ঠিক রাত আটটা পনেরো। হাওড়া স্টেশনের ২৩ নং প্ল্যাটফর্মে ধীরে ধীরে ঢুকছে জয়সালমীর এক্সপ্রেস। ব্যস্ত জনবহুল স্টেশনে এদিক-ওদিক ছুটছে মানুষ। উমাপতিকে সঙ্গে নিয়ে বেদব্যাসও ছুটছে। আপাতত মাস দুয়েকের জন্য পোস্টিং জয়সালমীরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম খুড়িতে।
কেন্দ্রীয় উদ্যোগে ১৫৬ একর জমির উপর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ চলছে সেখানে। প্রকল্পের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটা ছোট্ট টাউনশিপ। ঐ টাউনশিপেরই নির্মীয়মান হাসপাতালের দায়িত্ব নিতেই বেদব্যাসের এই অকাল যাত্রা। অকাল যাত্রা এই কারণে, বেরনোর কয়েকঘন্টা আগেও জানত না,যে এভাবে হঠাৎ ছুটতে হবে ওকে।
আটটা বাজতেই ট্রেন হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ছুটে চলল জয়সালমীরের পথে। রাতে সব যাত্রী শুয়ে পড়তেই বেদব্যাস ছোট্ট টর্চটা জ্বালিয়ে লিখতে বসল একটা জম্পেশ ভূতের গল্প। রাত বেশ গভীর। বেদব্যাস তাঁর সৃষ্ট চরিত্রে এতটাই নিমগ্ন যে, আচমকা গায়ে হাত পড়তেই প্রায় লাফিয়ে উঠে বসতে গিয়ে ট্রেনের ছাদে ঠুকে গেল মাথাটা। কিন্তু গায়ে হাত দিল কে? ঘুরে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না। সবাই যে যার মতো ঘুমে মগ্ন। ‘তবে কে? নাকি মনের ভুল!’ ভাবতে ভাবতে সঠিক কোনো যুক্তি সাজাতে না পেরে, অগত্যা পায়ের কাছে রাখা চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। একটা অদৃশ্য বোধ যেন মাঝে মাঝেই ঘিরে ধরছে বেদব্যাসকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল,খেয়ালই নেই। ঘুম ভাঙল উমাপতির ডাকে। তখন প্রায় সকাল আটটা। একটা অচেনা স্টেশন,লোকজন ওঠা নামা করছে। সকলেই ব্যস্ত, কিন্তু বেদব্যাস কিছুতেই গতরাতের হিসাবটা মিলাতে পারছে না। স্পষ্ট মনে আছে কেউ যেন ওর কোমরের উপর হাত রেখে ডেকেছিল! নিজের ভাবনার পিছনে নিজেই যুক্তি সাজাল। ‘ হতে পারে গল্পের নিমগ্নতায় এমন অনুভব হয়েছে’।
বাকি পথ যে আর লেখায় মন বসবে না সেটা বুঝতে পেরেই একটা বই নিয়ে বসল বেদব্যাস।সবে মাত্র বারো ঘন্টা কেটেছে। এখনও প্রায় চব্বিশ ঘন্টা বাকি। মাঝে মাঝেই অজানা গন্তব্যের কাল্পনিক চিত্র যেন ভেসে উঠছে চোখের সামনে। উমাপতি বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে।
ছত্রিশ ঘণ্টার ট্রেন জার্নির শেষে যখন ট্রেন জয়সালমীর পৌঁছাল,তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে বারোটা। পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো লেট করেছে ট্রেনটা। উমাপতিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে আসতেই চোখে পড়ল ওঁর নাম লেখা একটা কাগজ দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। বেদব্যাস কাছে আসতেই লোকটি মোটা গোঁফে হাত বুলিয়ে নিয়ে নমস্কারের ভঙ্গিতে বলল,
---খম্মা ঘনি। মারো নাম দেবল সিং হ্যঁয়। মারো দেশ মে স্বাগত হ্যঁয় স্যার।
বেদব্যাসও প্রতি উত্তরে নমস্কার জানাতেই লোকটি হাতেই ইশারায় গাড়ি দেখিয়ে বলল-
--মারো লাড়ে আও স্যার।
বেদব্যাস আর উমাপতি লোকটির পিছনে পিছনে এসে উঠে বসল গাড়িতে। গাড়ি ছাড়তেই বেদব্যাস জিজ্ঞাসা করল—
--দেবল সিং জি, খুড়ি গ্রাম এখান থেকে কত দূরে?
--পনরো-বিশ কিলোমিটার।
গাড়ি ছুটে চলল ধু-ধু প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর এসে পৌঁছাল খুড়ি গ্রামে। গাড়ি থেকে নেমেই চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিল বেদব্যাস। পাঁচিলঘেরা এরিয়ার মধ্যেই অফিস,ওয়াটার রিজার্ভার,স্কুল,বাজার, হাসপাতাল সব আছে। কর্মচারীদের থাকার জন্য ফ্ল্যাট সিস্টেমের কোয়ার্টার। একটু দূরেই একটা গেটের গায়ে বোর্ডের উপর লেখা প্রস্তাবিত হাসপাতাল। পাশেই একটা ছোট্ট ঘর। ওটাই বর্তমান অফিস বেদব্যাসের। বেদব্যাস এগিয়ে গেল সেই দিকে। ভিতরে দুটো টেবিল, তিনটে চেয়ার আর একটা কাঠের আলমারি। আপাতত জনা দশেক কর্মী,তার মধ্যে দু’জন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এখনও আসা বাকি। বেদব্যাস অফিস থেকে বেরতেই দেখল উমাপতি তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। দেবল সিং রাজপুত ভাষায় হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছে আর উমাপতি হাঁ করে শুনছে ওর কথা। বেদব্যাস এগিয়ে এসে দেবল সিং এর ঘারে হাত রেখে বলল—
--চলো হে ভায়া, এবার আমার মাথা গোঁজার জায়গাটা দেখিয়ে দাও।
--দেবল সিং বেদব্যাসের বলা কথার সবটা বুঝতে না পারলেও কিছুটা আন্দাজ করে নিয়ে বলল—
--মারো লাড়ে আও স্যার। আগগে হি তান কো ঘর সা।
দেবল সিং এর পিছন পিছন একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। মাঝে সিঁড়ি দু’পাশে দুটো, মানে উপর নিচ মিলিয়ে মোট চারটি ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ডান দিকের ঘরের চাবি খুলে সোজা ভিতরে ঢুকে গেল দেবল সিং। বেদব্যাসের দিকে তাকিয়ে বলল—
--মায়নে ( ভিতরে) আও স্যার। ইয়ো ঘর তান কো সা।
বেদব্যাস ঘরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে হাতের উলটো পিঠে থুতনি থেকে ঘামটা মুছে নিয়ে বলল—
--ধন্যবাদ দেবল ভাই। আবার দেখা হবে।
-- পাছে মিলাসাঁ। খম্মা ঘনি।
দেবল সিং চলে যেতেই বেদব্যাস দরজাটা লাগিয়ে দিল। আজ আর বিশেষ কোনো কাজ নেই। জমিয়ে গল্প লেখা অথবা বইপড়া ব্যস! ট্রেনের জামা-প্যান্ট দরজার পিছনের হুঁকে ঝুলিয়ে ব্যাগ থেকে গামছা আর পাজামাটা নিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল বাথরুমে। উমাপতিও লেগে পড়েছে কাজে। বেদব্যাস স্নান সেরে বাইরে এসেই দেখল, বিছানায় পরিপাটি চাদর বিছানো। ঘর মোটামুটি আগে থেকে পরিষ্কার করানোই ছিল। চায়ের সরঞ্জাম উমাপতি সঙ্গেই এনেছে, তাই বাথরুম থেকে বেরিয়ে উমাপতিকে চায়ের কথা বলে বেদব্যাস একটা বই হাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ল। পিঠের পিছনে একটা ছোট্ট খোলা জানালা। ঠিক এই মুহূর্তে বেদব্যাস পিছন ঘুরলেই দেখতে পেত অনন্ত বিস্তৃত ধু-ধু মরুবালু রাশি! হঠাৎ দরজায় টকটক টোকা মারার আওয়াজ হতেই বেদব্যাস সোজা হয়ে বসল। আওয়াজটা কি সে সত্যিই শুনছে! নিশ্চিত হতে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে,কান খাড়া করে রইল। আবার শব্দটা হতেই দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই দেখল, দরজার বাইরে একটা বছর ছয়েকের মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই মেয়েটি খপ্ করে বেদব্যাসের আঙুলটা ধরে বলে উঠল—
--আঙ্কেল.... আঙ্কেল... মা তোমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে যেতে বলল।
--মেয়েটির বাংলায় কথা বলা দেখে প্রথমেই খানিক অবাক হল বেদব্যাস। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি আবার ডাকল—আঙ্কেল.. চলো না আমাদের ঘরে। আঙুলে জোরে টান পড়াতে বেদব্যাস কিছুটা এগিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল, ওর ফ্ল্যাটের ঠিক উলটো দিকের দরজায় দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা। ছিপছিপে গড়ন। মুখের আদলটা বেশ পরিচিত যেন। আসলে কিছু কিছু মুখ এমনই হয়,হঠাৎ দেখলে মনে হয় চেনা। বয়স আন্দাজ করা মুশকিল। বেদব্যাসের দিকে তাকিয়ে মহিলা বলে উঠলেন-
--তিতলি যখন অত করে ডাকছে, তখন আসুন না একবার। চা খেয়ে যান। এখন থেকে আমরা কিন্তু প্রতিবেশী,তাও একমাত্র। নিচের তলার ঘর দুটো খালি এখনও।
বেদব্যাস হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বলল-
--যাব অবশ্যই,তবে এখন আর যাচ্ছি না। এত বড় একটা জার্নি করে বেশ ক্লান্ত লাগছে। আর তাছাড়া উমাপতি এতক্ষণে চা করে ফেলেছে। এখন তো এক সাথেই বসবাস। নিশ্চয় যাব।
--ঠিক আছে। এখন ছাড় দিলাম না হয়,কিন্তু বিকেলের চা আর রাতের ডিনারের আমন্ত্রণ জানালাম। সারাদিন বিশ্রাম নিয়ে নিন। বিকালে কোনো অজুহাত শুনব না।
--বেদব্যাস হেসে উত্তর দিল, ‘ঠিক আছে। তাই হবে’। বাচ্চা মেয়েটি চলে যেতেই,বেদব্যাস দরজা বন্ধ করে উমাপতির আনা চা এ চুমুক দিয়ে নিমগ্ন হলো বইয়ের পাতায়।
∆ ২
ঠিক রাত ন’টা। নতুন প্রতিবেশীর বাড়ি ডিনার সেরে হাত ধোয়ার জন্য বেসিনের সামনে দাঁড়াল বেদব্যাস। মুখে জলের ছিটে দিয়ে সামনে টাঙানো আয়নায় তাকাতেই থমকে গেল চোখ। জলের বাষ্পে যদিও আয়নার কাচটা অস্বচ্ছ,তবুও পিছনে টাঙানো ছবিটা কেমন যেন ভীষণ রকমের জীবন্ত মনে হল। ঝটিতে ঘুরে তাকাল পিছনে। দেওয়াল জুড়ে বিশাল আকৃতির একটা কালো ঘোড়া। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ছবিটার খুব কাছে। ঘোড়াটার চোখে চোখ রাখতেই যেন ডুবে গেল অতীতের পাতায়। কি যেন রয়েছে ঐ দৃষ্টিতে! একটা হিমেল স্রোত যেন নেমে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে।
-কি দেখছেন অমন করে?
মেয়েলি সূক্ষ্ণ গলায় আওয়াজে চমকে পিছন ফিরে তাকাল বেদব্যাস। সুদর্শনা প্রতিবেশীনির অদ্ভুত রকমের সুন্দর মুখটা খুব কাছ থেকে দেখে চমকে উঠল প্রায়।এক-পা পিছিয়ে সহাস্যে বলে উঠল—মিল খুঁজছি। এ ছবি আপনি পেলেন কোথায়?
--দার্জিলিংয়ে। বছর খানেক আগে। জানেন, ভীষণ দুঃখের ব্যাপার। ঘোড়াটা ম্যালে ঘুরছিল। আমার বেশ পছন্দ হল। ভাবলাম ওটার পিঠেই চাপবো। সব ঠিক, তিতিলিকে নিয়ে উঠতে যাব এমন সময় ঘোড়াটা আমাদের দিকে তাকিয়েই, কেমন যেন খেপে উঠল। সামনের পা দুটো উপরে তুলে ভীষণ চিৎকার করে সহিসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটতে লাগল। চোখের সামনে দেখলাম,জানেন? ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে লাফ দিয়ে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচে! উফ্! কি ভয়ানক সে দৃশ্য! দূর থেকে আগেই ঘোড়াটার একটা ছবি তুলেছিলাম। সেই ছবিই বাঁধিয়ে রেখেছি।
বেদব্যাস সোফায় বসতে বসতে অস্ফুটে বলে উঠল—এঘোড়ার মৃত্যু বোধহয় এভাবেই লেখা!
-মানে? একসাথে নারী-পুরুষ দুটি কণ্ঠস্বরে প্রশ্নটা ভেসে এল বেদব্যাসের কানে। প্রতিবেশী দম্পতি দুজনেই অবাক হয়ে এসে বসল বেদব্যাসের ঠিক সামনের সোফায়।
--মানে বোঝাতে গেলে একটা গল্প শোনাতে হয় আপনাদের। এই বছর ছয়েক আগের ঘটনা। আমি তখন শিমলায় পোস্টিং পেয়েছি। সেখানে অপ্রীতিকর একটি ঘটনা ঘটায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাই। মন ও স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য দিন দশেকের জন্য নেতারহাট গিয়েছিলাম। আর সেখানেই বলে চুপ করে বেদব্যাস কি যেন একটা ভাবল।
--ওকে চুপ করতে দেখেই দম্পতিদ্বয় সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘তারপর কি হল মিঃ ঘোষ?
--নেটারহাটে যেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম,সেটা আমার এক বন্ধুর পৈতৃক বাড়ি। বাড়িটি খালিই পড়ে থাকে। দীর্ঘবছর সেখানে কেউ থাকে না। এমনিতেই নেতারহাট একটু ফাঁকা জায়গা,তাতে বাড়িটি নেটারহাটের প্রাণকেন্দ্র থেকে দশ কি.মি. দূরে এক ফাঁকা জায়গায়। পাশেই এক পাহাড়। শুনেছিলাম ঐ পাহাড়ের চূড়া থেকে খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। নেতারহাটের সানসেট পয়েন্ট। মনে মনে ঠিক করেছিলাম,ভালো লাগলে আরোও কিছুদিন ছুটি বাড়িয়ে থেকে যাব ওখানেই। বাড়িটির সদর দরজায় লাগানো তালার চাবি কিছুতেই খুঁজে পায়নি আমার বন্ধু সিদ্ধার্থ,তাই নেতারহাটে পৌঁছেই স্থানীয় গ্রাম থেকে একটি লোক নিয়ে সোজা পৌঁছালাম সেই বাড়িতে। শুধু তো তালা ভাঙা নয়, থাকার জন্য ঘরও তো পরিষ্কার করে বাসযোগ্য করতে হবে। ভোলানাথ অর্থাৎ সেই লোকটির সাথে কথা হয়েছিল,প্রতিদিন সকাল ছ’টার সময় সে কাজে আসবে আর তিনটের সময় বাড়ি ফিরে যাবে। কথা মতোই সে সারাদিন কাজ করে সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে যেত। ভোলানাথ চলে গেলে আমি দরজা বাইরে দিয়ে ছিটকিনি টেনে গিয়ে বসতাম ঐ পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকে সূর্যাস্তের অপরূপ ছবি দেখতাম। ভয়ংকর সুন্দর সে দৃশ্য! খাড়া পাহাড়ের গায়ে রঙিন কিরণের ছটায় কেমন যেন মহনীয় হয়ে উঠত প্রকৃতি! ঠিক ঐ সময় কিনারা থেকে নিচের অতলান্তে তাকালে চাপচাপ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ত না! কান পাতলে যেন মনে হত প্রকৃতি গুমরে কাঁদছে। কারা যেন,ফিসফিস কথা বলছে! সেদিনও এমন বসে ছিলাম ঐ পাহাড়ের চূড়ায় একটা পাথরের উপর। সন্ধে হয়ে গিয়েছে,তবু মন যেন কিছুতেই ফিরতে চাইছে না। বসে থাকলাম মনের কথা শুনে। ঘরে ফিরেই বা কি হবে, কাজ তো কিছু নেই,বইপড়া আর গল্প লেখা ছাড়া। বসে বসে সেই রহস্যময় প্রকৃতির রূপে মগ্নপ্রায়; এমন সময় হঠাৎ মনে হল যেন পিছন দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কোনো ঘোড়া! টক্ টক্ টক্ টক্ ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম,পিছন ফিরে তাকালাম। যেন মনে হল শব্দটা আসতে আসতে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। মনে ভাবলাম, ‘হতে পারে দূরে কোনো গ্রামবাসীর ঘোড়া’।
পরদিন এক অবাক করা ঘটনা ঘটল। বেশ ভোরের দিকে পাহাড়ের কোল থেকে ভেসে আসা মিষ্টি এক পাহাড়িয়া বাঁশির সুরে ঘুম ভেঙে গেল। ভোলানাথ এর কিছুক্ষণ পর আসতেই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম-
--ভোলানাথ, এমন সুন্দর বাঁশি কে বাজাচ্ছে গো? শুনে সে অবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ বাবু আপকো রাতমে নিন্দ নেহি হুয়া কিয়া?’
--অবাক হয়ে বললাম, কেন? তুমি শুনতে পাচ্ছো না ঐ মিষ্টি সুর?
--নেহি বাবু, বলেই সে নিজের কাজে লেগে গেল। আমি হাঁটতে বেরোলাম। না কোনো বাঁশিওয়ালাকে চোখে পড়ল না! দুপুরের দিকে ভোলানাথ চলে যাওয়ার পর আমি তখন একটা বই পড়ছি। দরজায় শব্দ হল। মনে ভাবলাম,ভোলানাথ তো চলে গিয়েছে,তবে এই নির্জনে এইসময় কে হতে পারে! দরজা খুলতেই দেখলাম, এক সুদর্শন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। দেখলেই বোঝা যায় উঁনি অবাঙালি। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই একটা চিঠি এগিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন--
-আমি রাজকুমার রাউৎ। দিল্লি থেকে আসছি। বাকি কথা আপনার বন্ধু এই চিঠিতে লিখে দিয়েছেন।
চিঠি পড়ে জানতে পারলাম,ভদ্রলোক পেশায় একজন বাস্তুকার হলেও ওঁনার নেশা প্যারানরমাল বিষয়ে,মানে অশরীরি আত্মা নিয়ে কাজ। আমার বন্ধুর পরিচিত। এমনই কিছু কাজে তিনি এখানে আসছেন শুনে,সিদ্ধার্থ ওঁনাকে এখানে থাকার কথা বলেছেন। চিঠি পড়ে বললাম, ‘ভালোই হল। আপনি আসাতে কথা বলার একজন সঙ্গী পেলাম’। ভোলানাথ রাতের খাবার করেই যেত। চায়ের প্রয়োজন হলে আমি নিজেই করে নিতাম। সেদিনই সন্ধের আগেই চা খেয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম সূর্যাস্ত দেখতে। সকাল থেকেই সেদিন আকাশের মুখ ভার ছিল, একরাশ কালো মেঘ সূর্য ডোবার ঠিক আগেই এমন করে আকাশটা ঢেকে ফেলল যে, সেদিন সূর্যাস্তটা দেখাই গেল না। এদিকে আমিও ক’দিন ছুটি বাড়ানোর দরখাস্ত করেছিলাম,সকালেই তার সম্মতি পত্র পেয়েছি, মানে আরও কিছুদিন এই মহোময় পরিবেশে কাটাব। রাতে ভদ্রলোকের ভূত নিয়ে নানা কীর্তি বা অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে বেশ রাত হয়েছিল, তবু বেশ ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল। সেই একই মিষ্টি বাঁশির আওয়াজে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। দেখলাম রাজকুমার বাবু ঘুমাচ্ছেন। জোরে ধাক্কা দিতেই উঠে বসলেন। বললাম—
আপনি শুনতে পাচ্ছেন বাঁশির আওয়াজ? উঁনি মাথা নেড়ে জানালেন না। অবাক হলাম। কেবল আমিই কেন শুনতে পাচ্ছি! তবে বিষয়টা জেনে রাজকুমার বাবু বেশ আনন্দ পেলেন বলে মনে হল। বোধহয় রহস্যের গন্ধ পেলেন বলে! সেদিন সন্ধে বেলায় সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সূর্য পাহাড়ের খাদ বরাবর নিচে নেমে যেতেই আবার শুনতে পেলাম সেই টক টক ঘোড়ার আওয়াজ,সঙ্গে এক নারী আর পুরুষের গল্প করার অস্পষ্ট আওয়াজ। কথা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছু বলছে,কোনো দুর্বোধ্য ভাষায়। এই প্রথম সন্ধেতেও শুনতে পেলাম সেই বাঁশির সুর! ঘুরে তাকালাম সেই দিকে। কোনো মানুষ দেখতে পেলাম না ঠিক,তবে ... বলেই একটা ছোট্ট করে ঢোক গিলল বেদব্যাস।
--তবে কি মিঃ ঘোষ? বিস্ফারিত চোখে দম্পতিদ্বয় ওর দিকে তাকিয়ে বলল।
--দেখলাম, একটা কালো কুচকুচে ঘোড়া ধীরে ধীরে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, রাজকুমার বাবু, দেখলেন? দেখলেন আপনি? এবারেরও উঁনি মাথা নেড়ে জানালেন দেখেননি। বেশ হতাশ হলাম সেদিন! কেন এমন হচ্ছে আমার সঙ্গে বুঝতে পারছি না! শিমলাতেও ঠিক এমনই কিছু অস্বাভাবিক কারণের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম ফিরে যাব,কিন্তু রাজকুমার বাবুর অনুরোধে দু’দিন আরও থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সেদিন সকালে ভোলানাথ এসেই কাজে লেগে গেল। আমাকে দেখেই বলল—‘ বাবু আজ রাত কো বাহার মাৎ নিকাল না। আজ গ্রহণ হ্যয়। সূরয ডুবতেহি চাঁন্দকো গ্রহণ লাগ জায়ে গা’।
ওর কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলাম। বললাম, ‘গ্রহণ তো কি হবে? সে তো দেখার জিনিস’।
নেহি বাবু, সব জানতে হ্যয় গ্রহণকে রাত মে উস দুনিয়াকে লোগ ঘুমতে হ্যয়। অশিক্ষিত ভোলানাথকে অগ্রাহ্য করে ছোটো করার ইচ্ছা হল না। ওকে বললাম, ‘ ঠিক আছে। বেরব না বাইরে’। সেও মাথা নেড়ে কাজে মন দিল। কিন্তু দুপুরে ভোলানাথ চলে যেতেই আমরা গিয়ে বসলাম সেই পাহাড় চূড়ায় পাথরের উপর। দু’দিন ধরে মেঘের কারণে ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায়নি। সেদিন আকাশ পরিষ্কার দেখে উৎফুল্ল মনে রাজকুমার পাহাড়ের ঠিক কিনারার কাছে গিয়ে বসল। ধীরে ধীরে সূর্যটা নিচে নামতেই অন্ধকারে জ্বলে উঠল চাঁদ,কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল গ্রহণ। ধীরে ধীরে চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে ছায়ায়। যখন ঠিক একফালি মতো বাকি।পুরো পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে, রাজকুমার গিয়ে দাঁড়িয়েছে চূড়ার কিনারায়,কিজানি কি দেখছে? হঠাৎ শুনতে পেলাম খুব দ্রুত বেগে ছুটে আসা ঘোড়ার পায়ের শব্দ। আমি আতঙ্কে পিছন ঘুরে তাকালাম। দেখতে পেলাম একটা কালো ঘোড়া ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে আসছে। ছুটতে ছুটতে কিছুটা দূরে থেমে গেল। অন্ধকারে ওর উজ্জ্বল গভীর চোখ দুটো যেন জ্বলছে।উফ্,ভয়ানক সে দৃষ্টি! কোনও দিনও ভোলার নয়! ঘোড়াটা থামতেই এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। এক সাহেব কন্যা ওর কাছে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারে আমি ওদের স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আমি চিৎকার করে রাজকুমারকে ডাকতে গেলাম,কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরল না। দেখলাম সেই মেয়েটি তার প্রিয় ঘোড়াকে একটা চুমু খেল,তারপর চেপে বসল ওর পিঠে। একপা একপা করে এগোতে এগোতে ছুটিয়ে দিল ঘোড়া,ঠিক রাজকুমার যেখানে দাঁড়িয়ে ঐদিকে। দুরন্ত গতিতে ছুটছে ঘোড়া, আমিও শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে ছুট লাগালাম, কিন্তু পৌঁছতে পারলাম না। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। গলা দিয়ে মরণ চিৎকার বেরিয়ে এল—‘ রাজকুমার বাবু-উ-উ-উ!’
ঠিক তখনই দেখতে পেলাম দুরন্তগতিতে ছুটতে ছুটতে ঘোড়াটি তার মালকিনকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহাড় থেকে নিচে! বলতে বলতে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল বেদব্যাস। ঘোড়াটার কাছে গিয়ে বলল—‘অবিকল এই চোখ! সে চোখ ভোলার নয়! ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। The sunset point. ম্যাগনোলিয়া...ম্যাগনোলিয়া’...ছোট্ট ড্রয়িংরুমে বেদব্যাসের ভয়ার্ত গমগমে আওয়াজটা ঘুরে বেরাচ্ছে যেন! ছবিটার থেকে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে তাকাল প্রতিবেশী দম্পতির দিকে। উত্তেজনায় ততক্ষণে প্রতিবেশী দম্পতি দুজনও উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বেদব্যাস একটু একটু করে এগিয়ে গেল প্রতিবেশী মহিলার দিকে। ফিসফিস করে বলল—জানেন সেই ইংরেজ মহিলা ম্যাগনোলিয়ার গল্প?
ফ্যাকাশে মুখে মহিলা মাথা নাড়লেন। বেদব্যাস এক রহস্য ছড়ানো হাসি হেসে মৃদুস্বরে বলে উঠল—‘সুইসাইড। আত্মহত্যা করেছিলেন ইংরেজ কন্যা ম্যাগনোলিয়া। একটি মেষপালককে ভালোবেসে,না পাওয়ার ব্যর্থতায় ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐ পাহাড় চূড়া থেকে! ম্যাগনোলিয়া কেমন দেখতে ছিল জানেন?—ঠিক ... বলেই পিছন ঘুরে তিতলিকে কোলে তুলে নিল। তারপর এক রহস্যময় হাসি হেসে চুমু খেল তিতলির কপালে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন