শনিরবচন | শাসক যখন শোষক

শব্দের মিছিল sobder michil

শাসকপন্থী মিডিয়া। শাসকদলের নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসন। দলীয় সমর্থক। এবং দেশপ্রধান যখন লাগাতার মিথ্যা প্রচার করতে থাকে। তখন জনতার সামনে একটা পথই খোলা থাকে। কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিপদ, এক তৃতীয়াংশ ভোট পেয়েও গোটা দেশের একচ্ছত্র অধিপতি সেজে বসে পড়া যায় ক্ষমতার মসনদে। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বিমুখী হলে অবশ্য অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়। ক্ষমতার দখল পেতে। ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে শাসকের মিথ্যাচার থেকে জনতার আত্মরক্ষার পথটা অনেক বেশি কঠিন। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার রকম ফেরে জনতার কাজ কঠিন হোক আর সহজ। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়, বিশেষত সাংবিধানিক গণতন্ত্রে মিথ্যাচারী এবং ধোঁকাবাজ প্রশাসকের হাত থেকে দেশ ও জনগণকে রক্ষা করার সাংবিধানিক একটি পরিকাঠামো থাকা দরকার। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হলেই যে একটি রাজনৈতিক দল দেশ বিরোধী কার্ষকলাপের সাথে সংযুক্ত থাকবে না। এমনটাও নয়। বরং হিটলার মুসোলিনীর মতো অনেক দেশপ্রধানই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েই দেশ ও জনগণ বিরোধী এবং মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ শুরু করে দিয়ে থাকে। সেই কারণেই একটি নির্বাচিত সরকার নিজেকেই যদি আইনের উর্ধে মনে করে। সংবিধানের উর্ধে উঠে যায়। তবে সেটাই দেশের জন্য জনগণের জন্য সবচেয়ে বড়ো বিপদ। এই কারণেই কোন দেশের সরকারেরই আইনের উর্ধে থাকা উচিত নয়। সংবিধানের উর্ধে থাকাও উচিত নয়। এখন এই বিষয়টি সাংবিধানিক গণতন্ত্রে কিভাবে সুরক্ষিত থাকতে পারে। সেখানেই কিন্তু আসল প্রশ্ন। কেননা এমন কোন সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকা দরকার, যাতে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর সরকারকে সেই সাংবিধানিক বল প্রয়োগ করেই বরখাস্ত করা সহজ হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপরে গোটা বিষয়টি ছেড়ে না দিয়ে। যে সরকার দেশের জন্য ক্ষতিকর। জনগণের জন্য ক্ষতিকর। জাতির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। তেমন সরকারকে বরখাস্ত করতে যত দিন দেরি হতে থাকবে। দেশ ও জনগণ এবং সমগ্র জাতির ক্ষতিসাধন ততই বেশি হতে থাকবে।

নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া সরকারের শাসন ক্ষমতায় থাকার অধিকারই থাকা উচিত নয়। পরবর্তী নির্বাচন অব্দি অপেক্ষা করা মানে দেশ ও জাতি, সমাজ ও জনতা সকলের পক্ষেই বিপদজনক এবং ক্ষতিকর। আর সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতির সাথেই যদি একধারে দেশবিরোধী কার্ষকলাপ, আর সেই সাথে জনগণের জীবন দুর্বিষহ করার প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। তবে তো সমূহ সর্বনাশ। যে কোন দেশেই হোক না কেন। জনতার রায়ে যত বিপুল ভোটে জয়ী হয়েই শাসনক্ষমতায় যাক না কেন। সেই সরকারের শাসন ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকারই থাকা উচিত নয়। এখন জনগণের হাতে মাত্র একদিনের ক্ষমতা। নির্বাচনের দিন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সরকার উল্টিয়ে দেওয়া। তার বেশি কোন অধিকার ও ক্ষমতা জনতার হাতে থাকে না। থাকার কথাও নয়। 
ঠিক এই কারণেই সংবিধানের হাতে এমন কোন ব্রহ্মাস্ত্র থাকা দরকার। যার বলে যত বড়ো অত্যাচারী এবং দেশবিরোধী সরকারই হোক না কেন, প্রয়‌োজনে এক রাতের ভিতরে সরকারকে শাসন ক্ষমতা থেকে বরখাস্ত করা সম্ভব হয়। কিভাবে হবে, কোন নীতিমালায় হবে। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় হবে। সেই প্রক্রিয়ার ভালো মন্দ দিক কি কি থাকতে পারে। সেই পদ্ধতির নিরাপত্তাই বা কি। এই সকল বিষয়গুলি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিশ্চিত করার বিষয়। 
ফলে আমরা সেই আলোচনার অধিকারী নই। কিন্তু দেশপ্রেমী মানুষ হিসাবে যে কোন জাতির অধিকার রয়েছে সংবিধানের কাছে এই নিরাপত্তা দাবি করার।

একমাত্র জনগণই পারে গণ আন্দোলের পথে সংবিধানের কাছে এই নিরাপত্তার দাবি রাখতে। দেশের জনগণ যদি মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত না হওয়ার অঙ্গীকার করতে পারে। যদি রাজনৈতিক মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দিকে দিকে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে। যদি মিথ্যাচার করা রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দিক থেকে বরাবরের জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে। তাহলেই দেশের হাল ফিরতে পারে। জনগণকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিভ্রান্ত করার রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অবসান হতে পারে। জনগণের কাছে মিথ্যা কথা বলে রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়ার কুপ্রবৃত্তি বন্ধ করতে জনগণকেই পথে নামতে হবে। জনপ্রতিরোধ গড়ে তুলে মিথ্যাচার করা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে বয়কট করার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। রাজনীতির কারবারীরা যদি টের পায়। জনতা কোনভাবে ছেড়ে কথা বলবে না। জনতা কোনভাবে কোন ধরণের মিথ্যাচার আর বরদাস্ত করতে রাজি নয়। একমাত্র তখনই রাজনৈতিক দলগুলির চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন সম্ভব হবে। কেননা পাঁচ বছরের শেষে সেই জনতার দরবারেই তাদেরকে ভোট ভিক্ষা করতে দাঁড়াতে হবে। যে কোন দেশের চলমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির অবসান করতে শুধু জনগণই যথেষ্ঠ নয়। যদি না সংবিধান জনগণের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। এখন সংবিধানকে সর্বাংশে জনগণের রক্ষাকবচ করে তুলতে সেই জনতাকেই পথে নামতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করতে হবে প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই রক্ষকবচ নিশ্চিত করা। যে বা যারা সেই দাবি পূরণে সমর্থ হবে। একমাত্র তারাই দেশ শাসনের অধিকারী হবে।

এই একমাত্র পথ। যে পথে সংবিধান জনতার রক্ষাকবচ হয়ে দেশবিরোধী সরকারকে সাংবিধানিক নিয়মেই বরখাস্ত করতে সক্ষম হবে। যে কোন নির্বাচিত সরকারই হোক না কেন। সংবিধানের তেমন ক্ষমতা থাকলে সব সরকারই দেশবিরোধী কার্যকলাপ করার আগে সাত বার ভাবতে বাধ্য হবে। এবং জনগণকে নানান ছলে ও কৌশলে বিভ্রান্ত করে সেই কার্যকলাপ কিছুদিনের জন্য চালিয়ে নিয়ে যেতে পারলেও সাংবিধানিক পরিকাঠামোর কাছে আটকিয়ে যাবে অচিরেই। একমাত্র তখনই সফল হতে পারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো। একমাত্র তখনই জনগণের দেশ সুরক্ষিত থাকতে পারে। একমাত্র তখনই কোন সরকারের পক্ষে জনবিরোধী আইন প্রণয়ন করা থেকে শুরু করে নানান ভাবে জনগণের উপরে বিপর্যয় নামিয়ে আনার মতো অপকর্মগুলি করা সম্ভব হবে না। ঠিক যে কাজগুলি বর্তমান বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খুব সহজেই করতে পারা যায়।

শাসকপন্থী মিডিয়া দুইবেলা ধরে যে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যায়, একজন দেশ প্রধানও যদি সেই মিডিয়ার মতোনই দুইবেলা জনগণের কাছে মিথ্যাচার করতে থাকে। তবে সেই দেশের সমূহ সর্বনাশ। একটা দেশকে বিশ্বের মানুষ যে যে ভাবে চিনে থাকে, তার ভিতর সেই দেশের দেশ প্রধানের ভাবমূর্তি অন্যতম পথ। সেই দেশপ্রধানকেই যদি দেখা যায় প্রকাশ্য দিবালোকে সরাসরি মিথ্যা কথা বলতে। তবে সেই দেশপ্রধানের সাথে সেই দেশেরও মাথা হেঁট হয়ে যায়, বিশ্ববাসীর কাছে। কেননা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ বুঝতে পারে মিথ্যেবাদী দেশপ্রধানের বাড়বাড়ন্ত সেই দেশের জনতার দুর্বলতারই প্রমান। সেই দেশের জনতারই অক্ষমতা, রাষ্ট্র প্রধানকে শাসন ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে না পারা। অর্থাৎ গলদ সেই দেশবাসীর ভিতরেই। যে দেশবাসী একজন মিথ্যাবাদী শাসককে শাসন ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে। তাকে আর ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারছে না। এই না পারার ভিতর দিয়ে দেশবাসীর যে অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। সেই ছবিই বিশ্ববাসীর চেতনায় সেই দেশের ছবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বভাবতঃই সেই দেশের সম্বন্ধে বিশ্বের কোন জাতির চেতনাতেই সম্ভ্রম জাগে না। জাগতে পারে না।

এবং সেই মিথ্যাচারী দেশপ্রধান যদি ক্রমাগত ভাবে দেশবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে, এবং দেশবাসীকেই যদি তার মূল্য দিতে হয়। তবে তো দেশবাসীর মেরুদণ্ডহীনতাই প্রমাণিত হয়। যে কোন দেশের পক্ষেই সে বড়ো লজ্জার কথা। রাষ্ট্র প্রধান দেশপ্রধান যেই হোক না কেন। ক্ষমতার গদীতে বসে তার প্রতিটি কাজের জন্য দেশবাসীর কাছে জবাবদিহির দায় তার রয়েছে। কিন্তু কোন দেশের দেশপ্রধান যদি ক্রমাগত সেই দায় এড়িয়ে গিয়ে নানান ভাবে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে একটার পর একটা মিথ্যাচার চালিয়ে যেতেই থাকে। তবে সেই শাসককে ক্ষমতার গদী থেকে টেনে নামাতে গেলে। সেই শাসকের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে গেলে শাসক বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পথে নামতেই হবে প্রতিটি দেশবাসীকে। দেশবাসীর কাছে দেশদ্রোহী শাসক জবাবদিহি না করতেই পারেন। কিন্তু দেশের কাছে দেশবাসীর কিন্তু জবাবদিহির দায় থাকতেই হবে। সেখানেই আপামর দেশবাসীর দেশপ্রেমের প্রশ্ন।



৭ই জানুয়ারী’ ২০২২
©কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ