সুমনা সাহা | বিহন বেলা

মিছিল

আজ সকাল থেকে বাঁ চোখ নাচছে। কিছু একটা হবে আজ। সেটা ভালো কিছু। মা বলত, মেয়েদের বাম অঙ্গ শুভ, আর ছেলেদের দক্ষিণ অঙ্গ। মেয়েদের ডান চোখ, ডান ভুরু নাচলে সংসারে ঝগড়া অশান্তি হয়। কিন্তু বাম দিকের হলে ভালো, প্রিয় দর্শন ঘটে। ঝিমলির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। কে আমার প্রিয়? কাকে দেখলে খুশী হবো আমি? এই বিহন-বেলায় নতুন কি আর ঘটবে জীবনে? আপন মনে গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে সে, ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে যেন আমায়...কে ডাকে আয় চলে আয়!’।

কলঘরে জলের শব্দ। সাজু স্নান করছে। সকালে কর্পোরেশনের টাইমকলে জল এলে ভরে রাখা হয়। সাজু তাতেই স্নান করে নেয়। দুপুর বারোটায় আরেকবার জল আসবে। তখন টাটকা জলে ঝিমলি স্নান করে। সাজুর আজ বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণ। ও আজ ঘরে খাবে না। সাজুর বাবা দোকান থেকে আসবে দেড়টার সময়। ততক্ষণে একবার ফেসবুক ঘুরে নিই, ভাবে ঝিমলি। তার আগে কটা সেলফি তোলে। রান্না হয়ে গেছে। আজ সে রান্না করেছে লাউ দিয়ে মুগের ডাল, উচ্ছে ভাজা আর ফুলকপি-আলুর তরকারি। ঢাকনা সরিয়ে রান্নাগুলোরও ছবি তুলল। পোস্ট করে দিল ফেসবুকে। ঝিমলির অনেক ফলোয়ার। ও ঠাকুরের সব ভালো ভালো কথা পোস্ট করে। সেগুলো বেশী লাইক পায় না। তবে ওর নিজের সেলফিতে লাইক ওয়ান-কে ছাড়িয়ে যায়। ঝিমলি বুকের আঁচল সরিয়ে হাওয়া লাগায় গায়ে। টেবিল ফ্যানটা ঘুরে ঘুরে হাওয়া করছে। পাশের আয়নায় আনমনে চোখ চলে যায়। ঈষৎ কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা নিজের শরীরটা দেখে নিজেরই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মুখে কালো ছোপ পড়ে গেলেও গায়ের ভিতর ভাগ, বুকে-পেটে এখনও সোনা গলানো আভা! লাল স্লিভলেস ব্লাউজের মধ্যে দিয়ে উঁকি দেওয়া পরিপূর্ণ দুটি শ্রীফলের মতো স্তন...ঝিমলি সেলফি না তুলে থাকতে পারে না! কলঘরের দরজা খোলার শব্দ। সাজু চান করে বেরোল। চটপট কয়েকটা ছবি ডিলিট করে ঝিমলি। একটা রুদ্ধ শ্বাস বাইরে আসে, ‘ধুস্, এসব কি হবে? এগুলো তো কোথাও পোস্টও করা যাবে না!’ মনে একটা বিশ্রী চিন্তা হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এমন সুন্দর শরীরটা শেষমেষ আগুনে পুড়িয়ে ফেলবে?

‘সাজু, জল এসেছে রে?’

‘হ্যাঁ মা, সরু করে আসতে শুরু করেছে। তুমি চান করবে তো করে নাও। আমি তারপরেই বেরোব।’

কলঘরে ঢুকেই খেয়াল হয়, মোবাইলটা আনিনি। ঝিমলি তার মোবাইল এক মুহূর্তের জন্যেও কাছ ছাড়া করে না। শায়াটা বুক পর্যন্ত টেনে তুলে গায়ে চাদরের মত করে গামছা জড়িয়ে দৌড়ে কলঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে উঠোনের সামনের করিডোরে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। ‘মা গো! মরে গেলাম!’ চিৎকার শুনেই সাজু দৌড়ে আসে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কাতর কণ্ঠে ঝিমলি বলে, ‘সাজু, এই পড়ে যাওয়া অবস্থায় আমার একটা ছবি তোল্ তো!’

সাজু একটু অবাক হয়। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করে না। ভারি শান্ত আর বাধ্য সে মায়ের। ছুটে গিয়ে ঘর থেকে মায়ের মোবাইল আনে, পটাপট কয়েকটা ছবিও তুলে দেয়। তারপর মাকে ধরে তুলতে গেলে হাত ধরতেই ঝিমলি ত্রাহি চিৎকার করে ওঠে। বাঁ দিকে কাৎ হয়ে পড়েছে ও, মনে হয় বাঁ হাতের হাড় ভেঙেছে!

অরূপ এল তড়িঘড়ি দোকানের ঝাপ বন্ধ করে। বিক্রিবাটা কিছুই নেই এই করোনার বাজারে। তবুও নমো নমো করে দোকান খুলে রাখা। দূরপাল্লার রেলের ও ফ্লাইটের টিকিট বুকিং-এর একটা ছোট্ট দোকান। এমনিতেই এখন অনলাইন বুকিং-এর সুবিধা হয়ে গেছে, ঘরে ঘরে কম্প্যুটার এমনকি মোবাইলেও লোকে টিকিট বুক করে ফেলছে। পুরনো দিনের কিছু মানুষ এখনও যারা আধুনিক গ্যাজেট ব্যবহারে সড়গড় হয়নি, আবার লাইন দিয়ে টিকিট কাটার প্রাণশক্তি নেই, বা এজেন্টকে টাকা দিয়েও টিকিট বুক করাতে চায় না, তাঁরা অরূপের কাছে আসেন। অরূপের ব্যবহার অমায়িক, ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। তার লোভ নেই কোনকিছুরই। যা হোক করে দিন কেটে গেলেই হল। কয়েকজন পরিচিত লোকজনের দৌলতেই আজও টিমটিম করে টিঁকে আছে তার ব্যবসা। ঝিমলি পাড়ারই মেয়ে। বন্ধুর বোন। একসাথে ক্রিকেট ম্যাচ খেলত অরূপ আর ঝিমলির দাদা বিকাশ। বিকাশই তাকে ঝিমলির সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ঝিমলিকে দেখেছে ছোটবেলা থেকেই। ভাল মেয়ে। দেখতেও সুন্দর। গ্রাজুয়েশনের পরেই যখন একটু আধটু চাকরির চেষ্টা চলছে, হঠাৎ করে বাবা চলে গেলেন। তখন বাধ্য হয়েই বাবার দোকান সামালানোর দায় এসে পড়ল। ভাই তখনও পড়ছে। বোন আরও ছোট। বিধবা মা, আর ভাইবোন দুটোর মুখ চেয়ে সংসারের সুরাহা হবে ভেবেই বিকাশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। ঝিমলি তখন সবে বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়েছে। ওর কোন হাই ফাই অ্যাম্বিশন ছিল না। বাপের বাড়ির কাছে থাকতে পারবে এই আনন্দেই ও রাজি হয়ে যায়। আর দাদার বন্ধু লাজুক অরূপদাকে তো চিনতই। শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক পাওয়া থোক কিছু টাকা দিয়ে অরূপ ওদের পুরনো চল্টা ওঠা বাড়িটাকে হোয়াইট সিমেন্টের জাদুতে মনোহর রূপ দিয়ে ফেলল। ঢলঢলে লাবণ্য নিয়ে নতুন বৌ হয়ে ঝিমলি যখন আলতায় রাঙানো পা দুখানা অরূপের বাড়ির উঠোনে রেখেছিল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল অরূপ, “সারাজীবন তোমাকে আগলে রাখব ঝুমি!” ঝিমলি হলও ‘নো কমপ্লেন’ বৌমা ও বৌদি। কোন দাবীদাওয়া তার নেই। কেবল একটু সাজুগুজু করতে ভালবাসে। মা-ও বললেন, “তা সাজবে বৈকি বৌমা! তোমায় দেখতে এমন টুকটুকে, না সাজলে আমাদেরই ভাল লাগবে না যে!”

সেই থেকে, প্রতিদিন দোকান বন্ধ করে আসার সময় অরূপ হয় সেন্ট, নয় লিপস্টিক, বা আলতা-সিঁদুর, কিম্বা স্নো, কোন কোন দিন সুন্দর লেস বসানো ব্রা—এইসব নিয়ে আসে বৌয়ের জন্য। ঝিমলি তাতেই আহ্লাদে আটখানা। সংসারটাকে প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছে ঝিমলি, বুক দিয়ে আগলেছে। বিয়ে করে চাকরি পেয়ে স্বরূপ বৌ নিয়ে চলে গেল হরিয়ানা। বোন মাধুরীর বিয়ে হয়েছে দুটো স্টপেজ দূরে। সে আসে এখনো প্রায়ই। বছর চারেক আগে মা চলে গেলেন। ঝিমলি এবছর জুলাইয়ে পঞ্চাশে পড়েছে। অরূপের চোখে এখনও সে একই রকম সুন্দরী!

সারাটা দিন ঝড় বয়ে গেল। স্থানীয় নার্সিং হোম কোনও দায়িত্ব নিল না। হাতের এক্স-রে করিয়ে ব্যথার ওষুধ দিয়ে হাতে স্লিং ঝুলিয়ে বড় হাসপাতালে রেফার করে দিল। এক্স-রে রিপোর্ট আসতে দেখা গেল, কনুইয়ের নিচে হাড় ফেটে গেছে, একটা ছোট্ট অপারেশন করে স্টিলের পাত বসানো হবে। অবশেষে অনেক দৌড়াদৌড়ির পর একটা নার্সিং হোমে এডমিট করানো গেল। বাড়ি থেকে একটু দূরে। ঝিমলির রাত্রে পরবার নাইটি ও টুকিটাকি জিনিস দিয়ে সব ফর্মালিটি সেরে অরূপ আর সাজু যখন বাড়ি গেল, তখন রাত এগারোটা। বাপ-বেটা কারোই খাওয়া হয়নি। ঝিমলির সকালে রেঁধে রাখা রান্না অমৃত জ্ঞানে দুজনে চেটেপুটে খেল। আবার সকাল সকালই যেতে হবে নার্সিং হোমে।

নার্স ঝিমলির কাপড় ছাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে মোবাইলটা হাতে দিয়ে শাসনের সুরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে বলে চলে গেলেন। রাতের আয়া আসেনি এখনো। ডিউটি শিফট হবে। এখনই এসে পড়বে, তার আগে ঝিমলি চটপট ফেসবুকে সংবাদটা ছড়িয়ে দেয়। সঙ্গে আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়া ছবি। আহ্! সারাদিন পরে ফেসবুকে ঢুকে যেন প্রাণটা জুড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য রি-অ্যাকশান আসতে শুরু করল, “আহা রে!’ ‘ইস, কি করে হল?’ ‘গেট ওয়েল সুন, ঠাকুরের কৃপায় সব ঠিক হবে’... ইত্যাদি মেসেজে ঝিমলির মনোবলটা বাড়ল। এক কোনে একটা মুখ, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, দিব্যা সান্যাল! ঝিমলির বুকের ভিতর যেন একশটা প্রজাপতি নেচে উঠল। ‘ওমা! দিব্যা!’ সঙ্গে সঙ্গে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করল ও।

আয়া ঢুকল। “ফোনটা সুইচ অফ করে দিন ম্যাডাম। ওটা আমি ড্রয়ারে রেখে দেব। অপারেশন হয়ে গেলে আপনাকে দেওয়া হবে।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি, আত্মীয়দের একটু খবর দিচ্ছিলাম।”

“ওদের আপনার বাড়ির লোক খবর দেবে। আপনি এখন রিলাক্সড থাকুন।”

ঝিমলি দ্রুত নিজের ফোন নম্বর দিব্যার ইনবক্সে দিয়ে সংক্ষেপে লিখল, “আমি হাত ভেঙে নার্সিং হোমে। তুই এখন কোথায় আছিস? কেমন আছিস?” নার্সিং হোমের নামটাও লিখে দিল। এবার আয়াদিদিকে ফোনটা দিয়ে বলে, “নাও, রেখে দাও।”

এত দুঃখের মধ্যেও ঝিমলির হাসি পায়। “বাঁ চোখ নাচা তবে এইভাবে ফলল! দিব্যাকে দেখলাম! সে-ও ফেসবুকে!”

ঝিমলির অপারেশন হয়ে গেল। হাতের ভিতরে একটা ছোট্ট স্টিলের পাত ঢুকেছে। হাতটা থেকে থেকে টনটন করে ওঠে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, “হাতের এক্সারসাইজ করবেন। ব্যথা করলেও ঐ হাতেই কাজ করতে চেষ্টা করবেন। নয়তো হাত স্টিফ হয়ে যাবে। অরূপ তাই পাঁচ কেজি আটা কিনেছে। বলল, “ঝিমলি, এবার থেকে রাত্রে রুটি খাব। স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, আর তোমার হাতের নাড়াচাড়াও হবে।” অরূপ, সাজু ওরা কোনদিনই রুটি পছন্দ করে না, সকাল সন্ধ্যে ভাতই রান্না হয়। কিন্তু ঝিমলির হাতের জন্য এবার আটা এল ঘরে। ইতিমধ্যে দিব্যার সঙ্গে ভাব বেশ জমে উঠেছে। ও রোজ ফোন করে। রাত্রের দিকে। এছাড়া ওর সময় হয় না। ও এখন একটা নিউজ চ্যানেলের এডিটর। খুবই ব্যস্ত জীবন। আর গৃহবধূ ঝিমলিরও সারাদিনের কাজের শেষে রাত্রেই অবসর হয়। দুই সখীতে মনের প্রাণের কত কথা হয়। দিব্যা ঝিমলিকে নার্সিং হোমে দেখতে এসেছিল। তখন একটা বই এনেছিল, ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’, বলেছিল, শুয়ে শুয়ে পাতা ওলটাস, ভাল লাগবে।” বইটা পড়তে পড়তে ঝিমলি হারিয়ে যায়। সারাদিন মনের মধ্যে ঘোর লেগে থাকে। ফোনেও দিব্যা শ্রীরামকৃষ্ণের কথা, সারদা মায়ের অপূর্ব মাতৃস্নেহের কথা, স্বামী বিবেকানন্দের পরিব্রাজক জীবনের কথা, নিবেদিতার ত্যাগের কথা, বিদেশ থেকে সব ছেড়েছুড়ে ভারতে এসে মেয়েদের জন্য স্কুল করার কথা, তাঁর লড়াইয়ের কথা বলে। ওর বলার মধ্যে এমন সুন্দর একটা ভঙ্গি আছে ঝিমলি যেন ছবির মতো সব কিছু দেখতে পায়। আজকাল ওর ফেসবুকের আকর্ষণও কমে এসেছে। আগে পোস্ট করত বটে ঠাকুর-দেবতার কথা, সেসব এদিক ওদিক থেকে সংগ্রহ করা, পরের মুখে ঝাল খাওয়া। সত্যি বলতে কি, বইপত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক একরকম ঘুচেই গিয়েছিল বিয়ের পর থেকে। কিন্তু এখন সারদা-মায়ের বই পড়ছে, সব সময় মনে হয় যেন সে বাগবাজারে মায়ের কাছে গিয়েছে, মানস সান্নিধ্য কল্পনা করে আর মন ভরে যায়। দিব্যা ফোন করলে ঝিমলি রোজই বলে, “দিব্যা, তোর তো গাড়ি আছে, একবার আয় না! তোকে দেখতে বড় সাধ হয়। আগের মতো আমরা একসাথে বসে একটু গল্প করব। যেদিন আসবি, একটু আগে থেকে বলবি, তোর অরূপদাকে দিয়ে তোর ফেবারিট পাবদা মাছ আনাবো। দুপুরে দুটো খাবি আমাদের গরীবের ভাঙা ঘরে।”

আজ সকালে আবার ঝিমলির বাঁ ভ্রূ কাঁপে। “ও মা গো! আবার কি হবে গো!” সাড়ে দশটার দিকে দিব্যার ফোন। “কিরে, এই সময় ফোন করলি কেন? এখন রান্না করি, তুই তো জানিস!” দিব্যা বলে, “কোন্ গলির মধ্যে ঢুকে বসে আছিস বল্ তো? কখন থেকে গাড়ি নিয়ে ঘুরছি। খুঁজেই পাচ্ছি না!” ঝিমলি হৈ হৈ করে ওঠে। “ও মা! দেখ কাণ্ড! কতবার বলেছি খবর দিয়ে আসবি। সাজু গিয়ে গলির মোড় থেকে তোকে নিয়ে আসবে। তুই কোথায়, শিগগির বল। সাজুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমাদের গলিতে কিন্তু গাড়ি ঢুকবে না। অমিয়দের বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে তোকে হেঁটে আসতে হবে। আচ্ছা, মৌচাক মিষ্টির দোকানের সামনে? ঠিক আছে, ওখানেই অপেক্ষা কর। সাজুকে পাঠাচ্ছি। সাজুউউ, যা তো বাবা, মাসিমণিকে নিয়ে আয় গিয়ে!”

আজ ৩০ বছর পর দিব্যার সঙ্গে দেখা! পরনে সাদা সিল্কের কুর্তি, লাল-প্রিন্টেড কেপরি, চোখে রোদ-চশমা। আগের থেকে অনেক ভারী হয়েছে, কিন্তু চেহারায় একটা কমনীয় গাম্ভীর্য, আর চলনে বলনে একটা ধীর ভাব এসেছে। ঝিমলি যেন ওর কাছে অনেক ছেলেমানুষ। অনেক ফল, মিষ্টি, বই এনেছে। ঝিমলি ওকে উঠোনে দাঁড়াতে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। আর এক নিমেষে পৌঁছে যায় আমগাছের ছায়া ঘেরা মুর্শিদাবাদের সেই বিরাট সাদা বাড়িতে।

প্রত্যেক বছর গরমের ছুটিতে ঝিমলি মায়ের সঙ্গে যেত মুর্শিদাবাদের খাগড়ায় ওদের মামাবাড়িতে। ওখানেই পাশের মুখার্জি বাড়ির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া দিব্যার সঙ্গে বন্ধুত্ব। দুই বান্ধবীর গরমের ছুটিটা সারা দুপুর রান্নাবাটি খেলে, আম কুড়িয়ে আরও কতরকমের রোমাঞ্চকর খেলাধুলো করে যে কাটত, তার ঠিকানা নেই। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকে ঝিমলির আর মুর্শিদাবাদ যাওয়া হয়নি। দীদা মারা গেলেন, মা-ও আর যাওয়ার উৎসাহ পেতেন না। দাদু আগেই চলে গিয়েছিলেন। মামারা ছিলেন, কিন্তু মামাবাড়ি আর যাওয়া হয়নি। বারো ক্লাস পরীক্ষা দিয়ে তো বিয়েই হয়ে গেল। দিব্যার কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ত বটে, কিন্তু ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখব লিখব ভেবেও তা আর হয়ে ওঠেনি। দিব্যার বাবা রাজ্য সিভিল সার্ভিসের সরকারি চাকুরে, শুনেছিল উনি সুন্দরবনে বদলি হয়েছেন, দিব্যাকে ওঁরা ইলেভেন ক্লাসে কলকাতার হস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। দুই সখীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই এত বছরে দিব্যা সম্পর্কে আর কিছুই জানতে পারেনি, নতুন বিয়ের পর সংসারের চাপে আর সময়ও পায়নি।

ঝিমলি সাজুকে টাকা দিয়ে মিষ্টি আনতে পাঠায়। দিব্যা রাগ করে, “কেন ছেলেটাকে আবার রোদের মধ্যে পাঠাচ্ছিস? আমি মিষ্টি খাই না রে!” ঝিমলি ধমক দিয়ে বলে, “এই তুই থামবি? প্রথমবার এসেছিস, মিষ্টি খেতেই হবে। আমি রান্না করছি। দুপুরে এখানে একমুঠো খাবি। তারপর বিকেলে চা খেয়ে বাড়ি যাবি।” ঝিমলির ছেলেটা ভারি ঠাণ্ডা। দুটো মাত্র ঘর ওদের। একটা ঘরে এসি আছে টেলিভিশনও ঐ ঘরে। আরেকটা ঘরের মেঝেতে ফাটল ধরেছে। ঘরের চালে অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। ওটা ঠাকুরঘর কাম স্টোর রুম। এক পাশে একটা ছোট খাটও আছে, ঝিমলি নাকি সেখানেই শোয়। দিব্যাকে বসতে দিয়েছে ভাল ঘরটায়। এসি চালিয়ে দিয়েছে। ঝিমলির ছেলেটা খাটের এক পাশে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। কে মায়ের ছোটবেলার বন্ধু এল, বড় গাড়ি হাঁকিয়ে, আবার টিভি চ্যানেলে কাজ করে, ঘ্যাম ব্যাপার স্যাপার দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে বোধহয়। ও মিষ্টি আনবে বলে উঠছিল, দিব্যা বলে, “যেতে হবে না, বোসো তো! ভাল নাম কি?”

“সোমনাথ।”

“বাঃ! কি করছ এখন?”

“ডিপ্লোমা সিভিল করেছি, এখন চাকরির জন্য কয়েকটা কম্পানিতে এপ্লাই করছি...”

দিব্যা দেখে, ছেলেটার মুখখানা পুরো ঝিমলির আদলে। ওর মায়া হয়। তার ছেলে শুভ এখন সান ফ্রান্সিসকোয় রিসার্চ করছে। স্বামী রুদ্রর অফিস ট্যুর লেগেই থাকে। কাজে ডুবে থাকলে দিব্যার ফাঁকা মন অনেকটাই ভরে থাকে। ও হেসে বলে, “মিষ্টি আনবার কোন দরকার নেই। তুমি বোসো।” সাজু সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলের গেম-এ চোখ রেখে নিবিষ্ট হয়ে পড়ে।

দিব্যা উঠোনে বেরিয়ে আসে। রান্নাঘরটা উঠোনের এক পাশে আর ঠিক উল্টোদিকে বাথরুম। ঝিমলি শরবৎ নিয়ে আসে, “একি, তুই উঠোনে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কেন? সাজু? তুই গেলি?” দিব্যা ঝিমলির হাত থেকে গ্লাস টেনে নিয়ে বলে, “আমি যেতে বারণ করেছি। তোর একান্তই যদি আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়, আমার আনা প্যাকেট থেকে একটা তুলে দে না! আর সাজুকেও দে।” ঝিমলি অনেক কথা বলতে থাকে, ওর বিয়ের কথা, সংসারের কথা, শুনতে শুনতে আনমনে শরবতে চুমুক দিতে দিতে দিব্যা উঠোনের হরিতকী গাছে কাঠবিড়ালির ছুটোছুটি, তুলসীতলায় মাটির প্রদীপের পোড়া সলতে, টিনের গেটের পাশে সজনে গাছের মিহি ঝিরঝিরে ফুল আর পাঁচিলের গায়ে লতিয়ে ওঠা বরবটি লতায় ঝুলে থাকা বরবটি দেখে মুগ্ধ হয়ে। তার সাত তলার সাজানো ফ্ল্যাটের থেকে অনেক স্নিগ্ধ লাগে ঝিমলির এই ভাঙা বাড়ি। বলে, “চল আমরা সেই ছোটবেলার মতো রান্নাবাটি খেলি!” দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। ঝিমলি বলে, “আমার ঠাকুরঘর দেখবি আয়!” দিব্যা দেখে, কত ঠাকুরের পট। লক্ষ্মী-নারায়ণ থেকে শুরু করে চৈতন্য, জগন্নাথ, লোকনাথ পর্যন্ত—বাদ নেই কেউই। “আরে বাপরে! এত দেবতাদের অ্যাটেন্ড করিস কি করে?” খানিকক্ষণ গল্প করার পরে ঝিমলি রান্নাঘরে চলে গেল। দিব্যা একটা পুরনো এলবাম দেখার চেষ্টা করে, ঝিমলি ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সাজু কোথাও চলে গেছে বাইক নিয়ে, কাছেই, বন্ধুর বাড়িতে হয়তো। অরূপ এসে আলাপ করে গেল। ওরা হয়তো সম্ভ্রান্ত অতিথিকে ভাল ঘরটা ছেড়ে দিয়ে পাশের ঠাকুরঘরে আশ্রয় নিয়েছে। একটা নাগাদ ঝিমলি বলে, “খাবি চল। খবর দিয়ে আসিসনি। কিছুই তেমন করতে পারলাম না। কিন্তু আমাদের এখানে খুব ভাল বাজার বসে, জানিস তো! একটু যদি বলে আসতিস!” ঝিমলি বারবার দুঃখ করতে থাকে। বারান্দার এক পাশে ফোল্ডিং টেবিল-চেয়ার পেতে টেবিল ফ্যান চালিয়ে ঝিমলি ওকে খেতে দেয়। ঘিভাত, উচ্ছে ভাজা, কাঁচা আম দিয়ে টক ডাল, পটল ভাজা, ঝিঙ্গে-আলু পোস্ত, এঁচোড়ের ডালনা, টমেটোর চাটনি, দিব্যার আনা দুটো সন্দেশ আর ঘরে পাতা টক দই দিয়ে সই-এর আপ্যায়ন করে। দিব্যা বোধহয় বহু জন্ম এত সুস্বাদু রান্না খায়নি। তার রান্নার মাসি আছে। দুবেলা রান্না করে দিয়ে যায়। ওর কাছে ঘরের চাবিও থাকে। সে রান্না খেতে হয়, তাই খাওয়া। এমন যত্ন করে গুছিয়ে কত দিন তাকে কেউ বসিয়ে খাওয়ায়নি! খাওয়ার পর এসি চালিয়ে দিব্যাকে বালিশ দিয়ে ঝিমলি বলে, “একটু গড়িয়ে নে, আমি তোর দাদাকে আর সাজুকে খেতে দিই।”

বিকেলে দিব্যার গাড়িতে ওরা দুই সখী কাছেই গঙ্গার তীরে অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শন করে আসে। ঝিমলিকে ওর বাড়ির গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে দিব্যা বিদায় নেয়, বলে, “এরপর একদিন এসে তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। আগে থেকে বলব, দেখবি, ওখানে তোর খুব ভাল লাগবে।” ঝিমলি উৎসুক প্রশ্ন করে, “কোথায় রে?” দিব্যা মুচকি হেসে বলে, “সেটা না হয় সাসপেন্সই রইলো!”

এরপর একদিন আগে থেকে খবর দিয়ে দিব্যা আসে গাড়ি নিয়ে। ঝিমলি রেডি হয়ে থাকবে, কথা ছিল। ঝিমলি সকাল সকাল উঠে পূজো, রান্নাবান্না সেরে নেয়। ছেলেকে পই পই করে ঢাকা দেওয়া খাবার সময় মতো খেয়ে নিতে বলে, বাবা দোকান থেকে ফিরলে বাবাকেও যেন খাবার বেড়ে দেয়, সেটাও বুঝিয়ে বলে সাজুকে। বিয়ের পর থেকে এই এতগুলো বছর ঝিমলি একটা দিনের জন্যেও সংসার ফেলে একলা কোথাও যায়নি। দিব্যা তো বুঝবে না, ওর তো সংসারের ঝামেলা কিছুই সামলাতে হয় না। ব্যাটাছেলেদের মতো গাড়ি নিয়ে একাই ঘোরে। কোথায় যে নিয়ে যাবে, তা মেয়ে কিছুতেই বলল না! সে যেখানেই নিয়ে যাক, ঝিমলির বুকের মধ্যে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ গান বাজছে। ‘অনেকদিন পরে বাইরে বেরোনোর একটা সুযোগ পেয়েছি, আজ ভালো করে সাজবো’—ভেবে ঝিমলি আলমারি থেকে একটা সুন্দর আসমানি রঙের কাঞ্জিভরম শাড়ি বের করে। আলগা খোঁপা বেঁধে রূপোর কাঁটা দিয়ে গেঁথে দেয় সাটিনের গোলাপ কুঁড়ি। কপালে টিপ আর পারফিউম স্প্রে করে সাজ সম্পূর্ণ হতে বাইরে গাড়ির হর্ন বেজে ওঠে। ঝিমলি ছেলেকে ডাকে, “সাজু, মাসিমনি এসে গেছে মনে হয়। আমি বেরোচ্ছি। তুই খেয়ে নিবি, বাবাকে খেতে দিবি। আর এঁটো বাসন কলপাড়ে রেখে দিবি। সন্ধ্যা হলে বাইরে থেকে শুকনো কাপড় গুলো তুলে রাখিস।” সাজু মায়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এত সুন্দরী তার মা! গর্ব হয় তার। মুখে বিরক্তি দেখিয়ে বলে, “আরে ছাড়ো তো! যাচ্ছ তো এই কলকাতার মধ্যেই। এমন করছ, যেন আউট অব স্টেশন যাচ্ছ! অত ভেব না তো। সব ঠিক থাকবে।”

গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দিব্যা বলে, “কি করেছিস! এত্ত সেজেছিস কেন? আরে যেখানে যাচ্ছি...” কথা শেষ করে না দিব্যা। ঝিমলির মুখটা কেমন ম্লান দেখে ও চুপ করে যায়। আহা বেচারি বাড়ি থেকে কোথাও বেরোয় না। সাজতে বড্ড ভালবাসে। আর সেলফি তোলার নেশা! এমন একটা দিনও নেই, ও সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেনি! দিব্যা বোঝে। ঝিমলির কোন জীবন নেই সংসারের বাইরে। অথচ ওর গুণ ছিল অনেক। ভাল রাঁধতে জানে। গাছপালার যত্ন করতে জানে। ওর হাতের সেলাইয়ের কাজও ছিল চমৎকার! কিন্তু সকলের সব গুণই যে তার জীবনকালে প্রকাশের সুযোগ পাবে, এমনও কথা নেই। জহুরির হাতে পড়লেই মাণিকের কপাল খুলে যায়। খনির অন্ধকারে আত্মগোপন করে থাকা এক ডেলা পাথর অলঙ্কারের বহুমূল্য মধ্যমণি হয়ে ওঠে! জহর আর জহুরীর মণিকাঞ্চন যোগ কি সকলের ভাগ্যে ঘটে? দিব্যা নিজেও বোঝে, অফিসের কাজের চাপে তার গান, ছবি আঁকা হারিয়ে গেছে। ঝিমলির গলা জড়িয়ে বলে, “ইশশ্! আজ তোকে দেখে মনে হচ্ছে, যদি আমি ছেলে হতাম, তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম!” ঝিমলির মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। লজ্জা পেয়ে বলে, “ধুস্! কি যে বলিস না! কত কালো হয়ে গেছি আগের থেকে! চুলও উঠে গেছে অনেক! যাক গে, যাচ্ছি কোথায় আমরা?”

দিব্যা বলে, “তোর অতুল মামাকে মনে আছে? আমার ছোটমামা? আমাদের মুর্শিদাবাদের বাড়িতে সেই অতুল মামা আর তার এক বন্ধু রবি মামা আসত, মনে পড়ে তোর?”

ঝিমলি উৎসাহের সুরে বলে ওঠে, “হ্যাঁ রে, হ্যাঁ, খুব মনে আছে! কত দেশ বিদেশের গল্প বলতেন মামার সেই বন্ধু, সেও মনে আছে!”

“সেই রবি মামা সাধু হয়ে গিয়েছিলেন, জানিস?”

“ওমা! তাই? কেন রে? মনে দাগা পেয়েছিলেন বুঝি?”

“নারে, সেরকম কিছু না। সবাই কি আর দাগা পেয়ে সাধু হয়? উনি তো স্কুল লাইফ থেকেই বিবেকানন্দের ভক্ত। প্রথমে রামকৃষ্ণ মিশনে জয়েন করেছিলেন। পরে শুনেছি কি সব গোলমাল হয়েছিল, উনি মিশন ছেড়ে দিয়েছিলেন।”

“তারপর?”

“হ্যাঁ, সেটাই বলছি। গত বছর একটা কাজে আমাকে সাঁকরাইলে একটা গ্রামের ভিতর, একদম ইন্টিরিয়রে যেতে হয়েছিল। সেখানেই হঠাৎ ওনার দেখা পেয়ে যাই। আমি তো চিনতেই পারিনি! উনি আমাকে চিনেছেন। একটা ছোট আশ্রম করেছেন। আশেপাশের এলাকার গরীব ছেলেমেয়েদের ফ্রি টিউশন দেন। ভীষণ অভাবী এলাকা, বুঝলি? খুব লড়ছেন উনি। ওদের লেখাপড়া শেখানো, টিফিন খাওয়ানো, যোগ ব্যায়াম শেখানো, মায়েদের হাতের কাজের ট্রেনিং দিয়ে স্বনির্ভর করার চেষ্টা, পুরুষদের জন্য রাত্রে স্কুল—কত কাজ যে করছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবি!”

ঝিমলি জিজ্ঞাসা করে, “ওনার চলে কি করে?”

দিব্যা একটা শ্বাস ফেলে বলে, “দু’চারজন পুরনো ভক্ত আছেন, তাঁরা কিছু কিছু সাহায্য করেন, এলাকার মানুষ চাঁদা তুলে কিছু দেন, ঐ...চলে যায় কোন ভাবে!”

“আমরা কি ওই আশ্রমেই যাচ্ছি?”

“হ্যাঁ, সেখানেই। আমি বছরে এক আধবার আসি। উনি চেষ্টা করছেন একটা স্কুল আর ছেলেদের থাকার হস্টেল করতে। যখন যেমন পারি, সাধ্যমতো সাহায্য করবার চেষ্টা করি।”

ঝিমলি আনমনা হয়ে যায়। দিব্যা ভাবে, “বেচারি বোধ হয় সিনেমা বা মেলা টেলায় যাবে ভেবেছিল। আহা এত সাজগোজ করে শেষমেষ কি না আশ্রমে?”

গাড়ি শহরের চিহ্ন ছাড়িয়েছে অনেকক্ষণ। এবড়ো খেবড়ো কাঁচা রাস্তায় গাড়ি এত লাফাচ্ছে যে গা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। চাষের জমি, মাঠ-গোয়াল, খানাখন্দ, পুকুর-ডোবা, পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাখারির বেড়া ঘেরা একটি ছোট মাটির উঠোনের পাশে। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একদল ছোট ছেলেমেয়ে। তাদের কারু খালি গা, খালি পা, কারু বা গায়ে ছেঁড়া বেঢপ জামা-প্যান্ট। দিব্যা গাড়ি থেকে নামতেই সবাই মিলে ওকে ঘিরে ধরে। গাড়ির ডিকি থেকে ও বের করে অনেকগুলো জামাকাপড়ের প্যাকেট আর বই-খাতা, খেলনা বিস্কুট-লজেন্সের প্যাকেট। ঝিমলি এসমস্ত অপলকে দেখে। নতুন জামা, বইপত্র, খেলনা পেয়ে বাচ্চাদের মুখের অপূর্ব স্বর্গীয় হাসি দেখে ঝিমলির মনপ্রাণ ভরে যায়। অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে দীর্ঘদেহী যে মানুষটি বেরিয়ে আসেন, তাঁর মধ্যে সেই কলেজ লাইফের সুদর্শন যুবক রবির ছায়া খুঁজলে আজও পাওয়া যাবে। কাঁচা পাকা কদম ছাট চুল, গেরুয়া ধুতি আর গেরুয়া ফতুয়া পরা রবিমামা এগিয়ে আসেন, “এবার অনেকদিন পরে এলি!” দিব্যা ওনাকে প্রণাম করে বলে, “কাকে নিয়ে এলাম দেখুন! চিনতে পারছেন?”

ঝিমলি এগিয়ে এসে প্রণাম করতেই ওনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, “আরে! আমাদের ঝিমলি দিদিমনি না?”

উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় বসে অনেক গল্প হয়। দিব্যা আবদার করে, “আগে কী সুন্দর গান গাইতেন আপনি! একটু শোনান না!” ডাবের জল আসে ওদের জন্য। মামা এখন মহারাজ। দরাজ গলায় রবি মহারাজ গান ধরেন, “রাখতে যদি আপন ঘরে, বিশ্ব মাঝে পেতাম না ঠাঁই!” তাঁর গানের রেশ অনেকক্ষণ ওদের বুঁদ করে রাখে। শ্যাম নামে একটি কালো ছিপছিপে ছেলেকে ডেকে উনি বলেন, “এঁরা আজ আমাদের অতিথি। এখানে ডাল ভাত দুটি খাবেন। তুমি এঁদের একটু আশপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দাও।”

দিব্যা মহারাজের সঙ্গে কাজের কথায় ডুবে যায়, ঝিমলি শ্যামের সঙ্গে আশ্রম ঘুরে দেখতে বেরোয়। খানিকক্ষণ পরে মহারাজ বলেন, “আমি একটু রান্নাবান্নার দিকটা কতদূর হল দেখি গে, তুমি আমার ছেলেপিলেদের একটু পড়াও তো দিদিমণি!”

বেলা অনেক হল। ঘণ্টা বাজিয়ে ছেলেদের খেতে ডাকা হল। দিব্যা ঝিমলিকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পায় না। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে আশ্রমের পিছনে পুকুর পাড়ে দেখে ঝিমলির সঙ্গে রবি মহারাজ মৃদু স্বরে কথা বলছেন, দিব্যা নিঃশব্দে সরে যায়। দূর থেকে লক্ষ্য করে, মহারাজ চলে যাচ্ছেন আর ঝিমলি দাঁড়িয়ে একলা চোখের জল মুছছে কাপড়ের আঁচলে। দিব্যার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, রবি মামা ঝিমলিকে কি বললেন, ও কাঁদছে কেন? কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে ভদ্রতায় বাঁধে। বাচ্চাদের খাইয়ে মহারাজ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দুই অতিথির খাওয়া তদারক করেন। শ্যাম পরিবেশন করে। মোটা চালের ভাত, পাতলা কড়াইয়ের ডাল, ঝিঙ্গে আলু পোস্ত আর আশ্রমের বাগানের টমেটোর চাটনি। নিতান্ত মামুলি আহার, কিন্তু তাই সুধা মনে হয়। মহারাজ বারবার দুঃখ করেন, “তোমরা এত দূর থেকে এলে, কিছুই যত্ন করতে পারলাম না!”

অফিসের কাজের চাপ খুব বেড়ে যাওয়ায় সেদিনের পর ঝিমলির সঙ্গে সেভাবে অনেকদিন যোগাযোগ করতে পারেনি দিব্যা। ঝিমলিও ফোন করে না। আজ একটু ফুরসত পেয়ে রবি মামার আশ্রমে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় দিব্যা। ভাবে, “ঝিমলিকে সঙ্গে নিয়ে যাব? ও কি আবার ঐ গ্রামে যেতে আগ্রহী হবে?” সাতপাঁচ ভেবে ঝিমলিকে ফোন করে। কিন্তু ফোনটা রিং হয়ে যায়। কেউ ধরে না। দিব্যা একাই বেরিয়ে পড়ে, সঙ্গে আজও বাচ্চাদের জন্য নানারকম খাবারদাবার আর বইপত্র। আশ্রমে পৌঁছে বাচ্চাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবার পর দিব্যা আশ্রমের চারপাশটা ঘুরে দেখতে থাকে। হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে ওঠে। ঝিমলি একটা সাধারণ সুতী শাড়ি পড়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে মন দিয়ে রান্না করছে। কয়লার গনগনে আঁচে ওর মুখ লাল, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ওকে দেবীর মত মনে হচ্ছে। দিব্যাকে ও দেখেনি। আপন মনে কাজ করছে। দিব্যা একটাও কথা না বলে নীরবে সরে আসে। রবি মামাকে আড়ালে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কি ব্যাপার মহারাজ? এ কি দেখছি? ঝিমলি এখানে একা একা আসে নাকি?” মহারাজ হাসলেন, “হ্যাঁ গো দিদিমণি! ঝিমলি দিদিমণি যেন স্বয়ং অন্নপূর্ণা! সেই যে তুমি নিয়ে এলে, তারপর থেকে মাঝে মাঝেই আসে। কখনো বাচ্চাদের জন্য রান্না করে আনে, কখনো এখানে এসে সকাল থেকে কত কাজ করে! বাচ্চাদের বইখাতা মলাট দেয়, ওদের ছেঁড়া জামাকাপড় সেলাই করে, আশ্রমের গাছের যত্ন করে, আমাদের রান্না করে খাওয়ায়... মেয়েটার যে কত বড় মন, কি বলব!” আবেগে মহারাজের চোখ দুটো চিক চিক করে, বলেন, “টাকাপয়সা জুটে যায়, কিন্তু মানুষ পাওয়া যায় না! মানুষ বড় দুর্লভ গো! যে আশ্রমের জন্য নিজের সময় দেবে, শ্রম দেবে, এমন মানুষ কই জোটে? ভগবান তোমার মাধ্যমে ওকে জুটিয়ে দিয়েছেন! এত গুণ ওর! আমি বলি, মা! সংসারের জন্য সমস্ত জীবনটা তো দিলে। এবার এই বিশ্ব সংসারের দিকে একবার তাকাও। শরীরটা তো যাওয়ার, একদিন যাবেও, পরহিতায় যেটুকু করবে, তাই অক্ষয় ধন হয়ে থাকবে!... সেকথা শুনে সেদিন কী কান্না! আমি বুঝেছি সেদিনই, ওর মধ্যে একটা বিরাট মাতৃহৃদয় আছে, এতদিন যা বেরুবার পথ পায়নি!” মহারাজের কথা শুনতে শুনতে,, তাঁর আনন্দময় মুখখানি দেখতে দেখতে দিব্যার মনের আকাশ জুড়ে ভাললাগার মেঘ ঘনায়, ও গুন গুন করে গেয়ে ওঠে—“আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়/ আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি, পথে যে-জন ভাসায়!”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ