েছি ? হুঁ : ! একমাত্র সন্তানের জন্য এ টু জেড স্যাক্রিফাইস করার রেজাল্ট কী ? না, এত জনের সামনে ..... জাস্ট ইনটলারেবল্ ! ওকে সরাও আমার চোখের সামনে থেকে।
রাহী প্রচণ্ড রাগে আরেকটা থাপ্পড় মারতেই রান্নাঘর থেকে সীমা ছুটে এসে টুংটাংকে ধরে ফেলে ,
---- কী করছ বৌদি ! এই একরত্তি মেয়েকেও কেউ এভাবে মারে ?
---- সীমা, আমাদের মধ্যে ঢুকবে না । কেন ওকে শাসন করছি, এটা তোমার বুদ্ধিতে বোঝা সম্ভব নয়।
---- তা তো বটেই ! কিন্তু এমন নিষ্ঠুরের মতো মার কি আর চোখে দেখা যায় ?
---- তুমি এখন বাড়ি যাও তো । কথা বাড়িও না । আমাদের মন মেজাজ ভাল নেই ।
সীমা কিছু না বলে বেরিয়ে গেল । যেতে যেতে টুংটাং এর দিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো । সীমা বেরিয়ে যেতেই রাহী আবার শুরু করলো ,
---- ইস ! ওই মোমেন্টটার কথা ভাবলেই মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে । মিসেস ইরফান, মিসেস ব্যানার্জি, মিসেস দত্ত, মিসেস প্যাটেল এর মুখগুলো যদি দেখতে না সৌজন্য! মিসেস প্যাটেল তো বললেনই, "মিসেস সেন, এতো টাকা খরচ করে সুহৃতার স্পীচের ব্যবস্থা করলেন, আর কী বলবে, কী বলবে না, সেটা শেখালেন না!"
সৌজন্য আবার ফুঁসে উঠলো ,
---- তুমি তো ওইটুকু শুনেছ, আমাকে ওই ভড়ংবাজ চৌধুরীটা বলে কিনা, "সেনবাবু, শুধু টাকা কামালেই হবে ? মেয়েকে আপগ্রেড করার দিকেও তো চোখটা রাখতে হয় নাকি!" — ভাব একবার!
মা বাবার ভয়ংকর রাগের সামনে দাঁড়িয়ে টুংটাং গুটিয়ে এতটুকু হয়ে গেলো ।
(৬)
ক্লাস সিক্স এর ফার্স্ট গার্ল টুংটাং গভীর রাতে বাবা মায়ের ঘরে আলো নেভার পর দাদুনকে ফোন করলো।
---- দাদুন, আমি আজ যে স্পীচটা দিয়েছি, তুমি শুনবে?
---- নিশ্চয় দিদিভাই। আমি তো এইজন্যই না ঘুমিয়ে জেগে আছি। বলো দেখি, কী বলেছো আজ?
---- আজ আমাদের দেশের স্বাধীনতার বয়স হলো পঁচাত্তর। আমাদের বইয়ের প্রথমে লেখা সংবিধানে বলা আছে , প্রত্যেক ভারতীয় সমানাধিকার পাবে । সমানাধিকার মানে নিজের ভাবনা, নিজের কথা, নিজের শিক্ষা, নিজের কাজ, নিজের জীবনের স্বাধীনতা প্রত্যেক মানুষের থাকবে। প্রত্যেকের শরীর এবং মন থাকবে নিজের অধীনে। কিন্তু কোথায় সেই সমানাধিকার ? মান্তু কি স্বাধীন ? যে আমাদের কুকুরের কারণে দুপুরে মায়ের রান্না করা ভাত পায় না? সীমা পিসি কি স্বাধীন, যে সন্তানের জন্য খাবার না বানিয়ে আমাদের ঘর এবং কুকুর পাহারা দিতে বাধ্য হয় মাইনে কেটে নেওয়ার ভয়ে ? বলাই আঙ্কেল কি স্বাধীন, যে শরীর খারাপ নিয়েও গাড়ি চালাতে বাধ্য হয় ? আমার দেখা এই মানুষগুলো কেউ স্বাধীন নয়! আমি বা আমার মতো বাচ্চারাই কি স্বাধীন? তাহলে কেন দেশের স্বাধীনতা দিবসে কতকগুলো সাজানো মিথ্যা কথা আমাকে আমার মা বাবা জোর করে শিখিয়েছেন? কেন আমার দাদুনের ফ্রিডম ফাইটার বাবার কথা কিংবা দাদুনের কথা উঠলেই মা বাবা বলেন, "ওসব বস্তা পচা ধারনা?"
---- দিদিভাই, তুমি এসব সত্যিই বলেছো?
---- তুমিও কি শাস্তি দেবে বাবা মায়ের মতো?
---- শাস্তি! ওরা তোমাকে....
---- খুব মেরেছে আজ। আমার রাতের খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই সত্যিকথা গুলো বলেছি বলে। দাদুন, তুমি বলেছিলে, শিশুমনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের নামই স্বাধীনতা! মা-ও তো ইকুয়াল রাইটস-এর কথা আমাকে মুখস্থ করিয়েছে। তাহলে বলো, আমি তো সেটাই নিজের মতো করে ভেবে বলেছি, "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় " এই কবিতাটা স্পীচের মাঝে বাংলায় আবৃত্তি করেছি বলে, বাবা মায়ের মুখ রাগে থমথম করছিল কেন? অন্য আঙ্কেল আন্টিরাও মুখ টিপে টিপে হাসছিলো কেন ? কবিতাটা শেখানোর সময় তুমি বলেছিলে না, "টুংটাং , এ কবিতা আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনের কবিতা । যে যেমন অবস্থায় থাকি না কেন , মন আর শরীর যেন কারো কাছে বাঁধা না পড়ে?"
---- দিদিভাই, তুই তো বিপ্লব করেছিস! ওরে, আমার এই ঝাপসা চোখদুটো আজ এই রাতের অন্ধকারেও কী আলো দেখতে পাচ্ছে, তোকে কী করে বোঝাই! মনে হচ্ছে তোকে বুকে করে নাচি, গাই, পলাশগাঁয়ের মাঠটায় পাক দিয়ে বেড়াই! আমার সোনা রে, মানিক রে।
---- দাদুন তুমি একসাইটেড হচ্ছো! কিন্তু বাবা মা তো....
---- ওদের ওপর অভিমান কোরো না দিদিভাই। ওরা বোকা। ওদের মানুষ করতে পারি নি আমরা। তাই হীরের বদলে কাচ আগলাতেই ওরা ব্যস্ত। তোমার বুকে হীরে আছে দিদিভাই। তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের জন্যই এ দেশ অপেক্ষা করছে। কখনো নিজেকে বদলে ফেলো না। কখনো না। আজ মনে হচ্ছে বাপ দাদাদের লড়াই, আমাদের লড়াই বৃথা যাবে না। আজ আমি নিশ্চিন্তে ঘুমবো দিদিভাই।
ফোন বন্ধ করে টুংটাং পা টিপে টিপে উঠে যায় ছাদে । মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশে তখন ঝিকমিক করছে চাঁদ আর অসংখ্য তারা । প্রত্যেকটি তারা আলাদা অথচ প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের কি মিল! কেউ কাউকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে না, কেউ কারো গায়ের ওপর চেপে বসছে না, আবার কেউ কাউকে ছেড়েও যাচ্ছে না ! তার হঠাৎ মনে হলো, মানুষের স্বাধীনতাও কি এমনটা হতে পারে না কখনো? কেউ কারো দখলে থাকবে না আবার কেউ কাউকে ছেড়েও থাকবে না ? নাঃ ! টুংটাং হেরে যাবে না । তাকে শেষ পর্যন্ত এমনই একটা স্বাধীনতার স্বাদ পেতে হবে । পঁচাত্তর বছরের পরে নাহয় আরও পঁচাত্তর বছর যাবে , কিন্তু টুংটাং এর দল একদিন এমন একটা স্বাধীনতার মুখ দেখবেই । মা বাবার ওপর টুংটাং এর অভিমানটা কমতে থাকে , দাদুন তো বললো, ওরাও যে পরিস্থিতির কাছে পরাধীন ! সে ধীরে ধীরে ছাদ থেকে নেমে আসে। ঘুমোতে হবে। কাল অনেক কাজ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন