✓ রাহুল ঘোষ | চোখের বারান্দা থেকে

মিছিল


অনেকদিনের ক্লান্ত চোখ ঘুম চাইছিল। তবু ঘুম ছিল না কোথাও! কোনো এক শায়েরানা উচ্চারণে পঠিত হচ্ছিল,​

"ইয়াহাঁ কিসিকো ভি কুছ হাসব-এ-আরজু না মিলা
কিসিকো হম না মিলে অউর হমকো তু না মিলা।"​

এভাবেই কেটে যাবে বলে হয়তো প্রস্তুত হচ্ছিল দিন। যদি অবশ্য তাকে আদৌ 'কেটে যাওয়া' বলে! কিন্তু নিয়তি কবেই-বা ছকে বাঁধা পথ ধরে চলেছে! এক অভাবিত পরিস্থিতিতে সে আবার নিবিড়ে পৌঁছে যায় ঠিক। গন্তব্যটি চিরকালীন বলেই হয়তো! অতএব একদিন অক্লেশে সরে যায় প্রাচীর। প্রাথমিক দ্বিধার কুয়াশা কাটিয়ে, জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়ি। সহজেই আগের সুরে বেজে ওঠে জলতরঙ্গ। পৃথিবীর বুকে এমন ব্যাপার অল্পই ঘটে থাকে, যা আসলে কখনও হারায় না! ছাই হয়ে যাওয়া ফিনিক্সের মতো, ফিরে আসে ধ্বংসস্তূপ থেকে।

তবুও বিষাদ-বিকেল নামে। অথবা, মধ্যাহ্নেও ধূসর আকাশ। রেখে যাওয়া যাবতীয় উদ্ভাস কীভাবে যে ম্লান হতে থাকে তখন! কোনো এক বিচ্যুতির অন্ধকার আজও দানবীয় হাতে মুছে দিতে থাকে তার যাবতীয় সঞ্চয়। অক্ষরের ছোটো-ছোটো ভাঁজে অজান্তে জমতে থাকে লেখা-পড়ার ভুল। সংলাপে আবার জমতে থাকে​ বিচ্ছিন্নতার সম্ভাব্য ছায়াছবি। অথচ ফিরে এসে চাওয়ার ছিল গাঢ় নীল রঙের দিন। সুরভিত রোদের মিঠাস। সুরেলা পাখির শিসে ভরে যাওয়া মন। কিন্তু এখানে এখনও পাতাঝরার শব্দ পাওয়া যায়। তাকে পদপিষ্ট করে হেঁটে যাওয়ার মর্মর। অজান্তে ভিজে ওঠে চোখ। এমনটা কোনো দূরবর্তী দ্বীপে ঘটতে দেখলে, অনায়াসে বলা যেত —

"আঁসু নিকল আয়ে তো খুদ পোছিয়েগা
লোগ পোছনে আয়েঙ্গে তো সওদা করেঙ্গে।"

কিন্তু চিরচেনা নদীর ক্ষেত্রে তো এই কথা প্রযোজ্য নয়! এখানে জীবনকে অনেক দিয়েছে সে। এখনও দিয়ে চলেছে সাধ্যমতো। নিকটতমার কাছে তাই অনুযোগ থাকে শুধু। একবার করে যাওয়া কালোর ভার কি আজীবন বয়ে যেতে হবে!

ঈশ্বরী হয়তো ভেবেছিল, কনফেশন শেষ হয়ে গেছে। এইসব স্বীকারোক্তি যে আসলে নেহাতই মৃদু, একথা তার মুখে কোনো এক ক্ষুব্ধ মুহূর্তে ঝড় হয়ে আসে। এমন মুহূর্তে বোঝা যায়, এই টান গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ফিরে এলেও, পায়ের নিচে এখনও কতটা ভঙ্গুর হয়ে আছে মাটি! সুতো ছিঁড়ে যাওয়া এবং জোড়া লাগার এই যাপনকাহিনিতে এমনটাই হয়তো হওয়ার ছিল! সময়ের পাতা থেকে নিজস্ব হাহাকারকে গোপন রাখার চেষ্টা চলতে থাকে তাই। কিন্তু ওই অনিবার্য কালোকে যদি কোনোদিন পরাজিত করা না-যায়? তাহলে কোথাও আবার উচ্চারিত হবে,

"সবকুছ পা কর ভি হাসিল-এ-জিন্দগি কুছ ভি নেহি​
ম্যায়নে দেখে হ্যাঁয় এক সে এক সিকন্দর খালি হাত যাতে হুয়ে।"

তবুও এই চোখের বারান্দায় যে আন্তরিক নোনাজল ছিল, মৃন্ময়ীর দিনলিপি সেকথা কি কোনোদিন লিখবে না?


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ