শনির বচন | নব ভ্যাকসিনবর্ষ

Michil মিছিল

একে একে পুরো দুটি বছর চলে গেল করোনা জুজুর জাদুতে। বহুরূপী করোনা ডেল্টা বেশ ছেড়ে এবারে ওমনিক্রন বেশে চোখ রাঙাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রির মুনাফা ঘরে তুলে ফেলেছে হাতে গোনা কয়েকটি মাল্টিন্যাশানালের ধনকুবের মালিক গোষ্ঠী। কিন্তু তাতেও লক্ষ্যপূরণ হয়নি। হাতের আস্তিনে এখনো একের পর এক তুরুপের তাস লুকানো রয়েছে। একে তো ডেল্টা ও ওমনিক্রন রূপী করোনার কোন ভ্যাকসিন এখনো বাজারে আসেনি। তবু মানুষকে গরু ছাগলের মতো বাধ্য করা হচ্ছে বুস্টার ডোজসহ প্রাথমিক দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিতে। যে ভ্যাকসিন তৈরী হয়েছে ডেল্টা ও ওমনিক্রন বাজারে ছাড়ার আগেই। ফলে ভ্যাকসিনের বাজার এখন সরগরম। একের পর এক নতুন ভ্যারিয়েন্ট। আর নিত্য নতুন বুস্টার ডোজ। নিলে নাও নয়। তোমায় নিতেই হবে। না হলে তোমার ধোপা নাপিত বন্ধ। বাইরে বার হওয়া বন্ধ। চমৎকার দাওয়াই গোটা বিশ্বজুড়ে। আর এই বিষয়ে উন্নত বিশ্বের ইউরোপ আমেরিকায় কড়াকড়ি সবচেয়ে বেশি। কারণ সেখানে অধিকাংশ মানুষই ভিতরের হাঁড়ির খবর টের পেয়ে গিয়েছে। তাই সেখানে ভ্যাকসিন বিরোধী আন্দোলন যত জোরালো হচ্ছে। ধোপা নাপিত বন্ধের দাওয়াই তত কড়াকড়ি করা হচ্ছে। না হলেই বিপদ। ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ভ্যাকসিন মুনাফার লক্ষ্যপূরণ হবে কি উপায়ে?

ফলে ভয় আপনাকে পেতেই হবে। আপনার ভয়ই ভ্যাকসিন বাণিজ্যের পুঁজি। আর এই করোনা ভীতির পুঁজিকে দিনে দিনে বাড়িয়ে তোলার উদ্দেশে বিশ্বজুড়ে মানুষের বুকের ভিতরে করোনাতঙ্কের ভয় বাজানোর কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে মিডিয়াকে। টিভি খুললেই করোনাতঙ্ক। 
কাগজের পাতা ওল্টালেই করোনাভীতি। সাথে সরকারী দাওয়াই। সরকারী প্রকল্প। এবং সেই সাথে দ্বিতীয় ঢেউ। তৃতীয় ঢেউয়ের বন্দোবস্ত। এবং একের পর এক ঢেউয়ের মিছিল। এক একটি ভ্যারিয়েন্ট। এক একটি ঢেউ। একেবারে অভিনব স্ক্রিপ্ট। এবং প্রায় নিখুঁত। 
বিশেষ করে আমাদের মতো ঔপনিবেশিক মানসিকতার দেশগুলিতে, সাগরপারের বিলাতী ঘোষণা মানেই বেদবাক্য। সেই ঘোষণাকে সুবোধ ছাত্রের মতো মুখস্থ করা ও পালন করাকেই আমরা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করে থাকি। আর বাকিদেরকে নেহাতই বেকুব এবং অশিক্ষিত বলে ধরে নিই। এই সকল বুদ্ধিমানরাও করোনা ভীতি ছড়ানোর দায়িত্ব পালন করে চলেছে স্বেচ্ছায়। তাদের কথায় এতবড় মহামারী পৃথিবীতে আগে আসেনি কখনো। এই মহামারী ঠেকানোর একটাই পথ। ভ্যাকসিন নিয়ে যেতে থাকা। ভ্যাকসিনই মানুষের জীয়নকাঠি। আর দেশে দেশে সরকার বিনামূল্যে সেই ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে যখন। তখন ভ্যাকসিন তো নিতেই হবে। ফ্রী’তে বিষ পেলেও বোধকরি আমাদের দেশের বুদ্ধিমানেদের কোন আপত্তি নেই। এদিকে সরকার ফ্রী’তে ভ্যাকসিন দিচ্ছে না, ফ্রী’তে দেওয়ার নাম করে জনতার পকেট কেটে চলেছে। সেই সোজা হিসেবটিও বুদ্ধিমান নাগরিকদের চেতনায় ঢোকানো মুশকিল। করোনা মহামারী কোভিড অতিমারীর স্ক্রিপ্ট লিখিয়েরা এসব বিষয়ে যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল বলেই তারা এতবড় একটা প্রকল্প হাতে নিতে সাহস পেয়েছে।

ফলে একদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এক দিকে সরাসরি প্রতিটি দেশের সরকারের সাথে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক মাল্টিন্যাশানালগুলির অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি। আর এক দিকে কেনা মিডিয়া। বিশ্বজুড়ে মানুষকে ভ্যাকসিনের লাইনে বছরের পর বছর দাঁড় করিয়ে রাখার ব্যবস্থা প্রায় নিখুঁত। না, পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে মড়া পড়ে নেই। প্রতিদিন কোন না কোন আত্মীয়স্বজন বিয়োগ হয়নি কারুরই। যে দুইটি বিষয় একটি মহামারীর অন্যতম প্রধান শর্ত। তবু মানুষকে বিশ্বাস করানো গিয়েছে, কোভিড-১৯ এর মতো ভয়াবহ মহামারী বিশ্বে এই প্রথম। মানুষকে নতুন করে বিশ্বাস করানো হচ্ছে ওমনিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আরও ভয়ানক। আরও দুর্বার বেগে ধেয়ে আসছে। মানুষ বিশ্বাস করে নিয়েছে ফ্রান্সে একদিনে দুই লক্ষ আট হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছে সম্প্রতি। আমেরিকায় যে সংখ্যা একদিনেই চার লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। এরপরেই আসবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান। ডেডবডি নিয়ে বাণিজ্য শুরু হবে আরও একবার। প্রতিদিন কোন দেশে কতজন মারা যাচ্ছে। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকবো সেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা পরিসংখ্যানের দিকে। আর অধীর অস্থিরতায় অপেক্ষা করতে শুরু করে দেবো পরবর্তী বুস্টার ডোজের লাইন কোনদিকে পড়েছে জানার জন্য। একটা দুটো ডোজ শরীরে ঢুকিয়ে নিয়েই আলেকজাণ্ডারের ভারতজয়ের মতো উল্লাসে সেল্ফি পোস্ট করে দেবো সোশ্যালসাইটে। না, এই স্ক্রিপ্টের কোন বদল হবে না। ডেল্টাপর্বেও হয়নি। ওমনিক্রন পর্বেও হবে না।

স্মরণে থাকার কথা করা । গত বছরে ভারতবর্ষ জুড়ে অক্সিজেনের কৃত্রিম অভাব ঘটিয়ে মৃত্যুমিছিল ঘটানোর ঘটনাও। অক্সিজেনের অভাবে ঘটা প্রতিটি মৃত্যুকেই সরকারী হিসাবে করোনায় মৃত্যু বলে দাখিল করা হয়েছিল। সেই সাথে আরও একটি কাজ করা হয়েছিল। শহরে শহরে একাধিক শ্মশান বন্ধ করে দিয়ে একটি দুইটি খোলা রেখে ডেডবডির লাইন দেখানো গিয়েছিল। মানুষ শিহরিত হয়ে উঠে দৌড় লাগিয়েছিল ভ্যাকসিনের লাইনে দাঁড়াতে। সেই লাইনে হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি, পরস্পর গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি ভিড়েও কিন্তু সেই পরিমাণে সংক্রমণ ছড়ানো যায়নি। গেলে এতদিনে ভারতবর্ষে কোটি দশেক মানুষের জীবন চলে যাওয়ার কথা ছিল। তবুও মিডিয়া জুড়ে সরকারী ঘোষণা জুড়ে ক্রমাগত সামাজিক দূরত্ববিধির বিধান দেওয়া বন্ধ হয়নি। নি্র্বাচনী জনসভা মিটিং মিছিলে করেও সংক্রমণ হার ও মৃত্যু মিছিল তেমন করে বাড়ানো‌ যায়নি। তাই অক্সিজেনের অভাব ও শ্মশান বন্ধের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল বাধ্য হয়েই। নয়তো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাছে মুখ দেখানোর উপায় ছিল না রাষ্ট্রের।

তবে কি করোনায় মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে না? মানুষ কি মরছে না? নিশ্চয় সংক্রমিত হচ্ছে। যেমন হয়ে আসছে শত শত শতাব্দি ধরে। যেমন মারা যাচ্ছে শত শত শতাব্দি ধরে। হ্যাঁ আগে সেই পরিসংখ্যানের ডেটাবেস এইভাবে রাখা হতো না। এই ভাবে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে তার প্রচার করা হতো না। এখন হচ্ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতো প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে সর্দিকাশি জ্বরে প্রায় আট লক্ষ মানুষ মারা যায়। গত দুই বছরেও গিয়েছে। এই বছরেও যাবে। কিন্তু তার সাথে যদি অক্সিজেনের অভাবে ঘটা মৃত্যু থেকে শুরু করে হৃদরোগে মৃত্যুসহ হসপিটালের অসুস্থ রুগীদের মৃত্যুর পরিসংখ্যানও জুড়ে দেওয়া হয়। তবে সংখ্যাটিকে চার পাঁচগুন বাড়িয়ে দেখানোও সম্ভব হয়। হ্যাঁ অনেকেরই পরিচিত মানুষজন এই করোনায় মারা গিয়েছে। কিন্তু ঠিক কিসে তাদের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ সর্দি কাশি জ্বরে নিউমিনায় ভুগে প্রতি বছর বহু মানুষই যেমন মারা যায় সেইরকম, নাকি ভয়াল ভয়ানক কোভিড-১৯-এ? তার কোন প্রমাণ রয়েছে কি মানুষের হাতে? রাষ্ট্র মৃত্যুর যে কারণ প্রচার করছে। মানুষকে সেই প্রচারেই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। কারণ ডেথসার্টিফিকেটে সেই কথাই লেখা রয়েছে। ফলে সেই ভয়াল ভয়ঙ্কর ভয়ানক করোনায় মৃত্যু বলে ধরে নেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কোন উপায়ও নাই।

এই উপায়হীনতার সুযোগটাকেই বিশ্ববন্দোবস্ত বানিয়ে ফেলার নাম নিউনর্ম্যাল। মিডিয়া ও রাষ্ট্র যা প্রচার করবে। যে বন্দোবস্তের পক্ষে ওকালতি করবে। সেটাকেই নিউ নর্ম্যাল বলে মেনে নিতে হবে মানুষকে। তার হাতে অন্য কোন উপায় নাই আর। মেনে নেওয়া ছাড়া। না হলেই ধোপা নাপিত বন্ধ। বাংলার ধোপা নাপিত বন্ধের সেই আবহমান ঐতিহ্য এখন নিউ নর্ম্যাল রূপ নিয়ে বিশ্ববন্দোবস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বাঙালি হিসাবে গর্ব বোধ করতে পারেন বৈকি! করুন না করুন এটাই বাস্তব বর্তমানে। আর সেই বাস্তবতার দুই বছর পার করে আমরা আজ ২০২২শে এসে পৌঁছিয়ে গেলাম। এই নিউ নর্ম্যালের আরও বহু রকমের ণত্ব ও ষত্বের সাথে আমাদের পরিচয় হতে থাকবে এই বছরে। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকবে প্যান্ডেমিক স্ক্রিপ্টের পরবর্তী সিনগুলি।

আর অন্যদিকে বিশ্বজনসংখ্যার মাথাপিছু ভ্যাকসিন ডোজের মুনাফা জড়ো হতে থাকবে হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পপতির সিন্দুকে। এক একটি ভ্যারেয়িন্ট। নতুন করে এক একটি ওয়েভ। এখানে লকডাউন তো ওখানে লকডাউন। এবং বুস্টার ডোজের পর বুস্টার ডোজ। মানুষের লাইন যত দীর্ঘ হতে থাকবে। প্যানডেমিক স্ক্রিপ্টের সাফল্য ততই নিশ্চিত হতে থাকবে। প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্র এই প্যানডেমিক স্ক্রিপ্টের কাছে নিজ নিজ দেশকে বন্ধক রেখে দিয়েছে। আর স্বদেশবাসীকে ভ্যাকসিন বাণিজ্যের কাস্টমার করে তুলেছে। বেকুব জনতাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সরকারী কর বৃদ্ধি করে দিয়ে বিনামূল্যের ভ্যাকসিনের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মানুষ খুশি। সরকার খুশি। শিল্পপতি খুশি।

না, তাই বলে প্যানডেমিক স্ক্রিপ্টের এখানেই শেষ নয়। এই স্ক্রিপ্টে করোনার সাথে শুধু ভ্যাকসিনই জুড়ে নেই। জুড়ে রয়েছে ফাইভ-জি টেকনলজিও। যে পর্বের ঢেউ আমাদের জীবনে এসে পৌঁছাতে আরও কিছু দিন বাকি রয়েছে। অলিতে গলিতে ফাইভ-জি টাওয়ার। আর হাতে হাতে ফাইভ-জি মোবাইল হ্যাণ্ডসেট এসে পৌঁছালেই শুরু হয়ে যাবে প্যানডেমিক স্ক্রিপ্টের দ্বিতীয় অধ্যায়। যার পেটেন্ট নিয়ে রেখেছেন বিল গেটস স্বয়ং। দ্য মাস্টারমাইণ্ড অফ দ্য টোটাল গেম। গোটা দুনিয়াই তখন তার হাতের মুঠোয় এসে যাবে। করোনা-ভ্যাকসিন-নিউ নরম্যাল-ফাইভ-জি টেকনোলজি। সব এক সুতোয় বাঁধা। যে সুতোর অপর প্রান্তে রয়েছে গাভি-হু-রাষ্ট্রযন্ত্র আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন জনতা। সুতোর মালিকানা যাদের হাতে, প্যানডেমিক স্ক্রিপ্টের তারাই রচয়িতা। অনেকেই জানেন না এইসব। তাঁরা নিশ্চিন্তে রয়েছেন। কেউ কেউ জানতে পেরে গিয়েছে। তাঁদের রাতের ঘুম ছুটে গিয়েছে। কিন্তু তাঁরা সংখ্যালঘু। তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। আর মাঝখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পেইড মিডিয়া।


১লা জানুয়ারী’ ২০২২
©কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ