অন্যমন পাবলিশিং হাউসের অফিসে হাঁ করে বসেছিল অহনা । তার আজ এই অফিসে জুনিয়র ট্রান্সলেটর হিসেবে জয়েন করার কথা । ইনটারভিউয়ের বেড়া পেরিয়ে অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল সে । জয়েনিং লেটারও পেয়েছিল তা প্রায় মাসখানেক আগে কিন্তু কি একটা কারণ দেখিয়ে এই অন্যমন পাবলিশিং হাউসের একজন অফিস ক্লার্ক বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে আরো দুই একজন জয়েন করবে । তাই সকলকে একসঙ্গে জয়েন করাবার জন্য একটু দেরি হচ্ছে । সময়মত অফিস থেকে অহনাকে ডেকে নেওয়া হবে । অহনা গত একটা মাস তীর্থের কাকের মত বসে ছিল । কবে সেই কাঙ্খিত ফোনটা আসে তার !
তারপর গতকাল সেই বহুপ্রতীক্ষিত ফোন আসতেই আজ সকালে সেই বাহিরখন্ড থেকে সক্কাল সক্কাল রওনা দিয়ে এই অন্যমন পাবলিশিং -এর অফিসে এসে হাঁ করে বসে রয়েছে সে । কখন আসে সেই আরও দুই একজন নিউলি এপয়েন্টেড সহকর্মী ।
অন্যমন পাবলিশিং হাউস স্বাধীনতাপূর্ব যুগ থেকেই বাংলা পত্র পত্রিকার জগতে একটি সুপরিচিত নাম । ব্রিটিশ বিরোধী প্রকাশনার তালিকায় অন্যমনের নাম সগৌরবে স্থান পায় । বর্তমানে এই হাউস শুধুমাত্র পত্রিকা বা সংবাদপত্র প্রকাশ নয় , দেশ বিদেশের জানা অজানা সাহিত্য কর্ম বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে মানুষের সামনে নিয়ে আসে। ঋদ্ধ হয় মানুষ । অধুনা এই প্রকাশনা হাউস থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রটির নাম ‘অন্যবার্তা’ রাখা হয়েছে , মাসিক পত্রিকাটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অন্যরূপ’ আর বিশেষ অনুবাদ সংখ্যাগুলির নাম বিষয়ের গুরুত্ব অনুযায়ী বদলে দেওয়া হচ্ছে । মোদ্দা কথা হল এই হাউসে কাজ পেতে গেলে লেখাপড়ায় বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপরে বেশ দখল থাকা প্রয়োজন ।আর ইংরাজিসহ অন্য যে কোন বিদেশি ভাষায় ও বাংলা ছাড়া অন্য যে কোন ভারতীয় ভাষায় ভালোরকম দখল থাকলে অনুবাদ বিভাগে কাজের জন্য আবেদন করা যায় ।এদের পে প্যাকেট বেশ আকর্ষনীয় ।সারা বিশ্বের পাঠক বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এই পত্র পত্রিকাগুলি পড়েন । কাজেই এই হাউসে কাজ পাওয়া বেশ একটু শ্লাঘার ব্যাপার ।
অহনার বাবা বাঙালি হলেও মা হরপ্রীত লুধিয়ানার মেয়ে। লুধিয়ানা শহর থেকে দূরে গ্রামের দিকে বাড়ি ছিল মায়েদের । বাবা কাপড়ের ব্যবসার প্রয়োজনে ওখানে গিয়ে ছিলেন কিছুদিন । ওখানেই প্রেম এবং বিয়ে । বিয়ের পর পুরোপুরি পাঞ্জাবি কায়দায় অভ্যস্ত মা , তার প্রেমিক তথা বর মানে অহনার বাবার সঙ্গে এখানে চলে এসেছিলেন । তারকেশ্বর লাইনে বাহিরখন্ড নামে জায়গাটায় বাবাদের পাঁচ পুরুষের বাস । আত্মীয়স্বজন সব এখানেই । বাহিরখন্ডের বাড়িতে রসিকলাল কুন্ডুর বৌ হরপ্রীত কৌর ওরফে কুন্ডু মানে অহনার মা মানিয়ে নিয়েছিলেন দারুণভাবে । আবার নিজের ভাষাকেও ভোলেননি একটুও । মা-ই পড়াতেন অহনাকে । শিক্ষক শিক্ষিকার কাছে বাংলা ইংরাজি পড়িয়েছেন আর এর পাশাপাশি নিজে মেয়েকে গুরুমুখী শিখিয়েছেন যত্ন করে। মায়ের সঙ্গে অহনা যখনই মামারবাড়ি বেড়াতে গেছে তখন সে মামা মামীদের সঙ্গে ঝরঝরে গুরুমুখীতেই আলাপ করেছে । মামারা খুশি হয়ে তাকে বলেছে –সাবাস গুড়িয়ারাণী ।তু সি গ্রেট হো । লগে রহো গুড়িয়া ।
আর মামাদের মুখে এসব শুনলেই মায়ের মুখটা গর্বে আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠত । আজ মায়ের শেখানো গুরুমুখীর জোরেই এখানে চাকরিটা পেল সে ।তার সংগে আর যে দুজন জয়েন করছে তাদের একজন ফরাসি আর একজন মালয়ালম জানে বলে শুনেছে সে ।
অহনা ট্রেনের যাত্রী বলে সে বেশ একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে আজ । অন্য দুজন কলকাতার বাসিন্দা । একজন ঢাকুরিয়া অন্যজন বালিগঞ্জ । ঢাকুরিয়া থেকে যার আসার সে কিছুক্ষন পরেই চলে এল । লম্বা চওড়া চশমা পরা উজ্জ্বল রঙের এক যুবক ।নাম প্রতাপাদিত্য মিত্র । এপয়েন্টমেন্ট লেটারেই এর নামের উল্লেখ দেখেছে সে । তিনজন একসঙ্গে জয়েন করবে বলে একটিই এপয়েন্টমেন্ট লেটারের কপি ইস্যু করা হয়েছে তিনজনকেই ।জয়েনিং লেটার যার যার নামে আলাদা আলাদা দেওয়া হবে বোধহয় । কিন্তু ছেলেটিকে দেখে একটুও খুশি হলনা অহনা । কেমন যেন ভীতু ভীতু লুকিয়ে থাকা স্বভাব । রিসেপশানে গিয়ে কথা বলে এসে কোথায় যে পালিয়ে গেল কে জানে । মোস্ট আনইম্প্রেসিভ একখানা ! যাকগে -----
প্রায় ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করার পরে এল তৃতীয় জন ।টকটকে ফর্সা , লম্বা স্লিম লাল চুলের এক সুন্দরী যুবতী । অহনা বুঝল এরই নাম অদ্বিতীয়া দত্ত । অহনা মফঃস্বলের মেয়ে হলে কি হবে কলকাতার কলেজে পড়ত সে । অনেকদিনই ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে । একটা সাধারণ স্মারটনেস আছে তার মধ্যে । সে এগিয়ে গেল ----অদ্বিতীয়া ?
-----হ্যাঁ --বেশ কুণ্ঠিত সম্মতি এল ।
---আমি অহনা কুন্ডু । আমিও আজ এখানে জয়েন করছি ।
এক মুহূর্ত চুপচাপ । তারপরেই হেসে জবাব এল ----- ও আচ্ছা বাহিরখন্ড না কোথা থেকে কে একজন আসছে শুনেছিলাম । আমি তো বাপিকে বারবার জিজ্ঞেস করছি এই জায়গাটা আবার কোথায় ? শুনলেই মনে হয় যেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও ---
অহনার মনটা দমে গেল । আহা হলেই বা বালিগঞ্জের মেয়ে । বাহিরখন্ড যে তারকেশ্বর লাইনের একটা স্টেশন সেটাও জানেনা এই মেয়েটি ! আশ্চর্য !
অদ্বিতীয়ার সঙ্গে দু চার মিনিট কথা বলতে না বলতে অফিসের ভেতর থেকে এক খর্বকায় ক্ষিপ্রগতির বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে সসম্ভ্রমে জিজ্ঞেস করলেন --- অদ্বিতীয়া দত্ত কে আছেন ?
যুবতী এগিয়ে গেল –আমিই অদ্বিতীয়া দত্ত ।
---অঃ আচ্ছা । আসুন আসুন । আপনার সঙ্গে যে আরো দুজন জয়েন করবেন তারা এসেছেন ?
অদ্বিতীয়া কোন তাপ উত্তাপ দেখাল না । এবার অহনাই এগিয়ে গিয়ে বলল –হ্যাঁ আমিও জয়েন করব ।আর একজন আছেন । কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছেন হয়ত ।
বৃদ্ধ তড়বড় করে বলল ---আপনি কোন সেকশন , মানে ফরাসি না পাঞ্জাবি না সাউথ ইন্ডিয়ান ?
---মানে ?
---মানে আপনি কোন ভাষায় জয়েন করবেন এটাই শুধোচ্ছি ।
অহনা গম্ভীর হয়ে বলল ---গুরুমুখী ।
---অহ আচ্ছা । এবার বুঝে নিয়েছি । অদ্বিতীয়া দত্ত ফরাসি ভাষায় জয়েন করছেন , এটা আমার জানাই ছিল। তাহলে ওই ছেলেটি সাউথ ইন্ডিয়ান ।
অহনা সংশোধন করে বলল –মালয়ালম । যতদূর জানি।
---অই হল আর কি । বোঝা নিয়ে কথা ।
প্রতাপাদিত্য মিত্রকে খুঁজে নিয়ে আসতে হল । সে কাছেই এক বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে বই পত্র ঘাঁটছিল । যাহোক জয়েনিঙের দিন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে অদ্বিতীয়া দত্ত এই অন্যমন পাবলিশিং হাউসে অন্যরকম মর্যাদা পাওয়ার বা বলা ভাল বেশ একটু খাতিরদারি পাওয়ার জন্যই এসেছে । তার বাবা সৌরেশ দত্ত একজন নামকরা শিল্পপতি এবং সৌরেশ দত্ত নামক মুরুব্বির জোরে এই অন্যমন পাবলিশিং হাউসের বাড়বাড়ন্তও মন্দ নয় । কাজেই তাঁর মেয়ে যখন এই অফিসে চাকরি করতে এসেছেন তখন বিশেষ খাতির তো তিনি পাবেনই ।
কাজে কাজেই অন্যমন পাবলিশিং হাউসের বড়কর্তা জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগী মাঝে মাঝেই অদ্বিতীয়াকে ডেকে পাঠিয়ে তার খোঁজখবর নিতে লাগলেন আর অন্যান্য অধস্তন কর্মচারীরা বেশ একটু হেঁ হেঁ গোছের ভাবভঙ্গি করে অদ্বিতীয়া দত্তকে ম্যানেজ করতে লাগল ।
এই অফিসে তাবড় গুনী জ্ঞানীর ভিড় ।সাংবাদিক , অনুবাদক , কুশলী ফটোগ্রাফার , নানা বিষয়ের লেখক লেখিকা ,ওস্তাদ ইন্টারভিউ করিয়ে , দক্ষ নিউজ ডেস্ক কর্মচারীতে অফিস বাড়ি গমগম করে ।সেখানে নিজের সামান্য অস্তিত্বটুকু প্রমাণ করাই মস্ত বড় একটা চ্যালেঞ্জের প্রশ্ন । অহনা প্রথম থেকেই মন দিয়ে নিজের কাজটুকু করতে ধ্যান দিল আর প্রতাপাদিত্য যে কোথায় সেঁধিয়ে গেল কে জানে ! প্রথম দিনের পরে অহনার সঙ্গে তার দুই একবার চোখাচোখি ছাড়া আর কোন যোগাযোগ হলনা ।কিন্তু কাজের বিষয় আলাদা হলেও অদ্বিতীয়াকে প্রায়ই চোখে পড়ে যেতে লাগল অহনার ।প্রথম কারণ অদ্বিতীয়ার অদ্ভুত সুন্দর চেহারা এবং ফিগার আর দ্বিতীয় কারণ অদ্বিতীয়ার বিচিত্র চালচলন ।
অদ্বিতীয়া দেখা গেল ভারি সরল ।বাহিরখন্ড নামক জায়গায় যে ফোর লেন রাজপথ নেই নামী ব্রান্ডের দামী দোকানপাট নেই বা অনলাইন অরডার করে খাবার দাবার আনার বিশেষ চল নেই এসব সে জানেনা বা না জানার ভাণ করে পুলকিত হয় । কেমন করে শাড়ি জামা পরলে বা চুল বাঁধলে তাকে স্মার্ট দেখাবে কেমন করে হাঁটা চলা করলে তাকে আরো একটু দেখনসই দেখাবে এসব সম্পর্কে সে নিতান্তই অজ্ঞ বা অজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতেই সে ভালবাসে । আবার শহরের সেরা বিউটি পার্লারের যত্ন ছাড়া তার দিন চলেনা । শুধু পিতৃগর্বে নিদারুণ গরবিনী সে । পিতার কৃতিত্বগুলি সকলের কাছে সবিস্তারে সুনিপুণভাবে বর্ণনা করতে সে নিরতিশয় আগ্রহী । সে অনেক কিছু না জানলেও এটা জানে যে আর পাঁচজনের থেকে সে কেন এবং কিভাবে আলাদা সেটা রীতিমত কায়দা করে প্রকাশ করতে হয় ।অমায়িক অসংবদ্ধ অথচ অত্যাশ্চর্য সব কৌশল ! অহনা প্রথম প্রথম অত বুঝত না ।ক্রমে বুঝল । বলা ভাল যে অদ্বিতীয়া তাকে বুঝিয়ে ছাড়ল ।তবু সমবয়সী সহকর্মী হিসেবে অদ্বিতীয়ার সঙ্গে কেন যেন একটু আধটু আলাপচারিতার সম্বন্ধ বজায় রাখতে চেয়েছিল অহনা কিন্তু অদ্বিতীয়ার পরাক্রমে সে স্রেফ রণে ভংগ দিল ।
দেখা গেল যে অদ্বিতীয়া ডিগ্রিধারী হলেও অফিসের কাজেকম্মে পটু নয় , ব্যবহারিক জ্ঞান তার নেই বললেই চলে । আরো অন্যান্য টেকনিকাল ব্যাপারেও সে নিতান্ত অপটু কিন্তু তার অপটুত্ব নিয়ে অফিসের ওপরমহলের কেউই কোনদিন একটি টুঁ শব্দও উচ্চারণ করল না । উল্টে অদ্ভুত সব উপায়ে সে মানুষজনের প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠল ।তার পরম দক্ষতা দেখা গেল আত্মউন্মোচনে । নিজের যে কোন অপকার্য সে সবিস্তারে অত্যন্ত সরল মুখে এবং অক্লেশে বর্ণনা করতে পারত এবং সে ব্যাপারে তার কোন রকম জড়তা থাকত না ।আবার সে যখন বর্ণনা করত তখন তার বলার ভঙ্গিতে ব্যাপারগুলো যে অপকার্য সেটা মনেই হত না ।
যেমন অদ্বিতীয়া হয়ত হিন্দি অনুবাদক রমেশ ঝাকে গল্পের ছলে বলছে ----আমার পরের দুই ভাই বোনের মধ্যে ভাইকেই এবার পুজোয় জামাকাপড় দিচ্ছি । বোনকে আর দিচ্ছিনা । ওকে বরং একদিন দামি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেব । তাহলেই যথেষ্ট হবে।
হিন্দি অনুবাদক রমেশ ঝা অবাক হয়ে বলছে ---- কিঁউ এয়সা কিঁউ? ছোটী বহিন ঔর ছোটা ভাই তো এক বরাবর হ্যাঁয় ।
অদ্বিতীয়া সরল মুখে বলত – ভাই আর বোন এক হয় বুঝি ? ভাই মানে পুরুষমানুষ । একটু বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য । তাই ওকেই পুজোয় দেব । আর বাবা তো আমাদের সকলকে পুজোয় জামা কাপড় কেনার জন্য মোটা টাকা দেবেনই । আমি এবছর থেকে চাকরি করছি তাই চক্ষুলজ্জার খাতিরে ভাইকে অন্তত কিছু দিতে হবে । নইলে ক’টাকাই বা মাইনে পাই ? বাবা বলেন কোন টাকা খরচ করতে হবেনা মা । সব টাকা তোমার নামে ব্যাঙ্কে ফেলে দেবে । চাকরিতে তো তোমার কোন প্রয়োজন নেই মা । চাকরি তোমার সময় কাটাবার উপায়।
নিম্নবিত্ত পরিবারের আর এক মফস্বলী মেয়ে নিউজ ডেস্কের আবীরা বলে ফেলত –আর তোমার হাতখরচ ?
-----হাতখরচ আবার কী ? বাড়ির গাড়িতে আসছি যাচ্ছি। দেদার টাকা বাড়ি থেকে পাচ্ছি । যা দরকার পড়বে বাবাকে বলব । বাবা কিনে দেবেন । আমি আর খরচা করব কেন ? অফিসের সামান্য মাইনেটুকু বরং জমিয়ে রাখব । স্যাটিসফ্যাকশন বাড়বে ।
সকলেই জানে যে অদ্বিতীয়ার বাবা একজন শিল্পপতি । তবু শুধুমাত্র স্যাটিসফ্যাকশন পাওয়ার জন্য তাঁর আদরের মেয়ে এই সামান্য চাকরিটুকু করতে এসেছে , এই কথায় আবীরার পাশে বসা রত্না মিত্রের একেবারে জ্বলে গেল । রত্না অন্যবার্তার খেলার খবরগুলো কভার করে । বলে উঠল --- তা অদ্বিতীয়া , তোমার চাকরি করারই বা কি দরকার ? যদ্দুর জানি তোমার বাবা তো একজন টাকার কুমীর ! আর তোমার অন্য দুই ভাই বোন নিজেদের ব্যবসাটাই দেখাশুনা করে । তুমিও তাই করতে নাহয় ।এইসব সামান্য মাইনের চাকরি করতে আসতে হত না !
অদ্বিতীয়া রত্নার দিকে একবার তেরছা চোখে তাকিয়ে চিরচেনা সরল ভঙ্গিতে বলে উঠল --- খেলার মাঠে ঘুরে বেড়ানো লোকজনেরা বুঝি এখন টাকার কুমীরদেরও খবর জোগাড় করে ?না ভাই আমি আমার ভাই বোনেদের চেয়ে লেখাপড়া অনেক বেশি জানি । তাই নিজেকে একটু বাজিয়ে নিচ্ছি ।
রত্না বিড়বিড় করে যেত --- তুমি নিজেই তো সকলকে বাজাচ্ছ । নিজেকে আর বাজাবে কখন ----
আবীরা ফিসফিস করত ---এই রত্নাদি চুপ কর প্লিজ ----
এইভাবে অদ্বিতীয়া অবিরাম তার নানান বিচিত্র খেয়াল ও ধ্যানধারনার কথা শিশুর সরলতামাখা মুখে বলে যেত আর উপস্থিত লোকজন রীতিমত আশ্চর্য হয়ে সেই অমৃতকথন শুনত । কেউ কেউ বিচিত্র কনসেপ্টের অধিকারী হয় ঠিকই কিন্তু এইভাবে প্রকাশ করতে কারুকেই কখনো দেখা যায়না যে !!
ইস্যু সেকশনের অমরবাবু ধারেকাছে থাকলে বিগলিতভাব মুখে মাখিয়ে বলেন ---বাঃ বাঃ ঠিকই বলেছেন । আজকালকার দিনে সকলে তো নারী পুরুষের সমানাধিকার বলে নাচে কিন্তু সত্যিই কি ছেলে মেয়ে সমান ? কক্ষনো না ।
অদ্বিতীয়া সরল্ভাবে বিগলিত হাসে । তার হাসিতে একটা হালকা ইঁ ইঁ শব্দ প্রকাশ পায় ।আহ্লাদি গলায় বলে --- নাঃ বাড়িতে আমার মত করে আর কেউ ভাবেনা । আমিই এমন করে ভাবি । কেন ভাবি বলুন না ?
অমরবাবু কোন লাগসই উত্তর খুঁজে পাননা । বশংবদের মত সৌরেশ দত্তের মেয়ের পিছু পিছু যান ।আজ নিশ্চিত অদ্বিতীয়া গাড়িতে লিফট দেবে তাঁকে । অমরবাবু খুব একটা দূরে থাকেন না কিন্তু দামি এয়ার কন্ডিশানড গাড়ি থেকে বাড়ির সামনে নামার মধ্যে বেশ একটা ইয়ে ইয়ে ব্যাপার আছে । অমরবাবু আজ সেটাই অনুভব করার সুযোগ পাবেন । রিটায়ার করতে আর দু বছর বাকি । এত বছরে এটাই শিখেছেন যে সুবিধে ছোট হোক বা বড় নাগালের মধ্যে এসে গেলে তা সবসময় গ্রহণ করা উচিত।
এই অফিসে চাকরি পেয়ে অহনার খাটুনি বেড়েছে ।অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে রোজই সন্ধে ছটা বাজে। তারপর তারকেশ্বর লোকাল ধরে নিয়মিত ডেলি প্যাসেঞ্জারির ধকল ! বাড়িতে মাকেও কাজেকম্মে সাহায্য করতে হয় এখন । হরপ্রীতের চেহারা একটু ঝুঁকেছে । হরপ্রীতও মেয়ের ওপরেই নির্ভর করেন এখন ।
নতুন জয়েন করা ছেলে মেয়েদের মধ্যে অদ্বিতীয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে আর প্রতাপাদিত্য একটি গর্তে সেঁধিয়ে থাকা জীব । এই দুই ধরনের মানুষই অহনা জন্মে দেখেনি।প্রতাপাদিত্য অফিসের কোন ব্যাপারে মাথা গলায় না , এমনকি নিজের ব্যাপারেও সে নির্লিপ্ত থাকে । সারাদিন বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে হয় অফিসের কাজ করে নয় খবরের কাগজ পড়ে । ।তারপর ছুটি হলে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ভূতে তাড়া করা মনিষ্যির মত ছুটে বাড়ির দিকে রওনা দেয় ।
যে যার কাজ করে বা সময় পেলে একে অপরকে তৈল মর্দন করে । এর বাইরে এই লোকগুলির আর কিছু করারও নেই , চাওয়ারও নেই । স্কুল কলেজ জীবনের উচ্ছল আনন্দের পরে অফিসের এই অদ্ভুত পরিবেশে অহনার কষ্ট হয় । তৈলমর্দনের কোন সীমা পরিসীমা নেই। কে যে কখন কাকে কিভাবে হাতে রাখতে চেষ্টা করবে বোঝা মুস্কিল ! অহনা এত পারেনা ।তার পছন্দ না হলে সে একে তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দেয় । কারো কারো কাছে অপ্রিয় হয় কিন্তু আর পাঁচজনের মত তৈলবিলাসী হতে পারেনা ।
অফিসের পুরনো সাংবাদিক প্রিয়বাবু , সত্যেনবাবু বা মিত্রদা বা উর্দু ভাষার দক্ষ অনুবাদক রৌশন আলিকে দেখতে পেলেই অদ্বিতীয়া গাড়িতে লিফট দেয়ার অফার করে । এখান ওখান শপিং করতেও যায় ওদের সঙ্গে । সরল মুখে বিচিত্র সব গল্প করে । সেসব গল্পে ---কোনদিন তার মা বাড়ির ম্যানেজারের সঙ্গে আবার কখনো বা বাড়ির হাউস ফিজিসিয়ানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে , কোনদিন সে নিজে তার পিতৃবন্ধুকে বিছানায় যাওয়ার আমন্ত্রন জানায় । আবার কোনদিন সে ছেলেবেলায় ফিরে যায় । স্কুলে পড়তে তার মা কেমন করে তার বালিকা বান্ধবীদের অপমান করে আনন্দ পেতেন এসব কথা ফলাও করে বলে চলে সে । তার বোন বিয়ের আগেই কবে কবে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে এসব কথাও এসে যায় গল্পে । ভাই বাবার ব্যবসা থেকে লাখ লাখ টাকা যখন তখন সরাচ্ছে নেশা করছে বা স্রেফ টাকা উড়িয়ে দিচ্ছে এসবও বলে অদ্বিতীয়া ।অদ্বিতীয়া সবেতেই খুশি । সবই তার কাছে গ্রহণযোগ্য । আড্ডা গল্পের উপাদান । ঐসব ব্যক্তিরা অদ্বিতীয়ার এসব অতি ব্যক্তিগত কথা শুনে চমৎকৃত হন আবার অদ্বিতীয়ার অসাক্ষাতে এইসব রসালো গল্পের শাখা প্রশাখা বিস্তার করে পাঁচজনকে শুনিয়ে আসর গরম করেন । তবু অদ্বিতীয়ার বাবার প্রতিপত্তিকে খর্ব করতে পারে এমন একটি কথাও জনসমক্ষে উঠে আসেনা । অদ্বিতীয়ার বিচিত্র জীবন যাপনের গসিপ ছাপিয়ে মেয়েটির ঢাক ঢাক গুরগুর না করা স্বভাব এবং সত্য অক্লেশে প্রকাশ করার চূড়ান্ত অহঙ্কার দেখে মানুষজন অদ্বিতীয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে । অদ্বিতীয়াকে কেউ এড়িয়ে চলে না বরং তাকে ঘিরে উত্তেজনার পারদ চড়তেই থাকে । অদ্বিতীয়াও মশগুল হয়ে থাকে তার নিজস্ব ভুবনে । নিজেকে নিয়ে এবং বাড়ির সকলকে নিয়ে সে প্রতিদিনই অজস্র সব গল্প বলে কিন্তু কখনো কোথাও একটিও বিপরীত কথা বলেনা তার বাবা সৌরেশ দত্তের নামে !
একটা সময় দেখা গেল অদ্বিতীয়াকে ঘিরে শুধু গুনমুগ্ধ মৌমাছি নয় অজস্র প্রেমিক মৌমাছিরও আগমন ঘটল ।রানী মৌমাছির মত অদ্বিতীয়া তাদের ধন্য করতে লাগল ।কাছে দূরে চলতে লাগল প্রমোদ ভ্রমণ ।প্রেমিকদের গুঞ্জরণে অফিসের পরিবেশ আবিল হল । কানাঘুষো শুরু হল । সৌরেশ দত্তের মেয়ের জন্য পাবলিশিং হাউসের রেপুটেশন নষ্ট হচ্ছে নাকি ! দ্রুত কৌশল বদলে ফেলল রানী মৌমাছি । কিছুদিন বাদে দেখা গেল যে অন্যমন পাবলিশিং হাউসের বড়কর্তা জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগী অদ্বিতীয়াতে মুগ্ধ হয়ে পড়লেন ।
অদ্বিতীয়া সফল হল আর জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগীর জীবন অন্য ছকে বাঁধা হয়ে গেল । হয় অদ্বিতীয়ার অপরূপ আলিঙ্গন নতুবা মরণ কামড় ।এর বাইরে তাঁর জীবনে আর কিছু সত্য নয় । নারী মাকড়শার মত অদ্বিতীয়া মধ্য পঞ্চাশের জিতেন্দ্রনাথকে একটু একটু করে শুষে নিতে লাগল । নাঃ টাকা পয়সার চাহিদা তার নেই । অন্য কোন নেশায় মাতাল সে । আর ছেলেবেলা থেকেই এরকম নেশা বার বার মাতাল করেছে তাকে ।অহনাকে অনুগ্রহ করে একবার সে এরকম একটি গল্প করেছিল । অদ্বিতীয়ার বছর চোদ্দ বয়সে তাদের দুই বোনকে গান শেখাবার জন্য এক গানের মাস্টারকে ঠিক করা হয়েছিল। বাড়িতে এসে বা বলা ভাল সৌরেশ দত্তের বাড়ি কাম প্রাসাদে এসে গান শেখাতেন সেই মাস্টার । কিন্তু উঠতি বয়সের অদ্বিতীয়াকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিতেন তিনি । গান শেখাবার সময় মাঝে মাঝেই টেবিলের নিচ দিয়ে অদ্বিতীয়ার ফ্রক সরিয়ে হাঁটু ও থাইয়ের ওপর হাত বোলাতেন । আরো ওপরে ওঠারও চেষ্টা করতেন কখনো কিন্তু বাড়িতে মা থাকত অন্যান্য চাকরবাকররা থাকত বলেই হয়ত সে চেষ্টায় ইতি পড়ত । একজায়গায় থামতেন মাস্টারমশাই ।
অহনা চূড়ান্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল –আর তোমার বোন কিছু দেখতে পেত না ? একসঙ্গেই তো গান শিখতে তোমরা ?
উত্তরে অদ্বিতীয়া একটা সরল ওস্তাদি হাসি হেসে বলেছিল –ওর অত বুদ্ধি থাকলে তো !
---আর তুমি কেন মাকে বলে দিলে না ? সাংঘাতিক খারাপ লোক ঐ মাস্টার । তোমার বাবাকে বললেই তো লোকটার জেল হাজত হয়ে যেত !
অদ্বিতীয়া মুচকি হেসে অহনার সামনে থেকে উঠে যেতে যেতে বলে গিয়েছিল --- ভাল লাগত মাস্টারকে। মাকে বলব কেন ? আমি তো চেয়েছিলাম লোকটার হাত আরো অনেক দূর অবধি পৌঁছাক !
অহনা নিরুত্তরে মাথা নিচু করে বসেছিল অনেকক্ষন । তার গা ঘিনঘিন করছিল। ইস সেও যদি ওই প্রতাপাদিত্যর মত গুটিপোকার মধ্যে ঢুকে থাকতে পারত!
অদ্বিতীয়ার সেই বহুচর্চিত প্রবল প্রতাপান্বিত বাবাকে সে এক দুবার দেখেছিল । গাড়ি নিয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন । দরকারের বাইরে কাউকে যেন দেখতেই পাননা উনি । অহনা মনে মনে গালি দিয়েছিল লোকটাকে ----অহঙ্কারী উন্নাসিক লোক একটা । ওই লোকটার জন্যই আজ এই মেয়েটা হয়তো এরকম ! অতি আদরে বাঁদর !
কিন্তু বছরের পর বছর এভাবে গেলনা । পরিস্থিতি বদলাল ।অদ্বিতীয়ার চালিয়াতি ছাপিয়ে তার মানসিক অসুস্থতা প্রকট হয়ে পড়ল । কাজকম্ম কথাবার্তা আগের মত থাকলেও সুর ছন্দ তাল সবই যে কেটে গেছে এ কথা সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেল । প্রতিদিনই বাড়তে লাগল অসংলগ্নতা ! ক্রমে তার স্তাবক গোষ্ঠীর সকলেই তাকে পরিত্যাগ করল ।আগে যারা অদ্বিতীয়াকে দেখলে কথা বলার জন্য দৌড়ে আসত বা তার সঙ্গে একদিন বেড়াতে যেতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করত তারা এখন অদ্বিতীয়াকে দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে । পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে । কারণ এখন অদ্বিতীয়া কোন রসের কথা বলে না । যে কোন ব্যক্তিকে পাকড়াও করতে পারলেই একটানা অনাবশ্যক সব কথা বলতে থাকে । কোন দোকানে সস্তায় কি কি জিনিস পাওয়া যাচ্ছে তার লম্বা লিস্ট দেয় -----রাসবিহারীতে অমুক দোকানের দুটো সার্ট কিনিলে একটা সার্ট ফ্রি , চাঁদনিতে চারটে বাটি কিনলে আরো চারটে ফ্রি , ডালহৌসিতে ফুটপাথে অবিশ্বাস্য কম দামে ঢালাও বিক্রি হচ্ছে তারাশঙ্কর রচনাবলী , পার্ক স্ট্রিটের তমুক দোকানে সাতখানা শিফন শাড়ির দাম মাত্র পাঁচ হাজার টাকা --- ইত্যাদি ইত্যাদি ---
লোকজন এখন তাকে এড়িয়ে চলে বলে এখন অদ্বিতীয়া একা একাই কলকাতা চষে বেড়ায় ! বিভিন্ন দোকানে গিয়ে নানান সুলুক সন্ধান করে ।
জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগী চাকরি বাঁচাবার তাগিদেই হোক বা চাকরি অতিরিক্ত ভিন্নতর কোন অনুভব থেকেই হোক অদ্বিতীয়াকে পরিত্যাগ করতে পারলেন না । অফিসের বড়সাহেব হিসাবে অলক্ষ্যে থেকে নারীটিকে শত সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে চলবার প্রানপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন ।
অহনা এখন আর বড়সাহেবকে ভয় পায়না , ওঁর জন্য বড্ড করুণা হয় মনের মধ্যে । অদ্বিতীয়ার চিকিৎসা চলে ।কিন্তু সে কিছুতেই ভাল হতে পারেনা । সে অফিসের কোন কাজ করে না ।শুধু অফিসে এসে সকলের বিরক্তি উৎপাদন করে কিন্তু তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা কারো কল্পনাতেও আসেনা । অদ্বিতীয়া কখনো ছুটি নেয় না । রোজ অফিসে আসে । তাকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেউ ছুটি নেওয়ার কথা বলতে গেলে সে সেই ব্যক্তিকে গালি দেয় ।কখনো সে সীটের চারপাশে জল ফেলে নোংরা করে কখনো কুচি কুচি কাগজ ছড়িয়ে নোংরা করে । তাকে অফিসের কোলাহলের বাইরে আলাদা একটি কিউবিকলে বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে । সেখানে সে তার যাবতীয় বিসদৃশতা নিয়ে আত্মগোপন করেছে ।আগের মত ছিপছিপে ফিগার নেই তার ।মনোরোগের দাপটে সে অবিরাম প্রচুর খাবার অর্ডার করে আনিয়ে খায় । ফলে মস্ত মোটা হয়েছে । ওজন একশো কেজি । ফর্সা ধপধপে রং এখন আরো খোলতাই । জামাকাপড় প্রায়ই এলোমেলো হয়ে যায় । সরে যায় আঁচল । চর্বিসর্বস্ব বুকের উপত্যকার সুবর্তুল ছন্দ বেপথু বিশ্রী । থপথপে গতিতে মন্থর চলন । স্মৃতি হয়ে গেছে মরালীসদৃশ ভঙ্গি ও দ্রুত সুন্দর গমনভঙ্গি ।
তার বাড়ি থেকে এখন তাকে নিতে বেশিরভাগ দিন গাড়ি আসেনা । যেদিনগুলোয় গাড়ি আসেনা বড়সাহেব নিজের গাড়িতে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন।অফিসে কানাকানি হয় --- এখনো কি জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগী অদ্বিতীয়াকে নিয়ে বিশেষভাবে সময় কাটান ? অমরবাবু বলেন –বৈরাগী এতদিনে সত্যিকারের বৈরাগ্য নিল !
প্রিয়বাবু হাসতে হাসতে বলেন --- আহা আগে ছিল টগবগে ঘোড়া আর এখন হয়েছে বুড়ি হাতি । বৈরাগীর জন্য কষ্ট হয়----
রৌশন আলি বিড়বিড় করেন ---- তুম ভি ওহ ঘোড়ি কো পিছা কিয়া থা সালে ---
সত্যেনবাবু রৌশন আলির দিকে মুখ বেঁকান । বিড়বিড় করে বলেন --- ঔর তুম ভি---
খিক খিক হাসির ঝড় ওঠে ।প্রতাপাদিত্য নামে ছেলেটি ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায় । অহনা মাথা নিচু করে বসে একটা এপ্লিকেশন লেখে ।তার বয়ফ্রেন্ড সৌহার্দ্যর সঙ্গে পরশুই বিয়ে করছে সে । অনেকদিনের বন্ধুত্ব তাদের । দুজনের ইচ্ছেতেই সাধারন সাদামাটা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হচ্ছে তাদের। বাড়ির ক’জন ছাড়া আর কাউকেই বলছে না তারা । অফিসেও জানাচ্ছে না । এই পরিবেশের কাউকেই জীবনের বিশেষ দিনটিতে আমন্ত্রন জানাবার ইচ্ছে নেই তার।এপ্লিকেশনে দিন কয়েকের ছুটি চাইবে শুধু । কারণ হিসাবে ‘ব্যক্তিগত কাজ আছে’ এইটুকুই শুধু উল্লেখ থাকবে । পরে কখনো আবার এপ্লিকেশন করেই বিয়ের ব্যাপারটা সে জানিয়ে দেবে অফিসে ।
ক’টা দিন তুমুল আনন্দে কাটিয়ে প্রায় দিন সাতেক পরে অফিসে জয়েন করল অহনা । এর মধ্যে হানিমুনটাও সেরে নিয়েছে সে । খুশি খুশি মনে অফিসের কাজ সারছিল । অদ্বিতীয়া এসে তার সিটের সামনে দাঁড়াল । মনটা খিঁচড়ে গেল তার । এইরে ! এক্ষুনি অদ্বিতীয়ার হাজারো ফালতু কথা শুনতে হবে তাকে ! অহনা কাঁচুমাচু মুখে বলল ----একটু ব্যস্ত আছি গো । পরে কথা বললে হবে ?
---পরে ? আচ্ছা । পরেই আসব ।
অদ্বিতীয়া চলে যাচ্ছিল । সেই মন্থর গমন । বিশাল মোটা চেহারায় কোনমতে জড়ানো একটি দামি তাঁতের শাড়ি আর বুকের আঁচল অবিন্যস্ত ।
কিছুটা গিয়ে ফিরে এল সে । বলল ---পরে আর সময় হবেনা হয়তো । তাই এখনই বলব ।
ওর গলায় আকুতি স্পষ্ট । অহনার খারাপ লাগল । সে বলল ----আচ্ছা আমি তোমার কিউবিকলে যাচ্ছি । ওখানেই কথা হবে ।
---নাঃ ওখানে যেতে হবেনা । আমি এখানেই বলে যাচ্ছি ।
---কি বল –
অদ্বিতীয়া অহনার হাতদুটো ধরে বলে --- আমার কাউকে ভাল লাগেনা । ভাল লাগেনি কখনো তাই যে কোন মানুষের নামে যেকোন কথা আমি অনায়াসে পাব্লিকলি বলে দিতে পারি ।এজন্য আমার কোন আত্মগ্লানি হয়না ।আর শুধু অপরের নামে হবে কেন ? আমি নিজের নামেও যে কোন কথা বলি , দেখেছ বোধহয় । কিন্তু এই চাকরি করতে এসে এই প্রথমবার আমার তোমাকে ভাল লেগেছিল ।
---আমাকে ? অহনা চমকে ওঠে ।
---হ্যাঁ তোমাকে ।তুমি খুব ভাল । অন্যদের মত নও । খাঁটি মানুষ ।
অদ্বিতীয়া চলে যাচ্ছিল । সর্বহারা এক নিঃস্বতা ফুটে উঠেছে ওর সর্বাবয়বে ।অহনা পিছন থেকে ডেকে বলল ---- তোমাকে কেউ কখনো ভালবাসেনা অদ্বিতীয়া ?
ফিরে দাঁড়ালো সে ---হ্যাঁ বাসে তো । একমাত্র আমার বাবা আমাকে ভালবাসেন ।
---আর তুমি ?
---হ্যাঁ , আমিও বোধহয় বাসি ।
---আর তোমার মা ভাই বোন ?
অদ্বিতীয়া করুণ হেসে বলল ---ওরা আমায় ঘেন্না করে । আমি বরাবর বাড়িতে বাজে বকে সকলকে জ্বালাতাম তো --তাই –
---অফিসের মত বাড়িতেও বাজে বকতে ?
---হ্যাঁ ।আসলে একটু শান্তি চাইতাম । চাইতাম সবাই ভালো মানুষ খাঁটি মানুষ হোক !
অদ্বিতীয়া চলে যায় । এই প্রথমবার অদ্বিতীয়ার জন্য বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে অহনার ।
সন্ধেতে ফার্স্ট শিফটের স্টাফেরা যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগপত্র গুছাচ্ছে অফিসের সিকিওরিটি গার্ড যোগেশ্বর দৌড়ে এল ওপরে ---- এক দিদিকো হার্ট এটাক হো গ্যয়া ।হসপিটাল লেনা পড়েগা । ডক্টর আয়া ।
অহনারা যতক্ষনে নিচে গিয়ে পৌঁছাল ততক্ষনে অদ্বিতীয়ার শেষ নিঃশ্বাস মিশে গেছে অন্যমন পাবলিশিং হাউসের বাতাসে । ম্যাসিভ হার্ট এটাক ।অহনা বাড়ি গেলনা ।ভিড়ের মধ্যে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। কেউ এলনা বডি নিতে । ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার পরে বড়সাহেব অদ্বিতীয়ার মরদেহ নিয়ে আরো ক’জন অফিস স্টাফের সঙ্গে সৌরেশ দত্তের বালিগঞ্জের বাড়ি তথা প্রাসাদের দিকে রওনা হলেন । রাত হয়ে গেছিল । তবু অহনা সঙ্গী হল ওদের ।সবিস্ময়ে দেখল প্রতাপাদিত্য মিত্র শবযাত্রার সঙ্গী হয়েছে ! অফিস ছুটির পরে ভূতে তাড়ানো মনিষ্যির মত দৌড়ে পালায় নি আজ।অহনার মত তারও দু চোখের কোল চিকচিক করছে !!!
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন