শনিরবচন | তুরুপের তাস ইভিএম

শব্দের মিছিল উত্তর প্রদেশ ভোট

তুরুপের তাস সেই ইভিএম। বুথ দখলের দরকার নেই। ছাপ্পা ভোটের খাটনি নেই। বোমাবাজি গোলাগুলির খরচ নেই। রক্তপাতের শিরোনাম নেই। শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে নিরাপদে ভোটলুঠ। সৌজন্যে নির্বাচন কমিশন, না ভীত সন্ত্রস্ত ভোটকর্মী? সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জনতার কাছে পরিস্কার নয়। তবে এটা পরিস্কার নির্বাচনী ফলাফলে মানুষের রায় প্রতিফলিত হয়নি। অন্তত উত্তরপ্রদেশের জনতার মনে এই বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ নাই। সন্দেহ থাকার কথাও নয়। গলিতে গলিতে মহল্লায় মহল্লায় উত্তরপ্রদেশের মানুষ ঠিকই করে রেখেছিল। বিধানসভায় তারা কাদেরকে নিয়ে আসবে। এমন কি, কোন দল পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সেই রাজ্যের পক্ষে উপযুক্ত হবে। সেই বিষয়ে তাদের মনের ভিতরে কোন ধোঁয়াশা ছিল না। নির্বাচনের প্রাক্কালে জনতা সরাসরি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কাছে সেই কথাই প্রকাশ করেছিল। ফলে লড়াইটা সরাসরি পদ্ম বনাম সাইকেলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যার স্পষ্ট ছবি ধরা পরছিল নির্বাচনী জনসভাগুলিতে। পদ্মশিবিরের নির্বাচনী সভায় হাজার হাজার চেয়ার ফাঁকা পড়ে থাকতো। উল্টো দিকে সাইকেল চালিয়েই হোক আর হেঁটে। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভিড়ে উপচে পড়তো বিরোধী জোটের নির্বাচনী সভা। এমনকি একের পর এক মহারথীকে পদ্মশিবিরের ফাঁকা সভায় ভাষণ দেওয়াও বাতিল করতে হচ্ছিল ফাঁকা চেয়ারের ভিড় দেখে। ভিড় বাড়াতে সরকারী পরিবহনকে ব্যবহার করে শত শত মাইল দূর থেকে হলেও মানুষ নিয়ে এসে সভা ভরাতে হয়েছে। ফলে মানুষের রায় বুথে বুথে লাইন দেওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। আরও বেশি স্পষ্ট হচ্ছিল। বুথ ফেরত মানুষের কথায়। বুথে বুথে, বুথ ফেরত মানুষের বয়ানে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মানুষের রায় কোন পক্ষে। অন্তত কার দিকে পাল্লা ভারী।

কিন্তু পাশা উল্টানো শুরু হলো। ভোট মিটে যাওয়ার পর। সরকারপন্থী টিভি চ্যানেলগুলিতে প্রচারিত একজিট পোলের হিসাব ও নিকেশে। সেটিই ছিল অশনি সংকেত। অনুমান করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। ইভিএমের ফল কোনদিকে যেতে পারে। কারণ উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতা ছাড়া দিল্লীর ক্ষমতা ধরে রাখা সহজ হতো না। উত্তরপ্রদেশ হাতছাড়া হলে অনেকগুলি বিষয় পরিস্কার হয়ে যেত। রাম মন্দির, ধারা ৩৭০, সিএএ, কাশী-বিশ্বনাথ করিডোর, পুলওয়ামা বালাকোট, ৫৬ ইঞ্চী, জয়শ্রীরাম, এবং হিন্দু-মুসলিম থেকে মানুষ বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে। আর সেই ছবিটা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ২০২৪ও হাতছাড়া হয়ে যাওয়া আটকানো সম্ভব হতো না। ফলে পদ্ধতি যেমনই হোক। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী ফলাফলে মানুষের রায়ের প্রতিফলন হতে দেওয়া যাবে না কোন মতেই।

সদ্যসমাপ্ত উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ইভিএমের ভুমিকা দিনে দিনে আরও হয়তো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিংবা ইভিএমের ভুমিকাকে ধামাচাপা দেওয়ার কাজ সফল হবে। আপাতত যেটুকু জানা যাচ্ছে। তাতে এটা পরিস্কার। ইভিএমের ভুমিকার স্ক্রিপ্ট নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যে তথ্যের দিকে আঙুল তুলেছেন। সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে সমস্ত পোস্টাল ব্যালেটের ৫১% ভোট সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষে গিয়ে পড়েছে। যে ভোটগুলি ইভিএমকে বাইপাস করতে সক্ষম হয়েছে। এই তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে অখিলেশের দাবি অনুযায়ী তার নেতৃত্বাধীন জোটের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা হওয়ার কথা ৩০৪টি। হ্যাঁ চোখে সর্ষেফুল দেখার মতোই তথ্য। বলাই বাহুল্য এমন চোখে সর্ষে ফুল দেখার মতো তথ্য দেখতে রাজি থাকার কথাও নয় পদ্মশিবিরের। এখানে আরও একটি বিষয় পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। সাধারণত পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেয় সরকারী কর্মচারীদের একটা বড়ো অংশ। সেই অংশের ৫১% ভোট বিরোধী জোটে গিয়ে পড়ার একটিই অর্থ হয়। জনতা শাসকদলকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। সরকারী কর্মচারীদের বড়ো অংশ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়া মানে সরকারের পতন অনিবার্য্য হওয়া। ফলে উত্তরপ্রদেশের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে পোস্টাল ভোটের ৫১% যদি সত্যি করেই বিরোধী জোটে গিয়ে পড়ে থাকে। তবে ইভিএমের ফলাফলে সন্দেহ করার যথেষ্ঠ কারণ বিদ্যমান। সাধারণত দুই আর দুইয়ে যোগ করতে পারলেই আসল সত্যটা ধরা পড়ার কথা। পোস্টাল ব্যালটের এই ফলের সাথে বুথ ফেরত ভোটারদের অন ক্যামেরা প্রতিক্রিয়ার হাজার হাজার ছবি যোগ করতে পারলেই। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আসল ফলাফলের ছবি স্পষ্ট ধরা পড়ার কথা।
এর ভিতরেই আরও একটি তথ্য মানুষের হাতে এসেছে। যদিও তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ঠ অবকাশ থাকতেই পারে। হতেই পারে, বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সাজানো নাটক। কিন্তু সন্দেহ অমূলক হোক আর না হোক। ইভিএমের ফলাফলের সাথে পোস্টাল ব্যালটর ফলাফল না মেলা। 
ইভিএমের ফলাফলের সাথে উত্তরপ্রদেশের গলিতে গলিতে মহল্লায় মহল্লায় জনতার রায় না মেলার ঘটনা দুটিকে যদি যোগ করা যায়। যদি মেলানো যায়। তাহলে কোন এক নির্বাচনকর্মীর সাথে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির ফাঁস হওয়া ফোনালাপে বুথে বুথে ইভিএম বদলানোর যে অভিযোগ উঠে এসেছে। তাকে নেহাত সাজানো নাটক বলে উড়িয়ে দেওয়াও সহজ নয়। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের বৃত্তে না ঢুকে আমরা বরং আরও কয়েকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিই।

উত্তরপ্রদশে জুড়ে ইভিএমের ভুমিকা নিয়ে সন্দেহের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সেই খবরকে ধামাচাপা দিতে নতুন দুইটি খবরকে শিরোনামে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। এবং একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে খবর দুইটির ভিতরে একটি সাধারণ মিল বা সূত্র রয়েছে। মুসলিম বিদ্বেষ। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী প্রচারে যে বিষয়টি একটি বড়ো ইস্যু ছিল। মনে রাখতে হবে। কর্ণাটক হাইকোর্টের রায়ে ক্লাসে হিজাব পরে ঢোকা নিষিদ্ধ হওয়া ঠিক হলো কিন্তু উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের ঠিক পর মুহুর্তেই। যে রায় ভারতবর্ষ জুড়ে নতুন করে হিজাব বিতর্ক এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চাকে নতুন মাত্রা দিতে শুরু করছে। এবং আরও ব্যাপক ভাবে করতে থাকবে। এর সাথেই সামনে নিয়ে আসা হলো। আরও একটি বিতর্কিত বিষয়। একটি সিনেমা। কাশ্মীর ফাইলস। কাশ্মীর থেকে বিতারিত কাশ্মীরী পণ্ডিতদের একটা বড়ো অংশই যে সিনেমাকে সত্যের অপলাপ বলে মনে করছেন। ফলে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএমের ভুমিকা থেকে মানুষের নজর সরাতে পরপর এই দুইটি বিষয়কে সংবাদ শিরোনামে নিয়ে আসা হলো। সাথে সাথে নতুন করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বীজ বোনার ধারাবাহিক কাজেরও পরবর্তী পর্বের শুভারম্ভ হয়ে গেল।

অর্থাৎ ঘটনাগুলিকে পরপর সাজাতে পারলে। এবং সেই সাজানোর পারম্পর্য ঠিক মতো অনুধাবন করতে পারলে। একটা ছবি কিন্তু স্পষ্ট হতে থাকে। সরকারপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলির প্রচারিত একজিট পোল আর ইভিএমের মাধ্যমে ঠিক করে দেওয়া নির্বাচনী ফলাফল যে মানুষের রায়ের বিপ্রতীপ। সেই সন্দেহের ছবিটি যে অমূলক নয় সেই ছবিটা অন্তত পরিস্কার এখন। এখন এই ছবিটিই যদি শেষ সত্য হয়। সেইক্ষেত্রে যে কোন সাধারণ মানুষের মনে নির্বাচন কমিশনের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। ইভিএমে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শাসকদল বিরোধীদল কারুরই হাত পড়ার কথা নয়। এখন সেই ইভিএম যাঁদের হেফাজতে থাকে। তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনস্ত কর্মচারী। বুথে বুথে ইভিএম মেশিন বদলে দেওয়া সহজ কথা নয়। এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। ইভিএম না বদলিয়েও মেশিন হ্যাক করে ফলাফলে পরিবর্তন ঘটানো যায়। আমরা শুনেছি। ফলে মেশিন বদলিয়ে হোক। আর মেশিন না বদলিয়েই হোক। ফলাফল যে শাসকদলের অনুকুলে তৈরী করে নেওয়া সম্ভব। সেটি আজ আর কোন গুপ্ত তথ্য বা অজানা কথা নয়। আরও যে বড়ো বিষটি আমাদের মনে রাখা দরকার। বিশ্বের কোন উন্নত দেশেই আর ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণ করা হয় না। কারণ একটিই। শাসকদলের পক্ষে নির্বাচন কমিশনকে হাত করে বা না করেও এই মেশিন হ্যাক করে ফলাফল নিজেদের অনুকুলে তৈরী করে নেওয়া সম্ভব। ঠিক সেই কারণেই প্রতিটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ থেকেই ইভিএম বাতিল করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে চিরপরিচিত ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণ পদ্ধতি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রেই এই খবরে আঁতকে উঠতে পারেন। যারা ছাপ্পা ভোটের সাথে পরিচিত। বুথ জ্যামের সাথে পরিচিত। হ্যাঁ, এটা ঠিক। কোন উন্নত দেশেই মানুষকে এই বিপদগুলির সাথে মুখোমুখি মোকাবিলা করতে হয় না। তবু, ইভিএম থেকে ব্যালটেই যে গণতান্ত্রিক অধিকার অধিকতর সুরক্ষিত থাকে। উত্তরপ্রদেশের সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে সেই চিত্রই স্পষ্ট হচ্ছে দিনে দিনে।

১৯শে মার্চ’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. নিরাপদ স্থানে বসে ঝর আগুন বন্যার বিশ্লেষন করা কোনো ব্যাপার না। যদি মেরুদন্ড থাকে এই বাংলার বিগত ভোটগুলো নিয়ে লিখুন। আইন ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখুন। তবেই না দম।

    উত্তরমুছুন

সুচিন্তিত মতামত দিন