✓১
বর্ষা এসে গেছে। মেঘলা আকাশ। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। নতুন স্করপিওটা নিয়ে গ্রামের রাস্তায় কাদা ছিটিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো শিশির। মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে মহুয়া হাতে একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে কোথায় চলেছে। শিশির ডাকলো “চিনতে পারছো? আজ আর আপত্তি কোরো না! উঠে এসো! বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি!” “না, না থাক! এইটুকু রাস্তা আমি দিব্বি চলে যেতে পারবো।“ কেমন কুঁকড়ে উঠে বলে মহুয়া, যেন শিশির অচ্ছুৎ! শিশির চোখ ফেরাতে পারে না মহুয়ার থেকে। কিছু এমন অপূর্ব সুন্দরী নয় মহুয়া। শ্যামলা গায়ের রঙ। মাথায় ঘন কোঁকড়া চুলে লম্বা বেণী। সাধারণ একটা হলুদ সালোয়ার কামিজ আর লাল ওড়না। মুখ মাস্কে ঢাকা। কাজল কালো বড় বড় দুটো চোখ আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! কিন্তু তাতেই কেমন পরীর মতো লাগছে মহুয়াকে! এতো মেয়ে ঘাঁটা শিশির, যে মেয়েদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবে না, সে যে কেন মহুয়াকে দেখলেই এমন ভ্যাবলা হয়ে পড়ে কে জানে? নামানো মাস্কটা টেনে তুলে নিঃশব্দে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যায়। নাঃ মহুয়াকে জোর করবে না শিশির।
শিশিরের বাবা শিবেন মন্ডল বসিরহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধাণ। পার্টির একজন হর্তাকত্তা! বিশাল পয়সা করেছে গত দশ বছরে। কীভাবে তা কেউ জানে না। লোকে বলে বর্ডার দিয়ে লোক পার করে এনে নাগরিকত্বের সব বন্দোবস্তো করে দেয় শিবেন। বদলে লোকপিছু পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা নেয়। গ্রামে বাড়ি করেছে। প্রচুর চাষের জমি কিনেছে! শিবেন যাদের এনে বসিয়েছে বর্ডার পার থেকে, তারাই কয়েকজন ওর জমি চাষ করে।
শিশিরের একটুও সুনাম নেই গ্রামে। ওকে কলেজে পড়তে কলকাতা পাঠিয়েছিলো শিবেন। হাতে দেদার পয়সা। পড়াশোনা শেষ করেছে কি না কেউ জানে না। কিন্তু নাইট ক্লাব, মদ, মেয়েমানুষ সব অভ্যাসই ছিলো। কলেজের বেশ কটি মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতো শিশির। তাদের একজন নাকি পোয়াতি হয়ে পড়ায় গা ঢাকা দিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। এখন পার্টির কাজকর্ম দেখে। মিটিং মিছিলে ভাগ নেয়। গ্রামে সবাই ওকে সমঝে চলে। গরীব মানুষের তো পঞ্চায়েত ছাড়া গতি নেই! ফ্রিতে নাকি করোনার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করছে পঞ্চায়েত! লকডাউনে চাল ডালও নাকি ফ্রিতে ব্যবস্থা করবে। তাই শিবেন আর শিশিরকে কেউ ঘাঁটায় না।
✓২
গ্রামের মানুষের এখন বড় দুরবস্থা। চাষ করে ফসল বেচার উপায় নেই। জেলে তাঁতি মজুরেরও কাজ লকডাউনে বন্ধ। বাইরে থেকে শ্রমিকরা ফিরে এসেছে। গ্রামের মানুষের খাওয়া জুটছে না। ঘরে ঘরে সর্দি কাশী! যারা বাড়িতে থেকে সেরে উঠছে, ভালো। কিন্তু যাদের শ্বাসকষ্ট ধরেছে, তারা পঞ্চায়েতকে ধরে করে যদি বা শহরের সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে, সেখান থেকে আর ফিরছে না বেশীরভাগই। মানুষ আতঙ্কে বাস করছে!
পঞ্চায়েত অফিসে, পার্টি থেকে প্রচুর চাল ডাল এসেছে ফ্রিতে বিলি করার জন্য। ছেলেরা সকাল থেকে প্যাকেট করেছে সে সব। শিশির, শিবেনের নির্দেশে বেশ কয়েক বস্তা চাল ডাল সরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু গ্রামের মানুষকে একেবারে বঞ্চিত করার মতো খারাপ লোক নয় তারা। সকালে মেলা লোক ভীড় করেছে পঞ্চায়েত অফিসের সামনে। দানের চালডালের জন্য। শিশির চালডাল বিলি করতে ঘেমে নেয়ে একশা! এসিতে থাকার অভ্যাস! সকাল থেকে মেঘলা আকাশ, ভ্যাপসা গরম! হঠাৎ লাইনে মহুয়াকে চোখে পড়তেই ঘামটাম মুছে পাঞ্জাবীটা ঠিকঠাক করে চুলটা আঁচড়ে দাঁড়ালো শিশির। চাল ডাল বিলিতে আর মন নেই। চোখ সেই মহুয়ার দিকে। মহুয়া সামনে আসতেই একটার জায়গায় তিনটে প্যাকেট ধরিয়ে দেয় শিশির। বলে “কষ্ট করে লাইনে দাঁড়াবার কী দরকার ছিলো? বললে তো বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম! একবার চোখ তুলে তাকানোও যায় না? পারলে বিকেলে ইছামতীর ধারে এসো।”মহুয়ার চোখে চোখ রাখলো শিশির!
লাইনে সবাই উসখুস করছে। মৃদু গুঞ্জন, হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছে। শিশিরের হুঁশ নেই! মহুয়ার মুখে থেকে সব রঙ সরে গেছে! সে ভালোই বুঝতে পারছে যে সে ফাঁদে পড়া হরিণ! তার মাংস না খেয়ে ছাড়বে না শিশির! ভিতরের জ্বলন্ত রাগ দেখাবার কোন উপায় নেই। শান্তভাবে মহুয়া বলে “বিকেলে রান্না আছে। সময় হবে না। বেলা হলো – বাবা অপেক্ষা করছে – যাই।“
সেই মূহূর্তেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো! লাইন ভেঙ্গে গেলো! পঞ্চায়েত অফিসের চাতালে অপেক্ষা করা ছাড়া মহুয়ার উপায় নেই! শিশির একটা চেয়ার পরিষ্কার করে মহুয়াকে বসায়। লোকজনের ভীড় সরে গেলে এসে বসে মহুয়ার পাশে। বলে “তুমি আমাকে কী ভাবো বলতো? আমি কি বাঘ যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো?” মহুয়া সিঁটিয়ে বসে থাকে! বেশ বুঝতে পারে শিকারকে ফাঁদে ফেলার জন্য যে কোন উপায়ে বশ করবে শিশির মিষ্টি কথা বলে। তারপর ওর শরীরটা ভোগ করে ছিবড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেবে, যেমন দিয়েছে শহরের কতো মেয়েকে! কেন সবাইকে ছেড়ে ওর পিছনে লাগলো শিশির? বাবা গ্রামের প্রাইমারী স্কুল টিচার! এখন স্কুল বন্ধ! বাবা মাইনে পায়নি দু’মাস। মা পাঁপড় বড়ি বিক্রি করতো, তাও বন্ধ। বাড়িতে ছোট ভাই! ও নিজে হায়ার সেকন্ডারী পাশ করেছে। ইচ্ছা ছিলো নার্সিং এ ভর্তি হবে। কিন্তু এই মহামারীতে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়ির যা অবস্থা! তবু যতক্ষণ পারা যায় লড়াই করবে মহুয়া। অতো সহজে শিকার করা যাবে না ওকে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। উঠে হনহন করে বাড়ির দিকে রওনা হয় মহুয়া। শিশির মুখ কালো করে তাকিয়ে থাকে।
✓৩
প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে! একফোঁটা সময় পাচ্ছে না শিবেন আর শিশির! সামনেই পঞ্চায়েত ভোট! শিশিরকে পার্টির টিকিট জোগাড় করে দিতে শিবেন এখন চারিদিকে দরবার করে বেড়াচ্ছে! বিরোধীরা বড় হল্লা করছে! কোনদিন এন আর সি চালু করে দেয় তার ঠিক নেই! নানা চিন্তায় শিবেনের ঘুম নেই।
সেদিন সকাল থেকে অঝোরে নিম্নচাপের বৃষ্টি! বিকেলের দিকে অনেকদিন পর আসর বসিয়েছিলো শিশির! শহর থেকে ভালো মাল এসেছে! বন্ধুদের ফোন করে ডেকে নিয়েছিলো। এই সময় খুব ভালো ইলিশ আসে বর্ডারের ওপার থেকে! ইলিশ মাছ ভাজার সঙ্গে দারুণ আড্ডা জমেছে! এমন দিনে একখানা পরী না হলে মানায়? ওপারের কিছু সরেশ মাগী নাকি এপারে এসে বাসা বেঁধেছে বেশী টাকার লোভে! তার মধ্যে জন্নতের নাম খুব রটেছে! পরীর মতো সুন্দরী আর নাচ জানে! শিশিরের মেজাজটা কয়েক পেগের পর বেশ ফুরফুরে হয়ে গেলো! হঠাত বন্ধুদের বললো “চল! জন্নতের বাসা থেকে ঘুরে আসি আজ! গা নিশপিশ করছে!” “তুমি যাবে কেন গুরু কষ্ট করে? বললে তোমার পায়ে এনে ফেলে দেবো শালীকে!” দল বেঁধে বেরিয়ে গেলো বন্ধুর দল। বেশী দূর নয়! বসিরহাট বাজারে বাসা বেঁধেছে জন্নত! আধ ঘন্টার বেশী লাগার কথা নয়। দর যাই লাগুক দেবে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলে! বন্ধুদের দেখা নেই! রাত বাড়ে! নেশাটা ছানা কেটে যায় শিশিরের! তাও কারো দেখা নেই। অস্থির হয়ে ফোন করে শিশির! বহুবার করার পর একটা গম্ভীর গলা শোনা যায় “এটা পুলিশ স্টেশন! যার ফোন সে হাজতে!” “কেন?” চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে শিশির! “মাগীবাজি করবে আর পুলিশ কি আদর করবে? ওখানে আজকে রেড হয়েছে! ওপার থেকে এসে বেআইনী বেশ্যাখানা খুলে বসেছে। সবকটাকে তুলে এনেছি!” প্রমাদ গণে শিশির! বাপকে এ সব বলাই বিপদ! কাল পার্টিকে বলে যদি এদের ছাড়ানো যায়! শালারা দিলো সন্ধেটা কিচাইন করে! বৃষ্টিটা সন্ধে থেকে ধরেছিলো, আবার চেপে এলো! রাত বাড়ে! ক্লান্ত হয়ে সোফার ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ে শিশির! গভীর রাতে হঠাত বাড়ির দরজায় পাগলের মতো ধাক্কা! শিশিরের মা মারা গেছেন বেশ কিছুদিন। আজ শিবেন শহরে গেছে। বাড়িতে শিশির একা। মহফিল বসাবে বলে চাকরবাকরকে ছুটি দিয়েছে। বুকটা হঠাত ধড়াস করে উঠলো! যদিও ভূতে মোটেই বিশ্বাস করে না, তবু গ্রামগঞ্জ জায়গা!
বিপক্ষের ছেলেপুলে? শিশির একা আছে জেনে লাঠিপেটা করতে এলো না তো! আজকাল মারামারি গোলাগুলি খুব বেড়ে গেছে এই অঞ্চলে! কিছুতেই দরজা খোলা যাবে না! কিন্তু ও তো মেয়েছেলের গলার আওয়াজ! কানে কি ভুল শুনছে? নেশা তো কেটে গেছে! শুনেছে গ্রামের দিকে রাতে নিশি ডাকে! রাম নাম জপতে শুরু করে শিশির! গলাটা চেনা লাগছে কেমন! “শিশিরদা, আমি মহুয়া – একটু দরজাটা খুলুন প্লিজ!” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না শিশির! যে মেয়ে দিনেরবেলা একটা কথার উত্তর দেয় না সে কি না এই বৃষ্টির রাতে সেধে আসবে তার বাড়ি! “শিশিরদা দিব্যি খেয়ে বলছি, বড় বিপদ – আপনার পায়ে পড়ি!” আওয়াজ বেড়ে চলে! বাধ্য হয়ে আলোটা জ্বেলে দরজার আইহোলে চোখ লাগায় শিশির! সত্যিই তো মহুয়া! চুপসে ভেজা! পিছনে আবার কেউ নেই তো! বহুদিনের অভ্যাসে ড্রয়ার থেকে লাইসেন্সড ছোট রিভলবারটা হাতে ধরে দরজা খোলে শিশির! মূহূর্তে ঘরে ঢুকে হাঁফাতে থাকে মহুয়া! পাগলের মতো কাঁপছে! তাড়াতাড়ি একটা চাদর আর গামছা এনে দেয়! বলে “পাশেই বাথরুম! মাথাটা মুছে জামা ছেড়ে এই চাদরটা মুড়ি দিয়ে এসো।“ খানিক পরে চাদরে শরীর জড়িয়ে আসে মহুয়া। বিস্মিত শিশির বলে “কী ব্যাপার! এই সময় আমার কাছে!” “বাবা আজ মারা গেছেন করোনায়! গতো পনেরো দিন ধরে বাবা মা দুজনেই অসুস্থ! বাড়িতেই যা পারি করছিলাম! ভেবেছিলাম সেরে উঠবে! হঠাত বাবার আজ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়! কিছু করার আগেই সব শেষ! মার প্রচন্ড ডায়রিয়া! আজ কালের মধ্যে হয়তো মাও –“ “তুমি একবার বললে পঞ্চায়েত থেকে হাসপাতালের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতো –“ “না না, আমরা কারো দয়া নিতে চাই না! হাসপাতালে দেওয়ার পয়সা আমাদের নেই!” “দয়া কেন? গভর্নমেন্ট হাসপাতাল তো ফ্রি!” “ভেবেছিলাম সবাই সেরে ওঠে – বাবা মাও সেরে উঠবে” “এখন কী চাও?” “বাবাকে দাহ করার কেউ নেই! শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার মতো টাকাও নেই! আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন কিছু! বদলে – বদলে আপনি তো আমাকে চেয়েছিলেন! আপনি যে ভাবে চান আজ রাতে পাবেন আমাকে! আমার কাছে দেবার মতো আর কিছু নেই!” চাদরটা দেহ থেকে সরিয়ে দাঁড়ালো মহুয়া! কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো অপূর্ব একটি নারী শরীর শিশিরের সামনে! অনেক নারীকে ভোগ করেছে শিশির! কিন্তু শিশিরের মনে হলো এমন পবিত্র শরীর সে আগে দেখেনি! এ কি বাস্তব? না কি কোন পরী তার সামনে? অবদমিত বাসনা থেকে সে মহুয়ার নগ্ন মূর্তি দেখছে স্বপ্নে? কাঁপা গলায় শিশির বলে “তোমাকে চেয়েছি ঠিকই – কিন্তু এ ভাবে তো চাইনি! আমি জানি তুমি আমার সম্বন্ধে অনেক খারাপ কথা শুনেছো। আমি মদ মেয়েমানুষ নেশা কিছুই বাদ দিই না – যা শুনেছো সব সত্যি! কিন্তু তোমাকে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে – তেমনি পবিত্র! তোমাকে কিছুতেই অন্যায় ভাবে পেতে পারবো না।“ “কিন্তু আমি তো নিজেই এসেছি –দয়া করে আমাকে নিন – আর বদলে আমার বাবার শেষকৃত্য, আমার মা–“ অসহ্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মহুয়া। “দাঁড়াও তোমাকে আমার মায়ের একটা শাড়ি ব্লাউস এনে দিই! হাতে সময় খুব কম! পঞ্চায়েতে বলে তোমার বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার লোক জোগাড় করতে হবে আর তোমার মা কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে! পরী, তুমি আমারই থাকবে – আমি জানি!” সেই কষ্টিপাথরের মতো শরীরে আদরে একবার হাত বোলায় শিশির – অনুভব করে স্ফীত ইষদোন্নত স্তনযুগলের কাঠিন্য! ইছামতীর মতো কোমরের বাঁক! তারপর নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মায়ের শাড়িতে মহুয়াকে ঢেকে দেয়!
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন