পাঁচ ছয়দিন আর ঘর থেকে কোথাও বার হবে না প্রবীর। প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা গেল আকণ্ঠ মদ গিলে আর ঘুমিয়ে। তারপর নিজের হাতে খুন করার এই প্রবল ইচ্ছার ফলে যে মানসিক আর শারীরিক পরিশ্রম হল ,সেটা ভুলে আর আবার স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে লাগল প্রবীর। নিজে ঠিক কি ভাবে কত বার মেরেছে সেটা বার বার মনে আসতে লাগল তার। যদি কংক্রিট ফেটে দিবানাথ দেহ বার হয়ে আসে! কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করল সে। ঘুম টায় একমাত্র উপায় এই বীভৎসতা থেকে বেড়িয়ে আসার। রাজু ঠিক যত্ন করতে থাকে। রাজুদের জিনে কুকুরের জিন আছে। কক্ষনোও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। আচমকা ঘুম ভাঙল প্রবীরের। ‘সে এত বড় ভুল করে কি বলে’। দিবানাথের কাছ থেকে তো শিউলির খোঁজটায় নেওয়া হল না। এক বার দিবানাথ কে বাঁচানো যাবে না। আসলে তো শিউলির খোঁজটায় দরকার। এবার কি হবে। হাউমাউ করে দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে কাঁদতে থাকে প্রবীর।
কাগজে বড় বড় অক্ষরে দিবানাথের নিরুদ্দেশ সংবাদ। তার বাড়িতে বড় বড় পুলিশ অফিসার,নেতা,মন্ত্রী আসছে। মুম্বাই যাবার জন্যে গাড়িতে চেপেছিলেন । কিন্তু প্লেনে চাপেন নি। ফোনে কিছু বন্ধু কে জানিয়েছেন তাঁর একটা দরকারি কাজ আছে তাই পরিকল্পনা বাতিল।কিন্তু গাড়িটার কোন খোঁজ নেই। বাড়িতে কাজের লোকেদের পুলিশ জিজ্ঞাসা বাদ করছেন। রাঁধুনি, মালী, চাকর, আর একজন ‘সেবিকা’ সে নাকি মূক ও বধির। রক্ষিতা বলতে পুলিশ অফিসারের বাঁধছিল। এতো সরল আর মর্যাদা পূর্ণ চেহারা। চাঁদনী ওর নাম। সে লিখে জানাল তাকে যেন কোন সরকারি হোমে থাকবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
চাঁদনী কে সরকারী হোমে রেখে এলো পুলিশ। বিজনেস টাইকুনের রক্ষিতা তাই স্বাভাবিক আকর্ষণ হল সকলের। মেয়েরা একদিন তার খোলা গায়ে অনেক পোড়া দাগ দেখতে পেল।
চাঁদনী একমাস পরেই হোম ছাড়ল।তার মামার বাড়ির আত্মীয় এসে নিয়ে গেল। একটা খুব গরীব জায়গায় এসে উঠল চাঁদনী। আত্মীয় চলে যাবার আগে বেশ অনেক গুলো টাকা গুনে ধন্যবাদ দিল তাকে ।আর কোন দরকার থাকলে জানাতে বলল,ম্যাডাম কে। বস্তির কৌতুহলি বউ এসে দাঁড়ায় , কি নাম আপনার? পনের বছর পর খুব শুকনো গলায় চাঁদনী শব্দ করে বলে, “ আমি শিউলি,তোমার নাম কি?”
শিউলি ইনডিয়ান সিস্টেমে বহুদিন বসেনি। বেশ নোংরা পায়খানা। বাথরুমটা একটা শ্যাওলা ধরা আড়াল ছাড়া কিছু না। তবু কষ্ট হলেও রাগ বা ঘৃণা হল না। আর কিছুদিন এই ভাবে থাকবে। তারপর হারিয়ে যাবে আবার কোথাও। আচ্ছা দেশে আবার ফিরে যাওয়া যায় না।কুলের গাছের পাশে নবগোপাল বাবুদের বাড়ি। প্রবীর আর দিবানাথ দুজনে একসাথে মাটিতে মার্বেল খেলত। লাল রঙের একটা বাক্স ছিল ওদের। ইটের ভাঁটা থেকে ধোঁয়া বার হত। ইস্কুল থেকে ফিরে দিবানাথ আর প্রবীরের খেলা দেখত শিউলি। বালিকা শিউলি শিখে গিয়ে ছিল নানান ধরণের টিপ। ‘ছিদি বিদি বুকটান’ বলে একটা বিশেষ ভাবে টিপ প্রাকটিস করত ।ইটের ভাটায় বর্ষার শেষে কাশ ফুলের বন তৈরি হত। সারাদিন ছুটে ছুটে খেলা চলত। শিউলি রা এই রকম এক শরত কালেই ইটভাটার পাশ থেকে শহরের ভালো পাড়ায় উঠে এলো। বাবার মাইনে বেড়েছে, মা বাপের বাড়ি থেকে টাকা পয়সা পেল। দিবানাথ ,প্রবীর আরও সব পাড়ার বন্ধুদের ছেড়ে আসল শিউলি। বাবা ওদের নতুন উঠোনে একটা শিউলি গাছের চারা লাগাল। আর খুব ভালো রেজাল্ট করতে লাগলো শিউলি। সে আর পাড়া বেড়িয়ে বেড়ানো দস্যি নয়।
প্রবীরের বাবা কে একদিন হাতে হাতকড়া দিয়ে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেল। শহরের সবাই বলল ,নেহাত ভালো মানুষ লোকটাকে ফাঁসিয়ে দিল।মা খুব দুশ্চিন্তা করতে লাগল। বাবা গিয়ে একদিন সন্ধ্যে বেলা প্রবীরদের বাড়ি ঘুরে এল। প্রবীরের লক্ষ্মীমন্ত গিন্নি বান্নি মা, লোকের বাড়িতে কাজ করতে লাগল। মায়ের সাথে গিয়ে শিউলি স্কুল পাড়ায় একটা ফাঁকা জায়গায় ওর মায়ের হাতে কিছু টাকা দিত। একদিন প্রবীর এসেছিল। প্রবীরের চোখের দিকে তাকাতে ভয় করছিল শিউলির। সদ্য কিশোরী শিউলির রূপ গিলে খাচ্ছিল সে। কেমন রোগা আর অসভ্য হয়ে গেছে। কথা বলেনি শিউলি। মা বুঝেছিল। একদিন শিউলির স্কুলের সামনে আচমকা দেখল দিবানাথ আর প্রবীর কে। শ্যেন দৃষ্টিতে শিউলির দিকে তাকিয়ে আছে।
দিবানাথ সাইকেলের পেছনে প্রবীর কে ক্যারি করে ইট ভাঁটার কাশ বনে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। “ বুক, পাছা হেব্বি হয়েছে কি বলিস” বিড়িতে টান লাগিয়ে দিবানাথ ঘাসের ওপর শুয়ে বলেছিল প্রবীর কে। প্রবীরের থুতনি নেমে গিয়েছিল। সর্দি লাগা নাকে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নেয় । হতচকিত হয়ে যাওয়ায় কিছুই বলতে পারে না। দিবানাথ এর মত এতো তাড়না তার হয়নি। কিন্তু তার সাথে এক সময় আগানে বাগানে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটার এতো রূপ হবে, একেবারে সিনেমার মেয়েদের মত সেটা সে ভাবেনি। দিবানাথ তার সদ্য যৌবন প্রাপ্তির উদ্গমন বন্ধুর সামনে জাহির করে।বন্ধুর আদৌ সেই উন্নতি হয়েছে কি না সে জিজ্ঞাসা করে। মুখ হাঁ করে সে শুধু ফোঁস ফোঁস করে প্রবীর।সে বড় দুর্বল। মা প্রায় অসুস্থ থাকে থাকে। বাবার জেল হয়েছে তিন বছরের। কেস করতে সব টাকা শেষ। সারাদিন খিদে থাকে।প্রবীর অনেকক্ষন পরে জিজ্ঞাসা করেছিল,“তুই রোজ ডিম খাস নারে! দিবা”। “হ্যাঁ, হাফ-বয়েল,তুই খাবি ? কাল আসিস মাকে বলে রাখবো।” দিবানাথ চিত হয়ে শুয়ে বলে।দিবানাথ বলে ফেলে, মনে মনে চিন্তা হয়।মা নিঘ্যাত রেগে যাবে। আজকাল বাবার সাথে হেব্বি কিচাইন। বাবার নাকি বান্ধবী আছে।তাকে সোনার চেন বানিয়ে দিয়েছে।
ডিমটার খোসা ছাড়াতে হাতে গরম লাগছিল প্রবীরের। ডিমটা নুন লাগিয়ে মুখে পুরে চোখ তুলল সে। সামনে চোখ তুলে দেখল দিবানাথের মা একটু কুটিল চোখে তাকিয়ে আছে। “তোর মা এখন কটা বাড়িতে কাজ করে?” একটু তীব্র স্বরে দিবানাথের মা বলে। “ মার খুব শরীর খারাপ , বেশী কাজ পারে না।” একটু থেমে বলে ,“এখন একমাত্র সাধু দা দের বাড়িতে করে।” “ তা, তুই কিছু করিস না কেন? পনের বছর বয়স হয়ে গেছে।বসে বসে খাস!” দিবানাথের মা খরতর কণ্ঠে বলে।দিবানাথ লজ্জা পেয়ে যায়,“ চল প্রবীর মাঠে যাই”,প্রবীরকে হাত ধরে টানে।দিবানাথের মা বলে, “ একটা সাইকেল রিক্সা চালাতে পারিস তো। প্রতিদিনের বাজারের খরচ উঠে যাবে!” প্রবীরের পেটের মধ্যে কেমন ঘুলিয়ে উঠছে। সে দিবানাথের সাথে মাঠে গেল না। খুব ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। একদিনে অনেক বড় হয়ে গেল সে।বাবা কাজ করত যখন তখন দিবানাথের জন্যে কত দিন ডিমের মামলেট বানিয়ে দিয়েছে মা। মায়ের হাতের খাসির মাংস খেয়ে বাবার অফিসের বড় বাবু কি খুশি হয়েছিলেন। মা ফিরলে আর কাজ করতে দেবে না প্রবীর। দিবানাথের মা ঠিক বলেছে। তার উচিৎ নয় এভাবে বসে বসে খাওয়া। একা একা কাঁদল খুব।সর্দি ভরভরে ভাঙা গলায় খালি বাড়িতে কিছু শব্দ হল অনেকদিন পর।
সকালে বাজারের জন্যে রাস্তায় বার হতেই, শিউলির বাবা দেখল গলির সামনে প্রবীর দাঁড়িয়ে।“কি রে মুখ শুকনো কেন?” আলগা একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে, প্রবীর খুব অপ্রস্তুত ভাবে মৃদু স্বরে এগিয়ে এসে বলল, “ আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?”
প্রবীর সোজা ভাবে চোখ রাখতে পারে না শিউলির বাবার দিকে। শিউলির বাবা একটু অবাক হয়ে তাকায়। “ তুই কি কাজ করতে পারবি? বাড়ি যা। আমি তোর মার সাথে কথা বলব ।” “ না, না… মাকে কিছু বলবেন না।মা আমাকে কিছু করতে দেবে না। শুধু বলে পড়াশোনা কর।আমি পড়া ভালো পারি না। মাথায় কিছু ঢোকে না।” “তুই বাড়ি যা। আমি তোর মায়ের সাথে কথা বলব।” আগ্রাসী গলায় প্রবীর সানুনাসিক চিৎকার করে ওঠে, “ একটা রিক্সার ব্যবস্থা করে দিন না ,কাকু আমি চালাব। আমার পনের বছর বয়স হয়ে গেছে। মাকে আর কাজ করতে দেবো না” ।
রাস্তায় চিৎকার শুনে শিউলির মা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। প্রবীর কে দেখে একটু উদ্বেগের মধ্যে পড়ে যান। শিউলি অংক খাতা ছেড়ে মুখ বার করে। মা তাড়াতাড়ি ওকে ঢুকিয়ে দেন। খুব বকে দেন। শিউলি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সরে যায় পড়ার জায়গায়। সেদিনের ঘটনা মাকে সে আগেই জানিয়ে ছিল। সেদিন রাতে শিউলি ঘুমিয়ে গেলে , শিউলির মা শিউলির বাবাকে বলে, “ ছেলেটা কেমন হয়ে গেছে। শিউলি কে চোখ দিয়ে গিলছিল সেদিন, আমার ভয় করছে গো। ওর বাবা আর কত দিন জেলে থাকবে? ওর মা বেচারির কপাল এতো খারাপ। প্রবীর ছেলেটা দিবানাথ বলে যে ছেলেটার সাথে মেশে ওটাও তো খুব পাকা। ”
“ দেখছি কি করা যায়। রিক্সা চালাতে চাইছে। রিক্সা চালানো চাট্টি খানি ব্যাপার।”
“ ও যেন আর এই বাড়ি না আসে। শিউলি অনেক সময় একা থাকে। আমার খুব ভয় করছে।”
“আরে ,না না কিছু হবে না”
শিউলিদের বাড়িতে প্রবীরের মা এলো। শিউলির মা পরিষ্কার জানাল, “তোমার ছেলে আমার মেয়ের ইস্কুলের সামনে কি করে? এদিকে আবার রিক্সা চালাতে চাইছে। আমাদের রিক্সা কিনে দেবার মত ক্ষমতা নেই।তুমি ওকে বোঝাও”। বহুক্ষন কাঁদল প্রবীরের মা। তারপর কিছুক্ষন পর শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। সেদিন প্রবীর মায়ের কাছে প্রচণ্ড মার খেলো। রাতে ভাত খেতে বসে দেখল ভাতের পাশে ডিমভাজা। মায়ের চোখে আজ আর জল নেই। কেমন ভয়ানক শুকনো। খুব ভয় ভয় করতে লাগল। বাবা ফিরে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মা ঘুমালো না । বাসন মাজতে লাগলো ঘষ ঘষ করে। ঘুমাতে গেল প্রবীর।
শিউলির ঘুম ভাঙল শিউলির বাবার ডাকে।“ওঠ একটা খারাপ ব্যাপার হয়েছে। প্রবীরের মা ওদের রান্নাঘরের কড়িবর্গা থেকে ……।” শিউলি কেমন থম্ মেরে গেল। মা হাউমাউ করে কাঁদছে। শিউলির বাবা উঠোনের মাঝখানে টুল পেতে বসে আছে। শ্মশান ফেরত চান না করে ঘরে ওঠেনি।“ তুমি ওই ভাবে না বললেই পারতে শিউলির মা, ভদ্রঘরের মানুষ। কোনদিন কাজ করে খায়নি। সেখানে লোকের বাড়ি বাসন মেজে … তার মধ্যে এত অপমান।” শিউলির মা চোখের জলে আলুথালু হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল , “ওকি কিছু লিখে গেছে নাকি! তাহলে তো খুব বিপদ”।
“ নাহ্ ,কি লিখবে। আর কাকেই বা বলবে। রান্না বসাও। আমি চান করে আসি”। শিউলির বাবা কলতলায় যায়। রাতে শিউলির মা বুঝতে পারে মেয়ে ঘুমায়নি।“ ঘুমা, কাল তো ইস্কুল যেতে হবে। পরের হপ্তাতে পরীক্ষা।” “মা, পেবু কার কাছে থাকবে মা। ওই বাড়িতে তো আর কেউ নেই”। শিউলির বুজে আসা গলা থেকে কোন মতে এই শব্দ বার হল। শিউলির মা আর শিউলি দুজন দুজন কে জড়িয়ে নানান কষ্ট পেতে পেতে কাঁদতে লাগল।
গরীব মানুষ আত্মহত্যা করলে প্রধান কারণ ,সেই মানুষটার অর্থকষ্টটা।সে কোন কারণে দুঃখ পেয়েছে কিনা কোন তদন্তের মধ্যে আসেনা।তাই কোন তদন্ত হয়নি। প্রবীরের সাদামাটা বাবা নাকি জেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে খুব কান্নাকাটি করছে । আর বেশীদিন নাই শাস্তি শেষ হতে। নেড়া মাথায় প্রবীর ইস্কুল যাওয়া ছেড়ে দিল। বাসস্ট্যান্ডের কাছের পাইস হোটেলে কাজ করত বঙ্কা। বঙ্কার বাম হাত টা নুলো। অসম্ভব বুদ্ধিমান বঙ্কা প্রবীর কে রোজ খাওয়াতে লাগল। তার পরিবর্তে সে প্রবীরের বাড়িতে রাতে ঘুমাতে লাগল। দুরের কিছু আত্মীয় এসে খোঁজ খবর নিয়ে ছিল কদিন।
তারপর… ‘পরের ছেলে পরমানন্দ যত গোল্লায় যায় ততই আনন্দ’। প্রবীর আর দিবানাথদের বাড়ি যায় না। দিবানাথ রোজ একবার দেখা করতে আসে। প্রবীর বঙ্কার সাথে থেকে কিছু অদ্ভুত কাজ শিখেছে। যেমন,ঝুরঝুরে আলু ভাজা বানান, ডিমের ঝোল রান্না করা, ময়দা মাখা আর জ্যান্ত মুর্গি এক কোপে কাটা। যেদিন ভালো করে কাজ গুলো করতে পারে। সেদিন চিৎকার করে বলে “মা,তুমি দেখে গ্যেলা না… আমি কেমুন কাজ করতে পারি।”
দিবানাথ বিকেল বেলা এসে দেখল ,প্রবীর মন দিয়ে ক্ষুর দিয়ে দাড়ি চাঁচছে। “তোর দাড়ি হয়েছে পেবু? এমনি করে চাঁচলে খড়খড়ে দাড়ি হবে।তুই ক্ষুর কোথায় পেলি পেবু।”দিবানাথ একটু উদ্বেগের সাথে জিজ্ঞেস করে। বারান্দায় একটা পুরানো ইজিচেয়ারে শুয়ে ছিল বঙ্কা, তিড়িং করে উঠে বলে, “ আমি বে, তোর লাগবে,আমার কাছে নানান সাইজের আছে”। দিবানাথ চমকে উঠে বলে , “না না ,আমাকে আমার ছোটকাকা রেজার কিনে দিয়েছে।আমার লাগবে না।” “উড়ি লে, তোরা কি বড়লোক। তোর বাবার তো আবার দুটো বৌ… আরেকজন যেন কোথায় থাকে… সাহেব পাড়া তে …” বঙ্কা চোখ দিয়ে বিঁধতে বিঁধতে দিবানাথ কে বলে। দিবানাথ খুব অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে বার বার প্রবীরের দিকে তাকায়। প্রবীর আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের সদ্য কামানো গাল দেখতে থাকে। যেন কিছু শুনতে পায়নি। দিবানাথ কে এই ভাবে খারাপ কথা বলছে বঙ্কা তাতে যেন ওর কিছু যায় আসে না।ধীর পায়ে প্রবীরদের বাড়ি থেকে বার হয়ে আসে সে। এর চাইতে গানের ইস্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখা ভালো ছিল। শিউলিদের বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল নিয়ে গেল। শিউলিদের বাড়ির সামনে একটা বিরাট পোল বসছে। লোকজন বেশ উৎসুক। শিউলির বাবা খুব ব্যস্ত হয়ে ক upথা বলছে। শিউলিদের বাড়ি ফোন আসছে। দিননাথের মনে পুলক জাগল। ওদের বাড়ির পেছনে একটা সরু গলি আছে, নিচু প্রাচীর। ওদের বারান্দায় গামছা মেলা আছে। শিউলির টেপ জামা। সাইকেল নিয়ে খুব জোরে ইট ভাঁটার মাঠে গেল দিননাথ। আজ অন্ধকার হওয়া অবধি ওখানেই থাকবে।
“বুলুদিদির সাথে কথা বলা যাবে ,কি আনন্দ হবে বাবা।”শিউলির খুশিতে মুখ ডগমগ।শিউলির মাও খুব খুশি। “ফোন না হলে আজকাল আর চলে না।সবাই তো দূরে দূরে। তারমধ্যে চিঠিপত্র এতো দেরীতে আসা যাওয়া করে।” ফোনে খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কে শিউলির বাবা বলে।শিউলিদের পাড়ায় ফোন থাকা বাড়ি হিসাবে শিউলিরা একটু বেশী গুরুত্ব পায়। নানান সময়ে ফোন আসে। শিউলি আর শিউলির মা তাদের বাড়িতে ডাকাডাকি করে । কেউ কেউ আবার একটু ফোন করে খোঁজ নিয়ে নেয় কারো। সন্তান জন্ম, মৃত্যু সংবাদ, গন্তব্যে পৌঁছানোর খবর, বিয়ের তারিখ ঠিক করা, এছাড়া নানান খবর। শিউলি আর বুলুদিদি সপ্তাহে একঘণ্টা বাঁধা গল্প জারি হল। কিন্তু শিউলিরা কেউ জানল না। ওদের ফোন মাঝে মাঝে বেজে ওঠে কিন্তু ধরলে কেউ কথা বলে না।দিবানাথ শিউলিদের নম্বরটা জোগাড় করেছে।কথা বলার সাহস তার নেই। কিন্তু শিউলির ‘হ্যালো’ শুনে সে ফোন রেখে দেয়।
বঙ্কা প্রবীর কে রান্না শিখিয়ে দেওয়াতে খ্যাটন টা আজকাল ভালো হয়।কিন্তু একটা মেয়েছেলে পেলে জীবন টা সুবিধার হত। একটা বিয়ে করবে এরপর। তাকে পালংকের ওপর রেখে দেবে। তাকে নিয়ে সিনেমার মত জায়গায় বেড়াতে যাবে… ফিনফিনে কাপড় পরা সেই মেয়ে… উঃ… কিন্তু চমক ভেঙে যায়। নুলো হাত দেখে সুন্দরী রা আসবে? টাকা লাগবে টাকা। অনেক টাকা হলেই… সুন্দরী… পায়ে পায়ে কুকুরের মত ঘুরবে। ইস্ …ভাবতে গিয়েই তার যৌবন শরীরে জেগে ওঠে। এমন সময় হঠাৎ দেখে, বারান্দায় একটা বুড়ো লোক। খুব অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। ঘরের ভেতর থেকে এক ছুটে বার হয়ে আসে প্রবীর। ভাঙা গলায় আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে “বাবা…।”
“আমার সব শেষ হয়ে গেল দাদা। আপনার কাছে এত উদাসীনতা আসা করি নি। ভেবেছিলাম আপনারা দেখবেন।” আবেগ তাড়িত কণ্ঠে প্রবীরের বাবা শিউলিদের উঠোনে সূর্য নেভা সন্ধ্যে বেলায় বলে চলে। শিউলির বাবা তাপস বাবু লজ্জা আর অপ্রস্তুত হয়ে সামনে বসে আছেন কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। “ এখন ছেলে কে মানুষ করতে হবে। তাকে নিয়ে বুক বাঁধুন। পেবু মানুষ হয়ে গেলেই তো আপনার জীবন সার্থক।”কোন রকমে বুদ্ধি করে বললেন তাপস বাবু। “ ছেলে কে আর মানুষ করতে পারব! ও যে কেমন হয়ে গিয়েছে, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। কথা বলে দেখুন। আমার অমন চনমনে ছেলে কেমন হয়ে গেছে। বাস স্ট্যান্ডের বঙ্কা ওকে খারাপ করে দিয়েছে। জানেন মুর্গি কাটার দোকানে নিয়ে গিয়ে মুর্গি কাটতে শিখিয়েছে। ওই হতচ্ছাড়া কে আমি মেরে তাড়ালাম। আমাকে আবার বলে আপনার ছেলে কে একদিন আচ্ছা করে প্যাদাব। পেবু আর পড়াশোনা করতে পারবে কি না কে জানে! ওর মা তো মরে বাঁচল, আমি একে নিয়ে কি করি” “একটা ডাক্তার দেখান” তাপস বাবু বলেন।
শিউলির মা রান্না ঘরে লন্ঠন আর হ্যারিকেনে তেল পুরছেন। শিউলি মনে মনে অনেক বড় হয়ে গেল। পেবুর পাশে দাঁড়ানো উচিৎ ছিল তার। এভাবে এড়িয়ে যেতে ভয় পেয়ে যেতে নেই। পেবু কষ্ট পেয়ে এমনি হয়ে গেল। উঠোনে লম্বা ছায়া ফেলে প্রবীর আর তার বাবা চলে গেল।এক ঘর লোডশেডিং এর অন্ধকারের সামনে শিউলি নিজে নিজে শপত নিল। আর কক্ষনো এ ভাবে এড়িয়ে যাবে না।
বঙ্কা কে হোটেলের মালিক হেব্বি ঝাড় দিয়েছে। সাথে দুচার ঘা । বলে দিয়েছে আর যদি কোনদিন ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে মস্তানি করে, তবে একেবারে পা ভেঙ্গে রেখে দেবে।বঙ্কাও তার সহকর্মীদের মালিকের অজান্তে বলে দিয়েছে ‘চান্স পেলে সে মালিকের পাছার ছাল তুলে নেবার ক্ষমতা রাখে। মালিকের বউকে ট্রেনে ভিক্ষা করিয়ে তবে তার শান্তি।সহকর্মীরা এতে বিস্তর ফুর্তি পেয়েছে। কেউ কেউ জানিয়েছে পাড়ার সুন্দরী কোন বউদি নাকি বঙ্কার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বঙ্কা যেন তার কাছে একবার যায়। সেই বউদির শ্বশুর নাকি পুলিশ। সহকর্মীরা সেইখানে বঙ্কার দুরবস্তা দেখার ফুর্তি টা ছাড়তে নারাজ।
প্রবীরের আজকাল খুব ভালো লাগছে। বাবা থাকলে কাজ করতে হবে না। সে শুধু ঘুমাবে। তাকে আর রিক্সা চালাতে হবে না। কিন্তু মুর্গি কাটতে খুব ইচ্ছা করে। নড়েচড়ে বেড়িয়ে বেড়ান মুর্গিটার গলা থেকে ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত বেড়িয়ে এলেই ,আর আওয়াজ করে না মুর্গি টা। ওটা খুব আনন্দ দেয় তাকে। যারা খুব চিৎকার করে কথা বলে ,যাদের খুব গায়ে শক্তি তাদের অম্নি করে কেটে দিতে ইচ্ছা করে। বাবা কে এটা বলবে না। বাবা কে শুধু ভালো কথা বলবে। বাবা কাল রাতে মায়ের কাপড় জামা জড়িয়ে খুব কাঁদছিল।
দিবানাথের আজকাল বাড়িতে থাকতে খুব কষ্ট হয়। বাবা আর মায়ের মধ্যে অশান্তির শেষ নেই। গত তিন দিন থেকে মা কিছু খাচ্ছে না। বাবা কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফেরেনি। সম্ভবত ‘সেই মহিলা’র বাড়ি তে আছে। মা এমনি তে খুব শক্ত মহিলা। শেষ যেদিন খুব ঝগড়া হয়েছিল সেদিন মা ভেঙে পড়েছিল।দিবানাথ শুনেছিল পাশের ঘরে বসে, “তুমি সারাদিন ওখানে কাটাও,কিন্তু রাতে ফিরে এসো। ছেলেটার মুখের দিকে তাকাও। ও যে বড় হচ্ছে। পাড়া প্রতিবেশী ওকে যে হ্যাটা করবে। ওর কথা টা বোঝ।”মায়ের গলায় অসহায় আর্তি শুনে খুব খারাপ লাগছিল দিবানাথের। এই লোকটার কাছে এমন করে নিচু হয়ে কিছু না চাইলেই পারত মা।
সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল দিবানাথ।ঘুম ভাঙেনি পাড়ার কারো। গরমের ভোরের হাওয়া বেশ আরামদায়ক। সাহেব পাড়ার সেই বাড়িটা সে চেনে। খুব ছোট বেলায় একবার কি কারণে নিমন্ত্রিত হয়েছিল।ছোট দোতলা বাড়ীটার সামনে মাধবীলতার গাছ। ফুল হয়েছে। বাবা ওই বাড়িতে আছে এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। একটা নীল সাদা শাড়ি দোতলার বারান্দায়। পেছনে একটা গলি আছে। সেটাতে গিয়ে দেখল দোতলার জানালায় মানিপ্ল্যান্ট আর সিলিঙে ফ্যান ঘুরছে। এক তলার রান্না ঘরে কেউ একজন আছে। এখানেই কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। এখনো ৬ টা বাজেনি।দোতলার ঘরের জানালায় বাবাকে দেখতে পেল দিবানাথ। চুলে নতুন কলপ করেছে। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা বাবা কে দেখে খুব কুৎসিত গালি মনে এলো দিবানাথের। থু করে রাগ বার করে দিল সে। সাইকেল করে বাড়ির সামনের গেটে এল। এক দুধওয়ালা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। বাবার তো দুধ খাওয়া মানা। ওদের বাড়িতে দুধ আসেনা। দরজা খুলে একজন সাধারণ চেহারার মহিলা দুধের পাত্র এগিয়ে দিল। পেছনে দিবানাথ কে দেখে একটু চমকে গিয়ে ,এক গাল হাসি নিয়ে বলল, “ওমা তুমি এসেছ। এস এস। খুব ভালো হল। আজ আমি পায়েস করব।অসীমের আজ জন্মতিথি। খুব ভালো হল। এস এস।”
আজ বাবার জন্মদিন।মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। গেটের পাশে সাইকেল রাখে সে। পায়ে আওয়াজ করে বাড়িতে ঢোকে। দোতলায় সোজা উঠে যায়। অসীম বাবু চমকে ওঠে। “তুই এখানে” তারপর সামলে নিয়ে বলে, “একাই এসেছিস।” রাগে গলা বন্ধ হয়ে গেছে দিবানাথের , তবু খুব শান্ত হয়ে সে বলল, “ বাড়ি চল বাবা। মা তিন দিন খায়নি।” সেই মহিলা খুব লীলায়িত স্বরে বলেন, “ তাই হয় নাকি , আজ অসীমের জন্মদিন আমি কত কিছু রান্না করব ঠিক করেছি!” দিবানাথ তাকাল না তার দিকে। কিন্তু বাবার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। এই বাবা মেলায় নাগরদোলা চাপিয়েছে। সবচেয়ে ভালো জুতো কিনে দিয়েছে।নিজের পাতের চিংড়ি মাছ দিবানাথের পাতে তুলে দিয়েছে। মা পা মচকে পড়ে গেলে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে গিয়েছে। এই বাবা কি অদ্ভুত ভাবে বদলে গেল।অসীম বাবু কোন কথা না বলে জামা জুতো পরে দিবানাথের সাথে বার হয়ে এল। বাবার বান্ধবী ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলেন।নিচে নেমে আসবার সময় দেওয়ালে একটা ছবি দেখে অবাক হল দিবানাথ। বাবার খুব অল্প বয়সের একটা ছবি, পাশে এক কাজল পরা কিশোরী। সতের বছরের দিবানাথ বুঝল সে বড় হয়ে গেছে। খুব দ্রুত তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ফাটল টা খুব গভীর। মার জন্যে বুক কেঁপে উঠল তার ।
শিউলি সাইকেল চালাতে শিখে গেল। আজকাল মা কে না জানিয়ে অন্য অনেক রাস্তা দিয়ে এদিক ওদিক যায়। খুব জোরে সাইকেল চালাতে পারে বলে মা বুঝতে পারে না সে কতদূর গিয়েছে। বুদ্ধি করে ঠিক সময়ে বাড়ি ঢুকে যায়।বনলতা দির কাছে ইংরেজি টিউসান পড়ে আজকাল খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। বনলতা দি আগের মত মন দিয়ে সব কিছু কারেক্সান করেন না। দেবু বাবুর টিউসানটা রাতে। প্রায় রাত সারে নটা অবধি। অত রাতে ফেরা অসুবিধা জনক। পাপড়ি দত্ত আর মিতালী সাধুখাঁ দুজনেই দেবু বাবুর কাছে পড়ে। ওদের সাথে কথা বলতে হবে।
প্রবীর নতুন করে ইস্কুল যেতে শুরু করেছে। ইস্কুল তার ভালো লাগে না। তার বন্ধু সবাই উঁচু ক্লাসে উঠে গেছে। অংক স্যার বলেছেন,রোজ ১০ টা করে অংক করতে। কি বাজে ব্যাপার। পাইস হোটেলের পাশে বাজে সিনেমা দেখার একটা ভিডিও হল ছিল। সেখানে একদিন ইস্কুল কেটে যাবে।কিন্তু বঙ্কা যদি আসে… । এলোমেলো ভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চমকে ওঠে। পানবিড়ির বন্ধ দোকানের পাশে বঙ্কা। “কি বে হারামি। বাপ এলো বলে তুই এখন ভদ্রলোক” বঙ্কা কুৎসিত ভাবে চিৎকার করে। প্রবীর দ্রুত দৌড়ে পালাতে যায় । বঙ্কা ধাওয়া করে। বঙ্কা প্রবীর কে ধরে ফেলে । মাটিতে ফেলে দেয় প্রবীর কে। প্রবীর তাকে ছাড়িয়ে পালাতে শুরু করতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে। বঙ্কা এবার ওর কোমর ধরে প্যান্ট টেনে নামিয়ে দেয়। ঘাড় ধরে নর্দমায় নামিয়ে দেয় প্রবীর কে। প্রবীর তাঁর ভাঙা গলায় চিৎকার করে। বঙ্কা একটা ছোট ইটের টুকরো তার মাথায় টিপ করে ছুঁড়ে মারে। আচমকা একটা নারী কণ্ঠের জোরালো আওয়াজ, “ অ্যায় তুমি ওকে মারছ কেন? তোমাকে পুলিশে দেবো।” ঘাড় ঘুরিয়ে বঙ্কা দেখে
একটা ইস্কুল পোশাক পরা মেয়ে। প্রবীর অবাক হয়ে দেখে শিউলি। শিউলি সাইকেল থেকে নেমে একটা থান ইট তুলে নিয়েছে রাস্তার ধার থেকে। মেয়ের গলার আওয়াজে আসে পাশের বাড়ি থেকে লোক বেড়িয়ে এসেছে। বঙ্কা প্রবীরের প্যান্টটা খোলা নর্দমায় ফেলে দেয়। শিউলি প্রবীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্রবীর ওঠে না। চুপ করে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শিউলি ওর কাঁধের সেপ্টিপিন খুলে সুতীর ওড়না টা খুলে প্রবীরের দিকে এগিয়ে দেয়।
প্রবীরের জ্বর এসেছে। বাবা বহুদিন পর কপালে হাত দিয়ে দেখছে বারবার। ঠিক যেমন মা দেখত। বাবা আজকাল ছোট একটা চাকরি করে। সেখান থেকেই খাবার নিয়ে আসে। রান্না হয় না বাড়িতে। বাবা নিজে হাতে গোটা বাড়ি পরিষ্কার করে। কাপড় কেচে মেলে দেয় দড়িতে। কিন্তু মায়ের শাড়ি আর ঝোলে না। বাথরুমের নতুন বালতী এসেছে। আজ কেবল মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আজ শিউলি না থাকলে খুব বিপদে পড়েছিল আজ। শিউলির খুব সাহস। আগে কেমন নরম নরম ছিল। আচ্ছা মা থাকলে ঠিক এমনি করে প্রবীর কে বাঁচিয়ে দিত। বঙ্কা কে ভয় করে প্রবীরের। গায়ে যদি খুব জোর হয় তখন বঙ্কা কে দেখে নেবে একবার।শরীর গরম হয়ে ওঠে। ঠিক কি কি করে বঙ্কা কে কষ্ট দেওয়া যাবে ভাবতে থাকে সে। ঘুম আসে তার। ঘুমের মধ্যে সে দেখতে পায় তার শরীর বিরাট হয়ে গেছে। একটা লম্বা লোহার লাঠি দিয়ে বঙ্কার পেছনে ঘুরছে। বঙ্কা কে কিছুতেই ধরতে পারে না। সে কেমন ফস্কে ফস্কে যায়। মাঠে খুব হাওয়া । ওকি একটা লাল রঙের ঘুড়ি ওটার দিকে ছুটে যায় প্রবীর। “আমাকে ঘুড়ি টা দিবি” হলুদ রঙের ফ্রক পরা একটা মেয়ে বলে। মেয়েটা তো শিউলি। শিউলি এইটুকু মেয়ে। শিউলি বড় হয়ে উঠছে। শিউলি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ঘুড়িটা হারিয়ে গেছে।প্রবীর কি দেবে শিউলিকে। প্রবীর পুরুষ হয়ে উঠছে। প্রবীর ঘেমে উঠেছে।
দিবানাথ আর তার বাবা অসীম বাবুর মধ্যে সোজাসুজি কথা হয়ে গেল। দিবানাথ পরিষ্কার জানিয়ে দিল, বাবা এ ভাবে মাকে কষ্ট দিতে পারে না। অসীমবাবু নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল যে, বনলতা তাঁর কিশোর বেলার বান্ধবী। তাঁর পক্ষে তাঁকে ত্যাগ করা সম্ভব নয়। দিবানাথ বাবাকে জানিয়েছে, তাদের দুজনের জীবন যাপনের জন্যে যা খরচ লাগবে সেগুলো দিয়ে বাবা যা ইচ্ছে করুক। সম্পত্তি তাদের নামে করে দিক। দিবানাথের মা স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন।এইসব মাথার মধ্যে গজগজ করে দিবানাথের। সে সাইকেল নিয়ে টেলিফোন বুথের দিকে যায়। একটা মামা বাড়িতে ফোন করা দরকার। ফোন করে মামাতো দাদাকে সব জানাল । মামাতো দাদা বললেন, সে আর তার বাবা খুব শিগ্রি তাদের কাছে আসছে। ফোন নামিয়ে রেখে , শিউলির ফোন নম্বর টা মুখস্ত আছে দিবানাথের। সে রিং করে। ওপাশে ফোন ধরে শিউলি। হ্যালো হ্যালো করে সে। দিবানাথ মন ফুরফুরে করে দেয়। ফোন নামিয়ে রাখে সে। মুখে স্বাভাবিক ভাবে হাসি ফুটে ওঠে।
শিউলিদের বাড়িতে প্রবীরের বাবা আর প্রবীর এসেছে। শিউলির মা ঘুগনি বানিয়েছিল। প্রবীর খুব মন দিয়ে খাচ্ছিল। শিউলি কে প্রবীরের বাবা বারে বারে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। যদিও শিউলি কিন্তু মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছে। বাবা বাঁচিয়ে দিয়েছে। শিউলির খুব মায়া লাগছিল প্রবীর কে দেখে। কেমন হারিয়ে যাওয়া মানুষ। প্রবীর কে শিউলি জিজ্ঞাসা করে, “তোর একটা বন্ধু ছিল না। সেই যে দিবানাথ। ওর সাথে থাকিস না কেন? এই সব বাজে ছেলেদের সাথে কেন মিশিস।” শিউলির মা চোখ দিয়ে বারণ করে কথা বলতে। শিউলি শোনে না। পড়াশোনা করার নির্দেশ দেয়। প্রবীর ঘুগনির বাটি নামিয়ে রাখে। “দিবানাথ খুব ভালো। ও ডিম খাইয়েছে। ওর মা বলেছে রিক্সা চালাতে। বলেছে কাজ করতে।” খুব অস্পষ্ট ভাবে প্রবীর বলে। সবাই শুনতে পায় না। কিন্তু শিউলি পায়।
দিবানাথ মুদি খানা থেকে ভালো মুগের ডাল কিনেছে। খাতায় লিখে রেখেছে। বাবা মাসের শেষে দাম দিয়ে দেয়। আজকাল বনলতার বাড়িতে শনিবার থেকে বুধবার থাকে। বাকি দিন বাড়িতে থাকে। কিন্তু মা কোন কথা বলে না। মা কেবল রান্না করে। চুল বাঁধে না। গান করে না। পুজো করে না। দিবানাথের বুকে বড় বাজে। মুদীর দোকান থেকে বার হয়ে দেখে শিউলি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। একটু চমকে যায় সে। “ এই তুই পেবুর বন্ধু না। আমার সাথেও তো খেলেছিস।” শিউলি একটু চিৎকার করে বলে। আশেপাশের সবাই তাকিয়ে দেখে। এই অঞ্চলে কিশোরী মেয়েরা চিৎকার করে ছেলেদের সাথে কথা বলে না।
“পেবু উলটো পাল্টা ছেলেদের সাথে মিশছে। তুই ওকে বারণ করিস না কেন? ওর মা মরে গিয়েছে। মাথাটাও মনে হয় একটু গোলমাল। তোর বন্ধু হয় না!” শিউলি বেশ চিৎকার করে বলে। মুদীর দোকানি, পাড়ার মাসীমা, মাথায় টাক কাকু, হিরো হয়ে থাকা নতুন বিয়ে করা ছেলে সবাই শুনতে পায়। প্রবীর কে এই অঞ্চলেও অনেকে চেনে। দিবানাথ শিউলির কথায় একটু থতমত খেল। পেবুর কোন দায়িত্ব নেওয়া ওর উচিৎ কিনা সেটা ওর বোঝার বাইরে। তাছাড়া পেবু র সাথে ওই বঙ্কা মস্তান কে সহ্য হয় না তার। পেবুর জন্যে এই সুন্দরী মেয়ের এতো প্রেম উথলে উঠল কেন রে বাবা। “ হ্যাঁ ,বন্ধু তো।” কোন রকম তুৎলিয়ে বলে দিবানাথ। শিউলি সাইকেল থেকে নেবে দাঁড়ায়। একটু সচেতন হয় চারপাশ সমন্ধে।“ ও কেমন হয়ে গেছে। ওই যে বঙ্কা বলে একটা বাজে ছেলের সাথে থেকে কেমন হয়ে গেছে। তুই একটু বুঝিয়ে বলবি ! কয়েক দিন আগে বঙ্কা ওকে মেরেছে।” শিউলি স্বাভাবিক স্বরে বলে। দিবানাথ অবাক হয়। “বঙ্কা তো ওর বাড়িতে ছিল। খুব বন্ধু তো। আমাকে খুব আজে বাজে কথা বলত। পেবু সেই সব শুনে চুপ করে থাকত। সেই জন্যে যাইনি আর ওদের বাড়ি।” দিবানাথ একবার চোখ ওঠায় আবার নামিয়ে নেয়। ওর শিউলির দিকে তাকিয়ে থাকাতে স্বছন্দ হতে পারছে না। শিউলির কোন অসুবিধা ,লজ্জা নেই।“ ও আচ্ছা, আমি তো অত জানি না” শিউলি বলে। “আচ্ছা আমি দেখা করব, পেবুর সাথে।”দিবানাথ বলে।
দিবানাথ কে যত টা অসভ্য ভাবত শিউলি কথা বলার পর আর অত খারাপ লাগলো না। তবে আজকাল বড় রাস্তা দিয়েই বাড়ি যায় আসে। বঙ্কা কোথায় কখন লুকিয়ে থাকে কে জানে। বুলু দিদি বলে দিয়েছে একটা লংকার প্যাকেট ব্যাগে রাখতে। আমের কুসি কাটার জন্যে যে ব্লেড ব্যাগে রাখত,সেখানে একটা ছোট ছুড়ি রাখে শিউলি। বনলতা দির বাড়িতে অনেক মাধবী লতা ফুটেছে। সাইকেল রেখে বেল বাজাল সে। বনলতা দি ওপরের জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। খুব সুললিত গলায় জিজ্ঞেস করল , “ কে গো?” । অন্যদিন অন্য বন্ধুরা থাকলে ফিক ফিক করে সবাই হাসত। তাঁর এই অতি পরিশীলিত কণ্ঠস্বরের জন্যে।
“আমি দিদিমনি!”
“ও,শিউলি রানি, আজ যে ক্লাস নেবো না রে বাবু। আমার খুব শরীর খারাপ। ”
“আমার যে কয়েকটা কম্পোজিসান কারেক্সান করার দরকার”
“আজ বাড়ি যাও, তোমাকে ফোন করে ডেকে নেবো”
শিউলি বিরস বদনে সাইকেলে ওঠে। নাহ্ একে দিয়ে হবে না। দেবু বাবুর কাছে যেতে হবে। বাবাকে আজ বলবে।
দিবানাথের মামা, আর মামী এসেছে। মা চুপচাপ হয়ে গেছে। কোন কান্নাকাটি করে কিছু বলল না। বাবা আজ আর বাড়ি আসবে না বুঝতেই পারল মামা রা। রাতের ট্রেনে ফিরে গেল। দিবানাথ রাতের শোবার ব্যবস্থা হবার পর বহুদিন পর মায়ের পিঠে হাত রাখল। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মা ভেঙে পড়ল। দিবানাথ কে জড়িয়ে কাঁদতে থাকল। দিবানাথ বুঝতে পারে না কি করবে। বেশ কিছুক্ষন পরে বলল “দেখে নিও মা, এই লোকটা একদিন তোমার কাছে থাকবার জন্যে কাঁদবে। তুমি দেখে নিও।”তারপর দুজনেই অনেক কথা বলল। বহুদিন পর ছোটবেলার মত মা বারে বারে মাথার চুল সরিয়ে দিচ্ছিল কপাল থেকে। দিবানাথের মা এই পরিবর্তিত জীবনের জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এবার ছেলে কে তৈরি করতে হবে। লোকটা কে দেখিয়ে দেবে। মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার। এরপর দিবানাথের বাবা আর বাড়ি আসেন না। দিবানাথ আর তার মা টাকা ছাড়া অন্য কোন কারণে তার ওপর নির্ভর নয় বুঝিয়ে সেটা বুঝিয়ে দেয় তারা।
বঙ্কা কে অনেকেই মস্তান বলে চিনে গেছে। সবাই এড়িয়ে যায়। বঙ্কা যদিও পুলিশ কে বেশ ভয় পায়। হোটেলের মালিক তাড়িয়ে দিয়েছে। বঙ্কা বলে দিয়েছে একদিন দেখে নেবে। লোকজন আগে ব্যাপারগুলোয় মজা পেত কিন্তু এখন আর পায় না। শিউলি মেয়েটা কে একদিন হেব্বি চটকানোর ইচ্ছা তার। হাত মুটকে ধরে, জামা কাপড় খুলে চাবকানোর ইচ্ছা হয় বঙ্কার। আচমকা নিজের কব্জি থেকে কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে মন টা তেতো হল। রাস্তা দিয়ে দিবানাথ কে যেতে দেখল। ইট ভাঁটার মাঠের দিকে যাচ্ছে। বঙ্কার চোখ সরু হল। দিবানাথের পেছন পেছন যেতে থাকে। সন্ধ্যে হতে দেরী আছে। বেশ কিছু বাচ্চা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। দিবানাথ একটা ঢালু জায়গা ধরে উঁচু ধাপিতে গিয়ে বসল।খুব সন্তর্পণে পেছনে গিয়ে খ্যা খ্যা হাসতে থাকে বঙ্কা। “কি বে ,ভদ্রলোক তোর বাপ আর বনলতার প্রেম এখন কেমন চলছে”।
দিবানাথের মাথায় খুব খুন চেপে গিয়েছিল। সেদিন বঙ্কা কে মেরে ফেলত সে। কিন্তু মারেনি।বঙ্কার জন্যে একটা কিছু করতেই হবে। অন্য কোন মস্তানের হাতে ওকে খুব মার খাওয়াবে। দিবানাথ মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়। অনেক টাকা তাকে রোজগার করতে হবে। অনেক ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কিছুতেই সেই পথ থেকে সে সরে আসবে না। বাড়ি ফিরে এসে দেখল মা আলমারি থেকে প্রচুর পুরনো কাপড় জামা আর একটা কাশ্মীরি কাজকরা কাঠের বাক্স বার করেছে। মার মুখে কিঞ্চিৎ স্নেহ, “ এই দ্যাখ দিবু তোর বিয়ে হলে তোর বউকে এই মালা টা দেবো। একটা ভারী সোনার চেন। এটা তোর দিদার।সুন্দর না।” দিবানাথ তাকিয়ে দেখল। সোনার এখন দাম কত। এটার দাম কত হবে।কয়েকটা ছোট ছোট সোনার আংটি, রুপোর গয়না দেখাল মা। মার চিন্তা দিবানাথের বিয়েতে বউকে কি দিয়ে আশীর্বাদ করবে। দিবানাথের হাসি পেল। দিবানাথের মস্তিস্ক ইদানিং খুব সচল হয়েছে।মামাতো দাদার সাথে একটা আলোচনা করবে। কি যেন একটা ব্যবসার কথা বলছিল।ব্যবসা করবে দিবানাথ। প্রচুর টাকা করবে।
শিউলির নতুন টিউসানে বাবা ফিরবার সময় আনতে যায়। দেবু বাবু ভালো পড়ান। এখানে এসে শিউলির বনলতা ম্যাডামের আর দিবানাথের বাবার প্রেমের গল্প টা জানতে পেড়েছে। দিবানাথের জন্যে তার খুব খারাপ লাগছে।
ইদানিং আর ‘পেবুর’ খোঁজ পায় না। প্রবীরের বাবা এখন বড় একটা কি কাজ করছে।বুলু দি আর বুলুদির নব বিবাহিত বর আসবে তাই বাড়িতে সাজ সাজ রব। বর এসেই শিউলির দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে তাকায়।শিউলির অস্বস্তি হয়। মা ওকে দিয়ে খাবার পাঠায়। খপ্ করে হাত ধরে লোকটা। বুলুদি কেমন বোকার মত হাসে। শিউলি রাগ করে মা কে বলে খাবার দিতে যাব না।মা বুঝতে চায় না। মার রান্নার ত্রুটি ধরে লোকটা। কখনো নুন বেশী, কখন বলে ঠিক জমেনি। বুলুদি কেমন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সব সময়। যেন লোকটার উপযুক্ত সম্মান হচ্ছে না। মা ,বাবা খুব চেষ্টা করছে আপ্যায়ন করার। রাত জেগে পড়ে শিউলি। বুলুদিদের বড় খাটওয়ালা ঘরে রাতে থাকতে দেওয়া হয়েছে। রাতে নানান অদ্ভুত আওয়াজ। তিন জনেই বড্ড অস্বস্তি নিয়ে বেশ রাত অবধি জেগে কাটায়।রবিবার বিকেলে চলে যাবে ওরা। মা বুলুদিকে একটা শাড়ি কিনে দেবে বলে শনিবার বিকেলে বাজার গেল। শিউলি ইস্কুল থেকে ফিরে একা বাড়িতে প্রথম অসভ্য পুরুষের সামনা সামনি হল। লোকটা ভয়াবহ ভাবে তার কালো ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে এসে শিউলির ঠোঁটে চেপে ধরার চেষ্টা করে, জামার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। শিউলি ছিটকে সরে যায় এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে। লোকটা চোখ সরু করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। শিউলি হাঁটতে থাকে। ভরন্ত দুপুরে রাস্তায় বেড়িয়ে হতভম্ভ হয়ে হাঁটতে থাকে। পাড়ার চৌমাথা তে রিক্সা করে মা আর বুলুদিকে দেখতে পায় সে। মা আর বুলুদি পৌঁছানোর পর পাড়ার সন্ধ্যাকালীন শাঁখ বাজানোর আওয়াজের সাথে শিউলি বাড়ি ঢোকে। লোকটা নির্লজ্জের মত চা খাচ্ছে। শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে মা একটু অবাক হল। রাতে মাকে খুব নিচু স্বরে বলে ফেলল শিউলি। মা বলল, একথা কাউকে না বলতে। বুলু কষ্ট পাবে। বাথরুমে চান করতে গিয়ে বুকের ক্ষত দেখে অপমানে আর কষ্টে কেঁদে ফেলে শিউলি। লোকটাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে।পরের দিন বুলু দিদিরা চলে গেলে শিউলির বাবা যেন খুব শান্তি পেল।ধপ করে চেয়ারে বসে বলে, “ বুলুর বর টা ভালমানুষ হয় নি।”
প্রবীর খুব চেষ্টা করছে ত্রিকোণমিতির অংক গুলো ঠিক ভাবে করার। কিছুতেই পারছে না। ট্যান থিতা আর কস থিটা ব্যপার টা কিছুতেই বুঝতে পারে না। পেন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অমর মাস্টার আর বোঝাবে না। আর একবার যদি বুঝিয়ে দিত। পাস করলে বাবা বলেছে কলকাতা নিয়ে যাবে। পাস করলে সবাই ভালো বলবে। সর্দিটা সেরে গিয়ে এখন ভালো আছে প্রবীর। আচ্ছা শিউলি এই অংক পারবে মনে হয়। ও তো এখন বারো ক্লাস দেবে। ওর কাছে যাবে এটা নিয়ে। যদি খারাপ করে কথা বলে। খারাপ করে কথা বললেই প্রবীরের গলা টিপে দিতে ইচ্ছা হয়। চিৎকার করে কথা বললেই মনে হয় মুর্গির মত গলগল করে রক্ত বার করে চুপ হয়ে যাক। তবু শিউলি তো ভালো।অংক বই আর খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় প্রবীর।
প্রবীর শিউলিদের বাড়ির দরজায় টোকা মারলে শিউলির মার গলা পেল। ভয় ভয় করতে থাকে তার। “ কি জন্যে এসেছ?”ত্রস্ত ভাবে শিউলির মা বলে। খুব থতমত খেয়ে প্রবীর বলে, “শিউলি আমাকে এই অংক গুলো একটু দেখিয়ে দেবে?” ভেতর থেকে শিউলি বলে , “বারান্দায় বস্, আমি দেখছি। ”শিউলির মায়ের বুকে অন্ধকার নামে।কিছুদিন আগে বুলুর বরের ওই ব্যবহার, তারপরে এই আধ পাগল। কিছু যদি করে। ঘরে কি একটা লেখা শেষ করে শিউলি প্রবীরের খাতা টেনে নিয়ে বসে। শিউলির বাবার ফিরতে দেরী হবে। শিউলির মা সামনের দরজা খুলে রাখে। এর মাঝে যদি আবার লোডশেডিং হয় তাহলে খুব মুস্কিল।শিউলি কে খুব ভালো লাগতে থাকে প্রবীরের। প্রবীর মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে থাকে পাহাড়ের ঢাল বুঝে নেবার অংক। বুঝে নেবার চেষ্টা করতে থাকে ল্যাম্পপোস্টের ছায়ার লম্বা দিয়ে ল্যাম্পপোস্ট কতটা উঁচু । শিউলি তার সাধ্যমত চেষ্টা করে। সেই সময় তাদের দরজায় একটা দ্রুত ছায়া সাইকেল নিয়ে সরে যায়।
দিবানাথের বুকের মধ্যে কেমন ছাঁকা লাগে। পেবু কে পাশে নিয়ে এই ভর সন্ধ্যে বেলায় শিউলি কি করে। কেন? শিউলি এতো পাত্তা দেয় কেন? ওই লালা বার হওয়া, সর্দি ঘর্ঘরে, মাথা খারাপ ছেলেটার জন্যে এতো দরদ। এতো কুৎসিত ছেলেটাকে গায়ের কাছে বসিয়ে …।পেবু মুখ তুল্লেই চোখের সামনে শিউলির বুক দেখতে পাবে।শিউলির অমন সুন্দর চোখ। পেবুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি বলে। মাথার মধ্যে ঘুণ পোকা কামড়ায়।রাতে ঘুম আসে না দিবানাথের। যখন অনেক টাকা হবে তখন ওই সব মেয়ে ওর পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করবে। টাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন করে হোক অনেক টাকা। ওই পেবুর সাহস হয় কি করে!
দিবানাথের মাথায় ঘুণ পোকা কাটতে কাটতে অনেক দূর গেল। সে শিউলির ব্যাপার টা ভুলতেই পারল না। ওর ইস্কুলের বন্ধু গুজ্জু সিং বলেছে, মেয়েদের নাকি হেব্বি ইচ্ছা হয় ছেলেদের সাথে ইয়ে করার। ও নাকি কোন সিনেমায় দেখেছে। মেয়েরা চায় ছেলেরা ওদের কাছে আসুক। শিউলিও সেই জন্যে পেবুর কাছে যায়। আসলে তেমন কোন ছেলেকে তো পায় না। সেটাই কারণ। এই ভেবে দিবানাথ নিজেকে ঠাণ্ডা করল। শিউলি কে একবার বাগাতেই হবে। বাড়ি ফিরতেই সে দেখল তন্ন তন্ন করে মা কি খুঁজছে। “ও দিবু, তোর দিদার হার, কোথায় রাখলাম। খুঁজে পাচ্ছিনা।” দিবানাথ পাত্তা না দিয়ে দিয়ে গামছা কাঁধে নিয়ে বাথরুমে যায়। “কোথায় রেখেছ,ঠিক পেয়ে যাবে”।
দিবানাথের মা কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না তার মায়ের দেওয়া সোনার হার। অদ্ভুত লাগছে। বর সংসার খরচের টাকা দিলেও নিজের সম্পত্তি বলে তো এটা ছিল। রাতে ভাত খাবার পর দিবানাথ কে আবার বললেন।টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে দিবানাথ আবার পাত্তা দিল না “ওরে বাবা,ঠিক কোথাও গুঁজে রেখেছ।”মা জানতে পারলেন না,দিবানাথ বড় লোক হবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। হারটা বিক্রি করে প্রায় পনের হাজার টাকা রেডি করছে ব্যবসাতে নামবে বলে। গুজ্জু সিং এর বাড়িতে সবাই ব্যবসায়ী। আজকাল ওদের বাড়ি গিয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকে। ওরা কি ভাবে কাজ করে বুঝতে থাকে। ব্যবসা করার একটা নেশা আছে। সেটা আন্দাজ করে। গুজ্জু সিং কে ওর বাবা একটা জেরক্স মেসিন কিনে দেবে । গুজ্জু কলেজের পাশে গিয়ে একটা খুপরি ঘরে সেটা নিয়ে এবার বসবে। ঠিক মত চালাতে পারলে এক বছরের আগেই টাকা উঠে যাবে। পনের হাজার টাকা কোথায় কি ভাবে ব্যবসাতে লাগাবে খুঁজতে থাকে। টিভিতে একটা বিজনেস ম্যান কে দেখেছে। মন্ত্রিদের পাশে বসে আছে। হেবি স্যুট পরা,চকচকে চেহারা। অমনি হবে সে। বাবা কে দেখিয়ে দেবে, শিউলি কে বুঝিয়ে দেবে, পাড়া প্রতিবেশীর সবাই কে ওর পাশে ভিখারি লাগবে।
ঠিক মত কাজ আর খাওয়া থাকায় বঙ্কা বেশ অসুবিধায় পড়েছে। হোটেলের মালিক এর পেটোয়া লোকজন ওই এলাকায় ওকে দেখলেই মারতে আসে। প্রবীর দের পাড়ায় যেতে ঠিক সাহস হয় না। দিবানাথ সেদিন মারতে এসেছিল। বঙ্কা এখন অন্য জায়গায় ঘুরঘুর করে। বড় বিলের ধারে এক বউদির চান করা লুকিয়ে দেখতে বেশ লাগে। হেব্বি ফিগার। জীবনে বঙ্কার দুঃখ কি কম। একবার যদি একটা মেয়ে কাছে পেত। কিন্তু কাল রাত থেকে খেতে না পেয়ে আজ কিছুই ভালো লাগছে না। কেবল খাবার কথা মনে হচ্ছে। কয়েক টুকরো তেলে ভাসা মাংসের টুকরো। কিংবা কাতলা মাছের গাদা ঝোলে ভাসছে। রসে ডুবু ডুবু লেডিকেনি দুখান। নাহ আজ কাল আর বউদি দেখে কোন আনন্দ নেই।
প্রবীরের খুব ভালো হতে ইচ্ছা করে। মা যেমন ভালো ছিল। মা যেমন তাকে বাবা কে যত্ন করত অমনি যদি কেউ আসে। শিউলি কাল যা বুঝিয়ে দিয়েছে অমনি করে কেউ কোনদিন বুঝিয়ে দেয় নি। শিউলির কোনদিন কষ্ট হলে প্রবীর সব কষ্ট দূর করে দেবে।বাবা আজকাল আর বাড়ি ফিরে কাঁদে না। অল্প করে মদ খেয়ে ঘুমাতে চলে যায়। রাতে আলো নিভিয়ে শুতে যাবার সময় জানালার ওপারে দেখল, পাঁচিলের ওপর বঙ্কা। বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে প্রবীরের। বঙ্কা জানালার কাছে এসে বলে “কিছু খেতে দে না পেবু” । “কোন খাবার নাই,তুই চলে যা” । অনেক অনুনয় করার পর প্রবীরের কাছ থেকে কিছু না পেয়ে বঙ্কা বলে যায় , “ তুই মুখে রক্ত উঠে মরবি” । প্রবীরের মাথা আবার টাল খায় । অগোছাল রান্না ঘরে সে কি যেন হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়ায়।
শিউলি মন দিয়ে ভাত খাচ্ছিল। তাঁকে টিউসানে যেতে হবে।তার বাবা ঘষে ঘষে তেল মাখছিল,ছুটির দিনের দুপুর। এমন সময় দরজা ঠেলে প্রবীরের বাবা এসে ঢোকে। উতভ্রান্ত মুখ। কিছু একটা হয়েছে। রান্না ঘরে শিউলির মা বিড়বিড় করে ওঠে, “ এই হয়েছে বাবা নিত্য উৎপাত”। যা জানা গেল তাতে শিউলির চোখ গোল গোল হয়ে গেল। গত রাতে বাড়ির যত ইঁদুর কে খুঁজে খুঁজে বার করে গলা কেটে মেরেছে প্রবীর। সেগুলো কে সাজিয়ে রেখেছে বারান্দায়।অত্যন্ত আনন্দের সাথে এই কাজ করেছে সে। শিউলির শান্ত শিষ্ট বাবা খুব শক্ত গলায় বললেন , “মেন্টাল হাসপাতালে দিতেই হবে। আপনি বাড়ি যান। আমি চান করে খেয়ে যাচ্ছি। টাকার কথা চিন্তা করবেন না।” উনি জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলেন যে ওদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা আছে কিনা।
দিবানাথ অবাক হয়ে খবর জানল পেবুকে পাগলা গারদে দেওয়া হয়েছে। কি করেছে কেউ ঠিক বলতে পারল না। কেবল জানা গেল শিউলির বাবা আর প্রবীরের বাবা জেলা শহরে গিয়ে দিয়ে এসেছে। আজকাল মাথায় ঘুণপোকা তার আঠাল লালা দিয়ে অনেক কিছু জমিয়ে দেয়। একটা এমনি চিন্তা জমিয়ে খির বানিয়ে দিল। প্রবীর আর শিউলি নিঘ্যাত কিছু ইয়ে অবস্থায় ধরা-টরা পড়েছে।
প্রবীর খুব চেষ্টা করছে ত্রিকোণমিতির অংক গুলো ঠিক ভাবে করার। কিছুতেই পারছে না। ট্যান থিতা আর কস থিটা ব্যপার টা কিছুতেই বুঝতে পারে না। পেন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অমর মাস্টার আর বোঝাবে না। আর একবার যদি বুঝিয়ে দিত। পাস করলে বাবা বলেছে কলকাতা নিয়ে যাবে। পাস করলে সবাই ভালো বলবে। সর্দিটা সেরে গিয়ে এখন ভালো আছে প্রবীর। আচ্ছা শিউলি এই অংক পারবে মনে হয়। ও তো এখন বারো ক্লাস দেবে। ওর কাছে যাবে এটা নিয়ে। যদি খারাপ করে কথা বলে। খারাপ করে কথা বললেই প্রবীরের গলা টিপে দিতে ইচ্ছা হয়। চিৎকার করে কথা বললেই মনে হয় মুর্গির মত গলগল করে রক্ত বার করে চুপ হয়ে যাক। তবু শিউলি তো ভালো।অংক বই আর খাতা ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় প্রবীর।
প্রবীর শিউলিদের বাড়ির দরজায় টোকা মারলে শিউলির মার গলা পেল। ভয় ভয় করতে থাকে তার। “ কি জন্যে এসেছ?”ত্রস্ত ভাবে শিউলির মা বলে। খুব থতমত খেয়ে প্রবীর বলে, “শিউলি আমাকে এই অংক গুলো একটু দেখিয়ে দেবে?” ভেতর থেকে শিউলি বলে , “বারান্দায় বস্, আমি দেখছি। ”শিউলির মায়ের বুকে অন্ধকার নামে।কিছুদিন আগে বুলুর বরের ওই ব্যবহার, তারপরে এই আধ পাগল। কিছু যদি করে। ঘরে কি একটা লেখা শেষ করে শিউলি প্রবীরের খাতা টেনে নিয়ে বসে। শিউলির বাবার ফিরতে দেরী হবে। শিউলির মা সামনের দরজা খুলে রাখে। এর মাঝে যদি আবার লোডশেডিং হয় তাহলে খুব মুস্কিল।শিউলি কে খুব ভালো লাগতে থাকে প্রবীরের। প্রবীর মন দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে থাকে পাহাড়ের ঢাল বুঝে নেবার অংক। বুঝে নেবার চেষ্টা করতে থাকে ল্যাম্পপোস্টের ছায়ার লম্বা দিয়ে ল্যাম্পপোস্ট কতটা উঁচু । শিউলি তার সাধ্যমত চেষ্টা করে। সেই সময় তাদের দরজায় একটা দ্রুত ছায়া সাইকেল নিয়ে সরে যায়।
দিবানাথের বুকের মধ্যে কেমন ছাঁকা লাগে। পেবু কে পাশে নিয়ে এই ভর সন্ধ্যে বেলায় শিউলি কি করে। কেন? শিউলি এতো পাত্তা দেয় কেন? ওই লালা বার হওয়া, সর্দি ঘর্ঘরে, মাথা খারাপ ছেলেটার জন্যে এতো দরদ। এতো কুৎসিত ছেলেটাকে গায়ের কাছে বসিয়ে …।পেবু মুখ তুল্লেই চোখের সামনে শিউলির বুক দেখতে পাবে।শিউলির অমন সুন্দর চোখ। পেবুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি বলে। মাথার মধ্যে ঘুণ পোকা কামড়ায়।রাতে ঘুম আসে না দিবানাথের। যখন অনেক টাকা হবে তখন ওই সব মেয়ে ওর পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করবে। টাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন করে হোক অনেক টাকা। ওই পেবুর সাহস হয় কি করে!
দিবানাথের মাথায় ঘুণ পোকা কাটতে কাটতে অনেক দূর গেল। সে শিউলির ব্যাপার টা ভুলতেই পারল না। ওর ইস্কুলের বন্ধু গুজ্জু সিং বলেছে, মেয়েদের নাকি হেব্বি ইচ্ছা হয় ছেলেদের সাথে ইয়ে করার। ও নাকি কোন সিনেমায় দেখেছে। মেয়েরা চায় ছেলেরা ওদের কাছে আসুক। শিউলিও সেই জন্যে পেবুর কাছে যায়। আসলে তেমন কোন ছেলেকে তো পায় না। সেটাই কারণ। এই ভেবে দিবানাথ নিজেকে ঠাণ্ডা করল। শিউলি কে একবার বাগাতেই হবে। বাড়ি ফিরতেই সে দেখল তন্ন তন্ন করে মা কি খুঁজছে। “ও দিবু, তোর দিদার হার, কোথায় রাখলাম। খুঁজে পাচ্ছিনা।” দিবানাথ পাত্তা না দিয়ে দিয়ে গামছা কাঁধে নিয়ে বাথরুমে যায়। “কোথায় রেখেছ,ঠিক পেয়ে যাবে”।
দিবানাথের মা কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না তার মায়ের দেওয়া সোনার হার। অদ্ভুত লাগছে। বর সংসার খরচের টাকা দিলেও নিজের সম্পত্তি বলে তো এটা ছিল। রাতে ভাত খাবার পর দিবানাথ কে আবার বললেন।টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে দিবানাথ আবার পাত্তা দিল না “ওরে বাবা,ঠিক কোথাও গুঁজে রেখেছ।”মা জানতে পারলেন না,দিবানাথ বড় লোক হবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। হারটা বিক্রি করে প্রায় পনের হাজার টাকা রেডি করছে ব্যবসাতে নামবে বলে। গুজ্জু সিং এর বাড়িতে সবাই ব্যবসায়ী। আজকাল ওদের বাড়ি গিয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকে। ওরা কি ভাবে কাজ করে বুঝতে থাকে। ব্যবসা করার একটা নেশা আছে। সেটা আন্দাজ করে। গুজ্জু সিং কে ওর বাবা একটা জেরক্স মেসিন কিনে দেবে । গুজ্জু কলেজের পাশে গিয়ে একটা খুপরি ঘরে সেটা নিয়ে এবার বসবে। ঠিক মত চালাতে পারলে এক বছরের আগেই টাকা উঠে যাবে। পনের হাজার টাকা কোথায় কি ভাবে ব্যবসাতে লাগাবে খুঁজতে থাকে। টিভিতে একটা বিজনেস ম্যান কে দেখেছে। মন্ত্রিদের পাশে বসে আছে। হেবি স্যুট পরা,চকচকে চেহারা। অমনি হবে সে। বাবা কে দেখিয়ে দেবে, শিউলি কে বুঝিয়ে দেবে, পাড়া প্রতিবেশীর সবাই কে ওর পাশে ভিখারি লাগবে।
ঠিক মত কাজ আর খাওয়া থাকায় বঙ্কা বেশ অসুবিধায় পড়েছে। হোটেলের মালিক এর পেটোয়া লোকজন ওই এলাকায় ওকে দেখলেই মারতে আসে। প্রবীর দের পাড়ায় যেতে ঠিক সাহস হয় না। দিবানাথ সেদিন মারতে এসেছিল। বঙ্কা এখন অন্য জায়গায় ঘুরঘুর করে। বড় বিলের ধারে এক বউদির চান করা লুকিয়ে দেখতে বেশ লাগে। হেব্বি ফিগার। জীবনে বঙ্কার দুঃখ কি কম। একবার যদি একটা মেয়ে কাছে পেত। কিন্তু কাল রাত থেকে খেতে না পেয়ে আজ কিছুই ভালো লাগছে না। কেবল খাবার কথা মনে হচ্ছে। কয়েক টুকরো তেলে ভাসা মাংসের টুকরো। কিংবা কাতলা মাছের গাদা ঝোলে ভাসছে। রসে ডুবু ডুবু লেডিকেনি দুখান। নাহ আজ কাল আর বউদি দেখে কোন আনন্দ নেই।
প্রবীরের খুব ভালো হতে ইচ্ছা করে। মা যেমন ভালো ছিল। মা যেমন তাকে বাবা কে যত্ন করত অমনি যদি কেউ আসে। শিউলি কাল যা বুঝিয়ে দিয়েছে অমনি করে কেউ কোনদিন বুঝিয়ে দেয় নি। শিউলির কোনদিন কষ্ট হলে প্রবীর সব কষ্ট দূর করে দেবে।বাবা আজকাল আর বাড়ি ফিরে কাঁদে না। অল্প করে মদ খেয়ে ঘুমাতে চলে যায়। রাতে আলো নিভিয়ে শুতে যাবার সময় জানালার ওপারে দেখল, পাঁচিলের ওপর বঙ্কা। বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে প্রবীরের। বঙ্কা জানালার কাছে এসে বলে “কিছু খেতে দে না পেবু” । “কোন খাবার নাই,তুই চলে যা” । অনেক অনুনয় করার পর প্রবীরের কাছ থেকে কিছু না পেয়ে বঙ্কা বলে যায় , “ তুই মুখে রক্ত উঠে মরবি” । প্রবীরের মাথা আবার টাল খায় । অগোছাল রান্না ঘরে সে কি যেন হন্নে হয়ে খুঁজে বেড়ায়।
শিউলি মন দিয়ে ভাত খাচ্ছিল। তাঁকে টিউসানে যেতে হবে।তার বাবা ঘষে ঘষে তেল মাখছিল,ছুটির দিনের দুপুর। এমন সময় দরজা ঠেলে প্রবীরের বাবা এসে ঢোকে। উতভ্রান্ত মুখ। কিছু একটা হয়েছে। রান্না ঘরে শিউলির মা বিড়বিড় করে ওঠে, “ এই হয়েছে বাবা নিত্য উৎপাত”। যা জানা গেল তাতে শিউলির চোখ গোল গোল হয়ে গেল। গত রাতে বাড়ির যত ইঁদুর কে খুঁজে খুঁজে বার করে গলা কেটে মেরেছে প্রবীর। সেগুলো কে সাজিয়ে রেখেছে বারান্দায়।অত্যন্ত আনন্দের সাথে এই কাজ করেছে সে। শিউলির শান্ত শিষ্ট বাবা খুব শক্ত গলায় বললেন , “মেন্টাল হাসপাতালে দিতেই হবে। আপনি বাড়ি যান। আমি চান করে খেয়ে যাচ্ছি। টাকার কথা চিন্তা করবেন না।” উনি জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলেন যে ওদের দুপুরের খাবার ব্যবস্থা আছে কিনা।
দিবানাথ অবাক হয়ে খবর জানল পেবুকে পাগলা গারদে দেওয়া হয়েছে। কি করেছে কেউ ঠিক বলতে পারল না। কেবল জানা গেল শিউলির বাবা আর প্রবীরের বাবা জেলা শহরে গিয়ে দিয়ে এসেছে। আজকাল মাথায় ঘুণপোকা তার আঠাল লালা দিয়ে অনেক কিছু জমিয়ে দেয়। একটা এমনি চিন্তা জমিয়ে খির বানিয়ে দিল। প্রবীর আর শিউলি নিঘ্যাত কিছু ইয়ে অবস্থায় ধরা-টরা পড়েছে।
উত্তর প্রদেশে এই সব করলে মেয়ের বাড়ির লোকরা পিটিয়ে মারে, এখানেও শিউলির বাবা আর কি করবে পাগল বলে গারদে ঢুকিয়ে দিয়েছে।পাগলা গারদে হেব্বি পেটানি খাচ্ছে খুব। একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিল দিবানাথ। শিউলিকে একদিন ঠিক পটাতে পারবে সে।
মা সোনার হার খোয়া যাবার পর থেকে একটু চিন্তিত থাকে সব সময়। গুজ্জু সিং যে খুপরিতে ব্যবসা শুরু করবে সেখানে ইলেকট্রিকের কাজ করাবে। ইলেকট্রিকের মিস্ত্রির সাথে নানান রকম কথা বলতে বলতে কেন কি জানি দিবানাথের মনে হতে লাগল সে এই ব্যবসাটা পারবে। ইলেকট্রিকের ব্যবসাটা ভালো করে বুঝতে হবে। মিস্ত্রি খুব বেশী জানে বলে মনে হল না। টাও মিস্ত্রি কে জিজ্ঞাসা করল, কি ভাবে কাজ শেখা যায়। শহরের বেস্ট দোকান হল সনাতন সাধুখাঁর। সনাতনের দোকানে ঢুকলে কাজ টা একটু বুঝতে পারবে দিবানাথ।আজ বড় রাস্তার বিলের ধার ঘেঁসে সাইকেল চালিয়ে ফিরল দিবানাথ।আচমকা বিলের ধারে একটা ঝোপের মধ্যে কাকে দেখতে পেল সে? আরে বঙ্কা না। আজ হাত নিশপিস করে উঠল তার। লুকিয়ে কিছু একটা দেখছে সে। খুব ভালো করে দেখে কারো, বাথরুমের জানালা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।বঙ্কার পেছনে গিয়ে গলা টা পেঁচিয়ে ধরল দিবানাথ। কানের কাছে হিস হিস করে বলল, “ কি রে বঙ্কা চিৎকার করে ডাকব নাকি তোর এই বউদির শ্বশুর কে?শুনেছি পুলিশে কাজ করত লোকটা।”
শিউলির খুব মন খারাপ। একদিকে প্রবীরের ওই রকম ভয়াবহ কাণ্ড। অন্যদিকে বুলুদির শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ভয়ানক অশান্তির খবর।বুলুদির বর আর শাশুড়ি বুলুদিকে খুব মারে। বুলুদি একা একা বাড়ি চলে এসেছে। আর ফিরে যাবে না। মামা বাড়িতে তাই নিয়ে খুব অশান্তি। মা বুলুদিকে সমর্থন করল।শিউলি মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকল রাতে অনেকক্ষণ।শিউলি মনে মনে ঠিক করে নিল বিয়ে করবে না। বিয়ে করলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে।একটা চাকরি খুব দরকার। কি চাকরি ভালো হবে।নিজের পায়ে দাঁড়ান খুব দরকার। মা ঘুমিয়ে গেলে জেগে থাকে সে।ওই বদমাশ বুলুদির বরের আচরণ টা ভুলতে পারে না। আচ্ছা বিয়ে করলে কি ওই ভাবেই পুরুষ এগিয়ে আসে। ইস্ ওই রকম হলে কিছুতেই বিয়ে করবে না। সিনেমা তে তো গান গায়, কবিতা লেখে। ওর ক্লাসের সাধুখাঁ বাড়ির মেয়ে অনেক প্রেমপত্র পায়। তাতে কত কি লেখা! কি যেন সেদিন লিখেছে, ‘তোমার সাথে হল আলাপ, তোমার জন্যে লাল গোলাপ’। আসল ব্যপার টা তাহলে অমন নয়।কেমন যেন মন খারাপ হল তার।
প্রবীর বুঝতে পারছে না কেন তাকে এই বিচ্ছিরি জায়গায় এনে রাখা হল। সে বাড়িতে কেন থাকতে পারবে না। খুব খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করেছে পাঁচ ছয় দিন। একজন ঢুলুঢুলু চোখের ভদ্রলোক এসে কি সব জিজ্ঞাসা করে অসহ্য লাগে। আজ থেকে কিচ্ছু খাবে না। দেখি এবার কি করে এরা। সে বাড়ি যাবে। বাড়ি থেকে দূরে তাকে থাকতে কেন হবে।
“ তুমি খাচ্ছ না কেন?”
“ আমি বাড়ি যাব?”
“তোমার শরীর খারাপ, কিছুদিন এখানে থাকতে হবে”
“ আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন। আমার ক্লাসের পড়া হচ্ছে না।”
“ওহ্ পড়ে একেবারে উল্টে দিচ্ছে।পরে পড়বে। ওষুধ খেতে হবে। তাই খেতে হবে ”
“আমি বাড়ি যাব, ইস্কুল যাব, বাবার কাছে যাব, শিউলির কাছে যাব,”
“ এই ওকে হাত পা বাঁধ তো। ইঞ্জেক্সান টা দিয়ে দিই। তারপর গিলিয়ে দিবি”
আজকাল আর সেই ফালতু ফোন আসে না। শিউলির খুব জানতে ইচ্ছা করে কে করত। তাহলে ওই চিরকুটের চিঠির মতো তার জন্যে কেউ ফোন করত। কে জানে। বটতলার কালী ঠাকুরের সামনে হাত জোর করে মনে মনে রোজ বলে, “ওই রকম বর দিও না ঠাকুর।তার চাইতে বিয়ে না করা ভালো। আর যদি কাউকে পাঠাও তাহলে ভালো ছেলে র সাথে দিও। যেন না মারে। ভালো বাসে। আমাকে। বাবাকে। মাকে।” রেজাল্ট কেমন হবে বুঝতে পারছে না সে। অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে। সায়েন্স নেওয়া ঠিক হল কি না কে জানে। ভালো রেজাল্ট করলে জেলা শহরের কলেজে ভর্তি করে দেবে বাবা। যদি না পারে! ইদানিং খুব বিপর্যস্ত লাগে তার। প্রবীরের কথা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে শিউলির। স্বপ্ন দানা বাঁধলে হেরে যাওয়া মানুষের কথা মনে থাকে না।
দিবানাথ বঙ্কাকে বেশ টাইট দিয়েছে। বঙ্কা বুঝেছে সে খিস্তি দিতে পারে, গায়ে জোর থাকলেও বুদ্ধিতে দিবানাথের সাথে পেরে উঠবে না।দিবানাথ বুঝেছে বঙ্কা কে কাজে লাগাতে হবে। সে বঙ্কা কে দুপুরে খাবার জন্যে টাকা দিল একদিন। তার পরিবর্তে বলল ইলেকট্রিকের দোকানের মালিকের বাড়ির লোকজন রা কে কেমন জেনে আসতে। খবর দিলে আরও টাকা দেবে। বঙ্কার কাছে এসব জল ভাত। দুদিনের মধ্যে জানাল সাধুখাঁ দের বাড়ির মালিকের আরো দুই ভাই আছে। একটা সাথে থাকে আর একটা কলকাতায় থাকে শ্বশুরের ব্যবসা দেখে। তার সাথে সম্পর্ক খুব খারাপ। সম্পত্তি তে তাকে ভাগ দেয়নি মালিক অনিল সাধুখাঁ। বাড়িতে যে ভাই বাড়িতে থাকে সেটা অপদার্থ।নেশা করে। ব্যবসার কিছু বোঝে না। সাধু খাঁ র একটা মেয়ে। মহা ছেনাল। প্রচুর ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। বৌ অসুস্থ। সাধুখাঁ র একজন পোষা মেয়েছেলে আছে। ওর কাজের লোক তিনটে। কেউ সন্তুষ্ট নয়। দিবানাথ নতুন বিড়ি খেতে শিখেছে। বঙ্কা কে দিল। সাথে আরও কিছু টাকা। রাতে খেয়েও বঙ্কার কিছু থাকবে।
প্রবীরের ঘুম ভাঙলেও উঠতে ইচ্ছে করে না। এখানে লাইন করে খাবার নিতে যেতে বলে তার কিছু ভালো লাগে না। তার অংক গুলো শেখা হল না। শিউলির আঙুল গুলো চোখের সামনে ভাসে। ওই আঙুল দিয়ে বইএর অক্ষরের ওপর রেখেছিল। ও ঠিক কষ্ট বুঝে নিত। আচ্ছা কষ্ট থেকে বাঁচতে কি যেন করত? প্রবীরের কিছুতেই মনে পড়ে না।মাথার মধ্যে শুধু মায়ের পা দুটো মনে আসে। মার গলা দিয়ে পেঁচিয়ে থাকা দড়ি। আবার ঘুমিয়ে যায় সে। ভাতের থালায় মাছি বসে।
প্রবীরের বাবা প্রবীর কে দেখে চমকে গেল। একী অবস্থা হয়েছে ছেলের । “না না, একে আমি নিয়ে চলে যাব। এ যে মরে যাবে। ” ডাক্তারের সামনে কেঁদে ফেলে দমবন্ধ গলায় বলে ফেলে। “ নিয়ে যাবেন নিজের দায়িত্বে।” রুক্ষ স্বরে অফিসার বলে। প্রবীর বাবাকে দেখে সম্পূর্ণ ভাবলেশ হীন। চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ছেলের ডাক্তারের দেখা পেলেন প্রবীরের বাবা। যার কাছে ভর্তি করেছিলেন ইনি তিনি নন। একজন অল্প বয়সী ছেলে। চশমার পেছনে কি যেন একটা আশ্বাসের দৃষ্টি। “ ওকে নিয়ে যান। ওকে কেউ যেন খারাপ ভাবে কথা না বলে, সেটা দেখবেন।সময় লাগবে ঠিক হয়ে যাবে”প্রেস্কিপ্সানে খাঁটি বাংলায় কিছু নির্দেশ লিখলেন। একটা ঠিকানা দিলেন জেলা শহরের চেম্বারের,মুখে বললেন “এখানে চলে আসবেন”। বাড়ি নিয়ে এসে প্রবীরের বাবা প্রবীর কে জড়িয়ে খুব কাঁদল খানিক। প্রবীর একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল তারপর মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রবীরের বাবা তার নোংরা জামা কাপড় পরা শরীরের দুর্গন্ধের সাথে মলের গন্ধ পেলেন।
দিবানাথ আজ শিউলির ফোন নম্বরে ফোন করল। বেশ রাতের দিকে। শিউলি বেশ আয়েস করে মাছের কাঁটা চিবাচ্ছিল। অসময়ে ফোন। শিউলির বাবা ফোন ধরে একটু অবাক হল। একটি ছেলে শিউলি কে চাইছে। মা চোখ গোলগোল করে দেখছে। শিউলি আরও বেশী চিন্তিত। মায়ের কাছে বকুনি না ঠেঙানি কি যে প্রাপ্য আছে তার। বাবা আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন , “কি নাম তোমার?”।“ ওদিক থেকে উত্তর এলো,” “ কাকু আপনি আমাকে চেনেন। আমি দিবানাথ। আমি ,শিউলি, প্রবীর এক সাথে ইট ভাঁটার মাঠে খেলতাম। আপনি একবার সবাইকে কালীপটকা কিনে দিয়েছিলেন।” দিবানাথ কথা বলতে শিখে যাচ্ছে। শিউলির বাবার মনে পড়ল। তিনি খুশি হয়ে শিউলি ডাকলেন। শিউলি আর অবাক থাকল না।
“ হ্যাঁ রে, বল কি বলবি?”
“পেবু ,নাকি বাড়ি ফিরেছে ?”
“কই, জানি নাতো!”
“হাসপাতালে, খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিল। একেবারে আধমরা।কাপড়ে পেচ্ছাব পায়খানা করে ফেলছে।”
“সেকি! ওরা চিকিৎসা করেনি?”
“কে ,জানে। আমি ভেবেছিলাম তুই জানিস।”
“ না আমার এবছর উচ্চ মাধ্যমিক না! ইস্কুল আর টিউসান করেই সময় চলে যাচ্ছে”
“ সেটা তো আমারও”এটা বলে মৃদু হাসল দিবানাথ। “অবশ্য তোর মত ভালো রেজাল্টের চাপ আমার নেই”
“আমি ফিজিক্সে পাস করব কি না কে জানে, তুই আবার হ্যাটা করছিস।”
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে শিউলি এরপর বলে “ঠিক আছে রে, বাবাকে সব বলছি” ফোন কেটে দিয়ে দিবানাথের কচি গোঁফের নীচে এক খানা হাসি উঠে এল। দারুন লাগছে তার । কাছে বঙ্কা থাকলে তাকেও চুমু খেয়ে নিত। ফোনের বুথ থেকে বার হয়ে সাঁ করে সাইকেলে বাড়ি এল। মা খাবার নিয়ে বসে আছে। মার প্রচুর পাকা চুল হয়েছে। “হ্যাঁরে দিবু, তোর বাবার শরীর ঠিক আছে? একটু খোঁজ নিস তো।”
প্রায় এক সপ্তাহ পর খুব সকালে জেগে উঠে স্বাভাবিক চোখে তাকাল প্রবীর। বাবা বুকের কাছে হাতের আঙ্গুলে আঙুল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখ টা একটু হাঁ। খুব মায়া হল বাবাকে দেখে।বাবা কে আর কোন কষ্ট পেতে দেবে না। তার মাথা টা হিজিবিজি হয়ে আছে। কি যেন একটা হয়েছিল। কি একটা ফুলের গন্ধ পাওয়া গেল। কাদের বাড়িতে টিভিতে গান হচ্ছিল। বাবাকে বলবে একটা টিভি কিনতে। চিত্রাহার দেখবে। ‘জু জু জু জু’ বলে একটা গান হয় একটা মা বাচ্চা কে কোলে নিয়ে করে। সাবানের বিজ্ঞাপন দেখায়। ফেনা ফেনা হয়ে সব সাদা হয়ে যায়। সব নোংরা ধুয়ে যায়। আচ্ছা কোথায় টিভি দেখল প্রবীর। বুকে ছ্যাঁত করে উঠল। বাবা ওকে আবার ওই হাসপাতালে রেখে আসবে না তো। ওই তো টি ভি ছিল ওখানে। ওষুধ ,ফিনাইল, আর পেচ্ছাবের গন্ধে ভারী হওয়া অভিজ্ঞতার ভারে বুক কেঁপে উঠল তার। কি অসুখ করেছিল তার। বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল । বাবা কি চায়? বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল? বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল? বুকে পাথর হয়ে বসে এই কথা। বাবা কি চায় প্রবীর কষ্টে থাকুক? বাবা কেন চায়, প্রবীর কষ্টে থাকুক!
কেন? প্রবীরের বাবা ঘুম ভেঙে তাকে স্বাভাবিক ভাবে দেখে আনন্দ পায়। মোড়ের দোকান থেকে চা কিনে আনে।সাথে প্রবীরের পছন্দের বিস্কুট। ব্যাপারটা বঙ্কা নজর করল। নির্লজ্জের মত জিজ্ঞেস করল, “ কাকু, পেবুর শরীর কেমন আছে?” প্রবীরের বাবা সাবধান হলেন। মানসিক অসুস্থ মানুষকে সমাজ বড় বিব্রত করে।
“খুব ভালো আছে রে? একদম ঠিক হয়ে গেছে। এ নে দুটাকা। এই মদন একটা চা দিও তো এই ছেলে কে।” এর থেকে দূরে রাখতে হবে ছেলে কে । যেমন করে হোক।
“আমাকে তুমি ওখানে রেখে এসেছিলে কেন বাবা”
“তুই খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি রে পেবু”
“ কি করেছিলাম?”
“সেটা বললে তোর মন আবার খারাপ হবে।”
“আমি ভালো হব না বাবা?”
“হবি তো,সব ভালো হবে!” দু চোখে আর জল আসে না প্রবীরের বাবার। অসম্ভবের সাধনা করা মানুষ, হেরে যাওয়া স্বীকার করতেও ভয় পায়।
“আমাকে শিউলির কাছে নিয়ে যাবে বাবা! ও আমাকে পড়িয়ে দিলে সব শিখে যাব আমি।আমি আবার ইস্কুলে যাব। খাতাতে লিখব।”
“হ্যাঁ বাবা সব শিখবে তুমি।”
দিবানাথের বাবার সত্যি কি একটা জ্বর হয়েছে সারছে না। জগা ডাক্তার বলেছে বড় ডাক্তার দেখাতে। বনলতার বাড়ি গিয়ে অবাক হল। বনলতার চকচকে চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। তবে ঠাটবাট আগের মতোই আছে। গলায় একটা মোটা সোনার চেন পরে আছে। এটার দাম নাই নাই করে পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল দিবানাথ। বাবা কোন মতে চোখ তুলে তাকাল। চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করে, পরীক্ষা কবে থেকে। পরীক্ষা শেষ হলে দিবানাথ কে নিয়ে জেলা শহরে যাবে। একা ডাক্তার দেখানো সম্ভব না। দিবানাথ মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে ইটভাটার মাঠের পাশে গিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়ায়। বঙ্কা একটা গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে।
“ কি বে ‘জওয়ানি কি জ্বলন’ কেমন দেখলি”
“ হেব্বি মাইরি। কি কোমর! আর নাগিন নাচ তো… ” জিব দিয়ে লালা টেনে বঙ্কা বলে।
“আমি ওই নাচ দেখেই সেদিন বার হয়ে এসেছি, না হলে পুরো কেস খেতাম। পুলিশ এসেছিল। ভজা, আর পদু কে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”
“আমি তার পরের দিন ঢুকেছিলাম, মামাদের টাকা নিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে। এখন কদিন আর চুল্কাবে না।”
“মামা রা কিরকম নেয় রে!”সব কিছু ঘাঁত ঘোঁত এর খবর আজকাল জানবার চেষ্টা করে।
“মেয়েদের ইস্কুলে একটা মাল যা সুন্দরী। তুই মনে হয় চিনিস। ফুরফুর করে সাইকেল চালায়।শিউলি নাম…
কথা শেষ হবার আগেই বলল দিবানাথ, “একদম সাবধান। তাকাবি না। আমার বান্ধবী”
“উড়ি লে, তুই প্রেম করিস্?”
“ না প্রেম করব কেন? গার্ল ফ্রেন্ড।বান্ধবী”
শিউলি খুব ভালো রেজাল্ট না করলেও মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে ফেলেছে। বাবা চিন্তা মুক্ত। এবার জেলা শহরে চলে যাবে। কলেজের হোস্টেল । ওর কোন বন্ধু যাচ্ছে না। শিউলির বাড়ি একদিন রবিবার প্রবীর আর তার বাবা এলো। শিউলি একটু সাবধানে হাসল। প্রবীর কেমন ভাবলেশ। শান্ত হয়ে মোড়ায় বসল। সরষের তেলে ভাজা মুর্গির ডিম প্লেটে করে এনে দিল শিউলির মা। অন্য দিন শিউলিকে বলে অতিথিদের দেবার জন্যে।প্রবীরের বাবা বলল, “ বারবার তোমার কথা বলছিল মা জননী। তুমি নাকি ওকে পড়িয়ে দিয়েছিলে।” বাবার এই কথা শুনে মাথা নাড়ল প্রবীর। শিউলি একটু সাবধান হয়ে গেছে, “ আমি তো আর পড়াতে পারব না কাকু। এবার আমি কলেজে ভর্তি হব। হোস্টেলে থাকব।” “আমারাও চলে যাব। দূরে চলে যাব। এখানে থাকলে আমি ভালো থাকবো না।এখানে মা কষ্ট পেয়েছিল। হাওয়াতে তার গন্ধ” এক নিঃশ্বাসে বলল প্রবীর। সবাই চুপ। প্রবীরের বাবা বলল, “ ওই দ্যাখো, অমনি করে বলে নাকি। আমি ভাবছি অন্য কোথাও চলে যাব। এখানে থেকে কাজের জায়গা টা দূরে। আপনারা আমার অনেক করেছেন । তাই জানাতে এলাম।” প্রবীররা অন্য কোথাও চলে গেল। ওদের বাড়ীটা কারা যেন কিনে নিল।প্রবীরের মার সব গন্ধ সরিয়ে দিয়ে নতুন সিমেন্ট বালি দিয়ে ঘর উঠল।কোথায় গেল প্রবীরেরা এটা বঙ্কাও জানতে পারল না। জেলা শহরের একটা সরু গলিতে দোতলায় ঘর ভাড়া নিল প্রবীররা। প্রবীরখুব স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। প্রবীরের বাবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ছেলে কে যেমন করে হোক উপার্জন শীল করতে হবে।
‘ শ্রীচরণেষু,
দিবু পাস করেছে। একদিন রাতের খাবার এই বাড়িতে যদি খেয়ে যাও তাহলে ভালো হত। প্রণাম জেনো।
তোমার অলি’
দিবানাথ মন আরও হিসেবি হয়। বাবার কাছে কত টাকা আছে। বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়ে ব্যাপার টা জানতে হবে। কত টাকা আছে বাবার। ব্যবসাটা খাড়া করতে অনেক টাকা লাগবে।চিরকুটটা বাবা পড়ল। বনলতা পড়ল। বনলতা গলা পরিষ্কার করে বলল, “তোমার মাকে এখানে এসে দেখা করতে বল। অসীমের শরীর খুব খারাপ দেখতেই তো পাচ্ছ।” বাবা এই বিষয়ে কোন কথা বলল না।“ পরশু ডাক্তারের কাছে যাব ।তুই আমার সাথে যাবি”।মাথা নাড়ল দিবানাথ। চোখে রাখল বনলতার গলার সোনার হারের দিকে।
ডাক্তারবাবুর কাছে বাবাকে আনতে এতোটা কষ্ট হবে বুঝতে পারেনি দিবানাথ। বাবা খুব কষ্ট করে হাঁটছে। মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে পরিশ্রমে। বনলতা দিবানাথ কে ঠিক বিশ্বাস করে না। সেই ডাক্তারের সাথে কথা বলল। বেশ অনেক টাকা খরচ হবে । সেটা নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তিত হল না বনলতা বা বাবা। কিন্তু মার যদি এমন কিছু হয় দিবানাথ কি ভাবে চিকিৎসা করবে। মনটা খুব খারাপ হল দিবানাথের। “কলেজে ভর্তি তো হচ্ছ না কি করবে তুমি?” বাবা জিজ্ঞাসা করল দিবানাথ কে। “দেখি একটা দোকানে ঢুকব” দিবানাথ নিঃস্পৃহ ভাবে বলে।বাবা যেন অন্য কেউ। বাবার কোন দায়িত্ব নেই তার জন্যে। প্রবীরের বাবা প্রবীর কে ভালো করার জন্যে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।খুব জ্বালা করছে বুকের ভেতর। খুব জ্বলছে। মা কেন যে ওই চিরকুট টা লিখে দিল!শিউলি কে এই সব কষ্টের কথা বলা যাবে! বললে বুঝবে। বঙ্কা এই সব কষ্ট বুঝবে না।
শিউলি হোস্টেলে এসে একটা খোলা মেলা জানালা পেল। দূরে একটা চার্চ। ওর রুমমেট মেয়ে দুটির একটি চশমা পরা সিরিয়াস। অন্যটি মোটা হাসি মুখ মেয়ে। মন খুব ভালো হল তার। কিন্তু বিছানায় শুয়ে মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ হল। শিউলি জানল না, মা আজকে ভালো করে না খেয়ে শুতে গেছে।
প্রবীর এখানে এসে ভালো আছে। এখানে কেউ জানে না ওদের।নতুন ইস্কুলে কয়েকজন বন্ধু হয়েছে। তারাও ওর মত অনেক কিছুই পারে না। তাই সেই পিছিয়ে থাকা ছেলেদের একটা দল কে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে হেড মাস্টার মশাই। হেড মাস্টার মশাই কে এখানে লোকে ভয় পায় আবার ভালো বাসে। ভাড়া বাড়ি থেকে এবার একটা বাড়ি কিংবা ঘর কেনার কথা ভাবছে প্রবীরের বাবা।পাড়ায় মিউনিসিপালিটি ভোট। দেওয়ালে ভোটের প্রচার ।সকালে অনেক গুলো ছেলে রং তুলি নিয়ে সেই কাজ করছিল।কালো, লাল, সাদা, সবুজ ,কমলা নানান রঙ আর তুলি দিয়ে অক্ষর তৈরি হচ্ছিল। বেলা গড়িয়ে যেতে ছেলের সংখ্যা কমে গেল। প্রবীর অনেক ক্ষন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। খুব মৃদু স্বরে বলল , “আমাকে রঙ করতে দেবে।” লোকটার কানে দড়ি বাঁধা চশমা। মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল , “ ভুল্ভাল করবি না তো। নে এই টাতে সবুজ দে।”মন দিয়ে করল প্রবীর। বাবাকে দেখাবে। একটু খানি কাজ জায়গা রঙ করতে পেরে খুব গর্ব হল মনে মনে। লোকটার নাম ট্যাপা দা। লোকটা র সাথে দেখা হলেই হাসে প্রবীর । সে সব সময় না হাসলেও, চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। লোকটা অনেক রকম কাজ করে। ওষুধের দোকানে মাঝে মাঝে বসে থাকে।আরও অনেক গুলো দেওয়ালে প্রবীরের তুলির ছোঁয়া লাগল। একটা গোটা অক্ষরে একদিন রঙ করল প্রবীর। দেখে খুব সন্তুষ্ট হল ট্যাপা দা, “বাহ্ এই তো বেশ চ্যালা হয়ে উঠেছিস , তাহলে পেন্নামি দে। একটা চা খাওয়া।” হাসি মুখে বলল । প্রবীরের মুখ ছোট হয়ে গেছে। “আমার কাছে টাকা নাই”।“ সে কি রে, বগলে চুল , মুখে দাড়ি তোর পকেটে চা বিড়ির টাকা নাই।”অট্টহাস্য দিয়ে বলল। মুখ নিচু করে আছে প্রবীর। “এই নে তোর প্রথম রোজগার” বলে সবুজ পাঁচ টাকার করকরে নোট এগিয়ে দিল। আর কয়েক মাসের মধ্যে প্রবীরের বাবার দুটো চিন্তার অবসান হল। ট্যাপা দার সাথে নানান কাজে প্রবীর উপার্জন করতে লাগল। আর একটি কানা গলির শেষে এক উত্তরাধিকার হীন বুড়ি মরে যাওয়ায়,পাড়ার লোক তার বাড়ি প্রবীরের বাবা কে বেচে দিল।
“গুরু তোমার বান্ধবী হোস্টেল থেকে ফিরেছে। কি চকমক করছে।” বিড়িতে টান দিয়ে বলে বঙ্কা। দিবানাথ বুঝে গেছে আর শিউলির আশেপাশে যাওয়া বা কথা বলা বেশ দুস্কর।কিন্তু বঙ্কা কে সেটা বলল না, বরং একটু স্টাইল করে বলল “চলে এসেছে। আমি ভাবছিলাম পরের সপ্তাহে।”দিবানাথ এবার সাধুখাঁর দোকানের ব্যাপারে মন দেয়। দোকান টায় ঢুকতে হবে। কি ভাবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না। বনলতা ফরমান জারি করেছে যখন তখন ‘বাবা কেমন আছে ‘ বলে সাহেব পাড়ার বাড়ি চলে গেলে হবে না। বিকেলের দিকে যখন বাবা চা খায় কেবল তখন দেখা করা যাবে। মাকে ব্যাপার টা বলতে ইতস্তত করছিল দিবানাথ। কিন্তু জানাল। দেখল মা একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়া হীন ভাবে কেবল বলল, রোজ যাবি না। হপ্তা তে দুই দিন যাবি। ইলেকট্রিকের দোকানে দুপুরে লোক নেই। দিবানাথ গিয়ে মালিকের সাথে দেখা করবে বলে জানাল। লালা গেঞ্জি পরা অল্প বয়সী ছেলেটা বলল ,অপেক্ষা করতে হবে, দাদা খেতে গেছে। তার সাথে গল্প জুড়ল দিবানাথ। অনেক কিছুই জানতে পারল। বঙ্কা বেটা কেবল ‘ফ্যামিলি ম্যাটার’এর খোঁজ এনেছিল। আপাতত কোন কর্মচারী লাগবে না। কিন্তু ঢুকতে হবে। “ আজ আমাকে যেতে হবে” বলে সে সরে চলে এল।
শিউলি চিরকুট নয়, একটা সুন্দর খামের মধ্যে কার্ড আর চিঠি পেল। তাতে খুব সুন্দর হাতের লেখায়, খুব মিষ্টি করে প্রেম নিবেদন করেছে কেউ। কিঞ্চিৎ পুলকিত হল সে ।কিন্তু পুরুষ সমন্ধে বিপদ সে শিখে গেছে। তাই কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। পত্র প্রেরক আবার চিঠি দিয়ে জানতে চাইল, চার্চের মাঠে একবার দেখা করবে কিনা। সাথে একটা লম্বা কবিতা।
সাধু খাঁ দের ব্যাবসা টা নিয়ে আরও কিছু খোঁজ খবর নিল দিবানাথ। বেশ কিছু গণ্ডগোল আছে। এত বড় ব্যবসা কিন্তু কর্মচারীদের পয়সা কম দেয়। আদতে ব্যবসা টা শিখে নিতে হবে। দিবানাথের চেষ্টা থাকলেও ঠিক ঢুকতে পারছিল না।আসলে কিছুটা ‘ভদ্রলোক’ গন্ধ তার গায়ে লেগে আছে।সেটা পার করে গিয়ে চাইতে পারছে না…,আমাকে আপনাদের দোকানে একটা কাজ দেবেন বলা বেশ কঠিন । দিবানাথ অসুবিধা টা বুঝতে পারছে। দিবানাথের বাবা সম্পূর্ণ বনলতার হাতে বশীভূত। মার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। মা কেমন বিধবাদের মত শাড়ি পরে। টিপ পরে না। সোনার চেন টা খোয়া যাওয়ায় দুঃখ আরও বেড়েছে। তবে দিবানাথ মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা করতে যায়। চেয়ে চেয়ে দেখে বনলতার বাড়িঘরের জিনিস।একটা টেপ রেকর্ডার আছে।বেশ দামী কোম্পানির। চারশো টাকা তে বেচা যাবে। রুপোর চামচ, কাঁসার ফুলদানী, জাপানী ঘড়ি, ক্যামেরা সব গুলোর দিকে তাকিয়ে তৃষিত হয় সে। একটা ব্যবসা তৈরি করতে অনেক টাকা লাগবে। বঙ্কা কে বলেই ফেলল দিবানাথ, “আমরা একটু ভদ্রলোক তো! অনিল সাধুখাঁকে গিয়ে কাজ চাওয়াটা মাইরি হেব্বি পেস্টিজে লাগছে।”বংকা অবাক হল না, খসখস করে গা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “ইসব ন্যাকামি হলি আর খেতে হবে না। পোঁদে নাই ইন্দি ,ভজরে গোবিন্দি। উ শালার অনিলের এক খান ঢেমনি আছে।পাল পাড়ায় থাকে… যাবা একদিন। গিয়ে ন্যাকার মত হাত কচলে বল… থোবড়া তো বেশ হিরো হিরো। ও মাগী পটে গিয়ে যদি কিছু একটা করে।”বংকা পালপাড়ায় অনেক কেই চেনে দেখে দিবানাথ একটু অবাক হল। দিবানাথ কে নিয়ে একটা ঘরে অনায়াসে ঢুকে গেল বংকা। দিবানাথ ভেবেছিল, কোন মধ্য বয়সিনী হবে, দেখা গেল অল্পবয়সী চোখের তলে কালি পরা একটি মেয়ে। একটু বিরক্ত হয়ে বংকার কথা শুনল। বংকা বলে চলল, “ তুমি যদি মাসী হয়ে এই ছেলেটা কে না দ্যাখো কে দেখবে বল!” দিবানাথ মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মেয়েটি থালায় কি একটা বাছছিল। সেটা নামিয়ে রেখে,খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “ আমি কারো মাসী না। যার কথা তাকে বলতে বল।” দিবানাথের দিকে তাকিয়ে বলল , “ কি পাস দিয়েছ? টিউশানি করলে তো পার!” দিবানাথ দেখল মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন মেপে নিচ্ছে।দিবানাথ কোন রকমে জানাল সে ওখানে কাজ করতে চায়।অবাক হল দিবানাথ।মেয়েটি মন দিয়ে দিবানাথের কথা শুনে হাত মুছতে মুছতে বলল, “ পরের সোমবার একবার এস দুপুর করে। বলে দেখব।” বাইরে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে দিবানাথ। বংকা জানায় মেয়েটির আসল নাম, স্মিতা, লোকে ডাকে রেশমি বলে।
শিউলির প্রবল উচাটন মন কে চিঠি দেয় কিছুতেই বুঝতে পারে না। নানান জায়গায় অপেক্ষা করে চিঠি আসতেই থাকে। আজকাল পড়াতে মন বসে না তার। নানান কল্পনা চলছে মনের মধ্যে।কেমন দেখতে সে!পড়ার পাহাড় জমে যাচ্ছে এই করে। ক্লাস টেস্টে ফেল করল সে। জীবনে প্রথম।হোস্টেলের খাটের থেকে নামল না দুদিন কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। নাহ্ অনেক হয়েছে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। এবার থেকে চিঠি এলে আর পড়বে না সে। ফেলে দেবে। রুমমেটরা ওর অবস্থা বুঝল আর মুচকি হাসল।শিউলি মনের সাথে যুদ্ধ করে খাম গুলোকে উপেক্ষা করতে লাগল। খামের আয়তন মোটা হতে থাকে। শিউলি মন দিয়ে ফর্মুলা মুখস্ত করে, লিখে লিখে সমাধান করতে থাকে।চারটে খাতা শেষ করে ফেলল লিখে লিখে। পরের পরীক্ষা ঠিক মতো দিল সে। রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাবার বাস ধরল সন্ধ্যে বেলা।বাসে উঠে জানালার ধারের সিট ।তিন ঘণ্টার জার্নি। কন্ডাকটার চেনা। সে মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে পড়ল।বেশ কিছুক্ষন পর ঘুম ভাঙলে বুঝল ওর পাশে যে মাসীমা ছিল তার বদলে একটা লোক।সাধারণ যাত্রীদের চাইতে দামী সার্ট প্যান্ট পরা লোক।তার মুখের দিকে না তাকিয়ে, শিউলি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বুঝল লোকটা তাকে দেখছে মাঝে মাঝে। অসহ্য লাগে তার।বটতলা এসে গেল। আর কুড়ি মিনিট আছে ওদের বাড়ির কাছের স্টপেজের। লোকটা হঠাৎ বলে ওঠে , “ তোমার কলেজে পরীক্ষা চলছে ?” বিষ মুখে শিউলি বলে ,তার দিকে না তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, শেষ হয়ে গেল।” লোকটা আবার বলে, “এবার তাহলে কদিন ছুটি?” বিরক্ত হয়ে শিউলি হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়ায়। লোকটা নেমে যায়। বাড়ি এসে ব্যাগে একটা নতুন খাম পেল শিউলি। চমকে উঠল সে। পাশের ওই লোক টা? তার মুখ দেখেনি তো। কেবল জুতো দেখেছিল। আঙ্গুলে একটা লাল পাথর। হে ভগবান। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। একদিকে মা যদি জানতে পারে পেটানি খাবে সে। অন্য দিকে একটা লোক তাকে অনুসরণ করছে ভেবে ভয় পেল সে। বাথরুমে ঢুকে চিঠি টা খুলল। সেই চেনা হাতের লেখায় ,
‘ আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো। ভয় না পেয়ে একবার দেখা কর। আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না। বাস্তব কে স্বপ্ন করতে চাই………… ’
এই সব প্রচুর কিছু লেখা। শিউলি খুব দুশ্চিন্তায় পরে গেল। কিছুতেই সে দেখা করবে না। খুব আফসোস করতে লাগল। কেন যে লোকটার মুখটা দেখল না।এবার হোস্টেল একায় গেল না সে। পাড়ার দামু কাকুর সঙ্গ ধরল। শিউলির মার খুব বিশ্বাস মেয়ের ওপর ,মেয়ে বয়ে যায়নি। দামু কাকুর পাশে বসে কিছুটা চিন্তা মুক্ত থাকল। না বাসে ওই ধরণের কোন লোক নেই। ক্রমাগত মানুষের মুখ দেখতে থাকে সে। হোস্টেলে ফিরে বন্ধুদের ব্যাপার টা জানাল। ও যে বন্ধ খাম গুলো ফেলে দিয়েছিল, ওদের একজন মুচকে হেসে এনে দেখাল। সব গুলো তারা পড়েছে। সব কটা চিঠি শিউলি পড়ল। কোথাও সে লিখেছে ,ব্যাডমিন্টন ম্যাচে দু পয়েন্টের জন্যে সে রানার্স হয়েছে, কোথাও লিখছে তার বাবার শরীর ভালো নেই,কোথাও লিখছে সঞ্জয় দত্তের ফার্স্ট সিনেমার টিকিট আছে দেখতে যাবে কিনা… তার মানে তো অল্প বয়সী কেউ। তাহলে লোকটা কে? মহা চিন্তার মধ্যে পড়ল শিউলি। শিউলি এরপর ছোট ছোট কয়েকটা চিঠি পেল।তারপর হঠাৎ আর কোন চিঠি আসে না। এবার কেমন মন খারাপ হচ্ছে শিউলির। প্রথমে ভেবেছিল ,যাক বাবা বাঁচা গেল। কিন্তু কি মুস্কিল কেবল মন কেমন হয়, কিছু হয় নি তো তার। বাড়ি ফিরল শিউলি একগাদা পড়া মাথায় করে । ফাইনাল পরীক্ষার আর চারমাস দেরী। বাড়িতে ফিরে দেখল , মা যেন কেমন একটু খুশ্ মেজাজে আছে। মাঝে মাঝে পাশে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।বাবা একগাদা বাজার করে আনল একদিন। মা বলল , “মামনি কাল তোমার সাথে অপালার মামা শ্বশুরের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে। আজ একটু মাথায় শ্যাম্পু দিস।” “দেখতে আসবে মানে?” আকাশ থেকে পড়ে শিউলি। বুকের ভেতরে উথাল পাথাল। মা আমার বিয়ে দিয়ে দেবার কথা ভাবছে। কি কাণ্ড। এত্ত তাড়াতাড়ি। মুহূর্তে কেঁদে ফেলল শিউলি। মা মেয়েতে বহু টানাপোড়েন রাগা রাগি চল্ল। বাবা খুব মুস্কিলে পড়লেন। “আরে, ওরা আসুক না। এলে ভদ্রভাষায় বলে দেব আমরা মেয়ের এখন বিয়ে দেবো না।” শিউলি কে খানিক শান্ত করা গেল।
শিউলির মা, শিউলির বাবা, আর শিউলি অপেক্ষা করতে লাগল । তারা মনে করেছিলেন বোধহয় কয়েকজন বৃদ্ধ বা মধ্যবয়স্ক লোকজন আসবেন। একজন সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে আর একজন গৃহসহায়ক গোছের লোক।প্রচুর মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ছেলের মা অসুস্থ, বাবা গত হয়েছেন, এই মেয়েটি ছেলেটির দিদি হয়। তার ভাইয়ের জন্যে সম্বন্ধ চাইছে। শিউলির মা জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলে কেন আসেনি? সে এলে তো জানতে বুঝতে সুবিধা হত।” শিউলির মনে রাগ গজ গজ করছে। ছেলের বিরাট পৈতৃক ব্যবসা। খুব ব্যস্ত। বয়স বেশী না। ছেলের ছবি দিল। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় ।শিউলি রেগে ঠিক করে দেখল না। শিউলি কি করতে ভালোবাসে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। শিউলি বুঝল নিজের কথা নিজেকেই বলতে হবে। খুব বুক ঢিপ ঢিপ নিয়ে বলল, “আমি আসলে এম এস সি টা করতে চাই। তারপরে বিয়ে করা টা ঠিক হবে।” মেয়েটি একটুও অবাক হল না, মৃদু হেসে বলল , “ঠিক বলেছ। মেয়েদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ান উচিৎ। বিয়ে হবার পর এখন খুব বুঝছি। তবে আমার ভাই খুব ভালো ছাত্র।মাধ্যমিকে জেলায় স্ট্যান্ড করেছিল। খেলাধুলা এখন করে।” এরপর আর কথা এগোল না। মেয়েটি চলে যাওয়ার সময় শিউলির বাবা ছেলেটির ছবিটা তার হাতে তুলে দিল। মা খুব বকল খানিক শিউলি কে। কিন্তু বাবা আর মেয়ে দুজনেই চুপ করে বকুনি খেয়ে হেসে ফেলল। মাকে জড়িয়ে ধরে শিউলি আদর করে দেওয়াতে সংসারে ফুরফুরে অবস্থা হল আবার।
প্রবীরের দুটো জাঙিয়া লাগবে। বেশ বড়সর হয়ে উঠেছে সে। দোকানে গিয়ে বুঝল ওর কাছে যে টাকা আছে তাই দিয়ে হবে না। ফিরে আসল ঘরে। বাবা দুদিন কাজে যায়নি। বুকে ঘড়ঘড়ে কফ্। বাবা রান্না করেনি। রান্না প্রবীর বসাল, ভাত আর সব্জি । ডিম কেনা হয়নি। দুটো না হলে একটা জাঙিয়া কেনা উচিৎ ছিল এই ভেবে সে মনে মনে বিরক্ত হল। রঙ করার কাজ করে খুব একটা বেশী টাকা পাওয়া যাবে না বুঝতে পারছে সে।বাইরে ওর নাম ধরে কে যেন ডাক দেয়। মুখ বার করে দেখে শিলা বউদি। খ্যাড়খেড়ে গলায় বলে শিলা বউদি বলে, “তোদের রান্না হয়েছে? আমার কাছে থেকে একটু খাবার নিয়ে যা। বাটি নিয়ে আয়।” শিলা বউদির বর বাবার কাছ থেকে মাঝে মাঝে মদ খাবার পয়সা নেয়। শিলা মাঝে মাঝে খাবার দেয়। কাঁকড়ার ঝোল দিয়েছে বাটি ভরে। বাবাকে বিছানা থেকে তুলে ভাত দেয় প্রবীর।প্রবীর বেশ আনন্দ করে খায়। কিন্তু প্রবীরের বাবার শরীর টা ভালো নেই। সে খেতে পারল না। বাবা উঠতে পারছে না। প্রবীর তুলে নিয়ে যায় পায়খানায়। আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে চৌকিতে। বাবার গায়ে জ্বর। খেয়ে নিয়ে ওষুধের দোকান যায় প্রবীর। জাঙিয়ার বরাদ্দ টাকা নিয়ে ওষুধের দোকানে দাঁড়ায়। নিবারণ দা ছাড়া আর কেউ ছিল না। দুপুরে খদ্দের কম। জ্বরের ওষুধ কেনে প্রবীর। নিবারণ দা বলে, “ একটা বড় ডাক্তার দেখা। তোর বাবা টসকে গেলে তখন কি করবি রে ছোঁরা। ”
বাবাকে নিয়ে প্রবীর ডাক্তার দেখাতে গেল। পাঁচশো টাকা ভিজিট। ডাক্তার অনেকক্ষন বুক দেখলেন। টেস্ট দিলেন কিছু। টেস্টের অনেক খরচ। পোস্ট অফিসের আকাউন্ট খুলে প্রবীর টাকা গুলো এক জায়গায় করল। টেস্ট হয়ে গেল। কিন্তু রিপোর্ট বাজে । ফুসফুসে কর্কট। কর্কট মানে কাঁকড়া। কাঁকড়া আর খাওয়া উচিৎ না। কাঁকড়ার জন্যে বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে।বাবা যে কোন দিন মরে যেতে পারে। জাঙিয়া কেনার টাকার চেয়ে বাবার ওষুধ কেনা জরুরি।ওষুধ কিনলেও বুকের কাঁকড়া চলে যাবে না। প্রবীর বোকার মত বাবার পাশে বসে থাকে।
প্রবীরের কাছে যা টাকা আছে তাই নিয়ে প্রবীর এই যুদ্ধ জিততে পারবে না সেটা সে বুঝে গেল। ট্যাপা দাকে মনের দুঃখের কথা সব বলল। ট্যাপা দা সব শুনে প্রবীরের পিঠে হাত রাখে।রঙ করা অর্ধেক করে, কাঁধের গামছা দড়িতে রেখে ট্যাপা দা সার্ট গলায় গায়ে। প্রবীরের হাত ধরে টান মারে । দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রজত বক্সীর বাড়ি যায়। পার্টি লিডার রজত বক্সীর তিনটে কুকুর। তাদের দেখার জন্যে ‘গোপাল কাকা’ আছে। গোপাল চন্দ্র দাস কে সবাই গোপাল কাকা বলে। তার সাথে কথা হল ট্যাপা দার। ট্যাপা দাকে গোপাল বেশ সম্মান করে দেখে বেশ ভরসা পেল প্রবীর। রজত বাবুর কাছে যাওয়া হল। রজত বক্সী খুব বিরক্ত হল। বিরক্ত হয়ে বলল, “কি ভয়ানক, এতো খরচ এর জন্যে আমার কাছে এসেছ। আমার টাকার গাছ আছে নাকি?” পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে জানাল আর কিছু সে করতে পারবে না। ট্যাপা দা চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর প্রবীর কে ঘর থেকে বার হয়ে গিয়ে পাশের দোকানে অপেক্ষা করতে বলল। প্রবীর ট্যাপাদার তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। ‘বুর্জোয়া’ বলে গাল দিচ্ছে ট্যাপা দা। ‘বুর্জোয়া’ মানে কি। আচমকা বংকার কথা মনে পড়ল। বংকা খুব গালা গালি দিত। ও ঠিক এর মানে জানত। ট্যাপা দা কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে এল, চোখ মুখ লাল।প্রবীরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না।দুজনে মিলে কাজে ফিরে গেল। রঙের কাজ করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে ট্যাপা দা বলল, “তোর বাবা বেশীদিন বাঁচবে না, বুঝলি প্রবীর।আমি কিছু করতে পারব না।তুই বাড়ি যা।আমার মা টাও ওই রকম ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। এতো কষ্ট পেত ,মনে হত গলা টিপে মেরে ফেলি। তাতে যদি শান্তি হয়। ” চোখে জল ট্যাপা দার । “ জানিস, শেষে জল অবধি গিলতে পারল না।গরীব মানুষ হয়ে বাঁচতে নেই। যেমন করে পারিস বড়লোক হ্… নাহলে নিজের চোখের সামনে কেবল কষ্ট পেয়ে মরে যাওয়া দেখবি। যা বাবার কাছে যা।”রঙের হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে বাবার কাছে বসল প্রবীর। ওর বাবার গলায় কোন স্বরের আওয়াজ খুব মৃদু,“ফিরে এসেছো পেবু। আমি একটু জল খাবো”। কয়েক চামচ জল দেবার পর ওর বাবা পাশ ফেরার চেষ্টা করে। বাবার কোমরের হাড় বেড়িয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। শিলা বউদি মাছের ঝোল দিয়ে গেছে।
শিউলির নামে আবার একটা খাম আসে। খুলতেই তার মধ্যে থেকে ঝুরঝুর করে এক গাদা ছোট ছোট চিরকুট বেড়িয়ে আসে। নানান রঙের কাগজ কোথাও লেখা,
‘অত ভারী বই ভর্তি ব্যগ নিয়ে ঘুরো না পিঠে ব্যাথা করবে।’
‘মাছের চপ টা তোমার মা দারুন বানায়।’
‘বাসে কেউ অমনি করে বেহুঁশ হয়ে ঘুমায়!’
‘তোমাকে হলুদ রঙের শাড়িতে ভালো লাগছিল।’
‘বাম গালের পিম্পলের দাগ টা আশাকরি কমে গেছে। মাধুরীর পিম্পিল আছে, দারুন লাগে।’
‘এতো অবহেলা, ছবিটাও ফিরিয়ে দিলে’
থ্ হয়ে যায় যায় শিউলি।চিঠি লিখছে যে, বাসের লোক আর কনে দেখতে আসা এক মানুষের ব্যপার। বুকে একসাথে উচাটন, ভয় আর রাগ হয়। নাহ্ এইবার সামনা সামনি হতেই হবে। মাকে কি জানাবে! না জানানই ভালো, জানলেই বিয়ে দেবার জন্যে ক্ষেপে উঠবে।বুলুদির মত খারাপ লোকের সাথে বিয়ে হলে জীবন শেষ। কিন্তু কিভাবে। রুমমেট দের মধ্যেও একটা সিরিয়াস ব্যাপার এল। তারা বিপদ হতে পারে বুঝতে পারছে। শেষে ঠিক হল বাবা মাকে জানাবে গোটা ব্যাপারটা। বাবাকে গোটা ব্যাপারটা বোঝাতে হবে।এতো রহস্যময় কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় করছে শিউলির। কিন্তু কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না। রুমমেট প্রমীলা একলা পেয়ে শিউলি কে বলল, “তুই কোন স্টেপ নিস না। শান্ত থাক। ও নিজে সামনে আসবে।ও এটাই চাইছে।হয়ত খুব কাছেই আছে।আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একা ফিরিস না এবার।”কলেজ শেষ হলে খুব দ্রুত হোস্টেল ফিরে আসে শিউলি। মাকে কিছু জানায়নি শিউলি।সিনিয়ার একটি মেয়ে ওদের বাড়ির কাছে থাকে তার সাথে বাড়ি যাবার বাস ধরে। নাহ্ কেউ আর চিঠি দেয় না। খবর জানতে পারে ,প্রবীরের বাবা আর বাঁচবে না। বুকে ক্যান্সার হয়েছে।প্রবীরের জীবন টা যে খুব কষ্টের সেটা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। ওর বাবা মরে গেলে ওর কি হবে এটা ভেবে বাবা খুব চিন্তাগ্রস্ত। মা রান্না করতে করতে ঝামরে ওঠে।“তুমি আবার তাকে বাড়ি নিয়ে এসে তুলোনা, একে কপাল খারাপ অপয়া টাইপের তার মধ্যে মাথা খারাপ।সব দায়িত্ব নেওয়া যায় না।” বাবা একটু উদাস স্বরে বলে, “ সেই আমরা ছোট মানুষ, আমরা নিজেদের নিয়েই বাঁচি না।” শিউলির সব ঘটনা মনে পরে, সত্যি কপাল খুব খারাপ পেবুর। একটু মন খারাপ হল। সেই দিবানাথ ওর বন্ধু ছিল, ফোন করত মাঝে মাঝে তার সাথে যদি একবার দেখা করা যেত। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিল শিউলি। তার কোন দায় লেগেছে এই সব ভাববার।
বিকেলে চা খাবার সময় একটা ফোন এল। বাবা প্রথমে ধরল, তারপর মাকে ডেকে মাকে দেয়। মা একটু সংকুচিত ভাবে ফোনে কথা বলে সব কিছুতেই হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে থাকে । শিউলি কাঁচা আমড়া চিবোতে চিবোতে অনুচ্চ গলায় মায়ের সাথে বাবার আলোচনা শুনতে পায়। বাবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আগের দিন যে মেয়েটি দেখতে এসেছিল সে ফোন করে খুব অনুনয় জানিয়েছে শিউলি যেন একবার ছেলেটির সাথে দেখা করে।ইটভাঁটার খালের পাশে যে বড় বাড়ীটা হয়েছে ওখানে বাবা ,মা, সহ শিউলি যেন একবার যায়। একবার দেখা করতে চাইছে ছেলেটি। সে শিউলি কে চেনে। শিউলি এত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি। কোন কথা না বলে কেবল কেঁদে যাচ্ছে সে। মা পিঠে হাত বুলিয়ে যায়। বাবা বেশ কিছুক্ষণ পর আবার বলল, “ আরে চিন্তা করিস না। ও ছেলেকে আমরা ভদ্র ভাবে বলে দেবো আমরা এখন বিয়ে দেবো না”।
রিক্সা করে বড় বাড়ির সামনে পৌঁছে বাবা, মা, শিউলি তিন জনেই কিঞ্চিৎ হতবাক হল। অর্থের প্রাচুর্য চুইয়ে পড়ছে। এমন দামী পাথর, রং এর ব্যবহার আগে কোনদিন দেখেনি শিউলি। বিরাট সাদা কালো কুকুর দোতলার রেলিঙে মুখ বার করে আছে। নতুন মানুষ দেখে বেশ কয়েক বার ভুকভুক করল। সেদিনের মেয়েটি ,যার নাম মল্লিকা সে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করল। আজ শিউলি প্রায় কিছুই সাজেনি।বিশাল সোফা আর কাচের টেবিল, সম্ভবত নতুন। তাতে বসতে বলা হল। শিউলির বাবা , মা খুব অস্বস্তি তে পড়লেন। এতটা আর্থিক বৈষম্য তাদের সাথে সেটা বোঝেন নি। একটু উৎকণ্ঠা তাদের হল। দামী কাপে চা এল। “দাঁড়ান এবার ভাই কে ডাকি”,মল্লিকা খুব সপ্রতিভ ভাবে বলল। “বিজু, এই বিজু, নীচে আয়।” বেশ গলার জোর মল্লিকার। শিউলির পা ঘামছে। সিঁড়ি দিয়ে টি শার্ট আর আটপৌরে গেঞ্জির প্যান্ট পরা একটি ছেলে। শিউলির সব গুলিয়ে গেল। পুরুষ মানুষের এতো রূপ হয়!
বিজুর পুরো বিজন প্রকাশ রায়, ওর বাবার নাম কমল প্রকাশ রায়। মা বিছানায় শয্যাশায়ী। ঠাকুর দার গারমেন্ট এর ব্যবসা বাবা উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছিলান। সেটাই বিজু চালায়। তবে এবার অশোধিত কেমিক্যালের ব্যবসা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বিজুর মার খুব ইচ্ছা ছেলের বিয়ে দেয়। শিউলি মুখ তুলে ছেলেটির দিকে তাকাতে পারছে না। সে যে গুচ্ছের চিঠি শিউলি কে লিখেছে, সেটা বিজু বা মল্লিকা কেও বলল না।বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “শিউলির বড় ইচ্ছা আরও একটু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেই জন্যে এখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারছি না।” বিজু একমুখ হাসি নিয়ে বলল, “ একেবারে ঠিক মনোভাব, আসলে আমিও চাই এমন কাউকে বিয়ে করতে যে আমাদের পরিবারের উপযুক্ত হবে,তবে আপনার কি মনে হয় আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছি সংসার দেখার জন্যে, রান্না বান্না করার জন্যে!” এই কথা শুনে অট্টহাসি হেসে উঠল মল্লিকা। শিউলি খুব আশ্চর্য হয়ে সোজা তাকাল ছেলেটির দিকে। এই প্রথম চোখের দিকে তাকাল সে। অহংকার আর মেধার মিশ্রণে ভয়ানক শানিত চোখ ছেলেটার। তার সরু ঠোঁটে চাপা ব্যক্তিত্বের কাছে শিউলির বাবার সোজা সাপটা কথা কোথায় বুদবুদের মতো নেই হয়ে যায়। চারিদিক চুপ। মা অস্বস্তিতে পড়েছে। শিউলি চোখ নামিয়ে খুব শান্ত স্বরে বলল, “আমি এম এস সি না করে বিয়ে করব না।” “আমার মার শরীর ভালো থাকছে না। তিনি বেঁচে থাকতে বিয়ে করতে চাইছি।” বিজু ঠাণ্ডা গলায় বলে।বাবা শিউলির কথায় একটু জোর পান, “আমরা খুব সাধারণ মানুষ, আমাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক হওয়া টা খুব …” তিনি শেষ করার আগেই মল্লিকা বলল, “আমার ভাই আপনার মেয়েকে গত তিন বছর থেকে চেনে।ওর এতো পছন্দ আপনার মেয়েকে … বনলতা দি তো আমাদের মাসী হন। ওর বাড়িতে শিউলির হাতে লেখা একটা খাতা চুপ করে নিয়ে চলে এসেছিল।আপনার মেয়ের হাতের লেখা এতো সুন্দর।আমাকে বলল দিদি , যদি কাউকে বিয়ে করি এই মেয়েকে বিয়ে করব, এতো ভালো ইংরেজি লেখে আর এতো সুন্দর হাতের লেখা।” শিউলি হতবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। সত্যি তো একটা খাতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মা শিউলির দিকে তাকায়। শিউলি কান লাল করে বসে থাকে। বাবা মেয়ের গর্বে আলো আলো মুখ করে ছেলেটির দিকে তাকায়।
দিবানাথ তিন দিন ঘুরল পাল পাড়ার মেয়েটির কাছে। তারপর মেয়েটি ডেকে পাঠাল বংকা মারফৎ। বংকা জানাল, “যাও ঢেমনি তোমাকে সোহাগ করে ডেকেছে, একাই যাও। আমাকে যেতে বারণ করেছে।” দিবানাথ সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়। আজকেই শেষ আর কোন দিন যাবে না। পাল পাড়ায় একটু চুপচাপ চলছে। কদিন আগে নাকি পুলিশ হয়েছিল। খোলা ড্রেনের জন্যে অসহ্য নোংরা। সাধু খাঁ এই খানে এই বাড়িতে আসে জেনে অবাক লাগে দিবানাথের। মেয়েটিকে ডাকতে হল না। বাইরের বারান্দায় বসে পায়ের নখে নেল পালিশ পরছিল। হাসি হাসি মুখে প্রতিবেশীনির সাথে গল্প করছিল। দিবানাথ কে দেখে,উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে আসতে বলল। “কাল সকালে গিয়ে অনিল বাবুর সাথে দেখা করবে। বলা আছে তোমার কথা। ভালো কাজের জন্যে বলেছি। মাল তোলা, ঘড় ঝাঁট দেওয়ার কাজ যেন না দেয় বলেছি।” দিবানাথ খুব নিশ্চিন্ত হল। খুব শান্ত ভাবে বলে “ অনেক উপকার করলেন আপনি।” মেয়েটি হেসে ফেলে, “ বাবা গো আমাকে আপনি বলেছে”। দিবানাথ বলল, “আমি তাহলে আসি”। “সে কি আমি তোমাকে এত বড় সুযোগ করে দিলাম, আমাকে কিছু দাও।”মেয়েটি সোজা চোখে তাকিয়ে বলে। দিবানাথ খুব সঙ্কুচিত হয়ে মানিব্যাগে আলাদা করে রাখা একটা কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা বার করে তার হাতে দিল। দিবানাথের হাত থেকে টাকা নিয়ে স্মিতা ওরফে রেশমি দিবানাথের বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিল। “ টাকা দিলেই হবে! আজ থাক… আমি চেয়ে নেবো।তখন না দিলে হবে না কিন্তু” চোখে রহস্য নিয়ে যৌবনবতী নারী, কাছে আসে দিবানাথের। মাথা অবধি ঝনঝন করতে থাকে। কান গরম হয়। ভেতরের পুরুষ জেগে ওঠে।
সাইকেল নিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফেরে দিবানাথ। পথে শিউলিদের বাড়ি দেখতে পায়। অনেক টাকা হলে শিউলিকে একবার জানাবে… বলবে “শিউলি তোকে আমি বিয়ে করে সুজারল্যান্ড নিয়ে যেতে চাই। খারাপ সিনেমায় ছেলেরা যেভাবে আদর করে তার চেয়ে ভালো ভাবে আদর করব।” মরার খাট যেখানে বিক্রি হয় তার পাশে শুকনো রজনীগন্ধা দেখল দিবানাথ। শিউলি কে সে লাল গোলাপ দেবে। হাজার টাকার লাল গোলাপ। শিউলি সাদা রঙের শাড়ি পরবে… এপাশ অপাশ দেখা যাবে।রাতে আবছা দুশ্চিন্তা হয় । কাল যদি অনিল সাধুখাঁ ঠিক ভাবে তাকে কাজে না নেয়। তখন হবে চিত্তির। মা আজকাল খুব খারাপ রাঁধছে। মায়ের ব্যাপার টা বোঝে দিবানাথ কিন্তু তাও বলেই ফেলল , “খাওয়া যাচ্ছে না মা”। মা আগে হলে জোর বকুনি দিত। কিছুই বলল না। ঘুম আসতে খুব দেরী হল দিবানাথের। ভোরে ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, বংকা সাধুখাঁর চেয়ারে বসে আছে, বলছে কটা মশা মেরে দে। মা ডাকছে খেতে আয়।স্মিতা তার দেহ জড়িয়ে বলছে আমাকে আদর কর, না করলে সাধুখাঁ কে বলে দেব,কণ্ঠস্বর শিউলির মত। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
চারদিকে মশা ভন ভন করছে। এখনো সূর্য ডোবেনি।আজ এবেলায় কোন কাজ নেই প্রবীরের। বাবার বোধহয় একটু আরাম হয়েছে। সাঁই সাঁই আওয়াজটা করছে না। পাশ ফিরে আছে বাবা। প্রবীর খানিক নিজের মাথা চুলকাল। খানিক পুরনো খবরের কাগজের টুকরো পড়ল। কটা লোকাল বেকারির বিস্কুটের টুকরো ছিল তাই খেল। চিনির কৌটোতে খানিকটা চিনি আছে তাই দেখে ঠিক করল চা বানাবে।গত তিন হপ্তা শিলা বউদি তিন বেলা খাবার দিচ্ছে। বেশ কড়া করে চা করল প্রবীর। বাবা কে ডাকল। বাবার গায়ে জ্বর নেই, বাবা ঠাণ্ডা। প্রবীর নাকের নীচে হাত দিল। কোন বাতাস আসছে না। পাশ ফেরাল প্রবীর। নাক মুখ দিয়ে তরল কালো রক্ত বার হয়ে এল।প্রবীর বুঝতে পারল বাবা চলে গেছে। বসে বসে চা খেল প্রবীর। বাবার পায়ের তলায় হাত দিয়ে দেখল। মায়ের পাতা বেঁকে গিয়েছিল। বাবারটা সোজা হয়ে আছে। দুটো গোড়ালি তোশকের সাথে লেগে আছে। হাতের আঙুল গুলো মুঠো বন্ধ হয়ে আছে। বাবার পাশে বসে থাকল প্রবীর। রাতে শিলা খাবার নিয়ে এসে বুঝল। তারপর চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাই কে ডাকল। ট্যাপাদা এল। অজানা অনেক লোক এল। খুব খিদে পেয়েছে প্রবীরের। সে সবার সামনেই শিলার আনা খাবার খেতে বসল। শিলা বারণ করছিল। ট্যাপাদা বলল, “খাক্, প্রবীর খেয়ে নে। বাবার কাজ করতে কিছু টাকা লাগবে, আছে কি তোর কাছে?” প্রবীর একটা কুলুঙ্গি মতন জায়গা থেকে দুশো টাকা বার করে ট্যাপাদা কে দিল। তারপর অনেক রাতে পাড়ার সুখি মানুষের ঘুম ভাঙ্গিয়ে, জোরে জোরে ‘বল্ হরি হরি বল’ চিৎকারের সাথে প্রবীরের বাবা তার মলিন, গ্লানিকর জীবন ফেলে দিয়ে যাত্রা শুরু করল।
দিবানাথ কাজ বুঝে নিতে পারল খুব অল্প দিনের মধ্যেই।মেন রোডের ধারের দোকানে যে রঘু মিশ্র বলে একটা লোক আছে সে ছাড়া আর সবাই মালিক কে গালাগালি দেয়। রঘু মিশ্রর সামনে কেউ খারাপ কথা কিছু বলে না। রঘু দিবানাথ কে মন দিয়ে কাজ শিখতে বলেছে। সাধুখাঁর মেয়ে কে নিয়েও নানান অশ্লীল কথা চালু আছে। দিবানাথ কে সাবধান করল কর্মচারীরা। মেয়ে নাকি তার হিরো হিরো চেহারা দেখে ‘ছেনালি’ করতে পারে। ওষুধের জেনেরিক নাম, কোম্পানির নাম, দামের তফাৎ ইত্যাদি মন দিয়ে শিখতে লাগল দিবানাথ। মা কে যখন বলল আমি একটা কাজ করছি তখন মা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাকে জানাল। এমন কি পালপাড়ার রেশমির কথা। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।তারপর বংকা কে একদিন বাড়ি নিয়ে আসতে বলল। একটু অবাক হল দিবানাথ। “তোর এতো বড় উপকার করেছে, নিয়ে আসিস একদিন। আর তোর বাবাকে এসব জানাস না। বনলতারা খুব বড়লোক তো। এই সব কাজ ঘেন্না করবে।তুই আর ওই বাড়ি যাস না।” মার কথা শুনে দিবানাথ হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়ল। বংকা কে সে এই বাড়ি আনবে না। আর বাবাকে দেখার আছিলায় বনলতার বাড়ি যাবে। মাকে না জানালেই হল।
প্রথম মাসে মাইনে পেল দিবানাথ। খুশি হবার মত না হলেও। বেশ ভালো লাগছে তার। মেনরোডের পাশে সবচেয়ে বড় সেলুনটাতে চুল কাটতে গেল সে। আগে মিঠুনের ছবি থাকত। এখন সঞ্জয় দত্তের। নিজের চেহারা ভালো করে দেখল সে। সাধুখাঁর মেয়ের ব্যাপারে তার একটা আকর্ষণ হয়েছে। মেয়েটাকে যদিও সে একবার দেখেছে। খুব সাধারণ চেহারা। তার সামনে গেলে চেহারাটা খোলতাই করে রাখতে হবে। যাইহোক একবার শিউলিকেও জানাতে হবে যে ‘শিউলি আমি এখন রোজগার করছি।কিছুদিনের মধ্যে নিজের বিজনেস করব।’সেলুনের লোকটা মাথায় হাত দিতেই ঘুম এসে গেল। চুল কাটা হলে, নিজের চেহারা খুব একটা পছন্দ হল না। গালের চামড়া ঠিক ভদ্রলোকেদের মত না। একটু দমে গেল দিবানাথ। বিড়ি খাওয়া কমিয়ে দেবে। সেলুন থেকে বেড়িয়ে দেখল সামনে একটা নেড়া মাথা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেশ নোংরা।বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল ‘পেবু’। “তুই এখানে কবে এসেছিস?” দিবানাথ অত্যন্ত অস্বস্তির সাথে জিজ্ঞেস করে। “খবর দিতে এসেছি, আমার বাবা মরে গেল। তাই……”প্রবীর বলে, “বংকা বলল তুই চুল কাটতে এসেছিস।”দিবানাথের নিজের ডিম পাউরুটির সঙ্গে আর এক প্লেটের দাম খসল পকেট থেকে। পেবুও উপার্জন করে জেনে সে অবাক হল। মনে মনে বিরক্ত হল, “ তোর বাপ মরেছে তো আমার কি হল রে হারামি।” পাড়ার মোড়ের এস টি ডি বুথ থেকে শিউলি কে ফোন করে। শিউলির মা ফোন ধরে। সেখানে দিবানাথ জানায়, ‘পেবুর বাবা মারা গেছে’। শিউলির মা জানায় শিউলি বাড়ি নেই আর প্রবীর ওদের বাড়ি গিয়েও খবর দিয়েছে। এখন আগের মত নেই। এমন কি বংকা কেও আর ভয় পায় না। বংকা কে সাথে করে নিয়ে এসেছিল।
আজকাল প্রবীর সকালে নিজের খাবার ব্যবস্থা নিজে করে নেয়। ও আর ট্যাপাদা দুপুরে ভাতের হোটেলে খায়। রাতে শিলা বউদি রুটি তরকারি দেয়। দুপুরে ভাত খেয়ে একটা বিড়ি ধরাল প্রবীর। আজ আর কাজ নেই। “ট্যাপাদা চল আমার ঘরে।” ট্যাপাদা না বলল না।খুব ভালো লাগছে প্রবীরের রোজ ঘরে ঢুকে মন খারাপ হয়ে যায়। আজ বেশ লাগছে। “ঘর গুছাস না কেন? ঝাঁট মোছা করবি। অসুস্থ হয়ে যাবি তো।”স্নেহ ঝরে পড়ে ট্যাপাদার গলা থেকে। “খানিক পয়সা জমা। তোর তো খরচ নেই।ঘর আছে। তারপর একটা ছোট্ট মতন মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো। যা একটা ঝ্যাঁটা নিয়ে আয়।” “ আমার ঝাঁটা নাই তো। শিলা বউদির কাছ থেকে নিয়ে আসি।” খাটের তলা , কুলুঙ্গি, ছোট্ট বারান্দা সব জায়গা থেকে এক পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় মায়ের মত স্নেহ নিয়ে পরিস্কার করতে লাগলেন।মাঝে মাঝে ভাঙা গলায় গান করছেন, “মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে বিদেয় কর।” তাই শুনে প্রবীর খিল খিল করে শিশুর মত হাসছে। ছোট একটা ফাইল বার হয়ে এল চৌকির তলা থেকে,“এগুলো কি রে পেব্যা।দ্যাখ আবার তোর বাপ কিছু টাকা পয়সা রেখে গিয়েছে নাকি?”
দুজনেই আবার হাসে। একটা গাদা প্রেস্কিপ্সান, ওপরে প্রবীরের নাম লেখা বছর তিনেক আগের। “বাবা, এ কি ওষুধের নাম রে জীবনে তো শুনিনি তোর কি কিডনি তে হার্ট অ্যাটাক, হয়েছিল দাঁরা কি লেখা আছে, ভি আর এ ওয়াই এল এ আর (Vraylar)” । আরও প্রেস্কিপ্সান উল্টে দেখতে দেখতে ট্যাপাদা বুঝতে পারে, তিনি প্রবীরকে যা জানেন তার চেয়ে প্রবীর আলাদা। “তুই মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি ছিলি? কেন রে? মা মরে গিয়েছে সেই দুঃখে!” ট্যাপা দা জানল না প্রবীরের খুব বুকের ক্ষতের জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছেন। যেখানে প্রবীর নিজেও তাকিয়ে দেখে না।শিলা বউদি চা নিয়ে এসেছে। প্রবীর কিছু উত্তর দিল না। ট্যাপা দা বার বার অস্ফুট উচ্চারণে বলতে লাগল, ‘সিজোফ্রেনিয়া’ ‘সিজোফ্রেনিয়া’।
শিউলি একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চারপাশে বিজু স্বপ্ন বোনে, মায়া তৈরি করে আবার অসহায় করে দেয়। বিজু হঠাৎ করে এসে সব ভাবনা চিন্তা বালির মত গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়।সদ্য বিকেলে আচমকা হাত ধরে শিউলির শরীরের এতো কাছে চলে আসে শিউলি মোমের মত গলে যেতে থাকে। সে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু সরে যেতে পারে না। বিজু এক সপ্তাহের মধ্যে সোজাসুজি শরীরের অধিকার চায়। শিউলি চমকে ওঠে। বিজু সব সাবধানতার আশ্বাস দেয়। তারপর এক অপরূপ আধুনিক শহুরে এপার্টমেন্টের সিনেমার মত ঘরে মধ্য দুপুরে শিউলি নিজের কৌমার্য তুলে দেয় বিজন প্রকাশের হাতে।নতুন অভিজ্ঞতাতে ক্লান্ত শিউলি আনন্দ পাবে, না রাগ করবে বুঝতে পারে না। তার খুব ঘুম আসছে। শিউলির কপালে চুমু খেয়ে বলল বিজু বলল, “ নাহ্ তোমাকে মনে বিয়ে করতেই হবে।” শিউলির মা অনেক কিছু বুঝতে পারে বলতে পারে না। মেয়েকে অচেনা মনে হয়। বিয়ের দিন ঠিক করার জন্যে শিউলির বাবাকে বলতে বলে। শিউলির বাবা প্রথমে অতটা উদ্বিগ্ন না হলেও ধীরে ধীরে অসুবিধাটা বুঝতে পারছে। একটা বাইক করে খুব জোরে দুজন এলাকায় ছুটে বেড়ায়। তাঁর ভয় করে কোন দিন কোন দুর্ঘটনা যদি ঘটে। আজকাল বাড়ি ঢুকলেই, শিউলির কেন কি জানি খুব বাজে লাগে। এতো সাধারণ বাড়ি তাদের। বাবা আর মা এতো পিছিয়ে থাকা গরিব গরিব মানুষ। ভালো লাগে না তার। বিজুর সাথে বিয়ে হলে চারিদিক অন্য রকম হবে বুঝতে পারে।
বনলতার বাড়ি যায় দিবানাথ।বাবা ডেকে পাঠিয়েছে। মা যেতে বারণ করেছিল। মা কে সে জানিয়েছে যাবে না। কিন্তু সাধুখাঁর মেডিক্যাল শপ যাবার আগে সাইকেলে নিয়ে বনলতার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে অচেনা লোকজনের গলার স্বর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।খোলা দরজা দিয়ে সোজা ওপরে গেল দিবানাথ। একজন চাকর গোছের লোক আর একটি বড়লোকের মেয়ে। দিবানাথ কে দেখে খুব বিরক্ত হল বনলতা। “যাও গিয়ে ওই ঘরে বসো, সকালে দেখা করে যাবে। এখন ওর বিশ্রামের সময়। এখন এলে অসুবিধা।” বনলতা বলে চলেন। মেয়েটির বোধহয় চোখে কোন জিজ্ঞাসা ছিল। তার উত্তরে বনলতা তাকে বলেন, “ অসীমের সাহায্য প্রার্থী। টাকা পয়সা লাগলে মাঝে মাঝে চাইতে আসে।” মেয়েটি বলে , “দেখতে একদম অসীমদার মতো, আমি ভাবলাম ভাই হয়ত!” দিবানাথের দুঃখ হবার বদলে হাসি এল। বুকটা প্রথমে জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বেশ জোরে চিৎকার করে অসীম বাবুর ঘরের পর্দা সরিয়ে বলল, “কি অসীম কাকু কেমন আছো?” ঘরে দিবানাথের বাবা অত্যন্ত আহত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বনলতার তার পুত্রের পরিচয় না দেওয়াটা তাঁকে বিব্রত করছে। শয্যাগত অবস্থা থেকে উঠবার চেষ্টা করছেন। দিবানাথ দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তার আর ইচ্ছা করছে না বাবার কাছে যেতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটা টুল টেনে সে বসল। “তুই নাকি ওষুধের দোকানে কাজ করছিস? তুই পারবি?” অসীম খুব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। “ মা,তোমাকে জানাতে বারণ করেছে। তোমার কোথায় মান-সম্মানে লেগে যাবে। কিন্তু আমার তো আর উপায় নাই। কাজ শিখতে গেলে এই ভাবেই এগোতে হবে।” “ না না আমি আবার কি ভাববো! কিন্তু সাধুখাঁদের ব্যাপারে তো অনেক বদনাম জানি। সব রকম দোষ আছে। মদ খায়, খারাপ সঙ্গ করে…তোকে যদি কোন বিপদে ফেলে দেয়।” দিবানাথের মায়ের জন্যে মন কেমন হল। আসলে বাবা তাদের কথা এখনো ভাবে। সে হাসি মুখে বলল, “না, না আমি সাধারণ কর্মচারী। আমাকে কেন বিপদে ফেলবে।” বনলতা তার অতিথিদের নীচে বিদায় দিতে গিয়েছে। ইস্ আগে জানা থাকলে আজকে বংকা কে বলত পেছনের রাস্তায় থাকতে। ওই জাপানী ক্যামেরা ছুঁড়ে দিলেই হয়ে যেত। বনলতা এসে প্রায় মুনমুন সেনের মতো করে বলে, “অসীম, কি যে আনন্দের খবর বিজু খোকার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল।কার সাথে জানো। আমার ছাত্রী শিউলির সাথে। ভাবতে পার। আমার সেরা ছাত্রী।” দিবানাথের চোখ মুহূর্তে ঝাপ্সা। হাত পা যেন খুলে আসছে। বিজু মানে বিজন প্রকাশ… সেতো এলাকার সবচেয়ে বড়লোক বাড়ির ছেলে। শিউলির সাথে।
ট্যাপাদা প্রবীর কে অন্য আর কিছু কাজ শিখতে বলল। প্রবীরের শরীর তেমন শক্তপোক্ত নয়। রঙের কাজ সে করে নেয়। কিন্তু কাঠের মিস্ত্রির কাজ সে কি ভাবে করবে! সে পারে না।তাই সেটা বাতিল। ট্যাপা দা আর প্রবীর মন দিয়ে একটা পুরনো ট্রাংক রঙ করছিল। “আচ্ছা ট্যাপা দা ট্রাক রঙ করলে অনেক পয়সা না!” প্রবীর ব্রাশ চালাতে চালাতে বলে।ট্যাপা দা মজা করে বলে, “ তোর হাতের লেখা খারাপ,ছবিও আঁকতে পারবি না। পেছনে লিখতে হবে…” ।“জানি জানি, ‘দেখবি আর জ্বলবি লুচির মত ফুলবি’, ‘বুড়ে নজর বালে’ … তুমি এক কোট দিয়ে লিখে দিবা, আমি অর ওপর মোটা করে চাপিয়ে দেবো।”এই সব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রবীর বলে, “আমি একটা কাজ খুব ভালো পারব, দারুন শিখেছিলাম। মা যখন মরে গেল, বাবা তো জেলে… আমাকে বংকা মুরগীর দোকানে লাগিয়েছিল। …এক কোপে মুর্গি কেটে ফেলতাম… সবার চেয়ে ভালো… বাবা কিছুতেই করতে দিল না… আমি ভালো পারতাম… রক্ত বার হয়ে এসে মুর্গি যখন চুপ করে যায় তখন …” ।ট্যাপা দা দেখল, চোখ মুখ চকচক করছে প্রবীরের। যেন খুব কৃতিত্বের কোন কাজ সে করে ফেলেছে।একটু অদ্ভুত লাগল।প্রবীর কে নিয়ে ট্যাপাদার একটু উদ্বিগ্ন লাগছে। প্রবীর আচমকা বলল, “দাঁরাও দাদা, বংকা কে একদিন ডাকব। হেব্বি খিস্তি জানে। একটা হাত নাই। মানে হাতের পাতা নাই। ওই নিয়ে সব করতে পারে।” ট্যাপা দা ভেতর ভেতর খুব দমে গেল।
দিবানাথ দোকান থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেল ইট ভাঁটার মাঠে। সন্ধ্যের অন্ধকারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। খুব কাঁদল। কাঁদলে যে এতো কষ্ট হয় এই প্রথম বুঝল। গলা ব্যাথা করছে তার। আচমকা পাশে খসখস আওয়াজ। বংকা একটা চুল্লুর পাউচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, করুনা করার সুরে বলল“ আজ ঘুম হবে না, চুমুক মারো।” “ শালা, তুই একটা খবর দিলি না।” রাগে কাঁপতে কাঁপতে দিবানাথ এক ঘুষি মারতে যায় ,কিন্তু বংকা পালিয়ে দূরে দাঁড়ায়। “ বললে তুমি কি করত্যা,তুমি ঢ্যামনা , ওষুধের দোকানের কাজ দেখিয়ে বলত্যা, শিউলি মেরি জানু আমার রাজ পেসাদে আসো, আমাদের টিউবওয়েলের জল খাও, আমার খিটখিটে মায়ের পা টিপো…রাজার বেটার পছন্দ হয়েছে তোমার গাল ফ্রেন্ডে। আগে বড়লোক হও ,তারপর ওই সব সুন্দরীর সাথে ঘুমাবা। আমার ওপর মেজাজ দেখাছও…” থুঃ থুঃ করে শুকনো মখে আওয়াজ করে। দিবানাথের বাস্তব বোধ ফিরে আসে। তাকে যেমন করে হোক বড়লোক হতে হবে। যেমন করে হোক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আচমকা তার একটা অন্য বোধ হল। মার কতটা কষ্ট হয় সেটা বুঝতে পারল দিবানাথ। মা কত যত্নে সংসার সাজিয়ে ছিল। বাড়ি এসে দেখল মায়ের জ্বর হয়েছে। জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে বুঝল মা খুব রোগা হয়েছে। বংকা সব কথায় ঠিক বলেছে দিবানাথ একটা ‘ঢ্যামনা’।
শিউলির বাবা, মা অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে দিন যাপন করছেন। বিয়ের খরচ ঠিক কি ভাবে করবেন বুঝতে পারছেন না। সাথে শিউলির বিয়ে নিয়ে নানান আবদার বুঝতে পারছেন না কোন দিক দিয়ে কি করবেন। শিউলির বাবা বুঝতে পারলেন বেশ কিছুটা টাকা ধার করতে হবে।কিন্তু তাতেও ঠিক সামাল দিতে পারা যাবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শরীরে আর মনে শিউলির বাবা পেরে উঠছেন না। সকালে বাজার থেকে ঝোলা বয়ে আনার সময় চোখে অন্ধকার দেখলেন। তার মাথায় জল দিল লোকজন। তাকে উদ্ভ্রান্তের মত ফিরে আসতে দেখে শিউলির মায়ের বুক কেঁপে উঠল। সাথে একটা ছেলে ঝোলা বয়ে এনেছে। পাড়ার মুদি দোকানের মালিক ভানু এসেছে, সে বলল,“বউদি, ভয় পাবেন না। ত্রিদিব ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যে বেলায় দেখিয়ে নেবেন।এই ছেলেটি কে রাখতে পারেন। ও ধরে ধরে নিয়ে যাবে দাদাকে, একে একটু খেতে দেবেন, দু দশ টাকা দেবেন। কি রে পারবি না” । ছেলেটা কে চিনতে পারলেন শিউলির মা, “ না, না, খুব বজ্জাত ছেলে, ওর জ্বালায় পেবুকে নিয়ে পেবুর বাবা এখান ছেড়ে চলেই গেল।আমার কাউকে লাগবে না আমি চলে যাব।” ভানু হাসল, “এখন খুব বিশ্বাসী হয়ে গেছে বউদি, আমাদের কাঁচা নর্দমা, পায়খানা সব ওই পরিস্কার করে। ”
বংকা বোকার মত হাসল। শিউলি পরের দিন বাড়ি এল। আজকাল বাসে আসে না। বিজু গাড়ি পাঠায়।মধ্যে রাস্তায় গাড়িতে বিজু উঠল। হবু শ্বশুর অসুস্থ, তাই দেখতে যাচ্ছে, এই প্রথম সে শিউলির বাড়ি যাচ্ছে। শিউলি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। মা ঘর দোর ঘুছিয়ে রাখতে পারবে কি? বিজু গলিতে ঢুকে একটু বিব্রত বোধ করছে। গাড়ি ঢুকল না। বাড়িতে লোডশেডিং। শিউলি খুব বিরক্ত হল। মা বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করেছিল, বিজু আসতে পারে। যাই হোক, ভালো কাপে চা, গরম শিঙারা, ভালো মিষ্টি তার প্রাণপণে সমাদর করার চেষ্টা দেখে কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হল শিউলি। বিজু বাবার শরীর নিয়ে সেরকম কিছু জিজ্ঞাসা করল না। যেটুকু শিউলির মা বলল।বিয়ের সময় গাড়ি ঢুকবে না এটা একটা বড় সমস্যা হবে এটা বারবার বলতে লাগল।শিউলির খুব বিব্রত লাগছে। ঘণ্টা দুয়েক পর বিজু বলল, “ চল গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে।সাবধানে থাকবেন।” শিউলি মনে মনে চাইছিল একটু একান্তে কথা বলতে। গলিতে সব জানালা ,দরজা, বারান্দায় মানুষের মুখ। লজ্জায় মিশে যাচ্ছিল শিউলি। বিজুর বিরক্ত লাগছে। গলির মুখেই গাড়ীটা দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো ড্রাইভার কে নাম ধরে হাঁক পাড়ল বিজু।গাড়িতে উঠবার ঠিক আগে বিজু বলল, “ তোমরা ঠিক এতোটা গরীব বুঝতে পারিনি। তোমাকে দেখে একটুও বুঝতে পারা যায় না।”মুখ সাদা হয়ে গেল শিউলির। বিজু আচমকা প্রায় হলিউডের মতো শিউলির কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট লাগায়। শিউলি হতবাক হয়ে যায়। চারপাশে কৌতূহলী পাড়ার লোকজন, বুড়ো ড্রাইভার… সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে।দ্রুত ছাড়াবার চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু যেন বদলে গেল। গাড়িতে উঠে বিজু হাত নাড়িয়ে চলে যায়। কারেন্ট আসে। আলো জ্বলা রাস্তা দিয়ে শিউলি কান লাল করে, কালশিটে পরা হৃদয় নিয়ে ঘরে ফেরে।
শিউলির বিয়ে এগিয়ে আসছে। শিউলি মায়ের সাথে আর আগের মত মন খুলে কথা বলতে পারে না। মা ক্রমাগত মেজাজ হারান। একটি প্রবল দোলাচলের মধ্যে থাকে শিউলি। একদিন সকালে আধা ঘুমের মধ্যে শুনতে পেল শিউলি, মা ফোনে সম্ভবত বুলুদিদিকে বলছে, “…পাড়ায় লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না… সবার সামনে ওই ছেলে চুমু খেয়েছে… চিন্তা করতে পারিস… আমি ভেবেছিলাম মেয়েকে লেখাপড়া শেখালাম ভদ্রলোকের মতন জীবন হবে… আমার হাত পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সব ভুলে গেল রে… সব ভুলে গেল… আর জামাই হলে বাড়ির ছেলে হবে… কচু হবে… ও আপনি আর কপনি… এখন বিয়ে দিয়ে আমি বাঁচি… আমার জীবন নরকের মত জ্বলছে।তুই আগে আগে চলে আসিস… তোর ওপরেই সব ভরসা। কে করবে আমার।…” আরও অনেক কথা বলে গেল মা। শিউলির খুব খারাপ লাগছে। আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। এছাড়া সে কি ভাবে পালাবে। শিউলির বাবার অনেক ধার হল। অনেক দিন এলাকায় থাকায় জন্যে সবাই বিয়ের কাজে এগিয়ে এল। সাধারণ প্রতিবেশীদের কাছে তাক লেগে গেছে এমন বিয়ের সম্বন্ধ।তাদের পাড়ার সম্মান রাখার জন্যে সকলে সাহায্য করতে চাইছে। এই দক্ষযজ্ঞ সামলাতে যতটা ভয় পাচ্ছিল শিউলির মা আর বাবা, ততটা পরিশ্রম হল না।বুলু দিদি চলে এসেছে।কেবল সদা হাস্যময়ী মেয়েটি সংসার ভাঙার ফলে বিষাদ প্রতিমা। কাজ সে করছে, কিন্তু শিউলি তাকে বুঝতে পাড়ল না।বংকা সুযোগ খুঁজে ব্যর্থ হয়।ওকে বাড়ির কাজে নেওয়া হয় না। কিন্তু শিউলির বাবা একটা কার্ড দিয়ে বলেন, খেতে আসিস।কার্ড পেয়ে সেটা বংকা লটারির টিকিটের মতো সেটা নিয়ে দ্রুত ইট ভাঁটার মাঠে চলে যায়।
ট্যাপাদা কে অবাক করে প্রবীর সত্যি মুর্গি কাটার দোকানে কাজ পেয়ে গেল।প্রবীর আর রঙের কাজ করবে না বলে দিল।শিলা বউদি এখন আবার আগের মত তিনবেলা খেতে দেয়। শিলা বউদি কে প্রবীর টাকা দেয় বাজার করার, তেল নুন কেনার, স্নো - পাউডার কেনার দুজনের দুজন কে দরকার। প্রবীর নিজের একটা শার্ট কিনে দোকান থেকে বার হল, ফের কি মনে হওয়াতে আরো একটা শার্ট কিনে নিয়ে ট্যাপাদার ঘরে গেল। ট্যাপাদার মেজাজ ভালো নেই। ঠিক কথাবার্তা জমল না। রঙের দাম বেড়েছে এদিকে খদ্দের টাকা কম দিয়েছে। শার্টটা ট্যাপাদা কে দেওয়াতে খুব একটা খুশি দেখাল না ট্যাপাদা কে। প্রবীরের মন খারাপ হল। সে বুঝল, ট্যাপাদা আসলে ভালোবাসে না তাকে।গুটি গুটি পায়ে বার হয়ে এসে চায়ের দোকানের দিকে এগোতেই,পেছন থেকে ডাক, “ ও পেব্যা, আসিস মাঝে মাঝে। জামা নেমতন্ন বাড়ি পরে যাব।” পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রবীর। বুকের মধ্যে আলো জ্বলে। সেখান থেকে নিজের ঘরে এসে খানিক বসে থাকল। বাবা আর মা থাকলে তাদেরকেও দিত প্রবীর।একটা শার্ট তার বংকা কেও দেওয়া উচিৎ। পরের মাসে একটা শার্ট কিনে সে বংকা কে দেবে। বংকা না থাকলে এত ভালো কাজ সে শিখত না।শিলা বউদি ভাত রেখে দিয়ে গেল।প্রবীর হিসাব করল একটা শাড়ি কিনতে হবে শিলা বউদির জন্যে। আর মাঝে মাঝে মাংস কিনে এনে দেবে। মুরগীর ঝোল দিতে রুটি খাবে একদিন। ভাতের থালা খুলে চমকে গেল প্রবীর, ডিমের অমলেট আর ভাত। প্রবীর কেমন হয়ে গেল। একলা ফাঁকা ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হল ছাদ নেমে তার বুকের ওপর নেমে আসছে। সব অন্ধকার। তারপর কি হল সে জানে না। ভোরবেলা শিলা বউদি চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করল, তখন ঘোর ভাঙল প্রবীরের । শিলা বউদিরা যে বেড়াল কে খেতে দেয় ,তাকে যেন কে মাথা থেঁতলে মেরে দিয়ে গেছে। প্রবীর খুব ভালো করে স্নান করে মুরগীর দোকানে গেল।
বংকা শিউলির বিয়ের কার্ড এনে দিবানাথ কে দিল। দিবানাথ ছুঁড়ে ফেলে দিল। বংকা খানিক ফিচেল হেসে বলল, “আমারে খেতে বলেছে, একখান ভালো জামা দিও তোমার পরে যাব।” দিবানাথ খানিক থম্ মেরে বসে থাকল। তারপর বলল “আমি তো কোন দিন বলিনি শিউলিকে, যে আমি আসলে ওকে লাইক করি।” “ইহ্, তাহলে ও এই ছেলেকে না বলে দিত।” দিবানাথ বুঝতে পারল বংকা কে সে যত বোকা ভাবে বংকা ততটা নয়। লেখাপড়া জানে না বলে ওকে ওই রকম লাগে। হেসে ফেলল সে। বংকা হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। “শোন পালপাড়ায় রেশমি একবার যেতি বলেছে।কি নাকি দরকার আছে।” বংকার কাছে খবর শুনে চিন্তায় পড়ে গেল দিবানাথ।যেদিন ছুটি থাকবে সেদিন একবার যেতে হবে। সকালে বনলতার বাড়ি গিয়ে বাবার সাথে খানিক কথা বলল দিবানাথ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল কাজের কথা। হিসাব ঠিক করে করতে পারে কিনা। সব শেষে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মা কেমন আছে?’ দিবানাথ খুব শান্তভাবে বলল, “খুব খারাপ।” “একদিন নিয়ে আয়, দেখতে ইচ্ছা করছে” দিবানাথের বাবা বলল।
দিবানাথ বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।আচমকা দেখল বনলতা সাশ্রু নয়নে তাকিয়ে আছে। তার লীলায়িত কণ্ঠস্বর আর নেই, “আমি জানতাম, আমি জানতাম, এই ছেলে নিত্য এসে এসে বাবাকে বুঝিয়ে ছাড়বে… আমি জানতাম… আমি রোজ তোমার পেচ্ছাব ,পায়খানা পরিস্কার করি, আমাকে দেখলেই কেবল শরীর খারাপের কথা মনে হয়… তোমার কেবল বমি পায়… আমিও চেয়েছিলাম মা হতে। কিছুতেই সেটা হতে দিলে না… প্রথমটা নষ্ট করালে…পরের টা এসেই চলে গেল… আমার একটা থাকলে তুমি এমন করতে পারতে না… উঃ কি পিরিত… দেখতে ইচ্ছা করছে।” দিবানাথ খুব ধীরে উঠে সিঁড়ি বেয়ে নেবে গেল। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে শুনতে পেল, বাবা ঘড়ঘড়ে গলায় বলছে, “আমি আর কক্ষনো বলবো না, তুমি রাগ কোর না লতা আমি আর কক্ষনো বলব না”। মাকে দিবানাথ সবটা জানাল। ভেবেছিল মা বোধহয় রেগে যাবে। মা কোন কথা বলল না। মুখ নামিয়ে রাখল। মায়ের থুতনিতে নোনতা জল। “দিবু, ওদের বাড়ির পেছনের গলি থেকে তোর বাবাকে দেখা যায়? আমাকে কাল নিয়ে চল। আমি একবার দেখে চললে আসব।তোর বাবা জানতেও পারবে না।” দিবানাথের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে, এই বনলতাকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। সে বাথরুমে গিয়ে চোখে জল নিয়ে বিড়িতে টান দিল।
বিজুদের বাড়ি থেকে মাত্র বারোজন এল। কোন বন্ধুবান্ধব নয়। কিছু কাজের লোক আর বয়স্ক কিছু আত্মীয়। শিউলির পাড়ার মেয়েরা ইস্কুলের মেয়েরা মজা করতে পেল না। শিউলির মা খুব চাপ নিয়ে কাজকম্ম করে গেলেন। ছোটখাটো দুচারটে গণ্ডগোল হল। বংকা বিয়েতে পরার জন্যে এক ধোপার শরনাপন্ন হল। সে তার খদ্দেরের একটা জমকালো পাঞ্জাবি নিয়ে এসে তাকে দিল। তাই পরে বিয়ে বাড়ি গেল সে। শিউলি কে দেখে খামে করে দশ টাকা দিল। সাঁটিয়ে খাবার খেল। কেবল যার জামা সেও সম্ভবত নিমন্ত্রিত ছিল। ওকে দেখে সে একটু চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছিল। বংকা সুরুত করে পালিয়ে গেছে। বর যাত্রীদের কেউ একজন খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাই নিয়ে চাপা উত্তেজনা হল। বিজু কে খুব সুন্দর লাগছিল। শিউলির বিদায়ের সময় আসন্ন। মা নাক লাল করে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছিলেন। শিউলি বহুবার একটু কথা বলতে চাইছিল কিন্তু মা ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন। বাবা এসে কিছুক্ষণ বসে ছিল। বিদায়ের সময় সাজানো হয়ে গেছে। এক গাদা গয়না পরে একাই বসে আছে শিউলি। ফাঁকা ঘরে বুলুদিদি এসে বসল। তার চোখে জল। “খুব ভালো জামাই হয়েছে রে। কি অমায়িক ব্যবহার। খুব আদরে রাখবে তোকে”।“বুলু দিদি, আমার খুব ভয় করছে।” “ভয় কি রে পাগলি।ভয় পাস না। খুব ভালো রাখবে তোকে।” খানিক আদর করল শিউলিকে। তারপর শিউলিকে বুলু দিদি বলল, “ একটা কথা বলছি তোকে, তোর বর তো অনেক বড়লোক দ্যাখ না যদি আমাকে কোথাও একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। একটা ছোট চাকরি।মনে করে বলিস না রে, বুনু আমার খুব দরকার। তুই তো আমার সব জানিস।”
দিবানাথ পাল পাড়ার মোড়ের আগে আটকে গেল। শিউলির বিয়ের শোভাযাত্রা চলেছে। সাহা ব্যাণ্ডে বাজছে, ‘উঠ উঠ সুর্যায় রে ছিকিমিকি দিয়া’ তার সাথে প্রচুর আলো মাথায় নিয়ে লোক চলেছে। গোলাপ ফুলে সাজানো সাদা মোটর গাড়ি বুক জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেল।ভীর ফাঁকা হতে পাল পাড়ায় রেশমির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুঝল ঘরে তালা । রেশমি অর্থাৎ স্মিতা নেই। যাক বাবা, যত জ্বালা। ইটভাঁটার মাঠে গিয়ে দাঁড়াল যখন তখন সন্ধ্যে পার হয়ে আকাশে তারা ঝলমল করছে। ধাপির ওপর বংকা শুয়ে আছে। “ কি হে গুরু, বুকে এখুন আগুন লেগেছে। তুমার গার্ল ফ্রেন্ড চলে গেল। এখানে একজুন তুমার জন্যে ইন্তেজার করছে।” বংকা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারের মধ্যে একটি নারী শরীর আন্দাজ করল দিবানাথ। মেয়েটি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ তোমার নাকি খুব মন খারাপ। বংকা দুঃখ করছিল। তাই তোমাকে দেখতে এলাম।” দিবানাথ এই কণ্ঠের স্বর চেনে।
দিবানাথ এর বুকে কিঞ্চিৎ দ্বিধা আর ভয় এলো। সাধুখাঁর বাঁধা মেয়েছেলে রেশমি সে দেখা করতে এসেছে এক কর্মচারীর সঙ্গে এই ব্যাপারটা সাধুখাঁ জানতে পারলে বেজায় মুস্কিল হবে।রেশমি রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, “কতদিন থেকে বলছি একবার দেখা করে যাও।আমি না বললে তোমার চাকরি হত?” “আসলে আমার বাবা অসুস্থ সেটা নিয়েও একটু ব্যস্ত ছিলাম তো! কি দরকার বলুন”, শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে চেটে বলে দিবানাথ। রেশমি রোগা, কিন্তু শরীর আঁটসাঁট নয়, তার বুকে একটা এলিয়ে যাওয়া ব্যাপার আছে, গায়ে একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ, শরীরের এতো কাছে চলে আসা অস্বস্তিকর দিবানাথের।“ বাব্বা, আমাকে আবার, ‘আপনি’। ওসব ছাড়ো, কটা ওষুধ এনে দিতে পারবে? পয়সা দিতে পারব না।” “কি ওষুধ, লিস্ট দিয়ে দেবেন এনে দেবো।” দিবানাথ ঢোঁক গিলে বলে। আচমকা হাত ধরে বলে রেশমি, “তোমার দুঃখ হলে আমাকে এসে বলবে, কেমন! আমি কত লোকের দুঃখ কথা শুনি।” বংকা দূরে বসে হাসছে। অশ্লীল ইঙ্গিত বুঝতে পারে দিবানাথ। বাবা, মা, শিউলি সব মাথায় জট পাকিয়ে আছে, তার ভালো লাগছে না। ফালতু ঝামেলা। সে এবার একটু মনে মনে শক্ত হল। “আপাতত আমার তো কোন দুঃখ নেই। সন্ধ্যে হয়েছে আপনি একা ফিরতে পারবেন! বংকা আর আমি আপনাকে ঘরে ছেড়ে আসছি।” বংকা আর হাসল না।একটা শেষ হয়ে যাওয়া ওষুধের স্ট্রিপ দিল দিবানাথের হাতে।সেটাই এনে দিতে হবে।কোন রকমে নড়েচড়ে হাঁটতে লাগল রেশমি। পালপাড়ার আগে ফোনের বুথ দেখে দিবানাথ সেখানে ঢুকে গেল। বংকা রেশমির পেছন পেছন গেল। দিবানাথ বনলতা কে ফোন করে বাবার খবর জিজ্ঞেস করল। খুব খারাপ করে উত্তর দিল বনলতা। কিন্তু সামনের সপ্তাহে আবার বড় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে জানাল। দিবানাথ জানালো সে সাথে যাবে। দিবানাথের ইচ্ছা সেদিন বাবা আর মায়ের যদি একবার দেখা করিয়ে দেওয়া যায়। বড়লোক তাকে হতেই হবে! বড়লোক হলে এই বনলতা, এই শিউলি, এই বংকা সব থেকে অনেক অনেক দূরে উঠে যাবে সে। গাড়ি থাকবে একটা, সাদা দুধের মত গাড়ি।
আর একটু হলেই হাতের পাতা পুরো কেটে যেত। খুব লেগেছে প্রবীরের। বিরাট ব্যান্ডেজ হয়েছে। বাম হাতটা নিয়ে নিয়ে বেজায় অসুবিধা। শিলা বউদি খুব বকাবকি করেছে। তার বক্তব্য আগের কাজ টা ভালো ছিল পয়সা কম হলেও ভয় কম ছিল। হাত সারতে হপ্তা দুয়েক লাগবে। গলায় হাত ঝুলিয়ে কদিন হাত কেমন করে কাটল তাই নিয়ে সবাই কে গল্প করে বেরাল প্রবীর। রাতে বেশ ব্যাথা হচ্ছে। বংকার হাত কি করে কেটেছিল? জানা হয়নি তার।পড়াশোনা টা করলে এই সব কাজ করতে হত না। শিউলির গলার স্বর শুনতে পেল প্রবীর।ও যদি পড়িয়ে দিত। আচ্ছা আবার যদি পড়াশোনা করা যায় ইস্কুলে ভর্তি হওয়া যায়। রাতে নানান আওয়াজ আসে।ঘুম আসে না প্রবীরের। আচমকা তার বীভৎস স্মৃতি গুলো ভেসে আসে।বাবা তাকে হাসপাতালে দিয়েছিল। কি ভয়ানক দিন গুলো।কি যেন হয়েছিল কি একটা কাজ করেছিল প্রবীর। তারপর বাবা এখানে নিয়ে চলে এল। বাবা কেন চাইত না পুরনো বাড়িতে থাকতে। মাথাগুলিয়ে যায় তার। আকাশে আলো দেখা দেয়। হাত সেরে গেলে আবার বংকার কাছে যাবে। সকাল হয়ে বাঁচল সে।
বরযাত্রী কম গেলেও বিজুর বাড়ি ঢুকে শিউলি দেখল ওদের বাড়ি প্রচুর মানুষ। কাজের লোক অনেক। বিজুর একটা দাপট আছে বাড়িতে সেটা বুঝল। বিছানায় শায়িত বিজুর মা একটা বিরাট সোনার হার দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তার পাশের ঘরে আর একজন বৃদ্ধা তিনিও আশীর্বাদ করলেন। তিনি ঠিক কে সেটা বুঝতে পাড়ল না শিউলি।তাকে যে ঘরে রাখা হল সেটা এতো বড় যে একলা হলে ভয় ভয় করতে লাগল শিউলির। শিউলি এই বিরাট বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেল। দ্বিরাগমনে গিয়ে কয়েকঘন্টার জন্যে থাকল বিজু। বিজু চলে গেলে একটু শান্তি পেল শিউলি। বাড়িতে এখনো উৎসব শেষের গন্ধ আছে। বাবা কে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। বাবা একটু তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বাবা চোখে জল নিয়ে খানিক আদর করল। ফাঁকা বাড়িতে মা কেবল জিনিস গুছিয়ে চলছে। মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শিউলি বুঝল তাকে এই বরফটা গলাতে হবে।মার পেছনে পেছনে খানিক ঘুরল। “মা, একটু বস্, শুধুই দেখছি কাজ করছ, ওমা …।” শিউলির মার কষ্ট ক্রোধ হয়ে বার হয়ে আসে। বিরক্তি হয়ে বার হয়ে আসে। শিউলি দুহাতের মধ্যে মাকে ধরে। মা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। গর্ভজাত তাকে হৃদয়ের তোলে ধারণ করে। সেদিন সারাদিন মা মেয়েতে সেই ছোট বেলার মত গল্প হয়। বুলুদিদির কথা জানায় মাকে। মা অবাক হয়ে বলে, “ ওসব জামাই কে বলতে যাস না। কি কাণ্ড বুলু তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল।” মুখে কিছু না বললেও শিউলি ,ঠিক করে রাখে বুলু দিদির জন্যে একটা কিছু সে করবে। বিজু ওকে ভালোবাসে। দুপুরে মা চোখ বুজে শুলে, নিজের ড্রয়ার খুলে বিজুর সব চিঠি গুলো একটা প্যাকেটে ঢোকায়। মনে অনুরাগের একটা গোলাপি আকাশ তৈরি হয়। বিজুর সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে সে। মজা হবে।
দিবানাথ রেশমির দেওয়া ওষুধের স্ট্রিপ নিয়ে দোকানে খোঁজ করল। ওষুধটা আউট অফ স্টক।জেনেরিক লিস্ট দেখে ওষুধটা খুঁজতে গিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ওষুধ টা একটা খারাপ অসুখের। সেক্স ওয়ার্কারদের এই ছোঁয়াচে অসুখটা হয়।আচমকা মাথার গুবরে পোকা ঢুকল। অনিল সাধুখাঁর তার মানে এই রোগ আছে। এই রেশমি থেকে দূরে থাকতে হবে। ওষুধটা বেশ দামী।
দোকানে ফোন এল সাধুখাঁর বাড়ি থেকে। গাড়িতে করে জেলাশহরে একজন কে যেতে হবে।রঘু মিশ্র দিবানাথ কে ডাক দিল। “চল দিবু, আজ তুমার কাজ শেষ। বেড়িয়ে আসবা চল।” দিবানাথের ইচ্ছা নেই রঘু মিশ্রর সাথে যাবার। কিন্তু সে না বলে না। গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে গেল রঘু মিশ্র পেছনে একটা ব্রিফকেস নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসল। জেলা শহরে ঢুকবার আগে ঢুলছিল দিবানাথ।আচমকা ঘুম কেটে গেলে দ্যাখে বিরাট বড় একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। রঘু মিশ্র ঢুকে গেল ভেতরে।সন্ধ্যে নেমে আসছে। ড্রাইভার আর দিবানাথ দুজন মিলে বিড়ি ফোঁকে। মশা ভন ভন করছে। ভেতর থেকে মাঝে মাঝে খুব জোর মহিলা কণ্ঠের চিৎকার আসছে।সম্ভবত অনিল সাধুখাঁর মেয়ের। “এটাও কি সাধুখাঁ দের বাড়ি?” দিবানাথ জিজ্ঞেস করে। “টাকা থাকলে বাতি জ্বেলে লোকে পাদে, মাঝে মাঝে শহরে এসে মেয়ে জামা কাপড় কেনে, বন্ধুদের সাথে মদ খায়, সিনেমা দেখে, সেই জন্যে বাড়ি।”ড্রাইভার বলে। কিছুক্ষণ পর কান লাল করে রঘু মিশ্র বার হয়ে আসে। চোখ মুখে অবস্থা খুব খারাপ। এই বয়সে অপমান সহ্য করা কঠিন। দিবানাথের খারাপ লাগছে। অনিল সাধুখাঁর মেয়ে বার হয়ে আসে। বড়লোকের মেয়ে কিন্তু কোন শ্রী নেই তার চেহারায়। তবে বেশ দামী পোশাক আর দামী কোন সুগন্ধ মেখেছে। গন্ধটা ভালো লাগল। ড্রাইভারের সিটের পাশে রঘু মিশ্র আর দিবানাথ দুজনেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে।কেন মৌসুমি সাধুখাঁ এতো রেগে আছে কে জানে।দিবানাথ বাড়ির কাছে নেমে গেল।আড়চোখে বুঝল মৌসুমি সাধুখাঁ তাকে তাকিয়ে দেখছে। বাড়ি ফিরে অবাক হল। বংকা বাড়ির দরজার সামনে ধাপিতে বসে আছে। “ মা জননী, আজ রাতে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে।”নুলো হাতটা দিয়ে গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল বংকা। বাড়ি ঢুকে দেখল বহুদিন পর মা গুনগুন করে গান করতে করতে রান্না করছে।ভালো লাগল দিবানাথের। রাতে খেতে বসে জানল। আজ তার জন্মদিন। জন্মের সময় মা কে খুব কষ্ট দিয়েছে সে। প্রাণ সংশয় হয়েছিল। বাবা কে নাকি খুব ছোটাছুটি করতে হয়েছিল।
ট্যাপা দা ডেকে পাঠিয়েছে। প্রবীর মুর্গি কাটা জামা প্যান্ট ছেড়ে একটা ভালো জামা পড়ল। হাতটা এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে সাবধানে কাজ করতে। মুরগীর দোকানের কানুবাবু খরচ করেছেন। কিন্তু কথা শোনান রোজ। এক ভাষায়, “আমি হলাম ভদ্রলোকের ছেলে, কাউকে ঠকাতে পারি না।এই যে আট শো টাকা খরচ হল সে টা কি এ বাজারের অন্য কোন শালা দেবে।” প্রবীরের লজ্জা লাগে না। বলে যাক। কিন্তু ট্যাপা দাকে ব্যাপার টা জানাবে। ট্যাপা দা একটা বিরাট রঙের কাজ পেয়েছে। একটা অফিসের কাজ। প্রবীর সাথে থাকলে সুবিধা হবে। তাছাড়া প্রবীরের হাতটা সেরে ওঠা দরকার। ট্যাপাদা কে কানুবাবুর কথা বলাতে ট্যাপা দা কিছু বলল না।যাই হোক ট্যাপা দা কিছু বললে না বলতে পারে না। তাছাড়া ট্যাপাদার সাথে থাকতেও ভালো লাগবে। ট্যাপাদা খুচরো দুশো টাকা হাতে দিল প্রবীরের । “যাহ্, তোর কানুবাবুকে এটা দিয়ে আয় বলবি বাকি টাকা শোধ করে দেওয়া হবে।” ট্যাপা দা এই সব বলে গামছা কাঁধে কলতলার দিকে গেল। বাবার মত লাগছে ট্যাপা দা কে। ট্যাপা দা কে ছেড়ে কোথাও যাবে না প্রবীর। যদি এবার রঙের কাজ টা ঠিক মতো দাঁড়িয়ে যায়। তাহলে আবার লেখাপড়া শিখবে। ভালো কাজ করবে। পরিস্কার কাজ। ভয়ের কাজ না। কিন্তু মুর্গি কাটতে প্রবীরের বেশ লাগে। মুর্গি যখন নিঃস্পন্দ হয়ে যায় তখন অদ্ভুত আনন্দ হয়। সেদিন নিজের হাতের রক্ত আর মুরগীর রক্ত মিশে যাচ্ছিল, যন্ত্রণা হচ্ছিল বটে কিন্তু তার সাথে একটা মজা ছিল। টাকা টা বুক পকেটে রাখে সে।
শিউলি বিজুর বাড়ির অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। এরা কেউ এক সাথে খেতে বসে না। বিরাট খুব সুন্দর খাবার টেবিল একটা রান্না ঘরের পাশে আছে। বিজু বাড়ি ফিরে একবার মায়ের ঘর ঘুরে এসে ঘরে ঢুকে যায়। সেখানে রাতের খাবার চলে আসে। বেশির ভাগ দিন দুপুরে নানান বন্ধু আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খেতে যেতে হয়। গাড়ি পাঠিয়ে দেয় বিজু। বিজু আর শিউলি ঝড়ের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে প্রায় পাঁচ টা কাজের লোক । এছাড়া অফিসের একটা শানু দা আছে। শানু দা কে শিউলি দেখেনি। কিন্তু শানু দা ছাড়া বিজুর কাজ একেবারে চলে না সেটা বোঝে। শানু দা অফিসের সব বোঝে। শরীরের আনন্দ মনের আনন্দ, আর অপর্যাপ্ত বিলাসের মাঝে শিউলি ভুলে গেল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা পরিকল্পনা ছিল। দুজনে পাহাড়ে গেল হানিমুনে। সবচেয়ে দামী মদ খেয়ে নিজের মার কাছে দেওয়া কথা ভাঙল শিউলি।তার সারা শরীর আর মন জুড়ে কেবল বিজু।
শিউলি বিজুর মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে।খুব কম কথা বলেন।যে ব্যাপারটা খুব অবাক লাগে শিউলির সেটা হল, বিজুর মার কোন কৌতূহল নেই। নতুন বউএর বাপের বাড়ি নিয়ে, বিজু কোথায় গেল, বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া হল কিনা, কোন পূজা পার্বণ… কিছুতেই যেন কোন আকর্ষণ নেই।একদিন বমি করলেন সেটা নিয়েও কোন তাপ উত্তাপ নেই। অথচ কিছু কথা বললে শোনেন।ভালো খারাপ কিছু বলেন না। আর একজন বৃদ্ধা কে সেটা বুঝতে শিউলির অনেক দিন লাগলো। উনি মল্লিকার মা। মল্লিকা আর তার মা এই পরিবারে প্রতিপালিত। বিলাসিতায় তাদের সমান অধিকার কিন্তু বিজু যে দাপটে সংসারে থাকে সেখানে তারা কোন কথা বলে না। শুধু তাই নয় বিজুর ঘরে তারা কেউ আসে না।যে লোকটি মল্লিকার সাথে তাদের বাড়ি গিয়েছিল, সে বাড়ির সবার খোঁজ রাখে।খুব মা কালীর ভক্ত। বিজু আর শিউলি এতো ঘুরে বেড়ায় যে মায়ের জন্যে মন খারাপের সময় হয় না। মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলে শিউলি। বাবা জামাইয়ের খবর নেয়। আর মা শিউলিকে রান্না বান্না শিখতে বলে। মা বুঝতেই পারে না, এদের রান্না ঘরে শিউলি গিয়ে দাঁড়ালে কাজের লোকেরা শশব্যস্ত হয়ে যায়। শিউলি ভিসিআরে সিনেমা দ্যাখে। প্রচুর নেল পালিশ তার।স্কুলের বন্ধুদের কেউ কেউ ফোন করে। অনেকেই খুব হিংসে করছে এতো ভালো বিয়ে হওয়ার। নিচের ঘর গুলোর একটাতে অনেক আলমারি আছে। একটা বড় গেস্ট রুম। মল্লিকা এসে ওর মার ঘরে থাকে। মল্লিকার মা মাঝে মাঝে খুব সুন্দর ভজন গান করেন।শিউলি কে জিজ্ঞেস করেছেন, সে গান জানে কিনা।শিউলি আলপনা দিতে পারে জেনে আনন্দ পেয়েছেন। আয়নায় শিউলি বুঝল সে বেশ মোটা হচ্ছে।
আগে বনলতার জাপানী ক্যামেরা, দামী ফুলদানী দেখত, আজকাল কেবল বাবার একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে চলে যাওয়া দেখেছে। দিবানাথ সিরিঞ্জটা বাবার হাত থেকে বার করে এনে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, বাবা কিছু বলতে চাইছে। “লেগে গেল নাকি কাকা!” মজা করে সে বলে। “তোর মা কে একবার নিয়ে আয়। আমি খুব অন্যায় করেছি তার ওপর” দিবানাথের বাবা বলে। বনলতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। দিবানাথ বনলতার দিকে তাকায়, তারপর বেশ দৃঢ়তার সাথে বলে, “বাড়ির পাশে শম্ভুদের দোকানে একটা ফোনের পিসিও আছে। ওদের নম্বর টা দিচ্ছি। তুমি ফোন করে নিও। তোমার কথা আমি বল্লে শুনবে কেন!” বনলতা কেমন চুপ করে বসে থাকল। দিবানাথের দোকানে একটা গণ্ডগোল হয়েছে।কি একটা ভুল ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে বেজায় চিল্লামেল্লি। রঘু মিশ্র মালিকের কাছে বেজায় গালাগালি খেয়েছে। বেচারার মন মেজাজ খারাপ। কাজ গুটিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিতে গিয়ে দেখল, রঘু মিশ্র মদ কিনছে। “ও, দিবু আমাকে একটু বাড়ি অবধি পৌঁছে দে” রঘু বলে। দিবানাথের বিরক্ত লাগে। সারাদিন পর আর ভালো লাগছে না। রঘু বেশ ভারী। তার বাড়ি দেখে অবাক হল। প্রায় ঝুপড়ি গোছের একটা ঘর। সামনে একটু ঘেরা জায়গা আছে। সেখানে একটা সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা ছেলে। রঘু নেমে একবার ফিরেও তাকাল না। দিবানাথ বাড়ি এসে দেখল মা অপেক্ষা করছে। লোডশেডিং এর আলোয় ভাত খেতে বসে বুঝল, মার মুখ থমথমে। “তোর বাবা ফোন করেছিল। এতো শরীর খারাপ হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি তো। টাকারও অসুবিধা। ভেলোরে গিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। অত টাকা কি ভাবে জোগাড় করা যায় বলত? আমাদের বাড়ীটা বন্ধক রেখে দেবো!” দিবানাথের মা বলে চলে। দিবানাথ অবাক হয়ে যায়। বাড়ি গেলে তারা থাকবে কোথায়। মা কি একটু বুঝবে না। ওখানে কত খরচ খরচা করে বনলতার বাড়িতে থাকে বাবা। সেটা একটু কমালেই পারে। “বাড়ি বন্ধক দিলে তা আর উদ্ধার করা যাবে! সে যে অনেক টাকা, তেমন হলে কিছু ধার করা যেতে পারে।” দিবানাথ বলে। দিবানাথের মা আজ আবেগ রুদ্ধ হয়ে আছেন। তিনি ছেলের কথা আদৌ বুঝতে পারলেন বলে মনে হয় না।
রঙের কাজে বলে ভয় নেই! বাজে কথা। ওই যে ট্যাপাদা খুক্ খুক্ করে সারাদিন কাশে সেটা ওই রঙের জন্যে। রঙে বাজে কেমিক্যাল আছে।প্রবীর নতুন জানলো এসব। ট্যাপা দা বোঝাতে চাইছে এই কাজ টা করতেও যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।ট্যাপা দাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না প্রবীর। রঙ করবার নতুন জায়গা টা শহর থেকে একটু দূরে। বড় রাস্তার ধারে, কিন্তু গ্রাম্য এলাকা। কি একটা কেমিক্যালের ফ্যাকটারি হবে। পাশে একটা সুন্দর বাড়ি আছে। অনেক ফুলের গাছ। এর মালিক নাকি মাঝে মাঝে আসে। প্রবীর বিকেলে কাজ শেষ করে পা ঝুলিয়ে ফ্যাক্টারির পাঁচিলে বসে থাকে। বেশ লাগছে তার ।গরু চরা মাঠ, নিচু হয়ে আসা আকাশ, ইস্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের দল, এইসব দেখতে দেখতে আচমকা দেখল দুধ সাদা একটা চারচাকা গাড়ি। পাশের বাড়িতে ঢুকছে। প্রবীর কি স্বপ্ন দেখছে। গাড়ি থেকে ওটা কে নামল। শিউলি না, হ্যাঁ শিউলি তো, কি সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছে। পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামল প্রবীর, তার ভাঙা গলায় চিৎকার করতে থাকে, “এই শিউলি, এই শিউলি, তুই এখানে কার কাছে এসেছিস।”
শিউলি গেটের ভেতর ঢুকে যায়। বিজু তাকিয়ে থাকে নোংরা, খুব রোগা একটা ছেলের দিকে। ড্রাইভার আর গেটম্যান কে কিছু বলে। তারপর গেটের ভেতর ঢুকে যায়।শিউলি প্রবীরের গলার আওয়াজ পায়। কিন্তু তারপক্ষে তার সাথে কথা বলার মত মানসিক অবস্থা নেই। সে জানে, সে বিজন প্রকাশের স্ত্রী। তাকে এই সব ছোটলোকদের সাথে কথা বলতে নেই। তারমধ্যে বিয়ের আগের পুরুষ বন্ধুদের কথা বিয়ে হবার পর সামনে না আসায় ভালো। গেটের ওপারে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল শিউলি। সে দোতলায় উঠে গেল। বিজু অত্যন্ত বিরক্ত হল। তার ব্যবসার কিছু কাজ এখান থেকে কিছুদিনের মধ্যে শুরু হতে চলেছে। নানান টানা পোড়েন চলছে। এই ধরণের ফালতু ব্যাপার। শিউলি বিষণ্ণ। গত রাতেই সে বুলুদিদির জন্যে বিজু কে বলেছে। বিজু খুব বিরক্ত হয়েছে।“আমি কোন সাহায্য করতে পারব না। বাবা ওই সব সাহায্য প্রচুর করেছে। তারপর তারা আমার ঘাড়ে এখন বসে আছে।” বিজু ভ্রু কুঁচকে বলে যাচ্ছে। কথাটা যে মল্লিকা কে নিয়ে সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অথচ শিউলি বুঝেছে, মল্লিকা হৃদয় দিয়ে বিজুর ভালো চায়।ভেতর ভেতর মরে যায় শিউলি। এসব কথা না বলায় উচিৎ ছিল ।খামোকা সে বিজু কে বিরক্ত করল।
ট্যাপাদা না এলে প্রবীরের কপালে আজ কষ্ট ছিল। “ আরে কি করেন করেন , ওকে মারবেন না। খুব রোগা। কোথায় লেগে যাবে।” ট্যাপাদার কাছে ড্রাইভার এগিয়ে এসে বেশ রহস্য করে বলে, “ বউমনির নাম ধরে ডাকছিল। হেবি পেছন পাকা ছেলে তো ,মশাই”। ট্যাপাদা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ পেব্যা, এরা কি বলে রে।” প্রবীর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ ভুল হয়ে গেছে। আমি আর একজন কে ভেবেছিলাম।আমি ডাকলে সে ঠিক সারা দিত।” সারাদিন কোন কথা না বলে প্রবীর কাজ করল। ফিরবার সময় সাইকেল নিয়ে ট্যাপা দার সাথে ফিরল প্রবীর। রেলগেট পড়ে গিয়েছে। এক্সপ্রেস ট্রেন আসবে। অপেক্ষা রত সেই দুধ সাদা চারচাকা গাড়ির কাচে তার চেনা মুখ।বিড়বিড় করতে লাগল প্রবীর, “ আমি ঠিক দেখেছি। কথা কেন বলল না। কেন?”ট্যাপা দা কিছু একটা আন্দাজ করল। “আবার বিড়বিড় করিস ক্যান, চল চা খাই।” ট্যাপাদা এই প্রথম জানতে পারল, শিউলি বলে একটি অপূর্ব সুন্দর আর পবিত্র মেয়ে প্রবীর কে ত্রিকোনমিতির মতন কঠিন অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছিল। শিউলি পড়ালে প্রবীর আজ কলেজে পড়া ‘ভালো ছেলে’ হতে পারত। প্রবীর পরের সপ্তাহ কোন কথা না বলে কাজ করে গেল। ট্যাপাদাও খুব খুশি। এতো দ্রুত কাজ শেষ হলে আর একটা কাজের ব্যপারে সুবিধা হবে। হপ্তা শেষে টাকা পেয়ে একটা টি শার্ট কিনল প্রবীর। বংকা কে দিতে হবে।পুরনো বাড়ি ছিল যেখানে সেখানে কেউ বংকার খোঁজ দিতে পারল না।ইট ভাঁটার মাঠে গিয়ে বসে রইল। প্রবীর হাতের ক্ষতটা সেরে গেছে কিন্তু দাগ হয়ে আছে। ধোপা রা কাপড় মেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বংকা কে দেখতে পেল। বংকা অবাক হল প্রবীর কে দেখে। এক কালের সঙ্গী ,প্রবল শত্রু, কিন্তু অদ্ভুত টান দুজনের মধ্যে বংকা কে টিশার্ট টা এগিয়ে দিল প্রবীর। বংকা আনন্দ পেল,চোখ চিক চিক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা পরে নিল। গায়ে ঠিক মত ফিট করেছে। “আবে, পেবু তোর হাতে কি হয়েছে। আমার বন্দু বলে কতা।যে হাতে খাবি সেই হাতে পাছা ধুবি।” প্রবীরের মাথায় চাঁটি মেরে বলে ওঠে বংকা। তারপর অনেক কথা। শিউলির ব্যাপার তা বংকার কাছে জানল। কিন্তু শিউলি যে তার সাথে দেখা হলেও কথা বলেনি সেটা বলল না প্রবীর। ওটা খুব ব্যাথার জায়গা। খুব ব্যাথা। কাউকে বলবে না।
দিবানাথ বুঝতে পারল সাধুখাঁ দের কেবল ওষুধের ব্যবসা নয়। অন্য আর কিছু একটা লুকানো ব্যবসা আছে। অনিল সাধু খাঁর যে ভাই বিয়ে থা করেনি বাড়িতে থাকে। সে অন্য ব্যবসাটা দেখে। সম্ভবত অনিল সাধুখাঁ মালিক হলেও আসলে সেই গোটা ব্যাপারটা চালনা করে। রঘু মিশ্র বলল, “দিবু ভাই, তুমারে বাড়ি তে একবার ডাক পড়েছে।” ।রঘুর সাথে দিবু মালিকের বসত বাড়ি গেল।বড়লোক হলেও এতো অগোছালো বাড়িঘর হতে পারে ধারনা ছিল না। কিছুই যেন ঠিক মত নেই। রঘু ভেতরে একটা ঘরে ঢুকে গেল।কিছুক্ষন পর ডাক দিল “মেজবাবুজী ডাকছে এস।” ভেতরে একটু বুক গুড়গুড় নিয়ে গেল দিবানাথ। “ তুমি নাকি খুব ভালো কাজ করছ?” ব্যায়ামবীরের মত বেশ দশাসই চেহারার একজন চতুর গলায় জিজ্ঞাসা করে। দিবানাথ কোন উত্তর না দিয়ে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে সোজা তাকিয়ে থাকে। “তুমি আমার কাছে এবার থেকে কাজ করবে। ইংরেজি পড়ে বুঝতে পার তো।” দিবানাথের মাইনে অনেকটা বেড়ে গেল। কিন্তু কাজটা কি বুঝতে পারল না দিবানাথ।সে দামী সিগারেট কিনল এক প্যাকেট। ইট ভাঁটার মাঠে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল বংকা আর প্রবীর জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। প্রবীর দিবানাথ কে দেখে উদ্বেল হয়ে গেল। সেদিন অমাবস্যার আকাশ দেখল, ইটভাঁটার অন্ধকার মাঠে তিনটে আগুনের ফুটকি। যেন সমকোণী ত্রিভুজ।
শিউলির খুব মন খারাপ। একদিকে প্রবীরের ওই রকম ভয়াবহ কাণ্ড। অন্যদিকে বুলুদির শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ভয়ানক অশান্তির খবর।বুলুদির বর আর শাশুড়ি বুলুদিকে খুব মারে। বুলুদি একা একা বাড়ি চলে এসেছে। আর ফিরে যাবে না। মামা বাড়িতে তাই নিয়ে খুব অশান্তি। মা বুলুদিকে সমর্থন করল।শিউলি মাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকল রাতে অনেকক্ষণ।শিউলি মনে মনে ঠিক করে নিল বিয়ে করবে না। বিয়ে করলে বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে।একটা চাকরি খুব দরকার। কি চাকরি ভালো হবে।নিজের পায়ে দাঁড়ান খুব দরকার। মা ঘুমিয়ে গেলে জেগে থাকে সে।ওই বদমাশ বুলুদির বরের আচরণ টা ভুলতে পারে না। আচ্ছা বিয়ে করলে কি ওই ভাবেই পুরুষ এগিয়ে আসে। ইস্ ওই রকম হলে কিছুতেই বিয়ে করবে না। সিনেমা তে তো গান গায়, কবিতা লেখে। ওর ক্লাসের সাধুখাঁ বাড়ির মেয়ে অনেক প্রেমপত্র পায়। তাতে কত কি লেখা! কি যেন সেদিন লিখেছে, ‘তোমার সাথে হল আলাপ, তোমার জন্যে লাল গোলাপ’। আসল ব্যপার টা তাহলে অমন নয়।কেমন যেন মন খারাপ হল তার।
প্রবীর বুঝতে পারছে না কেন তাকে এই বিচ্ছিরি জায়গায় এনে রাখা হল। সে বাড়িতে কেন থাকতে পারবে না। খুব খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করেছে পাঁচ ছয় দিন। একজন ঢুলুঢুলু চোখের ভদ্রলোক এসে কি সব জিজ্ঞাসা করে অসহ্য লাগে। আজ থেকে কিচ্ছু খাবে না। দেখি এবার কি করে এরা। সে বাড়ি যাবে। বাড়ি থেকে দূরে তাকে থাকতে কেন হবে।
“ তুমি খাচ্ছ না কেন?”
“ আমি বাড়ি যাব?”
“তোমার শরীর খারাপ, কিছুদিন এখানে থাকতে হবে”
“ আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসুন। আমার ক্লাসের পড়া হচ্ছে না।”
“ওহ্ পড়ে একেবারে উল্টে দিচ্ছে।পরে পড়বে। ওষুধ খেতে হবে। তাই খেতে হবে ”
“আমি বাড়ি যাব, ইস্কুল যাব, বাবার কাছে যাব, শিউলির কাছে যাব,”
“ এই ওকে হাত পা বাঁধ তো। ইঞ্জেক্সান টা দিয়ে দিই। তারপর গিলিয়ে দিবি”
আজকাল আর সেই ফালতু ফোন আসে না। শিউলির খুব জানতে ইচ্ছা করে কে করত। তাহলে ওই চিরকুটের চিঠির মতো তার জন্যে কেউ ফোন করত। কে জানে। বটতলার কালী ঠাকুরের সামনে হাত জোর করে মনে মনে রোজ বলে, “ওই রকম বর দিও না ঠাকুর।তার চাইতে বিয়ে না করা ভালো। আর যদি কাউকে পাঠাও তাহলে ভালো ছেলে র সাথে দিও। যেন না মারে। ভালো বাসে। আমাকে। বাবাকে। মাকে।” রেজাল্ট কেমন হবে বুঝতে পারছে না সে। অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছে। সায়েন্স নেওয়া ঠিক হল কি না কে জানে। ভালো রেজাল্ট করলে জেলা শহরের কলেজে ভর্তি করে দেবে বাবা। যদি না পারে! ইদানিং খুব বিপর্যস্ত লাগে তার। প্রবীরের কথা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে শিউলির। স্বপ্ন দানা বাঁধলে হেরে যাওয়া মানুষের কথা মনে থাকে না।
দিবানাথ বঙ্কাকে বেশ টাইট দিয়েছে। বঙ্কা বুঝেছে সে খিস্তি দিতে পারে, গায়ে জোর থাকলেও বুদ্ধিতে দিবানাথের সাথে পেরে উঠবে না।দিবানাথ বুঝেছে বঙ্কা কে কাজে লাগাতে হবে। সে বঙ্কা কে দুপুরে খাবার জন্যে টাকা দিল একদিন। তার পরিবর্তে বলল ইলেকট্রিকের দোকানের মালিকের বাড়ির লোকজন রা কে কেমন জেনে আসতে। খবর দিলে আরও টাকা দেবে। বঙ্কার কাছে এসব জল ভাত। দুদিনের মধ্যে জানাল সাধুখাঁ দের বাড়ির মালিকের আরো দুই ভাই আছে। একটা সাথে থাকে আর একটা কলকাতায় থাকে শ্বশুরের ব্যবসা দেখে। তার সাথে সম্পর্ক খুব খারাপ। সম্পত্তি তে তাকে ভাগ দেয়নি মালিক অনিল সাধুখাঁ। বাড়িতে যে ভাই বাড়িতে থাকে সেটা অপদার্থ।নেশা করে। ব্যবসার কিছু বোঝে না। সাধু খাঁ র একটা মেয়ে। মহা ছেনাল। প্রচুর ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। বৌ অসুস্থ। সাধুখাঁ র একজন পোষা মেয়েছেলে আছে। ওর কাজের লোক তিনটে। কেউ সন্তুষ্ট নয়। দিবানাথ নতুন বিড়ি খেতে শিখেছে। বঙ্কা কে দিল। সাথে আরও কিছু টাকা। রাতে খেয়েও বঙ্কার কিছু থাকবে।
প্রবীরের ঘুম ভাঙলেও উঠতে ইচ্ছে করে না। এখানে লাইন করে খাবার নিতে যেতে বলে তার কিছু ভালো লাগে না। তার অংক গুলো শেখা হল না। শিউলির আঙুল গুলো চোখের সামনে ভাসে। ওই আঙুল দিয়ে বইএর অক্ষরের ওপর রেখেছিল। ও ঠিক কষ্ট বুঝে নিত। আচ্ছা কষ্ট থেকে বাঁচতে কি যেন করত? প্রবীরের কিছুতেই মনে পড়ে না।মাথার মধ্যে শুধু মায়ের পা দুটো মনে আসে। মার গলা দিয়ে পেঁচিয়ে থাকা দড়ি। আবার ঘুমিয়ে যায় সে। ভাতের থালায় মাছি বসে।
প্রবীরের বাবা প্রবীর কে দেখে চমকে গেল। একী অবস্থা হয়েছে ছেলের । “না না, একে আমি নিয়ে চলে যাব। এ যে মরে যাবে। ” ডাক্তারের সামনে কেঁদে ফেলে দমবন্ধ গলায় বলে ফেলে। “ নিয়ে যাবেন নিজের দায়িত্বে।” রুক্ষ স্বরে অফিসার বলে। প্রবীর বাবাকে দেখে সম্পূর্ণ ভাবলেশ হীন। চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর ছেলের ডাক্তারের দেখা পেলেন প্রবীরের বাবা। যার কাছে ভর্তি করেছিলেন ইনি তিনি নন। একজন অল্প বয়সী ছেলে। চশমার পেছনে কি যেন একটা আশ্বাসের দৃষ্টি। “ ওকে নিয়ে যান। ওকে কেউ যেন খারাপ ভাবে কথা না বলে, সেটা দেখবেন।সময় লাগবে ঠিক হয়ে যাবে”প্রেস্কিপ্সানে খাঁটি বাংলায় কিছু নির্দেশ লিখলেন। একটা ঠিকানা দিলেন জেলা শহরের চেম্বারের,মুখে বললেন “এখানে চলে আসবেন”। বাড়ি নিয়ে এসে প্রবীরের বাবা প্রবীর কে জড়িয়ে খুব কাঁদল খানিক। প্রবীর একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল তারপর মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। প্রবীরের বাবা তার নোংরা জামা কাপড় পরা শরীরের দুর্গন্ধের সাথে মলের গন্ধ পেলেন।
দিবানাথ আজ শিউলির ফোন নম্বরে ফোন করল। বেশ রাতের দিকে। শিউলি বেশ আয়েস করে মাছের কাঁটা চিবাচ্ছিল। অসময়ে ফোন। শিউলির বাবা ফোন ধরে একটু অবাক হল। একটি ছেলে শিউলি কে চাইছে। মা চোখ গোলগোল করে দেখছে। শিউলি আরও বেশী চিন্তিত। মায়ের কাছে বকুনি না ঠেঙানি কি যে প্রাপ্য আছে তার। বাবা আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলেন , “কি নাম তোমার?”।“ ওদিক থেকে উত্তর এলো,” “ কাকু আপনি আমাকে চেনেন। আমি দিবানাথ। আমি ,শিউলি, প্রবীর এক সাথে ইট ভাঁটার মাঠে খেলতাম। আপনি একবার সবাইকে কালীপটকা কিনে দিয়েছিলেন।” দিবানাথ কথা বলতে শিখে যাচ্ছে। শিউলির বাবার মনে পড়ল। তিনি খুশি হয়ে শিউলি ডাকলেন। শিউলি আর অবাক থাকল না।
“ হ্যাঁ রে, বল কি বলবি?”
“পেবু ,নাকি বাড়ি ফিরেছে ?”
“কই, জানি নাতো!”
“হাসপাতালে, খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিল। একেবারে আধমরা।কাপড়ে পেচ্ছাব পায়খানা করে ফেলছে।”
“সেকি! ওরা চিকিৎসা করেনি?”
“কে ,জানে। আমি ভেবেছিলাম তুই জানিস।”
“ না আমার এবছর উচ্চ মাধ্যমিক না! ইস্কুল আর টিউসান করেই সময় চলে যাচ্ছে”
“ সেটা তো আমারও”এটা বলে মৃদু হাসল দিবানাথ। “অবশ্য তোর মত ভালো রেজাল্টের চাপ আমার নেই”
“আমি ফিজিক্সে পাস করব কি না কে জানে, তুই আবার হ্যাটা করছিস।”
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে শিউলি এরপর বলে “ঠিক আছে রে, বাবাকে সব বলছি” ফোন কেটে দিয়ে দিবানাথের কচি গোঁফের নীচে এক খানা হাসি উঠে এল। দারুন লাগছে তার । কাছে বঙ্কা থাকলে তাকেও চুমু খেয়ে নিত। ফোনের বুথ থেকে বার হয়ে সাঁ করে সাইকেলে বাড়ি এল। মা খাবার নিয়ে বসে আছে। মার প্রচুর পাকা চুল হয়েছে। “হ্যাঁরে দিবু, তোর বাবার শরীর ঠিক আছে? একটু খোঁজ নিস তো।”
প্রায় এক সপ্তাহ পর খুব সকালে জেগে উঠে স্বাভাবিক চোখে তাকাল প্রবীর। বাবা বুকের কাছে হাতের আঙ্গুলে আঙুল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখ টা একটু হাঁ। খুব মায়া হল বাবাকে দেখে।বাবা কে আর কোন কষ্ট পেতে দেবে না। তার মাথা টা হিজিবিজি হয়ে আছে। কি যেন একটা হয়েছিল। কি একটা ফুলের গন্ধ পাওয়া গেল। কাদের বাড়িতে টিভিতে গান হচ্ছিল। বাবাকে বলবে একটা টিভি কিনতে। চিত্রাহার দেখবে। ‘জু জু জু জু’ বলে একটা গান হয় একটা মা বাচ্চা কে কোলে নিয়ে করে। সাবানের বিজ্ঞাপন দেখায়। ফেনা ফেনা হয়ে সব সাদা হয়ে যায়। সব নোংরা ধুয়ে যায়। আচ্ছা কোথায় টিভি দেখল প্রবীর। বুকে ছ্যাঁত করে উঠল। বাবা ওকে আবার ওই হাসপাতালে রেখে আসবে না তো। ওই তো টি ভি ছিল ওখানে। ওষুধ ,ফিনাইল, আর পেচ্ছাবের গন্ধে ভারী হওয়া অভিজ্ঞতার ভারে বুক কেঁপে উঠল তার। কি অসুখ করেছিল তার। বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল । বাবা কি চায়? বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল? বাবা কেন ওখানে দিয়েছিল? বুকে পাথর হয়ে বসে এই কথা। বাবা কি চায় প্রবীর কষ্টে থাকুক? বাবা কেন চায়, প্রবীর কষ্টে থাকুক!
কেন? প্রবীরের বাবা ঘুম ভেঙে তাকে স্বাভাবিক ভাবে দেখে আনন্দ পায়। মোড়ের দোকান থেকে চা কিনে আনে।সাথে প্রবীরের পছন্দের বিস্কুট। ব্যাপারটা বঙ্কা নজর করল। নির্লজ্জের মত জিজ্ঞেস করল, “ কাকু, পেবুর শরীর কেমন আছে?” প্রবীরের বাবা সাবধান হলেন। মানসিক অসুস্থ মানুষকে সমাজ বড় বিব্রত করে।
“খুব ভালো আছে রে? একদম ঠিক হয়ে গেছে। এ নে দুটাকা। এই মদন একটা চা দিও তো এই ছেলে কে।” এর থেকে দূরে রাখতে হবে ছেলে কে । যেমন করে হোক।
“আমাকে তুমি ওখানে রেখে এসেছিলে কেন বাবা”
“তুই খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি রে পেবু”
“ কি করেছিলাম?”
“সেটা বললে তোর মন আবার খারাপ হবে।”
“আমি ভালো হব না বাবা?”
“হবি তো,সব ভালো হবে!” দু চোখে আর জল আসে না প্রবীরের বাবার। অসম্ভবের সাধনা করা মানুষ, হেরে যাওয়া স্বীকার করতেও ভয় পায়।
“আমাকে শিউলির কাছে নিয়ে যাবে বাবা! ও আমাকে পড়িয়ে দিলে সব শিখে যাব আমি।আমি আবার ইস্কুলে যাব। খাতাতে লিখব।”
“হ্যাঁ বাবা সব শিখবে তুমি।”
দিবানাথের বাবার সত্যি কি একটা জ্বর হয়েছে সারছে না। জগা ডাক্তার বলেছে বড় ডাক্তার দেখাতে। বনলতার বাড়ি গিয়ে অবাক হল। বনলতার চকচকে চেহারা খারাপ হয়ে গেছে। তবে ঠাটবাট আগের মতোই আছে। গলায় একটা মোটা সোনার চেন পরে আছে। এটার দাম নাই নাই করে পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার হবে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল দিবানাথ। বাবা কোন মতে চোখ তুলে তাকাল। চোখ বন্ধ করে জিজ্ঞেস করে, পরীক্ষা কবে থেকে। পরীক্ষা শেষ হলে দিবানাথ কে নিয়ে জেলা শহরে যাবে। একা ডাক্তার দেখানো সম্ভব না। দিবানাথ মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে ইটভাটার মাঠের পাশে গিয়ে কিছুক্ষন দাঁড়ায়। বঙ্কা একটা গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে।
“ কি বে ‘জওয়ানি কি জ্বলন’ কেমন দেখলি”
“ হেব্বি মাইরি। কি কোমর! আর নাগিন নাচ তো… ” জিব দিয়ে লালা টেনে বঙ্কা বলে।
“আমি ওই নাচ দেখেই সেদিন বার হয়ে এসেছি, না হলে পুরো কেস খেতাম। পুলিশ এসেছিল। ভজা, আর পদু কে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”
“আমি তার পরের দিন ঢুকেছিলাম, মামাদের টাকা নিয়ে যাওয়া হয়ে গেছে। এখন কদিন আর চুল্কাবে না।”
“মামা রা কিরকম নেয় রে!”সব কিছু ঘাঁত ঘোঁত এর খবর আজকাল জানবার চেষ্টা করে।
“মেয়েদের ইস্কুলে একটা মাল যা সুন্দরী। তুই মনে হয় চিনিস। ফুরফুর করে সাইকেল চালায়।শিউলি নাম…
কথা শেষ হবার আগেই বলল দিবানাথ, “একদম সাবধান। তাকাবি না। আমার বান্ধবী”
“উড়ি লে, তুই প্রেম করিস্?”
“ না প্রেম করব কেন? গার্ল ফ্রেন্ড।বান্ধবী”
শিউলি খুব ভালো রেজাল্ট না করলেও মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে ফেলেছে। বাবা চিন্তা মুক্ত। এবার জেলা শহরে চলে যাবে। কলেজের হোস্টেল । ওর কোন বন্ধু যাচ্ছে না। শিউলির বাড়ি একদিন রবিবার প্রবীর আর তার বাবা এলো। শিউলি একটু সাবধানে হাসল। প্রবীর কেমন ভাবলেশ। শান্ত হয়ে মোড়ায় বসল। সরষের তেলে ভাজা মুর্গির ডিম প্লেটে করে এনে দিল শিউলির মা। অন্য দিন শিউলিকে বলে অতিথিদের দেবার জন্যে।প্রবীরের বাবা বলল, “ বারবার তোমার কথা বলছিল মা জননী। তুমি নাকি ওকে পড়িয়ে দিয়েছিলে।” বাবার এই কথা শুনে মাথা নাড়ল প্রবীর। শিউলি একটু সাবধান হয়ে গেছে, “ আমি তো আর পড়াতে পারব না কাকু। এবার আমি কলেজে ভর্তি হব। হোস্টেলে থাকব।” “আমারাও চলে যাব। দূরে চলে যাব। এখানে থাকলে আমি ভালো থাকবো না।এখানে মা কষ্ট পেয়েছিল। হাওয়াতে তার গন্ধ” এক নিঃশ্বাসে বলল প্রবীর। সবাই চুপ। প্রবীরের বাবা বলল, “ ওই দ্যাখো, অমনি করে বলে নাকি। আমি ভাবছি অন্য কোথাও চলে যাব। এখানে থেকে কাজের জায়গা টা দূরে। আপনারা আমার অনেক করেছেন । তাই জানাতে এলাম।” প্রবীররা অন্য কোথাও চলে গেল। ওদের বাড়ীটা কারা যেন কিনে নিল।প্রবীরের মার সব গন্ধ সরিয়ে দিয়ে নতুন সিমেন্ট বালি দিয়ে ঘর উঠল।কোথায় গেল প্রবীরেরা এটা বঙ্কাও জানতে পারল না। জেলা শহরের একটা সরু গলিতে দোতলায় ঘর ভাড়া নিল প্রবীররা। প্রবীরখুব স্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল। প্রবীরের বাবা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ছেলে কে যেমন করে হোক উপার্জন শীল করতে হবে।
দিবানাথ পাস করেছে। নিজে খুব খুশি হল। পাস করে এবার নিজের মত স্বাধীন ভাবে এগোতে পারবে। মা খুশি হল। মা একটা চিরকুট লিখে তার হাতে দিল। বাবাকে দেবার জন্যে। খুলে পড়ল দিবানাথ।
‘ শ্রীচরণেষু,
দিবু পাস করেছে। একদিন রাতের খাবার এই বাড়িতে যদি খেয়ে যাও তাহলে ভালো হত। প্রণাম জেনো।
তোমার অলি’
দিবানাথ মন আরও হিসেবি হয়। বাবার কাছে কত টাকা আছে। বাবাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়ে ব্যাপার টা জানতে হবে। কত টাকা আছে বাবার। ব্যবসাটা খাড়া করতে অনেক টাকা লাগবে।চিরকুটটা বাবা পড়ল। বনলতা পড়ল। বনলতা গলা পরিষ্কার করে বলল, “তোমার মাকে এখানে এসে দেখা করতে বল। অসীমের শরীর খুব খারাপ দেখতেই তো পাচ্ছ।” বাবা এই বিষয়ে কোন কথা বলল না।“ পরশু ডাক্তারের কাছে যাব ।তুই আমার সাথে যাবি”।মাথা নাড়ল দিবানাথ। চোখে রাখল বনলতার গলার সোনার হারের দিকে।
ডাক্তারবাবুর কাছে বাবাকে আনতে এতোটা কষ্ট হবে বুঝতে পারেনি দিবানাথ। বাবা খুব কষ্ট করে হাঁটছে। মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে পরিশ্রমে। বনলতা দিবানাথ কে ঠিক বিশ্বাস করে না। সেই ডাক্তারের সাথে কথা বলল। বেশ অনেক টাকা খরচ হবে । সেটা নিয়ে বিন্দু মাত্র চিন্তিত হল না বনলতা বা বাবা। কিন্তু মার যদি এমন কিছু হয় দিবানাথ কি ভাবে চিকিৎসা করবে। মনটা খুব খারাপ হল দিবানাথের। “কলেজে ভর্তি তো হচ্ছ না কি করবে তুমি?” বাবা জিজ্ঞাসা করল দিবানাথ কে। “দেখি একটা দোকানে ঢুকব” দিবানাথ নিঃস্পৃহ ভাবে বলে।বাবা যেন অন্য কেউ। বাবার কোন দায়িত্ব নেই তার জন্যে। প্রবীরের বাবা প্রবীর কে ভালো করার জন্যে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।খুব জ্বালা করছে বুকের ভেতর। খুব জ্বলছে। মা কেন যে ওই চিরকুট টা লিখে দিল!শিউলি কে এই সব কষ্টের কথা বলা যাবে! বললে বুঝবে। বঙ্কা এই সব কষ্ট বুঝবে না।
শিউলি হোস্টেলে এসে একটা খোলা মেলা জানালা পেল। দূরে একটা চার্চ। ওর রুমমেট মেয়ে দুটির একটি চশমা পরা সিরিয়াস। অন্যটি মোটা হাসি মুখ মেয়ে। মন খুব ভালো হল তার। কিন্তু বিছানায় শুয়ে মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ হল। শিউলি জানল না, মা আজকে ভালো করে না খেয়ে শুতে গেছে।
প্রবীর এখানে এসে ভালো আছে। এখানে কেউ জানে না ওদের।নতুন ইস্কুলে কয়েকজন বন্ধু হয়েছে। তারাও ওর মত অনেক কিছুই পারে না। তাই সেই পিছিয়ে থাকা ছেলেদের একটা দল কে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে হেড মাস্টার মশাই। হেড মাস্টার মশাই কে এখানে লোকে ভয় পায় আবার ভালো বাসে। ভাড়া বাড়ি থেকে এবার একটা বাড়ি কিংবা ঘর কেনার কথা ভাবছে প্রবীরের বাবা।পাড়ায় মিউনিসিপালিটি ভোট। দেওয়ালে ভোটের প্রচার ।সকালে অনেক গুলো ছেলে রং তুলি নিয়ে সেই কাজ করছিল।কালো, লাল, সাদা, সবুজ ,কমলা নানান রঙ আর তুলি দিয়ে অক্ষর তৈরি হচ্ছিল। বেলা গড়িয়ে যেতে ছেলের সংখ্যা কমে গেল। প্রবীর অনেক ক্ষন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। খুব মৃদু স্বরে বলল , “আমাকে রঙ করতে দেবে।” লোকটার কানে দড়ি বাঁধা চশমা। মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল , “ ভুল্ভাল করবি না তো। নে এই টাতে সবুজ দে।”মন দিয়ে করল প্রবীর। বাবাকে দেখাবে। একটু খানি কাজ জায়গা রঙ করতে পেরে খুব গর্ব হল মনে মনে। লোকটার নাম ট্যাপা দা। লোকটা র সাথে দেখা হলেই হাসে প্রবীর । সে সব সময় না হাসলেও, চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। লোকটা অনেক রকম কাজ করে। ওষুধের দোকানে মাঝে মাঝে বসে থাকে।আরও অনেক গুলো দেওয়ালে প্রবীরের তুলির ছোঁয়া লাগল। একটা গোটা অক্ষরে একদিন রঙ করল প্রবীর। দেখে খুব সন্তুষ্ট হল ট্যাপা দা, “বাহ্ এই তো বেশ চ্যালা হয়ে উঠেছিস , তাহলে পেন্নামি দে। একটা চা খাওয়া।” হাসি মুখে বলল । প্রবীরের মুখ ছোট হয়ে গেছে। “আমার কাছে টাকা নাই”।“ সে কি রে, বগলে চুল , মুখে দাড়ি তোর পকেটে চা বিড়ির টাকা নাই।”অট্টহাস্য দিয়ে বলল। মুখ নিচু করে আছে প্রবীর। “এই নে তোর প্রথম রোজগার” বলে সবুজ পাঁচ টাকার করকরে নোট এগিয়ে দিল। আর কয়েক মাসের মধ্যে প্রবীরের বাবার দুটো চিন্তার অবসান হল। ট্যাপা দার সাথে নানান কাজে প্রবীর উপার্জন করতে লাগল। আর একটি কানা গলির শেষে এক উত্তরাধিকার হীন বুড়ি মরে যাওয়ায়,পাড়ার লোক তার বাড়ি প্রবীরের বাবা কে বেচে দিল।
“গুরু তোমার বান্ধবী হোস্টেল থেকে ফিরেছে। কি চকমক করছে।” বিড়িতে টান দিয়ে বলে বঙ্কা। দিবানাথ বুঝে গেছে আর শিউলির আশেপাশে যাওয়া বা কথা বলা বেশ দুস্কর।কিন্তু বঙ্কা কে সেটা বলল না, বরং একটু স্টাইল করে বলল “চলে এসেছে। আমি ভাবছিলাম পরের সপ্তাহে।”দিবানাথ এবার সাধুখাঁর দোকানের ব্যাপারে মন দেয়। দোকান টায় ঢুকতে হবে। কি ভাবে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না। বনলতা ফরমান জারি করেছে যখন তখন ‘বাবা কেমন আছে ‘ বলে সাহেব পাড়ার বাড়ি চলে গেলে হবে না। বিকেলের দিকে যখন বাবা চা খায় কেবল তখন দেখা করা যাবে। মাকে ব্যাপার টা বলতে ইতস্তত করছিল দিবানাথ। কিন্তু জানাল। দেখল মা একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। প্রতিক্রিয়া হীন ভাবে কেবল বলল, রোজ যাবি না। হপ্তা তে দুই দিন যাবি। ইলেকট্রিকের দোকানে দুপুরে লোক নেই। দিবানাথ গিয়ে মালিকের সাথে দেখা করবে বলে জানাল। লালা গেঞ্জি পরা অল্প বয়সী ছেলেটা বলল ,অপেক্ষা করতে হবে, দাদা খেতে গেছে। তার সাথে গল্প জুড়ল দিবানাথ। অনেক কিছুই জানতে পারল। বঙ্কা বেটা কেবল ‘ফ্যামিলি ম্যাটার’এর খোঁজ এনেছিল। আপাতত কোন কর্মচারী লাগবে না। কিন্তু ঢুকতে হবে। “ আজ আমাকে যেতে হবে” বলে সে সরে চলে এল।
শিউলি চিরকুট নয়, একটা সুন্দর খামের মধ্যে কার্ড আর চিঠি পেল। তাতে খুব সুন্দর হাতের লেখায়, খুব মিষ্টি করে প্রেম নিবেদন করেছে কেউ। কিঞ্চিৎ পুলকিত হল সে ।কিন্তু পুরুষ সমন্ধে বিপদ সে শিখে গেছে। তাই কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল না। পত্র প্রেরক আবার চিঠি দিয়ে জানতে চাইল, চার্চের মাঠে একবার দেখা করবে কিনা। সাথে একটা লম্বা কবিতা।
সাধু খাঁ দের ব্যাবসা টা নিয়ে আরও কিছু খোঁজ খবর নিল দিবানাথ। বেশ কিছু গণ্ডগোল আছে। এত বড় ব্যবসা কিন্তু কর্মচারীদের পয়সা কম দেয়। আদতে ব্যবসা টা শিখে নিতে হবে। দিবানাথের চেষ্টা থাকলেও ঠিক ঢুকতে পারছিল না।আসলে কিছুটা ‘ভদ্রলোক’ গন্ধ তার গায়ে লেগে আছে।সেটা পার করে গিয়ে চাইতে পারছে না…,আমাকে আপনাদের দোকানে একটা কাজ দেবেন বলা বেশ কঠিন । দিবানাথ অসুবিধা টা বুঝতে পারছে। দিবানাথের বাবা সম্পূর্ণ বনলতার হাতে বশীভূত। মার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই। মা কেমন বিধবাদের মত শাড়ি পরে। টিপ পরে না। সোনার চেন টা খোয়া যাওয়ায় দুঃখ আরও বেড়েছে। তবে দিবানাথ মাঝে মাঝে বাবার সাথে দেখা করতে যায়। চেয়ে চেয়ে দেখে বনলতার বাড়িঘরের জিনিস।একটা টেপ রেকর্ডার আছে।বেশ দামী কোম্পানির। চারশো টাকা তে বেচা যাবে। রুপোর চামচ, কাঁসার ফুলদানী, জাপানী ঘড়ি, ক্যামেরা সব গুলোর দিকে তাকিয়ে তৃষিত হয় সে। একটা ব্যবসা তৈরি করতে অনেক টাকা লাগবে। বঙ্কা কে বলেই ফেলল দিবানাথ, “আমরা একটু ভদ্রলোক তো! অনিল সাধুখাঁকে গিয়ে কাজ চাওয়াটা মাইরি হেব্বি পেস্টিজে লাগছে।”বংকা অবাক হল না, খসখস করে গা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “ইসব ন্যাকামি হলি আর খেতে হবে না। পোঁদে নাই ইন্দি ,ভজরে গোবিন্দি। উ শালার অনিলের এক খান ঢেমনি আছে।পাল পাড়ায় থাকে… যাবা একদিন। গিয়ে ন্যাকার মত হাত কচলে বল… থোবড়া তো বেশ হিরো হিরো। ও মাগী পটে গিয়ে যদি কিছু একটা করে।”বংকা পালপাড়ায় অনেক কেই চেনে দেখে দিবানাথ একটু অবাক হল। দিবানাথ কে নিয়ে একটা ঘরে অনায়াসে ঢুকে গেল বংকা। দিবানাথ ভেবেছিল, কোন মধ্য বয়সিনী হবে, দেখা গেল অল্পবয়সী চোখের তলে কালি পরা একটি মেয়ে। একটু বিরক্ত হয়ে বংকার কথা শুনল। বংকা বলে চলল, “ তুমি যদি মাসী হয়ে এই ছেলেটা কে না দ্যাখো কে দেখবে বল!” দিবানাথ মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মেয়েটি থালায় কি একটা বাছছিল। সেটা নামিয়ে রেখে,খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “ আমি কারো মাসী না। যার কথা তাকে বলতে বল।” দিবানাথের দিকে তাকিয়ে বলল , “ কি পাস দিয়েছ? টিউশানি করলে তো পার!” দিবানাথ দেখল মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন মেপে নিচ্ছে।দিবানাথ কোন রকমে জানাল সে ওখানে কাজ করতে চায়।অবাক হল দিবানাথ।মেয়েটি মন দিয়ে দিবানাথের কথা শুনে হাত মুছতে মুছতে বলল, “ পরের সোমবার একবার এস দুপুর করে। বলে দেখব।” বাইরে এসে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে দিবানাথ। বংকা জানায় মেয়েটির আসল নাম, স্মিতা, লোকে ডাকে রেশমি বলে।
শিউলির প্রবল উচাটন মন কে চিঠি দেয় কিছুতেই বুঝতে পারে না। নানান জায়গায় অপেক্ষা করে চিঠি আসতেই থাকে। আজকাল পড়াতে মন বসে না তার। নানান কল্পনা চলছে মনের মধ্যে।কেমন দেখতে সে!পড়ার পাহাড় জমে যাচ্ছে এই করে। ক্লাস টেস্টে ফেল করল সে। জীবনে প্রথম।হোস্টেলের খাটের থেকে নামল না দুদিন কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। নাহ্ অনেক হয়েছে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে। এবার থেকে চিঠি এলে আর পড়বে না সে। ফেলে দেবে। রুমমেটরা ওর অবস্থা বুঝল আর মুচকি হাসল।শিউলি মনের সাথে যুদ্ধ করে খাম গুলোকে উপেক্ষা করতে লাগল। খামের আয়তন মোটা হতে থাকে। শিউলি মন দিয়ে ফর্মুলা মুখস্ত করে, লিখে লিখে সমাধান করতে থাকে।চারটে খাতা শেষ করে ফেলল লিখে লিখে। পরের পরীক্ষা ঠিক মতো দিল সে। রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাবার বাস ধরল সন্ধ্যে বেলা।বাসে উঠে জানালার ধারের সিট ।তিন ঘণ্টার জার্নি। কন্ডাকটার চেনা। সে মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে পড়ল।বেশ কিছুক্ষন পর ঘুম ভাঙলে বুঝল ওর পাশে যে মাসীমা ছিল তার বদলে একটা লোক।সাধারণ যাত্রীদের চাইতে দামী সার্ট প্যান্ট পরা লোক।তার মুখের দিকে না তাকিয়ে, শিউলি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বুঝল লোকটা তাকে দেখছে মাঝে মাঝে। অসহ্য লাগে তার।বটতলা এসে গেল। আর কুড়ি মিনিট আছে ওদের বাড়ির কাছের স্টপেজের। লোকটা হঠাৎ বলে ওঠে , “ তোমার কলেজে পরীক্ষা চলছে ?” বিষ মুখে শিউলি বলে ,তার দিকে না তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, শেষ হয়ে গেল।” লোকটা আবার বলে, “এবার তাহলে কদিন ছুটি?” বিরক্ত হয়ে শিউলি হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়ায়। লোকটা নেমে যায়। বাড়ি এসে ব্যাগে একটা নতুন খাম পেল শিউলি। চমকে উঠল সে। পাশের ওই লোক টা? তার মুখ দেখেনি তো। কেবল জুতো দেখেছিল। আঙ্গুলে একটা লাল পাথর। হে ভগবান। বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। একদিকে মা যদি জানতে পারে পেটানি খাবে সে। অন্য দিকে একটা লোক তাকে অনুসরণ করছে ভেবে ভয় পেল সে। বাথরুমে ঢুকে চিঠি টা খুলল। সেই চেনা হাতের লেখায় ,
‘ আমি জানি তুমি আমাকে নিয়ে ভাবো। ভয় না পেয়ে একবার দেখা কর। আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি না। বাস্তব কে স্বপ্ন করতে চাই………… ’
এই সব প্রচুর কিছু লেখা। শিউলি খুব দুশ্চিন্তায় পরে গেল। কিছুতেই সে দেখা করবে না। খুব আফসোস করতে লাগল। কেন যে লোকটার মুখটা দেখল না।এবার হোস্টেল একায় গেল না সে। পাড়ার দামু কাকুর সঙ্গ ধরল। শিউলির মার খুব বিশ্বাস মেয়ের ওপর ,মেয়ে বয়ে যায়নি। দামু কাকুর পাশে বসে কিছুটা চিন্তা মুক্ত থাকল। না বাসে ওই ধরণের কোন লোক নেই। ক্রমাগত মানুষের মুখ দেখতে থাকে সে। হোস্টেলে ফিরে বন্ধুদের ব্যাপার টা জানাল। ও যে বন্ধ খাম গুলো ফেলে দিয়েছিল, ওদের একজন মুচকে হেসে এনে দেখাল। সব গুলো তারা পড়েছে। সব কটা চিঠি শিউলি পড়ল। কোথাও সে লিখেছে ,ব্যাডমিন্টন ম্যাচে দু পয়েন্টের জন্যে সে রানার্স হয়েছে, কোথাও লিখছে তার বাবার শরীর ভালো নেই,কোথাও লিখছে সঞ্জয় দত্তের ফার্স্ট সিনেমার টিকিট আছে দেখতে যাবে কিনা… তার মানে তো অল্প বয়সী কেউ। তাহলে লোকটা কে? মহা চিন্তার মধ্যে পড়ল শিউলি। শিউলি এরপর ছোট ছোট কয়েকটা চিঠি পেল।তারপর হঠাৎ আর কোন চিঠি আসে না। এবার কেমন মন খারাপ হচ্ছে শিউলির। প্রথমে ভেবেছিল ,যাক বাবা বাঁচা গেল। কিন্তু কি মুস্কিল কেবল মন কেমন হয়, কিছু হয় নি তো তার। বাড়ি ফিরল শিউলি একগাদা পড়া মাথায় করে । ফাইনাল পরীক্ষার আর চারমাস দেরী। বাড়িতে ফিরে দেখল , মা যেন কেমন একটু খুশ্ মেজাজে আছে। মাঝে মাঝে পাশে এসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ।বাবা একগাদা বাজার করে আনল একদিন। মা বলল , “মামনি কাল তোমার সাথে অপালার মামা শ্বশুরের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে। আজ একটু মাথায় শ্যাম্পু দিস।” “দেখতে আসবে মানে?” আকাশ থেকে পড়ে শিউলি। বুকের ভেতরে উথাল পাথাল। মা আমার বিয়ে দিয়ে দেবার কথা ভাবছে। কি কাণ্ড। এত্ত তাড়াতাড়ি। মুহূর্তে কেঁদে ফেলল শিউলি। মা মেয়েতে বহু টানাপোড়েন রাগা রাগি চল্ল। বাবা খুব মুস্কিলে পড়লেন। “আরে, ওরা আসুক না। এলে ভদ্রভাষায় বলে দেব আমরা মেয়ের এখন বিয়ে দেবো না।” শিউলি কে খানিক শান্ত করা গেল।
শিউলির মা, শিউলির বাবা, আর শিউলি অপেক্ষা করতে লাগল । তারা মনে করেছিলেন বোধহয় কয়েকজন বৃদ্ধ বা মধ্যবয়স্ক লোকজন আসবেন। একজন সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ে আর একজন গৃহসহায়ক গোছের লোক।প্রচুর মিষ্টি নিয়ে এসেছে। ছেলের মা অসুস্থ, বাবা গত হয়েছেন, এই মেয়েটি ছেলেটির দিদি হয়। তার ভাইয়ের জন্যে সম্বন্ধ চাইছে। শিউলির মা জিজ্ঞেস করলেন, “ছেলে কেন আসেনি? সে এলে তো জানতে বুঝতে সুবিধা হত।” শিউলির মনে রাগ গজ গজ করছে। ছেলের বিরাট পৈতৃক ব্যবসা। খুব ব্যস্ত। বয়স বেশী না। ছেলের ছবি দিল। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় ।শিউলি রেগে ঠিক করে দেখল না। শিউলি কি করতে ভালোবাসে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি। শিউলি বুঝল নিজের কথা নিজেকেই বলতে হবে। খুব বুক ঢিপ ঢিপ নিয়ে বলল, “আমি আসলে এম এস সি টা করতে চাই। তারপরে বিয়ে করা টা ঠিক হবে।” মেয়েটি একটুও অবাক হল না, মৃদু হেসে বলল , “ঠিক বলেছ। মেয়েদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ান উচিৎ। বিয়ে হবার পর এখন খুব বুঝছি। তবে আমার ভাই খুব ভালো ছাত্র।মাধ্যমিকে জেলায় স্ট্যান্ড করেছিল। খেলাধুলা এখন করে।” এরপর আর কথা এগোল না। মেয়েটি চলে যাওয়ার সময় শিউলির বাবা ছেলেটির ছবিটা তার হাতে তুলে দিল। মা খুব বকল খানিক শিউলি কে। কিন্তু বাবা আর মেয়ে দুজনেই চুপ করে বকুনি খেয়ে হেসে ফেলল। মাকে জড়িয়ে ধরে শিউলি আদর করে দেওয়াতে সংসারে ফুরফুরে অবস্থা হল আবার।
প্রবীরের দুটো জাঙিয়া লাগবে। বেশ বড়সর হয়ে উঠেছে সে। দোকানে গিয়ে বুঝল ওর কাছে যে টাকা আছে তাই দিয়ে হবে না। ফিরে আসল ঘরে। বাবা দুদিন কাজে যায়নি। বুকে ঘড়ঘড়ে কফ্। বাবা রান্না করেনি। রান্না প্রবীর বসাল, ভাত আর সব্জি । ডিম কেনা হয়নি। দুটো না হলে একটা জাঙিয়া কেনা উচিৎ ছিল এই ভেবে সে মনে মনে বিরক্ত হল। রঙ করার কাজ করে খুব একটা বেশী টাকা পাওয়া যাবে না বুঝতে পারছে সে।বাইরে ওর নাম ধরে কে যেন ডাক দেয়। মুখ বার করে দেখে শিলা বউদি। খ্যাড়খেড়ে গলায় বলে শিলা বউদি বলে, “তোদের রান্না হয়েছে? আমার কাছে থেকে একটু খাবার নিয়ে যা। বাটি নিয়ে আয়।” শিলা বউদির বর বাবার কাছ থেকে মাঝে মাঝে মদ খাবার পয়সা নেয়। শিলা মাঝে মাঝে খাবার দেয়। কাঁকড়ার ঝোল দিয়েছে বাটি ভরে। বাবাকে বিছানা থেকে তুলে ভাত দেয় প্রবীর।প্রবীর বেশ আনন্দ করে খায়। কিন্তু প্রবীরের বাবার শরীর টা ভালো নেই। সে খেতে পারল না। বাবা উঠতে পারছে না। প্রবীর তুলে নিয়ে যায় পায়খানায়। আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে চৌকিতে। বাবার গায়ে জ্বর। খেয়ে নিয়ে ওষুধের দোকান যায় প্রবীর। জাঙিয়ার বরাদ্দ টাকা নিয়ে ওষুধের দোকানে দাঁড়ায়। নিবারণ দা ছাড়া আর কেউ ছিল না। দুপুরে খদ্দের কম। জ্বরের ওষুধ কেনে প্রবীর। নিবারণ দা বলে, “ একটা বড় ডাক্তার দেখা। তোর বাবা টসকে গেলে তখন কি করবি রে ছোঁরা। ”
বাবাকে নিয়ে প্রবীর ডাক্তার দেখাতে গেল। পাঁচশো টাকা ভিজিট। ডাক্তার অনেকক্ষন বুক দেখলেন। টেস্ট দিলেন কিছু। টেস্টের অনেক খরচ। পোস্ট অফিসের আকাউন্ট খুলে প্রবীর টাকা গুলো এক জায়গায় করল। টেস্ট হয়ে গেল। কিন্তু রিপোর্ট বাজে । ফুসফুসে কর্কট। কর্কট মানে কাঁকড়া। কাঁকড়া আর খাওয়া উচিৎ না। কাঁকড়ার জন্যে বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে।বাবা যে কোন দিন মরে যেতে পারে। জাঙিয়া কেনার টাকার চেয়ে বাবার ওষুধ কেনা জরুরি।ওষুধ কিনলেও বুকের কাঁকড়া চলে যাবে না। প্রবীর বোকার মত বাবার পাশে বসে থাকে।
প্রবীরের কাছে যা টাকা আছে তাই নিয়ে প্রবীর এই যুদ্ধ জিততে পারবে না সেটা সে বুঝে গেল। ট্যাপা দাকে মনের দুঃখের কথা সব বলল। ট্যাপা দা সব শুনে প্রবীরের পিঠে হাত রাখে।রঙ করা অর্ধেক করে, কাঁধের গামছা দড়িতে রেখে ট্যাপা দা সার্ট গলায় গায়ে। প্রবীরের হাত ধরে টান মারে । দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রজত বক্সীর বাড়ি যায়। পার্টি লিডার রজত বক্সীর তিনটে কুকুর। তাদের দেখার জন্যে ‘গোপাল কাকা’ আছে। গোপাল চন্দ্র দাস কে সবাই গোপাল কাকা বলে। তার সাথে কথা হল ট্যাপা দার। ট্যাপা দাকে গোপাল বেশ সম্মান করে দেখে বেশ ভরসা পেল প্রবীর। রজত বাবুর কাছে যাওয়া হল। রজত বক্সী খুব বিরক্ত হল। বিরক্ত হয়ে বলল, “কি ভয়ানক, এতো খরচ এর জন্যে আমার কাছে এসেছ। আমার টাকার গাছ আছে নাকি?” পাঁচশো টাকার একটা নোট দিয়ে জানাল আর কিছু সে করতে পারবে না। ট্যাপা দা চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর প্রবীর কে ঘর থেকে বার হয়ে গিয়ে পাশের দোকানে অপেক্ষা করতে বলল। প্রবীর ট্যাপাদার তীব্র চিৎকার শুনতে পেল। ‘বুর্জোয়া’ বলে গাল দিচ্ছে ট্যাপা দা। ‘বুর্জোয়া’ মানে কি। আচমকা বংকার কথা মনে পড়ল। বংকা খুব গালা গালি দিত। ও ঠিক এর মানে জানত। ট্যাপা দা কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে এল, চোখ মুখ লাল।প্রবীরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না।দুজনে মিলে কাজে ফিরে গেল। রঙের কাজ করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে ট্যাপা দা বলল, “তোর বাবা বেশীদিন বাঁচবে না, বুঝলি প্রবীর।আমি কিছু করতে পারব না।তুই বাড়ি যা।আমার মা টাও ওই রকম ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। এতো কষ্ট পেত ,মনে হত গলা টিপে মেরে ফেলি। তাতে যদি শান্তি হয়। ” চোখে জল ট্যাপা দার । “ জানিস, শেষে জল অবধি গিলতে পারল না।গরীব মানুষ হয়ে বাঁচতে নেই। যেমন করে পারিস বড়লোক হ্… নাহলে নিজের চোখের সামনে কেবল কষ্ট পেয়ে মরে যাওয়া দেখবি। যা বাবার কাছে যা।”রঙের হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে বাবার কাছে বসল প্রবীর। ওর বাবার গলায় কোন স্বরের আওয়াজ খুব মৃদু,“ফিরে এসেছো পেবু। আমি একটু জল খাবো”। কয়েক চামচ জল দেবার পর ওর বাবা পাশ ফেরার চেষ্টা করে। বাবার কোমরের হাড় বেড়িয়ে এসেছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। শিলা বউদি মাছের ঝোল দিয়ে গেছে।
শিউলির নামে আবার একটা খাম আসে। খুলতেই তার মধ্যে থেকে ঝুরঝুর করে এক গাদা ছোট ছোট চিরকুট বেড়িয়ে আসে। নানান রঙের কাগজ কোথাও লেখা,
‘অত ভারী বই ভর্তি ব্যগ নিয়ে ঘুরো না পিঠে ব্যাথা করবে।’
‘মাছের চপ টা তোমার মা দারুন বানায়।’
‘বাসে কেউ অমনি করে বেহুঁশ হয়ে ঘুমায়!’
‘তোমাকে হলুদ রঙের শাড়িতে ভালো লাগছিল।’
‘বাম গালের পিম্পলের দাগ টা আশাকরি কমে গেছে। মাধুরীর পিম্পিল আছে, দারুন লাগে।’
‘এতো অবহেলা, ছবিটাও ফিরিয়ে দিলে’
থ্ হয়ে যায় যায় শিউলি।চিঠি লিখছে যে, বাসের লোক আর কনে দেখতে আসা এক মানুষের ব্যপার। বুকে একসাথে উচাটন, ভয় আর রাগ হয়। নাহ্ এইবার সামনা সামনি হতেই হবে। মাকে কি জানাবে! না জানানই ভালো, জানলেই বিয়ে দেবার জন্যে ক্ষেপে উঠবে।বুলুদির মত খারাপ লোকের সাথে বিয়ে হলে জীবন শেষ। কিন্তু কিভাবে। রুমমেট দের মধ্যেও একটা সিরিয়াস ব্যাপার এল। তারা বিপদ হতে পারে বুঝতে পারছে। শেষে ঠিক হল বাবা মাকে জানাবে গোটা ব্যাপারটা। বাবাকে গোটা ব্যাপারটা বোঝাতে হবে।এতো রহস্যময় কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় করছে শিউলির। কিন্তু কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না। রুমমেট প্রমীলা একলা পেয়ে শিউলি কে বলল, “তুই কোন স্টেপ নিস না। শান্ত থাক। ও নিজে সামনে আসবে।ও এটাই চাইছে।হয়ত খুব কাছেই আছে।আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একা ফিরিস না এবার।”কলেজ শেষ হলে খুব দ্রুত হোস্টেল ফিরে আসে শিউলি। মাকে কিছু জানায়নি শিউলি।সিনিয়ার একটি মেয়ে ওদের বাড়ির কাছে থাকে তার সাথে বাড়ি যাবার বাস ধরে। নাহ্ কেউ আর চিঠি দেয় না। খবর জানতে পারে ,প্রবীরের বাবা আর বাঁচবে না। বুকে ক্যান্সার হয়েছে।প্রবীরের জীবন টা যে খুব কষ্টের সেটা নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। ওর বাবা মরে গেলে ওর কি হবে এটা ভেবে বাবা খুব চিন্তাগ্রস্ত। মা রান্না করতে করতে ঝামরে ওঠে।“তুমি আবার তাকে বাড়ি নিয়ে এসে তুলোনা, একে কপাল খারাপ অপয়া টাইপের তার মধ্যে মাথা খারাপ।সব দায়িত্ব নেওয়া যায় না।” বাবা একটু উদাস স্বরে বলে, “ সেই আমরা ছোট মানুষ, আমরা নিজেদের নিয়েই বাঁচি না।” শিউলির সব ঘটনা মনে পরে, সত্যি কপাল খুব খারাপ পেবুর। একটু মন খারাপ হল। সেই দিবানাথ ওর বন্ধু ছিল, ফোন করত মাঝে মাঝে তার সাথে যদি একবার দেখা করা যেত। তারপর নিজেকে গুটিয়ে নিল শিউলি। তার কোন দায় লেগেছে এই সব ভাববার।
বিকেলে চা খাবার সময় একটা ফোন এল। বাবা প্রথমে ধরল, তারপর মাকে ডেকে মাকে দেয়। মা একটু সংকুচিত ভাবে ফোনে কথা বলে সব কিছুতেই হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে থাকে । শিউলি কাঁচা আমড়া চিবোতে চিবোতে অনুচ্চ গলায় মায়ের সাথে বাবার আলোচনা শুনতে পায়। বাবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।আগের দিন যে মেয়েটি দেখতে এসেছিল সে ফোন করে খুব অনুনয় জানিয়েছে শিউলি যেন একবার ছেলেটির সাথে দেখা করে।ইটভাঁটার খালের পাশে যে বড় বাড়ীটা হয়েছে ওখানে বাবা ,মা, সহ শিউলি যেন একবার যায়। একবার দেখা করতে চাইছে ছেলেটি। সে শিউলি কে চেনে। শিউলি এত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি। কোন কথা না বলে কেবল কেঁদে যাচ্ছে সে। মা পিঠে হাত বুলিয়ে যায়। বাবা বেশ কিছুক্ষণ পর আবার বলল, “ আরে চিন্তা করিস না। ও ছেলেকে আমরা ভদ্র ভাবে বলে দেবো আমরা এখন বিয়ে দেবো না”।
রিক্সা করে বড় বাড়ির সামনে পৌঁছে বাবা, মা, শিউলি তিন জনেই কিঞ্চিৎ হতবাক হল। অর্থের প্রাচুর্য চুইয়ে পড়ছে। এমন দামী পাথর, রং এর ব্যবহার আগে কোনদিন দেখেনি শিউলি। বিরাট সাদা কালো কুকুর দোতলার রেলিঙে মুখ বার করে আছে। নতুন মানুষ দেখে বেশ কয়েক বার ভুকভুক করল। সেদিনের মেয়েটি ,যার নাম মল্লিকা সে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা করল। আজ শিউলি প্রায় কিছুই সাজেনি।বিশাল সোফা আর কাচের টেবিল, সম্ভবত নতুন। তাতে বসতে বলা হল। শিউলির বাবা , মা খুব অস্বস্তি তে পড়লেন। এতটা আর্থিক বৈষম্য তাদের সাথে সেটা বোঝেন নি। একটু উৎকণ্ঠা তাদের হল। দামী কাপে চা এল। “দাঁড়ান এবার ভাই কে ডাকি”,মল্লিকা খুব সপ্রতিভ ভাবে বলল। “বিজু, এই বিজু, নীচে আয়।” বেশ গলার জোর মল্লিকার। শিউলির পা ঘামছে। সিঁড়ি দিয়ে টি শার্ট আর আটপৌরে গেঞ্জির প্যান্ট পরা একটি ছেলে। শিউলির সব গুলিয়ে গেল। পুরুষ মানুষের এতো রূপ হয়!
বিজুর পুরো বিজন প্রকাশ রায়, ওর বাবার নাম কমল প্রকাশ রায়। মা বিছানায় শয্যাশায়ী। ঠাকুর দার গারমেন্ট এর ব্যবসা বাবা উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছিলান। সেটাই বিজু চালায়। তবে এবার অশোধিত কেমিক্যালের ব্যবসা করার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বিজুর মার খুব ইচ্ছা ছেলের বিয়ে দেয়। শিউলি মুখ তুলে ছেলেটির দিকে তাকাতে পারছে না। সে যে গুচ্ছের চিঠি শিউলি কে লিখেছে, সেটা বিজু বা মল্লিকা কেও বলল না।বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “শিউলির বড় ইচ্ছা আরও একটু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সেই জন্যে এখনো বিয়ের কথা ভাবতে পারছি না।” বিজু একমুখ হাসি নিয়ে বলল, “ একেবারে ঠিক মনোভাব, আসলে আমিও চাই এমন কাউকে বিয়ে করতে যে আমাদের পরিবারের উপযুক্ত হবে,তবে আপনার কি মনে হয় আমি ওকে বিয়ে করতে চাইছি সংসার দেখার জন্যে, রান্না বান্না করার জন্যে!” এই কথা শুনে অট্টহাসি হেসে উঠল মল্লিকা। শিউলি খুব আশ্চর্য হয়ে সোজা তাকাল ছেলেটির দিকে। এই প্রথম চোখের দিকে তাকাল সে। অহংকার আর মেধার মিশ্রণে ভয়ানক শানিত চোখ ছেলেটার। তার সরু ঠোঁটে চাপা ব্যক্তিত্বের কাছে শিউলির বাবার সোজা সাপটা কথা কোথায় বুদবুদের মতো নেই হয়ে যায়। চারিদিক চুপ। মা অস্বস্তিতে পড়েছে। শিউলি চোখ নামিয়ে খুব শান্ত স্বরে বলল, “আমি এম এস সি না করে বিয়ে করব না।” “আমার মার শরীর ভালো থাকছে না। তিনি বেঁচে থাকতে বিয়ে করতে চাইছি।” বিজু ঠাণ্ডা গলায় বলে।বাবা শিউলির কথায় একটু জোর পান, “আমরা খুব সাধারণ মানুষ, আমাদের সঙ্গে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক হওয়া টা খুব …” তিনি শেষ করার আগেই মল্লিকা বলল, “আমার ভাই আপনার মেয়েকে গত তিন বছর থেকে চেনে।ওর এতো পছন্দ আপনার মেয়েকে … বনলতা দি তো আমাদের মাসী হন। ওর বাড়িতে শিউলির হাতে লেখা একটা খাতা চুপ করে নিয়ে চলে এসেছিল।আপনার মেয়ের হাতের লেখা এতো সুন্দর।আমাকে বলল দিদি , যদি কাউকে বিয়ে করি এই মেয়েকে বিয়ে করব, এতো ভালো ইংরেজি লেখে আর এতো সুন্দর হাতের লেখা।” শিউলি হতবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। সত্যি তো একটা খাতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। মা শিউলির দিকে তাকায়। শিউলি কান লাল করে বসে থাকে। বাবা মেয়ের গর্বে আলো আলো মুখ করে ছেলেটির দিকে তাকায়।
দিবানাথ তিন দিন ঘুরল পাল পাড়ার মেয়েটির কাছে। তারপর মেয়েটি ডেকে পাঠাল বংকা মারফৎ। বংকা জানাল, “যাও ঢেমনি তোমাকে সোহাগ করে ডেকেছে, একাই যাও। আমাকে যেতে বারণ করেছে।” দিবানাথ সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়। আজকেই শেষ আর কোন দিন যাবে না। পাল পাড়ায় একটু চুপচাপ চলছে। কদিন আগে নাকি পুলিশ হয়েছিল। খোলা ড্রেনের জন্যে অসহ্য নোংরা। সাধু খাঁ এই খানে এই বাড়িতে আসে জেনে অবাক লাগে দিবানাথের। মেয়েটিকে ডাকতে হল না। বাইরের বারান্দায় বসে পায়ের নখে নেল পালিশ পরছিল। হাসি হাসি মুখে প্রতিবেশীনির সাথে গল্প করছিল। দিবানাথ কে দেখে,উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে আসতে বলল। “কাল সকালে গিয়ে অনিল বাবুর সাথে দেখা করবে। বলা আছে তোমার কথা। ভালো কাজের জন্যে বলেছি। মাল তোলা, ঘড় ঝাঁট দেওয়ার কাজ যেন না দেয় বলেছি।” দিবানাথ খুব নিশ্চিন্ত হল। খুব শান্ত ভাবে বলে “ অনেক উপকার করলেন আপনি।” মেয়েটি হেসে ফেলে, “ বাবা গো আমাকে আপনি বলেছে”। দিবানাথ বলল, “আমি তাহলে আসি”। “সে কি আমি তোমাকে এত বড় সুযোগ করে দিলাম, আমাকে কিছু দাও।”মেয়েটি সোজা চোখে তাকিয়ে বলে। দিবানাথ খুব সঙ্কুচিত হয়ে মানিব্যাগে আলাদা করে রাখা একটা কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকা বার করে তার হাতে দিল। দিবানাথের হাত থেকে টাকা নিয়ে স্মিতা ওরফে রেশমি দিবানাথের বুক পকেটে ঢুকিয়ে দিল। “ টাকা দিলেই হবে! আজ থাক… আমি চেয়ে নেবো।তখন না দিলে হবে না কিন্তু” চোখে রহস্য নিয়ে যৌবনবতী নারী, কাছে আসে দিবানাথের। মাথা অবধি ঝনঝন করতে থাকে। কান গরম হয়। ভেতরের পুরুষ জেগে ওঠে।
সাইকেল নিয়ে অনেক ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফেরে দিবানাথ। পথে শিউলিদের বাড়ি দেখতে পায়। অনেক টাকা হলে শিউলিকে একবার জানাবে… বলবে “শিউলি তোকে আমি বিয়ে করে সুজারল্যান্ড নিয়ে যেতে চাই। খারাপ সিনেমায় ছেলেরা যেভাবে আদর করে তার চেয়ে ভালো ভাবে আদর করব।” মরার খাট যেখানে বিক্রি হয় তার পাশে শুকনো রজনীগন্ধা দেখল দিবানাথ। শিউলি কে সে লাল গোলাপ দেবে। হাজার টাকার লাল গোলাপ। শিউলি সাদা রঙের শাড়ি পরবে… এপাশ অপাশ দেখা যাবে।রাতে আবছা দুশ্চিন্তা হয় । কাল যদি অনিল সাধুখাঁ ঠিক ভাবে তাকে কাজে না নেয়। তখন হবে চিত্তির। মা আজকাল খুব খারাপ রাঁধছে। মায়ের ব্যাপার টা বোঝে দিবানাথ কিন্তু তাও বলেই ফেলল , “খাওয়া যাচ্ছে না মা”। মা আগে হলে জোর বকুনি দিত। কিছুই বলল না। ঘুম আসতে খুব দেরী হল দিবানাথের। ভোরে ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, বংকা সাধুখাঁর চেয়ারে বসে আছে, বলছে কটা মশা মেরে দে। মা ডাকছে খেতে আয়।স্মিতা তার দেহ জড়িয়ে বলছে আমাকে আদর কর, না করলে সাধুখাঁ কে বলে দেব,কণ্ঠস্বর শিউলির মত। সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
চারদিকে মশা ভন ভন করছে। এখনো সূর্য ডোবেনি।আজ এবেলায় কোন কাজ নেই প্রবীরের। বাবার বোধহয় একটু আরাম হয়েছে। সাঁই সাঁই আওয়াজটা করছে না। পাশ ফিরে আছে বাবা। প্রবীর খানিক নিজের মাথা চুলকাল। খানিক পুরনো খবরের কাগজের টুকরো পড়ল। কটা লোকাল বেকারির বিস্কুটের টুকরো ছিল তাই খেল। চিনির কৌটোতে খানিকটা চিনি আছে তাই দেখে ঠিক করল চা বানাবে।গত তিন হপ্তা শিলা বউদি তিন বেলা খাবার দিচ্ছে। বেশ কড়া করে চা করল প্রবীর। বাবা কে ডাকল। বাবার গায়ে জ্বর নেই, বাবা ঠাণ্ডা। প্রবীর নাকের নীচে হাত দিল। কোন বাতাস আসছে না। পাশ ফেরাল প্রবীর। নাক মুখ দিয়ে তরল কালো রক্ত বার হয়ে এল।প্রবীর বুঝতে পারল বাবা চলে গেছে। বসে বসে চা খেল প্রবীর। বাবার পায়ের তলায় হাত দিয়ে দেখল। মায়ের পাতা বেঁকে গিয়েছিল। বাবারটা সোজা হয়ে আছে। দুটো গোড়ালি তোশকের সাথে লেগে আছে। হাতের আঙুল গুলো মুঠো বন্ধ হয়ে আছে। বাবার পাশে বসে থাকল প্রবীর। রাতে শিলা খাবার নিয়ে এসে বুঝল। তারপর চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাই কে ডাকল। ট্যাপাদা এল। অজানা অনেক লোক এল। খুব খিদে পেয়েছে প্রবীরের। সে সবার সামনেই শিলার আনা খাবার খেতে বসল। শিলা বারণ করছিল। ট্যাপাদা বলল, “খাক্, প্রবীর খেয়ে নে। বাবার কাজ করতে কিছু টাকা লাগবে, আছে কি তোর কাছে?” প্রবীর একটা কুলুঙ্গি মতন জায়গা থেকে দুশো টাকা বার করে ট্যাপাদা কে দিল। তারপর অনেক রাতে পাড়ার সুখি মানুষের ঘুম ভাঙ্গিয়ে, জোরে জোরে ‘বল্ হরি হরি বল’ চিৎকারের সাথে প্রবীরের বাবা তার মলিন, গ্লানিকর জীবন ফেলে দিয়ে যাত্রা শুরু করল।
দিবানাথ কাজ বুঝে নিতে পারল খুব অল্প দিনের মধ্যেই।মেন রোডের ধারের দোকানে যে রঘু মিশ্র বলে একটা লোক আছে সে ছাড়া আর সবাই মালিক কে গালাগালি দেয়। রঘু মিশ্রর সামনে কেউ খারাপ কথা কিছু বলে না। রঘু দিবানাথ কে মন দিয়ে কাজ শিখতে বলেছে। সাধুখাঁর মেয়ে কে নিয়েও নানান অশ্লীল কথা চালু আছে। দিবানাথ কে সাবধান করল কর্মচারীরা। মেয়ে নাকি তার হিরো হিরো চেহারা দেখে ‘ছেনালি’ করতে পারে। ওষুধের জেনেরিক নাম, কোম্পানির নাম, দামের তফাৎ ইত্যাদি মন দিয়ে শিখতে লাগল দিবানাথ। মা কে যখন বলল আমি একটা কাজ করছি তখন মা খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাকে জানাল। এমন কি পালপাড়ার রেশমির কথা। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।তারপর বংকা কে একদিন বাড়ি নিয়ে আসতে বলল। একটু অবাক হল দিবানাথ। “তোর এতো বড় উপকার করেছে, নিয়ে আসিস একদিন। আর তোর বাবাকে এসব জানাস না। বনলতারা খুব বড়লোক তো। এই সব কাজ ঘেন্না করবে।তুই আর ওই বাড়ি যাস না।” মার কথা শুনে দিবানাথ হ্যাঁ বাচক মাথা নাড়ল। বংকা কে সে এই বাড়ি আনবে না। আর বাবাকে দেখার আছিলায় বনলতার বাড়ি যাবে। মাকে না জানালেই হল।
প্রথম মাসে মাইনে পেল দিবানাথ। খুশি হবার মত না হলেও। বেশ ভালো লাগছে তার। মেনরোডের পাশে সবচেয়ে বড় সেলুনটাতে চুল কাটতে গেল সে। আগে মিঠুনের ছবি থাকত। এখন সঞ্জয় দত্তের। নিজের চেহারা ভালো করে দেখল সে। সাধুখাঁর মেয়ের ব্যাপারে তার একটা আকর্ষণ হয়েছে। মেয়েটাকে যদিও সে একবার দেখেছে। খুব সাধারণ চেহারা। তার সামনে গেলে চেহারাটা খোলতাই করে রাখতে হবে। যাইহোক একবার শিউলিকেও জানাতে হবে যে ‘শিউলি আমি এখন রোজগার করছি।কিছুদিনের মধ্যে নিজের বিজনেস করব।’সেলুনের লোকটা মাথায় হাত দিতেই ঘুম এসে গেল। চুল কাটা হলে, নিজের চেহারা খুব একটা পছন্দ হল না। গালের চামড়া ঠিক ভদ্রলোকেদের মত না। একটু দমে গেল দিবানাথ। বিড়ি খাওয়া কমিয়ে দেবে। সেলুন থেকে বেড়িয়ে দেখল সামনে একটা নেড়া মাথা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেশ নোংরা।বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল ‘পেবু’। “তুই এখানে কবে এসেছিস?” দিবানাথ অত্যন্ত অস্বস্তির সাথে জিজ্ঞেস করে। “খবর দিতে এসেছি, আমার বাবা মরে গেল। তাই……”প্রবীর বলে, “বংকা বলল তুই চুল কাটতে এসেছিস।”দিবানাথের নিজের ডিম পাউরুটির সঙ্গে আর এক প্লেটের দাম খসল পকেট থেকে। পেবুও উপার্জন করে জেনে সে অবাক হল। মনে মনে বিরক্ত হল, “ তোর বাপ মরেছে তো আমার কি হল রে হারামি।” পাড়ার মোড়ের এস টি ডি বুথ থেকে শিউলি কে ফোন করে। শিউলির মা ফোন ধরে। সেখানে দিবানাথ জানায়, ‘পেবুর বাবা মারা গেছে’। শিউলির মা জানায় শিউলি বাড়ি নেই আর প্রবীর ওদের বাড়ি গিয়েও খবর দিয়েছে। এখন আগের মত নেই। এমন কি বংকা কেও আর ভয় পায় না। বংকা কে সাথে করে নিয়ে এসেছিল।
আজকাল প্রবীর সকালে নিজের খাবার ব্যবস্থা নিজে করে নেয়। ও আর ট্যাপাদা দুপুরে ভাতের হোটেলে খায়। রাতে শিলা বউদি রুটি তরকারি দেয়। দুপুরে ভাত খেয়ে একটা বিড়ি ধরাল প্রবীর। আজ আর কাজ নেই। “ট্যাপাদা চল আমার ঘরে।” ট্যাপাদা না বলল না।খুব ভালো লাগছে প্রবীরের রোজ ঘরে ঢুকে মন খারাপ হয়ে যায়। আজ বেশ লাগছে। “ঘর গুছাস না কেন? ঝাঁট মোছা করবি। অসুস্থ হয়ে যাবি তো।”স্নেহ ঝরে পড়ে ট্যাপাদার গলা থেকে। “খানিক পয়সা জমা। তোর তো খরচ নেই।ঘর আছে। তারপর একটা ছোট্ট মতন মেয়ে দেখে বিয়ে দেবো। যা একটা ঝ্যাঁটা নিয়ে আয়।” “ আমার ঝাঁটা নাই তো। শিলা বউদির কাছ থেকে নিয়ে আসি।” খাটের তলা , কুলুঙ্গি, ছোট্ট বারান্দা সব জায়গা থেকে এক পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ় মায়ের মত স্নেহ নিয়ে পরিস্কার করতে লাগলেন।মাঝে মাঝে ভাঙা গলায় গান করছেন, “মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু মেরে ঝেটিয়ে বিদেয় কর।” তাই শুনে প্রবীর খিল খিল করে শিশুর মত হাসছে। ছোট একটা ফাইল বার হয়ে এল চৌকির তলা থেকে,“এগুলো কি রে পেব্যা।দ্যাখ আবার তোর বাপ কিছু টাকা পয়সা রেখে গিয়েছে নাকি?”
দুজনেই আবার হাসে। একটা গাদা প্রেস্কিপ্সান, ওপরে প্রবীরের নাম লেখা বছর তিনেক আগের। “বাবা, এ কি ওষুধের নাম রে জীবনে তো শুনিনি তোর কি কিডনি তে হার্ট অ্যাটাক, হয়েছিল দাঁরা কি লেখা আছে, ভি আর এ ওয়াই এল এ আর (Vraylar)” । আরও প্রেস্কিপ্সান উল্টে দেখতে দেখতে ট্যাপাদা বুঝতে পারে, তিনি প্রবীরকে যা জানেন তার চেয়ে প্রবীর আলাদা। “তুই মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি ছিলি? কেন রে? মা মরে গিয়েছে সেই দুঃখে!” ট্যাপা দা জানল না প্রবীরের খুব বুকের ক্ষতের জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছেন। যেখানে প্রবীর নিজেও তাকিয়ে দেখে না।শিলা বউদি চা নিয়ে এসেছে। প্রবীর কিছু উত্তর দিল না। ট্যাপা দা বার বার অস্ফুট উচ্চারণে বলতে লাগল, ‘সিজোফ্রেনিয়া’ ‘সিজোফ্রেনিয়া’।
শিউলি একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চারপাশে বিজু স্বপ্ন বোনে, মায়া তৈরি করে আবার অসহায় করে দেয়। বিজু হঠাৎ করে এসে সব ভাবনা চিন্তা বালির মত গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেয়।সদ্য বিকেলে আচমকা হাত ধরে শিউলির শরীরের এতো কাছে চলে আসে শিউলি মোমের মত গলে যেতে থাকে। সে ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু সরে যেতে পারে না। বিজু এক সপ্তাহের মধ্যে সোজাসুজি শরীরের অধিকার চায়। শিউলি চমকে ওঠে। বিজু সব সাবধানতার আশ্বাস দেয়। তারপর এক অপরূপ আধুনিক শহুরে এপার্টমেন্টের সিনেমার মত ঘরে মধ্য দুপুরে শিউলি নিজের কৌমার্য তুলে দেয় বিজন প্রকাশের হাতে।নতুন অভিজ্ঞতাতে ক্লান্ত শিউলি আনন্দ পাবে, না রাগ করবে বুঝতে পারে না। তার খুব ঘুম আসছে। শিউলির কপালে চুমু খেয়ে বলল বিজু বলল, “ নাহ্ তোমাকে মনে বিয়ে করতেই হবে।” শিউলির মা অনেক কিছু বুঝতে পারে বলতে পারে না। মেয়েকে অচেনা মনে হয়। বিয়ের দিন ঠিক করার জন্যে শিউলির বাবাকে বলতে বলে। শিউলির বাবা প্রথমে অতটা উদ্বিগ্ন না হলেও ধীরে ধীরে অসুবিধাটা বুঝতে পারছে। একটা বাইক করে খুব জোরে দুজন এলাকায় ছুটে বেড়ায়। তাঁর ভয় করে কোন দিন কোন দুর্ঘটনা যদি ঘটে। আজকাল বাড়ি ঢুকলেই, শিউলির কেন কি জানি খুব বাজে লাগে। এতো সাধারণ বাড়ি তাদের। বাবা আর মা এতো পিছিয়ে থাকা গরিব গরিব মানুষ। ভালো লাগে না তার। বিজুর সাথে বিয়ে হলে চারিদিক অন্য রকম হবে বুঝতে পারে।
বনলতার বাড়ি যায় দিবানাথ।বাবা ডেকে পাঠিয়েছে। মা যেতে বারণ করেছিল। মা কে সে জানিয়েছে যাবে না। কিন্তু সাধুখাঁর মেডিক্যাল শপ যাবার আগে সাইকেলে নিয়ে বনলতার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখল একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওপরে অচেনা লোকজনের গলার স্বর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।খোলা দরজা দিয়ে সোজা ওপরে গেল দিবানাথ। একজন চাকর গোছের লোক আর একটি বড়লোকের মেয়ে। দিবানাথ কে দেখে খুব বিরক্ত হল বনলতা। “যাও গিয়ে ওই ঘরে বসো, সকালে দেখা করে যাবে। এখন ওর বিশ্রামের সময়। এখন এলে অসুবিধা।” বনলতা বলে চলেন। মেয়েটির বোধহয় চোখে কোন জিজ্ঞাসা ছিল। তার উত্তরে বনলতা তাকে বলেন, “ অসীমের সাহায্য প্রার্থী। টাকা পয়সা লাগলে মাঝে মাঝে চাইতে আসে।” মেয়েটি বলে , “দেখতে একদম অসীমদার মতো, আমি ভাবলাম ভাই হয়ত!” দিবানাথের দুঃখ হবার বদলে হাসি এল। বুকটা প্রথমে জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বেশ জোরে চিৎকার করে অসীম বাবুর ঘরের পর্দা সরিয়ে বলল, “কি অসীম কাকু কেমন আছো?” ঘরে দিবানাথের বাবা অত্যন্ত আহত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বনলতার তার পুত্রের পরিচয় না দেওয়াটা তাঁকে বিব্রত করছে। শয্যাগত অবস্থা থেকে উঠবার চেষ্টা করছেন। দিবানাথ দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তার আর ইচ্ছা করছে না বাবার কাছে যেতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একটা টুল টেনে সে বসল। “তুই নাকি ওষুধের দোকানে কাজ করছিস? তুই পারবি?” অসীম খুব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। “ মা,তোমাকে জানাতে বারণ করেছে। তোমার কোথায় মান-সম্মানে লেগে যাবে। কিন্তু আমার তো আর উপায় নাই। কাজ শিখতে গেলে এই ভাবেই এগোতে হবে।” “ না না আমি আবার কি ভাববো! কিন্তু সাধুখাঁদের ব্যাপারে তো অনেক বদনাম জানি। সব রকম দোষ আছে। মদ খায়, খারাপ সঙ্গ করে…তোকে যদি কোন বিপদে ফেলে দেয়।” দিবানাথের মায়ের জন্যে মন কেমন হল। আসলে বাবা তাদের কথা এখনো ভাবে। সে হাসি মুখে বলল, “না, না আমি সাধারণ কর্মচারী। আমাকে কেন বিপদে ফেলবে।” বনলতা তার অতিথিদের নীচে বিদায় দিতে গিয়েছে। ইস্ আগে জানা থাকলে আজকে বংকা কে বলত পেছনের রাস্তায় থাকতে। ওই জাপানী ক্যামেরা ছুঁড়ে দিলেই হয়ে যেত। বনলতা এসে প্রায় মুনমুন সেনের মতো করে বলে, “অসীম, কি যে আনন্দের খবর বিজু খোকার বিয়ের ঠিক হয়ে গেল।কার সাথে জানো। আমার ছাত্রী শিউলির সাথে। ভাবতে পার। আমার সেরা ছাত্রী।” দিবানাথের চোখ মুহূর্তে ঝাপ্সা। হাত পা যেন খুলে আসছে। বিজু মানে বিজন প্রকাশ… সেতো এলাকার সবচেয়ে বড়লোক বাড়ির ছেলে। শিউলির সাথে।
ট্যাপাদা প্রবীর কে অন্য আর কিছু কাজ শিখতে বলল। প্রবীরের শরীর তেমন শক্তপোক্ত নয়। রঙের কাজ সে করে নেয়। কিন্তু কাঠের মিস্ত্রির কাজ সে কি ভাবে করবে! সে পারে না।তাই সেটা বাতিল। ট্যাপা দা আর প্রবীর মন দিয়ে একটা পুরনো ট্রাংক রঙ করছিল। “আচ্ছা ট্যাপা দা ট্রাক রঙ করলে অনেক পয়সা না!” প্রবীর ব্রাশ চালাতে চালাতে বলে।ট্যাপা দা মজা করে বলে, “ তোর হাতের লেখা খারাপ,ছবিও আঁকতে পারবি না। পেছনে লিখতে হবে…” ।“জানি জানি, ‘দেখবি আর জ্বলবি লুচির মত ফুলবি’, ‘বুড়ে নজর বালে’ … তুমি এক কোট দিয়ে লিখে দিবা, আমি অর ওপর মোটা করে চাপিয়ে দেবো।”এই সব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রবীর বলে, “আমি একটা কাজ খুব ভালো পারব, দারুন শিখেছিলাম। মা যখন মরে গেল, বাবা তো জেলে… আমাকে বংকা মুরগীর দোকানে লাগিয়েছিল। …এক কোপে মুর্গি কেটে ফেলতাম… সবার চেয়ে ভালো… বাবা কিছুতেই করতে দিল না… আমি ভালো পারতাম… রক্ত বার হয়ে এসে মুর্গি যখন চুপ করে যায় তখন …” ।ট্যাপা দা দেখল, চোখ মুখ চকচক করছে প্রবীরের। যেন খুব কৃতিত্বের কোন কাজ সে করে ফেলেছে।একটু অদ্ভুত লাগল।প্রবীর কে নিয়ে ট্যাপাদার একটু উদ্বিগ্ন লাগছে। প্রবীর আচমকা বলল, “দাঁরাও দাদা, বংকা কে একদিন ডাকব। হেব্বি খিস্তি জানে। একটা হাত নাই। মানে হাতের পাতা নাই। ওই নিয়ে সব করতে পারে।” ট্যাপা দা ভেতর ভেতর খুব দমে গেল।
দিবানাথ দোকান থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেল ইট ভাঁটার মাঠে। সন্ধ্যের অন্ধকারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। খুব কাঁদল। কাঁদলে যে এতো কষ্ট হয় এই প্রথম বুঝল। গলা ব্যাথা করছে তার। আচমকা পাশে খসখস আওয়াজ। বংকা একটা চুল্লুর পাউচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, করুনা করার সুরে বলল“ আজ ঘুম হবে না, চুমুক মারো।” “ শালা, তুই একটা খবর দিলি না।” রাগে কাঁপতে কাঁপতে দিবানাথ এক ঘুষি মারতে যায় ,কিন্তু বংকা পালিয়ে দূরে দাঁড়ায়। “ বললে তুমি কি করত্যা,তুমি ঢ্যামনা , ওষুধের দোকানের কাজ দেখিয়ে বলত্যা, শিউলি মেরি জানু আমার রাজ পেসাদে আসো, আমাদের টিউবওয়েলের জল খাও, আমার খিটখিটে মায়ের পা টিপো…রাজার বেটার পছন্দ হয়েছে তোমার গাল ফ্রেন্ডে। আগে বড়লোক হও ,তারপর ওই সব সুন্দরীর সাথে ঘুমাবা। আমার ওপর মেজাজ দেখাছও…” থুঃ থুঃ করে শুকনো মখে আওয়াজ করে। দিবানাথের বাস্তব বোধ ফিরে আসে। তাকে যেমন করে হোক বড়লোক হতে হবে। যেমন করে হোক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আচমকা তার একটা অন্য বোধ হল। মার কতটা কষ্ট হয় সেটা বুঝতে পারল দিবানাথ। মা কত যত্নে সংসার সাজিয়ে ছিল। বাড়ি এসে দেখল মায়ের জ্বর হয়েছে। জ্বরের ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে বুঝল মা খুব রোগা হয়েছে। বংকা সব কথায় ঠিক বলেছে দিবানাথ একটা ‘ঢ্যামনা’।
শিউলির বাবা, মা অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে দিন যাপন করছেন। বিয়ের খরচ ঠিক কি ভাবে করবেন বুঝতে পারছেন না। সাথে শিউলির বিয়ে নিয়ে নানান আবদার বুঝতে পারছেন না কোন দিক দিয়ে কি করবেন। শিউলির বাবা বুঝতে পারলেন বেশ কিছুটা টাকা ধার করতে হবে।কিন্তু তাতেও ঠিক সামাল দিতে পারা যাবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। শরীরে আর মনে শিউলির বাবা পেরে উঠছেন না। সকালে বাজার থেকে ঝোলা বয়ে আনার সময় চোখে অন্ধকার দেখলেন। তার মাথায় জল দিল লোকজন। তাকে উদ্ভ্রান্তের মত ফিরে আসতে দেখে শিউলির মায়ের বুক কেঁপে উঠল। সাথে একটা ছেলে ঝোলা বয়ে এনেছে। পাড়ার মুদি দোকানের মালিক ভানু এসেছে, সে বলল,“বউদি, ভয় পাবেন না। ত্রিদিব ডাক্তারের কাছে নাম লিখিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যে বেলায় দেখিয়ে নেবেন।এই ছেলেটি কে রাখতে পারেন। ও ধরে ধরে নিয়ে যাবে দাদাকে, একে একটু খেতে দেবেন, দু দশ টাকা দেবেন। কি রে পারবি না” । ছেলেটা কে চিনতে পারলেন শিউলির মা, “ না, না, খুব বজ্জাত ছেলে, ওর জ্বালায় পেবুকে নিয়ে পেবুর বাবা এখান ছেড়ে চলেই গেল।আমার কাউকে লাগবে না আমি চলে যাব।” ভানু হাসল, “এখন খুব বিশ্বাসী হয়ে গেছে বউদি, আমাদের কাঁচা নর্দমা, পায়খানা সব ওই পরিস্কার করে। ”
বংকা বোকার মত হাসল। শিউলি পরের দিন বাড়ি এল। আজকাল বাসে আসে না। বিজু গাড়ি পাঠায়।মধ্যে রাস্তায় গাড়িতে বিজু উঠল। হবু শ্বশুর অসুস্থ, তাই দেখতে যাচ্ছে, এই প্রথম সে শিউলির বাড়ি যাচ্ছে। শিউলি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়ল। মা ঘর দোর ঘুছিয়ে রাখতে পারবে কি? বিজু গলিতে ঢুকে একটু বিব্রত বোধ করছে। গাড়ি ঢুকল না। বাড়িতে লোডশেডিং। শিউলি খুব বিরক্ত হল। মা বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করেছিল, বিজু আসতে পারে। যাই হোক, ভালো কাপে চা, গরম শিঙারা, ভালো মিষ্টি তার প্রাণপণে সমাদর করার চেষ্টা দেখে কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হল শিউলি। বিজু বাবার শরীর নিয়ে সেরকম কিছু জিজ্ঞাসা করল না। যেটুকু শিউলির মা বলল।বিয়ের সময় গাড়ি ঢুকবে না এটা একটা বড় সমস্যা হবে এটা বারবার বলতে লাগল।শিউলির খুব বিব্রত লাগছে। ঘণ্টা দুয়েক পর বিজু বলল, “ চল গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে।সাবধানে থাকবেন।” শিউলি মনে মনে চাইছিল একটু একান্তে কথা বলতে। গলিতে সব জানালা ,দরজা, বারান্দায় মানুষের মুখ। লজ্জায় মিশে যাচ্ছিল শিউলি। বিজুর বিরক্ত লাগছে। গলির মুখেই গাড়ীটা দাঁড়িয়ে ছিল। বুড়ো ড্রাইভার কে নাম ধরে হাঁক পাড়ল বিজু।গাড়িতে উঠবার ঠিক আগে বিজু বলল, “ তোমরা ঠিক এতোটা গরীব বুঝতে পারিনি। তোমাকে দেখে একটুও বুঝতে পারা যায় না।”মুখ সাদা হয়ে গেল শিউলির। বিজু আচমকা প্রায় হলিউডের মতো শিউলির কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট লাগায়। শিউলি হতবাক হয়ে যায়। চারপাশে কৌতূহলী পাড়ার লোকজন, বুড়ো ড্রাইভার… সে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে।দ্রুত ছাড়াবার চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু যেন বদলে গেল। গাড়িতে উঠে বিজু হাত নাড়িয়ে চলে যায়। কারেন্ট আসে। আলো জ্বলা রাস্তা দিয়ে শিউলি কান লাল করে, কালশিটে পরা হৃদয় নিয়ে ঘরে ফেরে।
শিউলির বিয়ে এগিয়ে আসছে। শিউলি মায়ের সাথে আর আগের মত মন খুলে কথা বলতে পারে না। মা ক্রমাগত মেজাজ হারান। একটি প্রবল দোলাচলের মধ্যে থাকে শিউলি। একদিন সকালে আধা ঘুমের মধ্যে শুনতে পেল শিউলি, মা ফোনে সম্ভবত বুলুদিদিকে বলছে, “…পাড়ায় লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না… সবার সামনে ওই ছেলে চুমু খেয়েছে… চিন্তা করতে পারিস… আমি ভেবেছিলাম মেয়েকে লেখাপড়া শেখালাম ভদ্রলোকের মতন জীবন হবে… আমার হাত পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে। সব ভুলে গেল রে… সব ভুলে গেল… আর জামাই হলে বাড়ির ছেলে হবে… কচু হবে… ও আপনি আর কপনি… এখন বিয়ে দিয়ে আমি বাঁচি… আমার জীবন নরকের মত জ্বলছে।তুই আগে আগে চলে আসিস… তোর ওপরেই সব ভরসা। কে করবে আমার।…” আরও অনেক কথা বলে গেল মা। শিউলির খুব খারাপ লাগছে। আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। এছাড়া সে কি ভাবে পালাবে। শিউলির বাবার অনেক ধার হল। অনেক দিন এলাকায় থাকায় জন্যে সবাই বিয়ের কাজে এগিয়ে এল। সাধারণ প্রতিবেশীদের কাছে তাক লেগে গেছে এমন বিয়ের সম্বন্ধ।তাদের পাড়ার সম্মান রাখার জন্যে সকলে সাহায্য করতে চাইছে। এই দক্ষযজ্ঞ সামলাতে যতটা ভয় পাচ্ছিল শিউলির মা আর বাবা, ততটা পরিশ্রম হল না।বুলু দিদি চলে এসেছে।কেবল সদা হাস্যময়ী মেয়েটি সংসার ভাঙার ফলে বিষাদ প্রতিমা। কাজ সে করছে, কিন্তু শিউলি তাকে বুঝতে পাড়ল না।বংকা সুযোগ খুঁজে ব্যর্থ হয়।ওকে বাড়ির কাজে নেওয়া হয় না। কিন্তু শিউলির বাবা একটা কার্ড দিয়ে বলেন, খেতে আসিস।কার্ড পেয়ে সেটা বংকা লটারির টিকিটের মতো সেটা নিয়ে দ্রুত ইট ভাঁটার মাঠে চলে যায়।
ট্যাপাদা কে অবাক করে প্রবীর সত্যি মুর্গি কাটার দোকানে কাজ পেয়ে গেল।প্রবীর আর রঙের কাজ করবে না বলে দিল।শিলা বউদি এখন আবার আগের মত তিনবেলা খেতে দেয়। শিলা বউদি কে প্রবীর টাকা দেয় বাজার করার, তেল নুন কেনার, স্নো - পাউডার কেনার দুজনের দুজন কে দরকার। প্রবীর নিজের একটা শার্ট কিনে দোকান থেকে বার হল, ফের কি মনে হওয়াতে আরো একটা শার্ট কিনে নিয়ে ট্যাপাদার ঘরে গেল। ট্যাপাদার মেজাজ ভালো নেই। ঠিক কথাবার্তা জমল না। রঙের দাম বেড়েছে এদিকে খদ্দের টাকা কম দিয়েছে। শার্টটা ট্যাপাদা কে দেওয়াতে খুব একটা খুশি দেখাল না ট্যাপাদা কে। প্রবীরের মন খারাপ হল। সে বুঝল, ট্যাপাদা আসলে ভালোবাসে না তাকে।গুটি গুটি পায়ে বার হয়ে এসে চায়ের দোকানের দিকে এগোতেই,পেছন থেকে ডাক, “ ও পেব্যা, আসিস মাঝে মাঝে। জামা নেমতন্ন বাড়ি পরে যাব।” পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রবীর। বুকের মধ্যে আলো জ্বলে। সেখান থেকে নিজের ঘরে এসে খানিক বসে থাকল। বাবা আর মা থাকলে তাদেরকেও দিত প্রবীর।একটা শার্ট তার বংকা কেও দেওয়া উচিৎ। পরের মাসে একটা শার্ট কিনে সে বংকা কে দেবে। বংকা না থাকলে এত ভালো কাজ সে শিখত না।শিলা বউদি ভাত রেখে দিয়ে গেল।প্রবীর হিসাব করল একটা শাড়ি কিনতে হবে শিলা বউদির জন্যে। আর মাঝে মাঝে মাংস কিনে এনে দেবে। মুরগীর ঝোল দিতে রুটি খাবে একদিন। ভাতের থালা খুলে চমকে গেল প্রবীর, ডিমের অমলেট আর ভাত। প্রবীর কেমন হয়ে গেল। একলা ফাঁকা ঘরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হল ছাদ নেমে তার বুকের ওপর নেমে আসছে। সব অন্ধকার। তারপর কি হল সে জানে না। ভোরবেলা শিলা বউদি চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করল, তখন ঘোর ভাঙল প্রবীরের । শিলা বউদিরা যে বেড়াল কে খেতে দেয় ,তাকে যেন কে মাথা থেঁতলে মেরে দিয়ে গেছে। প্রবীর খুব ভালো করে স্নান করে মুরগীর দোকানে গেল।
বংকা শিউলির বিয়ের কার্ড এনে দিবানাথ কে দিল। দিবানাথ ছুঁড়ে ফেলে দিল। বংকা খানিক ফিচেল হেসে বলল, “আমারে খেতে বলেছে, একখান ভালো জামা দিও তোমার পরে যাব।” দিবানাথ খানিক থম্ মেরে বসে থাকল। তারপর বলল “আমি তো কোন দিন বলিনি শিউলিকে, যে আমি আসলে ওকে লাইক করি।” “ইহ্, তাহলে ও এই ছেলেকে না বলে দিত।” দিবানাথ বুঝতে পারল বংকা কে সে যত বোকা ভাবে বংকা ততটা নয়। লেখাপড়া জানে না বলে ওকে ওই রকম লাগে। হেসে ফেলল সে। বংকা হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। “শোন পালপাড়ায় রেশমি একবার যেতি বলেছে।কি নাকি দরকার আছে।” বংকার কাছে খবর শুনে চিন্তায় পড়ে গেল দিবানাথ।যেদিন ছুটি থাকবে সেদিন একবার যেতে হবে। সকালে বনলতার বাড়ি গিয়ে বাবার সাথে খানিক কথা বলল দিবানাথ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল কাজের কথা। হিসাব ঠিক করে করতে পারে কিনা। সব শেষে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর মা কেমন আছে?’ দিবানাথ খুব শান্তভাবে বলল, “খুব খারাপ।” “একদিন নিয়ে আয়, দেখতে ইচ্ছা করছে” দিবানাথের বাবা বলল।
দিবানাথ বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকাল।আচমকা দেখল বনলতা সাশ্রু নয়নে তাকিয়ে আছে। তার লীলায়িত কণ্ঠস্বর আর নেই, “আমি জানতাম, আমি জানতাম, এই ছেলে নিত্য এসে এসে বাবাকে বুঝিয়ে ছাড়বে… আমি জানতাম… আমি রোজ তোমার পেচ্ছাব ,পায়খানা পরিস্কার করি, আমাকে দেখলেই কেবল শরীর খারাপের কথা মনে হয়… তোমার কেবল বমি পায়… আমিও চেয়েছিলাম মা হতে। কিছুতেই সেটা হতে দিলে না… প্রথমটা নষ্ট করালে…পরের টা এসেই চলে গেল… আমার একটা থাকলে তুমি এমন করতে পারতে না… উঃ কি পিরিত… দেখতে ইচ্ছা করছে।” দিবানাথ খুব ধীরে উঠে সিঁড়ি বেয়ে নেবে গেল। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে শুনতে পেল, বাবা ঘড়ঘড়ে গলায় বলছে, “আমি আর কক্ষনো বলবো না, তুমি রাগ কোর না লতা আমি আর কক্ষনো বলব না”। মাকে দিবানাথ সবটা জানাল। ভেবেছিল মা বোধহয় রেগে যাবে। মা কোন কথা বলল না। মুখ নামিয়ে রাখল। মায়ের থুতনিতে নোনতা জল। “দিবু, ওদের বাড়ির পেছনের গলি থেকে তোর বাবাকে দেখা যায়? আমাকে কাল নিয়ে চল। আমি একবার দেখে চললে আসব।তোর বাবা জানতেও পারবে না।” দিবানাথের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে, এই বনলতাকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। সে বাথরুমে গিয়ে চোখে জল নিয়ে বিড়িতে টান দিল।
বিজুদের বাড়ি থেকে মাত্র বারোজন এল। কোন বন্ধুবান্ধব নয়। কিছু কাজের লোক আর বয়স্ক কিছু আত্মীয়। শিউলির পাড়ার মেয়েরা ইস্কুলের মেয়েরা মজা করতে পেল না। শিউলির মা খুব চাপ নিয়ে কাজকম্ম করে গেলেন। ছোটখাটো দুচারটে গণ্ডগোল হল। বংকা বিয়েতে পরার জন্যে এক ধোপার শরনাপন্ন হল। সে তার খদ্দেরের একটা জমকালো পাঞ্জাবি নিয়ে এসে তাকে দিল। তাই পরে বিয়ে বাড়ি গেল সে। শিউলি কে দেখে খামে করে দশ টাকা দিল। সাঁটিয়ে খাবার খেল। কেবল যার জামা সেও সম্ভবত নিমন্ত্রিত ছিল। ওকে দেখে সে একটু চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছিল। বংকা সুরুত করে পালিয়ে গেছে। বর যাত্রীদের কেউ একজন খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাই নিয়ে চাপা উত্তেজনা হল। বিজু কে খুব সুন্দর লাগছিল। শিউলির বিদায়ের সময় আসন্ন। মা নাক লাল করে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করছিলেন। শিউলি বহুবার একটু কথা বলতে চাইছিল কিন্তু মা ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন। বাবা এসে কিছুক্ষণ বসে ছিল। বিদায়ের সময় সাজানো হয়ে গেছে। এক গাদা গয়না পরে একাই বসে আছে শিউলি। ফাঁকা ঘরে বুলুদিদি এসে বসল। তার চোখে জল। “খুব ভালো জামাই হয়েছে রে। কি অমায়িক ব্যবহার। খুব আদরে রাখবে তোকে”।“বুলু দিদি, আমার খুব ভয় করছে।” “ভয় কি রে পাগলি।ভয় পাস না। খুব ভালো রাখবে তোকে।” খানিক আদর করল শিউলিকে। তারপর শিউলিকে বুলু দিদি বলল, “ একটা কথা বলছি তোকে, তোর বর তো অনেক বড়লোক দ্যাখ না যদি আমাকে কোথাও একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। একটা ছোট চাকরি।মনে করে বলিস না রে, বুনু আমার খুব দরকার। তুই তো আমার সব জানিস।”
দিবানাথ পাল পাড়ার মোড়ের আগে আটকে গেল। শিউলির বিয়ের শোভাযাত্রা চলেছে। সাহা ব্যাণ্ডে বাজছে, ‘উঠ উঠ সুর্যায় রে ছিকিমিকি দিয়া’ তার সাথে প্রচুর আলো মাথায় নিয়ে লোক চলেছে। গোলাপ ফুলে সাজানো সাদা মোটর গাড়ি বুক জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেল।ভীর ফাঁকা হতে পাল পাড়ায় রেশমির ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুঝল ঘরে তালা । রেশমি অর্থাৎ স্মিতা নেই। যাক বাবা, যত জ্বালা। ইটভাঁটার মাঠে গিয়ে দাঁড়াল যখন তখন সন্ধ্যে পার হয়ে আকাশে তারা ঝলমল করছে। ধাপির ওপর বংকা শুয়ে আছে। “ কি হে গুরু, বুকে এখুন আগুন লেগেছে। তুমার গার্ল ফ্রেন্ড চলে গেল। এখানে একজুন তুমার জন্যে ইন্তেজার করছে।” বংকা ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়াল। অন্ধকারের মধ্যে একটি নারী শরীর আন্দাজ করল দিবানাথ। মেয়েটি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ তোমার নাকি খুব মন খারাপ। বংকা দুঃখ করছিল। তাই তোমাকে দেখতে এলাম।” দিবানাথ এই কণ্ঠের স্বর চেনে।
দিবানাথ এর বুকে কিঞ্চিৎ দ্বিধা আর ভয় এলো। সাধুখাঁর বাঁধা মেয়েছেলে রেশমি সে দেখা করতে এসেছে এক কর্মচারীর সঙ্গে এই ব্যাপারটা সাধুখাঁ জানতে পারলে বেজায় মুস্কিল হবে।রেশমি রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বলল, “কতদিন থেকে বলছি একবার দেখা করে যাও।আমি না বললে তোমার চাকরি হত?” “আসলে আমার বাবা অসুস্থ সেটা নিয়েও একটু ব্যস্ত ছিলাম তো! কি দরকার বলুন”, শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে চেটে বলে দিবানাথ। রেশমি রোগা, কিন্তু শরীর আঁটসাঁট নয়, তার বুকে একটা এলিয়ে যাওয়া ব্যাপার আছে, গায়ে একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ, শরীরের এতো কাছে চলে আসা অস্বস্তিকর দিবানাথের।“ বাব্বা, আমাকে আবার, ‘আপনি’। ওসব ছাড়ো, কটা ওষুধ এনে দিতে পারবে? পয়সা দিতে পারব না।” “কি ওষুধ, লিস্ট দিয়ে দেবেন এনে দেবো।” দিবানাথ ঢোঁক গিলে বলে। আচমকা হাত ধরে বলে রেশমি, “তোমার দুঃখ হলে আমাকে এসে বলবে, কেমন! আমি কত লোকের দুঃখ কথা শুনি।” বংকা দূরে বসে হাসছে। অশ্লীল ইঙ্গিত বুঝতে পারে দিবানাথ। বাবা, মা, শিউলি সব মাথায় জট পাকিয়ে আছে, তার ভালো লাগছে না। ফালতু ঝামেলা। সে এবার একটু মনে মনে শক্ত হল। “আপাতত আমার তো কোন দুঃখ নেই। সন্ধ্যে হয়েছে আপনি একা ফিরতে পারবেন! বংকা আর আমি আপনাকে ঘরে ছেড়ে আসছি।” বংকা আর হাসল না।একটা শেষ হয়ে যাওয়া ওষুধের স্ট্রিপ দিল দিবানাথের হাতে।সেটাই এনে দিতে হবে।কোন রকমে নড়েচড়ে হাঁটতে লাগল রেশমি। পালপাড়ার আগে ফোনের বুথ দেখে দিবানাথ সেখানে ঢুকে গেল। বংকা রেশমির পেছন পেছন গেল। দিবানাথ বনলতা কে ফোন করে বাবার খবর জিজ্ঞেস করল। খুব খারাপ করে উত্তর দিল বনলতা। কিন্তু সামনের সপ্তাহে আবার বড় ডাক্তারের কাছে যেতে হবে জানাল। দিবানাথ জানালো সে সাথে যাবে। দিবানাথের ইচ্ছা সেদিন বাবা আর মায়ের যদি একবার দেখা করিয়ে দেওয়া যায়। বড়লোক তাকে হতেই হবে! বড়লোক হলে এই বনলতা, এই শিউলি, এই বংকা সব থেকে অনেক অনেক দূরে উঠে যাবে সে। গাড়ি থাকবে একটা, সাদা দুধের মত গাড়ি।
আর একটু হলেই হাতের পাতা পুরো কেটে যেত। খুব লেগেছে প্রবীরের। বিরাট ব্যান্ডেজ হয়েছে। বাম হাতটা নিয়ে নিয়ে বেজায় অসুবিধা। শিলা বউদি খুব বকাবকি করেছে। তার বক্তব্য আগের কাজ টা ভালো ছিল পয়সা কম হলেও ভয় কম ছিল। হাত সারতে হপ্তা দুয়েক লাগবে। গলায় হাত ঝুলিয়ে কদিন হাত কেমন করে কাটল তাই নিয়ে সবাই কে গল্প করে বেরাল প্রবীর। রাতে বেশ ব্যাথা হচ্ছে। বংকার হাত কি করে কেটেছিল? জানা হয়নি তার।পড়াশোনা টা করলে এই সব কাজ করতে হত না। শিউলির গলার স্বর শুনতে পেল প্রবীর।ও যদি পড়িয়ে দিত। আচ্ছা আবার যদি পড়াশোনা করা যায় ইস্কুলে ভর্তি হওয়া যায়। রাতে নানান আওয়াজ আসে।ঘুম আসে না প্রবীরের। আচমকা তার বীভৎস স্মৃতি গুলো ভেসে আসে।বাবা তাকে হাসপাতালে দিয়েছিল। কি ভয়ানক দিন গুলো।কি যেন হয়েছিল কি একটা কাজ করেছিল প্রবীর। তারপর বাবা এখানে নিয়ে চলে এল। বাবা কেন চাইত না পুরনো বাড়িতে থাকতে। মাথাগুলিয়ে যায় তার। আকাশে আলো দেখা দেয়। হাত সেরে গেলে আবার বংকার কাছে যাবে। সকাল হয়ে বাঁচল সে।
বরযাত্রী কম গেলেও বিজুর বাড়ি ঢুকে শিউলি দেখল ওদের বাড়ি প্রচুর মানুষ। কাজের লোক অনেক। বিজুর একটা দাপট আছে বাড়িতে সেটা বুঝল। বিছানায় শায়িত বিজুর মা একটা বিরাট সোনার হার দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তার পাশের ঘরে আর একজন বৃদ্ধা তিনিও আশীর্বাদ করলেন। তিনি ঠিক কে সেটা বুঝতে পাড়ল না শিউলি।তাকে যে ঘরে রাখা হল সেটা এতো বড় যে একলা হলে ভয় ভয় করতে লাগল শিউলির। শিউলি এই বিরাট বিপুল ঐশ্বর্যের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেল। দ্বিরাগমনে গিয়ে কয়েকঘন্টার জন্যে থাকল বিজু। বিজু চলে গেলে একটু শান্তি পেল শিউলি। বাড়িতে এখনো উৎসব শেষের গন্ধ আছে। বাবা কে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সে। বাবা একটু তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। বাবা চোখে জল নিয়ে খানিক আদর করল। ফাঁকা বাড়িতে মা কেবল জিনিস গুছিয়ে চলছে। মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শিউলি বুঝল তাকে এই বরফটা গলাতে হবে।মার পেছনে পেছনে খানিক ঘুরল। “মা, একটু বস্, শুধুই দেখছি কাজ করছ, ওমা …।” শিউলির মার কষ্ট ক্রোধ হয়ে বার হয়ে আসে। বিরক্তি হয়ে বার হয়ে আসে। শিউলি দুহাতের মধ্যে মাকে ধরে। মা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। গর্ভজাত তাকে হৃদয়ের তোলে ধারণ করে। সেদিন সারাদিন মা মেয়েতে সেই ছোট বেলার মত গল্প হয়। বুলুদিদির কথা জানায় মাকে। মা অবাক হয়ে বলে, “ ওসব জামাই কে বলতে যাস না। কি কাণ্ড বুলু তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেল।” মুখে কিছু না বললেও শিউলি ,ঠিক করে রাখে বুলু দিদির জন্যে একটা কিছু সে করবে। বিজু ওকে ভালোবাসে। দুপুরে মা চোখ বুজে শুলে, নিজের ড্রয়ার খুলে বিজুর সব চিঠি গুলো একটা প্যাকেটে ঢোকায়। মনে অনুরাগের একটা গোলাপি আকাশ তৈরি হয়। বিজুর সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে সে। মজা হবে।
দিবানাথ রেশমির দেওয়া ওষুধের স্ট্রিপ নিয়ে দোকানে খোঁজ করল। ওষুধটা আউট অফ স্টক।জেনেরিক লিস্ট দেখে ওষুধটা খুঁজতে গিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ওষুধ টা একটা খারাপ অসুখের। সেক্স ওয়ার্কারদের এই ছোঁয়াচে অসুখটা হয়।আচমকা মাথার গুবরে পোকা ঢুকল। অনিল সাধুখাঁর তার মানে এই রোগ আছে। এই রেশমি থেকে দূরে থাকতে হবে। ওষুধটা বেশ দামী।
দোকানে ফোন এল সাধুখাঁর বাড়ি থেকে। গাড়িতে করে জেলাশহরে একজন কে যেতে হবে।রঘু মিশ্র দিবানাথ কে ডাক দিল। “চল দিবু, আজ তুমার কাজ শেষ। বেড়িয়ে আসবা চল।” দিবানাথের ইচ্ছা নেই রঘু মিশ্রর সাথে যাবার। কিন্তু সে না বলে না। গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে গেল রঘু মিশ্র পেছনে একটা ব্রিফকেস নিয়ে গম্ভীর হয়ে বসল। জেলা শহরে ঢুকবার আগে ঢুলছিল দিবানাথ।আচমকা ঘুম কেটে গেলে দ্যাখে বিরাট বড় একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। রঘু মিশ্র ঢুকে গেল ভেতরে।সন্ধ্যে নেমে আসছে। ড্রাইভার আর দিবানাথ দুজন মিলে বিড়ি ফোঁকে। মশা ভন ভন করছে। ভেতর থেকে মাঝে মাঝে খুব জোর মহিলা কণ্ঠের চিৎকার আসছে।সম্ভবত অনিল সাধুখাঁর মেয়ের। “এটাও কি সাধুখাঁ দের বাড়ি?” দিবানাথ জিজ্ঞেস করে। “টাকা থাকলে বাতি জ্বেলে লোকে পাদে, মাঝে মাঝে শহরে এসে মেয়ে জামা কাপড় কেনে, বন্ধুদের সাথে মদ খায়, সিনেমা দেখে, সেই জন্যে বাড়ি।”ড্রাইভার বলে। কিছুক্ষণ পর কান লাল করে রঘু মিশ্র বার হয়ে আসে। চোখ মুখে অবস্থা খুব খারাপ। এই বয়সে অপমান সহ্য করা কঠিন। দিবানাথের খারাপ লাগছে। অনিল সাধুখাঁর মেয়ে বার হয়ে আসে। বড়লোকের মেয়ে কিন্তু কোন শ্রী নেই তার চেহারায়। তবে বেশ দামী পোশাক আর দামী কোন সুগন্ধ মেখেছে। গন্ধটা ভালো লাগল। ড্রাইভারের সিটের পাশে রঘু মিশ্র আর দিবানাথ দুজনেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে।কেন মৌসুমি সাধুখাঁ এতো রেগে আছে কে জানে।দিবানাথ বাড়ির কাছে নেমে গেল।আড়চোখে বুঝল মৌসুমি সাধুখাঁ তাকে তাকিয়ে দেখছে। বাড়ি ফিরে অবাক হল। বংকা বাড়ির দরজার সামনে ধাপিতে বসে আছে। “ মা জননী, আজ রাতে ভাত খেয়ে যেতে বলেছে।”নুলো হাতটা দিয়ে গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল বংকা। বাড়ি ঢুকে দেখল বহুদিন পর মা গুনগুন করে গান করতে করতে রান্না করছে।ভালো লাগল দিবানাথের। রাতে খেতে বসে জানল। আজ তার জন্মদিন। জন্মের সময় মা কে খুব কষ্ট দিয়েছে সে। প্রাণ সংশয় হয়েছিল। বাবা কে নাকি খুব ছোটাছুটি করতে হয়েছিল।
ট্যাপা দা ডেকে পাঠিয়েছে। প্রবীর মুর্গি কাটা জামা প্যান্ট ছেড়ে একটা ভালো জামা পড়ল। হাতটা এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলেছে সাবধানে কাজ করতে। মুরগীর দোকানের কানুবাবু খরচ করেছেন। কিন্তু কথা শোনান রোজ। এক ভাষায়, “আমি হলাম ভদ্রলোকের ছেলে, কাউকে ঠকাতে পারি না।এই যে আট শো টাকা খরচ হল সে টা কি এ বাজারের অন্য কোন শালা দেবে।” প্রবীরের লজ্জা লাগে না। বলে যাক। কিন্তু ট্যাপা দাকে ব্যাপার টা জানাবে। ট্যাপা দা একটা বিরাট রঙের কাজ পেয়েছে। একটা অফিসের কাজ। প্রবীর সাথে থাকলে সুবিধা হবে। তাছাড়া প্রবীরের হাতটা সেরে ওঠা দরকার। ট্যাপাদা কে কানুবাবুর কথা বলাতে ট্যাপা দা কিছু বলল না।যাই হোক ট্যাপা দা কিছু বললে না বলতে পারে না। তাছাড়া ট্যাপাদার সাথে থাকতেও ভালো লাগবে। ট্যাপাদা খুচরো দুশো টাকা হাতে দিল প্রবীরের । “যাহ্, তোর কানুবাবুকে এটা দিয়ে আয় বলবি বাকি টাকা শোধ করে দেওয়া হবে।” ট্যাপা দা এই সব বলে গামছা কাঁধে কলতলার দিকে গেল। বাবার মত লাগছে ট্যাপা দা কে। ট্যাপা দা কে ছেড়ে কোথাও যাবে না প্রবীর। যদি এবার রঙের কাজ টা ঠিক মতো দাঁড়িয়ে যায়। তাহলে আবার লেখাপড়া শিখবে। ভালো কাজ করবে। পরিস্কার কাজ। ভয়ের কাজ না। কিন্তু মুর্গি কাটতে প্রবীরের বেশ লাগে। মুর্গি যখন নিঃস্পন্দ হয়ে যায় তখন অদ্ভুত আনন্দ হয়। সেদিন নিজের হাতের রক্ত আর মুরগীর রক্ত মিশে যাচ্ছিল, যন্ত্রণা হচ্ছিল বটে কিন্তু তার সাথে একটা মজা ছিল। টাকা টা বুক পকেটে রাখে সে।
শিউলি বিজুর বাড়ির অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। এরা কেউ এক সাথে খেতে বসে না। বিরাট খুব সুন্দর খাবার টেবিল একটা রান্না ঘরের পাশে আছে। বিজু বাড়ি ফিরে একবার মায়ের ঘর ঘুরে এসে ঘরে ঢুকে যায়। সেখানে রাতের খাবার চলে আসে। বেশির ভাগ দিন দুপুরে নানান বন্ধু আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খেতে যেতে হয়। গাড়ি পাঠিয়ে দেয় বিজু। বিজু আর শিউলি ঝড়ের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে প্রায় পাঁচ টা কাজের লোক । এছাড়া অফিসের একটা শানু দা আছে। শানু দা কে শিউলি দেখেনি। কিন্তু শানু দা ছাড়া বিজুর কাজ একেবারে চলে না সেটা বোঝে। শানু দা অফিসের সব বোঝে। শরীরের আনন্দ মনের আনন্দ, আর অপর্যাপ্ত বিলাসের মাঝে শিউলি ভুলে গেল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা পরিকল্পনা ছিল। দুজনে পাহাড়ে গেল হানিমুনে। সবচেয়ে দামী মদ খেয়ে নিজের মার কাছে দেওয়া কথা ভাঙল শিউলি।তার সারা শরীর আর মন জুড়ে কেবল বিজু।
শিউলি বিজুর মায়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে।খুব কম কথা বলেন।যে ব্যাপারটা খুব অবাক লাগে শিউলির সেটা হল, বিজুর মার কোন কৌতূহল নেই। নতুন বউএর বাপের বাড়ি নিয়ে, বিজু কোথায় গেল, বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া হল কিনা, কোন পূজা পার্বণ… কিছুতেই যেন কোন আকর্ষণ নেই।একদিন বমি করলেন সেটা নিয়েও কোন তাপ উত্তাপ নেই। অথচ কিছু কথা বললে শোনেন।ভালো খারাপ কিছু বলেন না। আর একজন বৃদ্ধা কে সেটা বুঝতে শিউলির অনেক দিন লাগলো। উনি মল্লিকার মা। মল্লিকা আর তার মা এই পরিবারে প্রতিপালিত। বিলাসিতায় তাদের সমান অধিকার কিন্তু বিজু যে দাপটে সংসারে থাকে সেখানে তারা কোন কথা বলে না। শুধু তাই নয় বিজুর ঘরে তারা কেউ আসে না।যে লোকটি মল্লিকার সাথে তাদের বাড়ি গিয়েছিল, সে বাড়ির সবার খোঁজ রাখে।খুব মা কালীর ভক্ত। বিজু আর শিউলি এতো ঘুরে বেড়ায় যে মায়ের জন্যে মন খারাপের সময় হয় না। মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলে শিউলি। বাবা জামাইয়ের খবর নেয়। আর মা শিউলিকে রান্না বান্না শিখতে বলে। মা বুঝতেই পারে না, এদের রান্না ঘরে শিউলি গিয়ে দাঁড়ালে কাজের লোকেরা শশব্যস্ত হয়ে যায়। শিউলি ভিসিআরে সিনেমা দ্যাখে। প্রচুর নেল পালিশ তার।স্কুলের বন্ধুদের কেউ কেউ ফোন করে। অনেকেই খুব হিংসে করছে এতো ভালো বিয়ে হওয়ার। নিচের ঘর গুলোর একটাতে অনেক আলমারি আছে। একটা বড় গেস্ট রুম। মল্লিকা এসে ওর মার ঘরে থাকে। মল্লিকার মা মাঝে মাঝে খুব সুন্দর ভজন গান করেন।শিউলি কে জিজ্ঞেস করেছেন, সে গান জানে কিনা।শিউলি আলপনা দিতে পারে জেনে আনন্দ পেয়েছেন। আয়নায় শিউলি বুঝল সে বেশ মোটা হচ্ছে।
দিবানাথ কে বনলতাদের বাড়ি যেতে হচ্ছে প্রায় রোজ। তার বাবার ইংজেক্সান শুরু হয়েছে। দিবানাথ নিজে হাতে দেয়। বনলতা শিখে নিতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। সে চুপ করে দেখে। ডাক্তার দেখানোর দিন সে চেয়েছিল বাবা আর মায়ের দেখা করিয়ে দেবে। মা ওভাবে যেতে চায়নি।
আগে বনলতার জাপানী ক্যামেরা, দামী ফুলদানী দেখত, আজকাল কেবল বাবার একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে চলে যাওয়া দেখেছে। দিবানাথ সিরিঞ্জটা বাবার হাত থেকে বার করে এনে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, বাবা কিছু বলতে চাইছে। “লেগে গেল নাকি কাকা!” মজা করে সে বলে। “তোর মা কে একবার নিয়ে আয়। আমি খুব অন্যায় করেছি তার ওপর” দিবানাথের বাবা বলে। বনলতা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। দিবানাথ বনলতার দিকে তাকায়, তারপর বেশ দৃঢ়তার সাথে বলে, “বাড়ির পাশে শম্ভুদের দোকানে একটা ফোনের পিসিও আছে। ওদের নম্বর টা দিচ্ছি। তুমি ফোন করে নিও। তোমার কথা আমি বল্লে শুনবে কেন!” বনলতা কেমন চুপ করে বসে থাকল। দিবানাথের দোকানে একটা গণ্ডগোল হয়েছে।কি একটা ভুল ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তাই নিয়ে বেজায় চিল্লামেল্লি। রঘু মিশ্র মালিকের কাছে বেজায় গালাগালি খেয়েছে। বেচারার মন মেজাজ খারাপ। কাজ গুটিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিতে গিয়ে দেখল, রঘু মিশ্র মদ কিনছে। “ও, দিবু আমাকে একটু বাড়ি অবধি পৌঁছে দে” রঘু বলে। দিবানাথের বিরক্ত লাগে। সারাদিন পর আর ভালো লাগছে না। রঘু বেশ ভারী। তার বাড়ি দেখে অবাক হল। প্রায় ঝুপড়ি গোছের একটা ঘর। সামনে একটু ঘেরা জায়গা আছে। সেখানে একটা সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্চা ছেলে। রঘু নেমে একবার ফিরেও তাকাল না। দিবানাথ বাড়ি এসে দেখল মা অপেক্ষা করছে। লোডশেডিং এর আলোয় ভাত খেতে বসে বুঝল, মার মুখ থমথমে। “তোর বাবা ফোন করেছিল। এতো শরীর খারাপ হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি তো। টাকারও অসুবিধা। ভেলোরে গিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। অত টাকা কি ভাবে জোগাড় করা যায় বলত? আমাদের বাড়ীটা বন্ধক রেখে দেবো!” দিবানাথের মা বলে চলে। দিবানাথ অবাক হয়ে যায়। বাড়ি গেলে তারা থাকবে কোথায়। মা কি একটু বুঝবে না। ওখানে কত খরচ খরচা করে বনলতার বাড়িতে থাকে বাবা। সেটা একটু কমালেই পারে। “বাড়ি বন্ধক দিলে তা আর উদ্ধার করা যাবে! সে যে অনেক টাকা, তেমন হলে কিছু ধার করা যেতে পারে।” দিবানাথ বলে। দিবানাথের মা আজ আবেগ রুদ্ধ হয়ে আছেন। তিনি ছেলের কথা আদৌ বুঝতে পারলেন বলে মনে হয় না।
রঙের কাজে বলে ভয় নেই! বাজে কথা। ওই যে ট্যাপাদা খুক্ খুক্ করে সারাদিন কাশে সেটা ওই রঙের জন্যে। রঙে বাজে কেমিক্যাল আছে।প্রবীর নতুন জানলো এসব। ট্যাপা দা বোঝাতে চাইছে এই কাজ টা করতেও যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে।ট্যাপা দাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না প্রবীর। রঙ করবার নতুন জায়গা টা শহর থেকে একটু দূরে। বড় রাস্তার ধারে, কিন্তু গ্রাম্য এলাকা। কি একটা কেমিক্যালের ফ্যাকটারি হবে। পাশে একটা সুন্দর বাড়ি আছে। অনেক ফুলের গাছ। এর মালিক নাকি মাঝে মাঝে আসে। প্রবীর বিকেলে কাজ শেষ করে পা ঝুলিয়ে ফ্যাক্টারির পাঁচিলে বসে থাকে। বেশ লাগছে তার ।গরু চরা মাঠ, নিচু হয়ে আসা আকাশ, ইস্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের দল, এইসব দেখতে দেখতে আচমকা দেখল দুধ সাদা একটা চারচাকা গাড়ি। পাশের বাড়িতে ঢুকছে। প্রবীর কি স্বপ্ন দেখছে। গাড়ি থেকে ওটা কে নামল। শিউলি না, হ্যাঁ শিউলি তো, কি সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছে। পাঁচিল থেকে লাফ দিয়ে নামল প্রবীর, তার ভাঙা গলায় চিৎকার করতে থাকে, “এই শিউলি, এই শিউলি, তুই এখানে কার কাছে এসেছিস।”
শিউলি গেটের ভেতর ঢুকে যায়। বিজু তাকিয়ে থাকে নোংরা, খুব রোগা একটা ছেলের দিকে। ড্রাইভার আর গেটম্যান কে কিছু বলে। তারপর গেটের ভেতর ঢুকে যায়।শিউলি প্রবীরের গলার আওয়াজ পায়। কিন্তু তারপক্ষে তার সাথে কথা বলার মত মানসিক অবস্থা নেই। সে জানে, সে বিজন প্রকাশের স্ত্রী। তাকে এই সব ছোটলোকদের সাথে কথা বলতে নেই। তারমধ্যে বিয়ের আগের পুরুষ বন্ধুদের কথা বিয়ে হবার পর সামনে না আসায় ভালো। গেটের ওপারে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল শিউলি। সে দোতলায় উঠে গেল। বিজু অত্যন্ত বিরক্ত হল। তার ব্যবসার কিছু কাজ এখান থেকে কিছুদিনের মধ্যে শুরু হতে চলেছে। নানান টানা পোড়েন চলছে। এই ধরণের ফালতু ব্যাপার। শিউলি বিষণ্ণ। গত রাতেই সে বুলুদিদির জন্যে বিজু কে বলেছে। বিজু খুব বিরক্ত হয়েছে।“আমি কোন সাহায্য করতে পারব না। বাবা ওই সব সাহায্য প্রচুর করেছে। তারপর তারা আমার ঘাড়ে এখন বসে আছে।” বিজু ভ্রু কুঁচকে বলে যাচ্ছে। কথাটা যে মল্লিকা কে নিয়ে সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। অথচ শিউলি বুঝেছে, মল্লিকা হৃদয় দিয়ে বিজুর ভালো চায়।ভেতর ভেতর মরে যায় শিউলি। এসব কথা না বলায় উচিৎ ছিল ।খামোকা সে বিজু কে বিরক্ত করল।
ট্যাপাদা না এলে প্রবীরের কপালে আজ কষ্ট ছিল। “ আরে কি করেন করেন , ওকে মারবেন না। খুব রোগা। কোথায় লেগে যাবে।” ট্যাপাদার কাছে ড্রাইভার এগিয়ে এসে বেশ রহস্য করে বলে, “ বউমনির নাম ধরে ডাকছিল। হেবি পেছন পাকা ছেলে তো ,মশাই”। ট্যাপাদা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, “ পেব্যা, এরা কি বলে রে।” প্রবীর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, “ ভুল হয়ে গেছে। আমি আর একজন কে ভেবেছিলাম।আমি ডাকলে সে ঠিক সারা দিত।” সারাদিন কোন কথা না বলে প্রবীর কাজ করল। ফিরবার সময় সাইকেল নিয়ে ট্যাপা দার সাথে ফিরল প্রবীর। রেলগেট পড়ে গিয়েছে। এক্সপ্রেস ট্রেন আসবে। অপেক্ষা রত সেই দুধ সাদা চারচাকা গাড়ির কাচে তার চেনা মুখ।বিড়বিড় করতে লাগল প্রবীর, “ আমি ঠিক দেখেছি। কথা কেন বলল না। কেন?”ট্যাপা দা কিছু একটা আন্দাজ করল। “আবার বিড়বিড় করিস ক্যান, চল চা খাই।” ট্যাপাদা এই প্রথম জানতে পারল, শিউলি বলে একটি অপূর্ব সুন্দর আর পবিত্র মেয়ে প্রবীর কে ত্রিকোনমিতির মতন কঠিন অঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছিল। শিউলি পড়ালে প্রবীর আজ কলেজে পড়া ‘ভালো ছেলে’ হতে পারত। প্রবীর পরের সপ্তাহ কোন কথা না বলে কাজ করে গেল। ট্যাপাদাও খুব খুশি। এতো দ্রুত কাজ শেষ হলে আর একটা কাজের ব্যপারে সুবিধা হবে। হপ্তা শেষে টাকা পেয়ে একটা টি শার্ট কিনল প্রবীর। বংকা কে দিতে হবে।পুরনো বাড়ি ছিল যেখানে সেখানে কেউ বংকার খোঁজ দিতে পারল না।ইট ভাঁটার মাঠে গিয়ে বসে রইল। প্রবীর হাতের ক্ষতটা সেরে গেছে কিন্তু দাগ হয়ে আছে। ধোপা রা কাপড় মেলছে। বেশ কিছুক্ষণ পর বংকা কে দেখতে পেল। বংকা অবাক হল প্রবীর কে দেখে। এক কালের সঙ্গী ,প্রবল শত্রু, কিন্তু অদ্ভুত টান দুজনের মধ্যে বংকা কে টিশার্ট টা এগিয়ে দিল প্রবীর। বংকা আনন্দ পেল,চোখ চিক চিক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সেটা পরে নিল। গায়ে ঠিক মত ফিট করেছে। “আবে, পেবু তোর হাতে কি হয়েছে। আমার বন্দু বলে কতা।যে হাতে খাবি সেই হাতে পাছা ধুবি।” প্রবীরের মাথায় চাঁটি মেরে বলে ওঠে বংকা। তারপর অনেক কথা। শিউলির ব্যাপার তা বংকার কাছে জানল। কিন্তু শিউলি যে তার সাথে দেখা হলেও কথা বলেনি সেটা বলল না প্রবীর। ওটা খুব ব্যাথার জায়গা। খুব ব্যাথা। কাউকে বলবে না।
দিবানাথ বুঝতে পারল সাধুখাঁ দের কেবল ওষুধের ব্যবসা নয়। অন্য আর কিছু একটা লুকানো ব্যবসা আছে। অনিল সাধু খাঁর যে ভাই বিয়ে থা করেনি বাড়িতে থাকে। সে অন্য ব্যবসাটা দেখে। সম্ভবত অনিল সাধুখাঁ মালিক হলেও আসলে সেই গোটা ব্যাপারটা চালনা করে। রঘু মিশ্র বলল, “দিবু ভাই, তুমারে বাড়ি তে একবার ডাক পড়েছে।” ।রঘুর সাথে দিবু মালিকের বসত বাড়ি গেল।বড়লোক হলেও এতো অগোছালো বাড়িঘর হতে পারে ধারনা ছিল না। কিছুই যেন ঠিক মত নেই। রঘু ভেতরে একটা ঘরে ঢুকে গেল।কিছুক্ষন পর ডাক দিল “মেজবাবুজী ডাকছে এস।” ভেতরে একটু বুক গুড়গুড় নিয়ে গেল দিবানাথ। “ তুমি নাকি খুব ভালো কাজ করছ?” ব্যায়ামবীরের মত বেশ দশাসই চেহারার একজন চতুর গলায় জিজ্ঞাসা করে। দিবানাথ কোন উত্তর না দিয়ে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে সোজা তাকিয়ে থাকে। “তুমি আমার কাছে এবার থেকে কাজ করবে। ইংরেজি পড়ে বুঝতে পার তো।” দিবানাথের মাইনে অনেকটা বেড়ে গেল। কিন্তু কাজটা কি বুঝতে পারল না দিবানাথ।সে দামী সিগারেট কিনল এক প্যাকেট। ইট ভাঁটার মাঠে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল বংকা আর প্রবীর জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। প্রবীর দিবানাথ কে দেখে উদ্বেল হয়ে গেল। সেদিন অমাবস্যার আকাশ দেখল, ইটভাঁটার অন্ধকার মাঠে তিনটে আগুনের ফুটকি। যেন সমকোণী ত্রিভুজ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন