কৃষ্ণা কর্মকার | রামধনু

Michil

--- রণ, তুই কিন্তু প্যাকেটটা এখনো খুললি না।

----- থাক, ওটা ওরকম‌ই থাক।

----- আরে, দরকারি যদি কিছু হয়?

----- সব দরকার না মিটলেও জীবন চলে মিমি।

----- আচ্ছা, তোর দরকার না হলেও আমার --- আই মিন, আমাদের জন্য দরকার হতে পারে।

----- মিমি, তুই - আমি কি এমনই একটা কাপল্ , যে সামান্য দরকারটুকুকেই অনিবার্য মনে হবে!

----- তা কেন রণ ? আমরা দুজনেই জানি, আমাদের কেমিস্ট্রিটাই হলো, লিমিটেশন অফ ডিমাণ্ডস। অল্পেই আমরা দিব্যি ভালো থাকি। কিন্তু কিয়োরিওসিটি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! কী আছে, না জেনেই.....

----- প্লিজ মিমি, আমি তো কোনো ব্যাপারেই তোর অবাধ্য ন‌ই, এটা থাক....

মিমি রণের মুখের দিকে তাকিয়ে টের পেলো, চোখের কোণে, চিবুকের খাঁজে যন্ত্রণা চুঁইয়ে পড়ছে। ও আলতো করে রণকে জড়িয়ে নিল নিজের সঙ্গে। মিমির বাঁ কাঁধে টুপ টুপ করে যেন শিশির ঝরছে। ও বুঝলো কিছু কষ্টের ভাগ নেবার সাধনা মানুষকে আজীবন করে যেতে হয়। ও নীরবে ঝরতে দিল রণকে।



তুতান একটা রামধনু কিনতে চায়। আর চায় অর্জুনের তীর ভরা তূণীরটা। হাতে পেলেই সে তার ইচ্ছেগুলোয় লক্ষ্যভেদ করবে ---- করবেই। তার ইচ্ছের তালিকাটা অবশ্য কম লম্বা নয়। রামধনুতে একটা ভালোবাসা মাখা তীর লাগিয়েই প্রথম তাক করবে বাবাকে। তীরটা সাঁই করে বাবার বুকে লাগামাত্র বাবা একছুটে চলে আসবে আর বলবে,

----- তুতান, আর কোনোদিন তোকে আর তোর মাকে ছেড়ে যাবো না। আমি তোকে খুব ভালোবাসি।

তুতানের দ্বিতীয় লক্ষ্য হবে ওদের ক্লাসটিচার। মিষ্টি রসে ডোবানো তীরটা মুখের ভেতর ঢুকে গেলেই আর কক্ষনো বলতে পারবে না,

----- মাইণ্ড ইট, ইউ আর সিঙ্গেল প্যারেণ্ট’স চাইল্ড, তোমাকে স্কুল হাফ ফ্রি করেছে তোমার মায়ের জন্য। পড়াশোনা না করলে, সেটা ক্যান্সেল করা হবে।

ও বুঝতে পারে না, ও আর ওর মা গরিব কেন? বুঝতে পারে না, গরিব আর বড়োলোক, এইরকম ভাগে মানুষ ভাগ হয় কেন? কেন গরিব হ‌ওয়াটা মানুষ মেনে নেয়? ও একটা একটা করে তীর মেরে ওর সব চাওয়া পাওয়াগুলো ঠিক মিটিয়ে নেবে একদিন। ওর তূণীরে একটা স্পেশাল তীর থাকবে, রোদ্দুরমাখা। ওটা ও মায়ের দিকে ছুঁড়বে, তাহলে আর কোনোদিন মায়ের হাসিটা মেঘের মতো কান্না কান্না হবে না, সুমালির মায়ের মতো ঝকঝকে হবে। এসব ভেবে ভেবেই ও চোখদুটোকে নাগাড়ে আকাশে আটকে রাখে। যাতে রামধনুটা ফসকে না যায়! ওটা যে ওর চাই!

#

রণজয় আর মিমি বিয়েটা সারলো মোটামুটি জনকুড়ি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। তাদের মধ্যে দুজন রণজয়ের বন্ধু আর বাকিরা মিমির বাবা মা আর কাছের আত্মীয়। বিয়ের জাস্ট দিন পাঁচেক আগে রণজয় চুপিচুপি ওর মাকে খবরটা দিয়ে একটা টেক্সট করেছিল। আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে মা- ও একটা টেক্সট ফেরত দিয়েছিল। ওই পর্যন্তই। বাড়ির সঙ্গে রণজয়ের যোগসূত্র ছিঁড়েই গেছে বহুকাল আগে। হায়ার সেকেণ্ডারিতে দুর্দান্ত মার্কস নিয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ও পড়তে এসেছিল ফিজিক্স। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ডিগ্রির ঝুলিতে হীরেমতি পুরে স্কলারশিপ নিয়ে ডক্টরেট করতে চড়ে বসলো লণ্ডনের ফ্লাইটে। ততদিনে জীবনজোড়া আলো নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সহপাঠী মিমি। তার ভালোবাসার দীপ্তি চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে রণজয় ধীরে ধীরে আচ্ছাদিত করেছে তার ফেলে আসা জীবন। বারবার মিমি শুনতে চেয়েছে রণজয়ের বাড়ির গল্প, ছোটবেলার গল্প, মায়ের গল্প। গল্প? হ্যাঁ গল্প‌ই তো! মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা কলেজ পেরিয়ে। কবেকার কথা! গল্প মনে হয় আজ। না! সে গল্প মিমিকে বলা হয়ে ওঠে নি। মেয়েটা এতো নরম! পাথরের ঠোক্কর স‌ইতে পারবে না। লণ্ডনের পড়া শেষ করেই ও কোলকাতায় ফিরে, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেই প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছে। তারপর‌ই মিমিকে বিয়ে। মিমির বাড়ির সবাই খুব ভালো মানুষ। ফ্যামিলি মেম্বারদের ভেতর একটা দারুণ বণ্ডিং কাজ করে। এরা প্রত্যেকেই রণজয়ের ভেতরের মানুষটাকে দেখেছে, আর কিছু নয়। তাই একমাত্র মেয়ের বিয়েটা ধুমধাম করে না দিয়ে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ভেতরেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, যাতে রণজয়কে অস্বস্তিতে পড়তে না হয়। ও এখন মিমির ফ্যামিলির একজন ইমপর্ট্যাণ্ট মেম্বার।


দশ বছরের জীবনে এই প্রথম তুতানের বার্থডে সেলিব্রেশন। গোটাপাঁচেক ফ্রেন্ডস, একখানা চকোলেট কেক, মোমবাতি, চকচকে র‍্যাপারে মোড়া কয়েকটা গিফট, লুচি আলুরদম, পোলাও, খাসির মাংস আর আইসক্রিম মিলে সে এক জমজমাট ব্যাপার। জাঁদরেল, জেদি, মারকুটে বাবার কাছ থেকে ডিভোর্স পাবার বছর দুয়েক পর, তুতানের প্রাইমারি স্কুলের পার্শ্বশিক্ষিকা মা, তুতানের জন্মদিন পালন করছে। বাবাকে সেভাবে ভালো না বাসলেও তুতান ভেবেছিল, মা নিশ্চয় বাবাকে নেমন্তন্ন করবে আর বাবাও নিশ্চয় আসবে। হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই ও একটা ফাঁকা খোপ রেখেছিল ছোট্ট বুকটায়, বাবা এলে সেখানে বসাবে বলে। সেটা ফাঁকা রেখেই একলা মায়ের আদর মেখে ঘুমাতে গিয়েছিল রাতে। পরদিন ঘুম থেকে উঠে বিছানার পাশে বড়োসড়ো একটা গিফটের প্যাকেট দেখে চোখ চকচক করে উঠলো তুতানের। র‍্যাপারের গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা -- "তুতানকে বাবা"। বাবা এসেছিল! মা তাকে ডাকে নি পর্যন্ত! বুকের ফাঁকা জায়গাটায় ও বাবার জন্য কান্না ভরলো, মায়ের জন্য কি অভিমান না রাগ! রাগ‌ই হবে। নাহলে বললো কেন! ----

----- দেখেছো তো, বলেছিলাম না, বাবা আমাকে খুব ভালোবাসে? তুমি কিচ্ছু বোঝো না। কত্তো বড়ো গাড়ি এনেছে আমার জন্য, তুমি তো কোনো গিফট‌ই দিলে না।

------ পাগল ছেলে। আমার চুমোটা বুঝি কিছু নয়?

----- সে তো রোজই দাও, না চাইলেও দাও। কিন্তু গিফট পাওয়ার মজাই আলাদা। আচ্ছা মা, বাবা জানলো কী করে, আমি এইরকম একটা গাড়িই চাইছিলাম?

কথাটা শুনেই মা সেই কান্না কান্না হাসিটা হেসে তুতানের চুলগুলো ঘেঁটে দিল।

ও যে কেন এখনো রামধনুটা হাতে পেলো না! তীরগুলোই বা কোথায় আছে ! নাঃ ! তাকে পেতেই হবে ওগুলো। ও এবার একটা লম্বা দৌড় দেবে ওই রামধনুটার দিকে। সাতরঙের আলোয় তীর রাঙিয়ে ও একদিন তাক করবেই মায়ের মুখে। লক্ষ্যভেদ ওকে করতেই হবে।

#

রবিবার। রণজয়ের ঘুমোনোর দিন। বেলা বারোটা নাগাদ মিমি ওকে প্রায় ঠেলে তুললো। মাঝরাতের ঘুম চোখে নিয়ে মিমিকে জড়িয়ে ধরে পাশ ফিরতে যেতেই মিমি বললো,

----- এই যে ঘুমবুড়ো, গা তুলুন দয়া করে। দুয়ারে অতিথি তব।

----- অতিথি সৎকার - ডিপার্টমেন্টের যিনি হেড, হেডেক‌ও তার‌ই। আমার বরাদ্দ ঘুম কাড়তে এলে আমি ফৌজদারি মামলা করবো।

----- ওরে আমার মামলাবাজ রে। মোল্লার দৌড় কতদূর, আমি জানি। এই শোন, সিরিয়াসলি তোকে একজন ডাকছেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, বললেন, কৃষ্ণনগর থেকে আসছেন।

রণজয় ঝটকা মেরে উঠে বসলো,

------ কে? কোথা থেকে? কৃষ্ণনগর ?

শক্ত পাথরের মতো মুখ করে রণজয় বিকাশবাবুর সামনে বসে। যত্ন করে জলখাবারের প্লেট সাজিয়ে ধরে মিমি বিকাশবাবুকে খেয়ে যেতে অনুরোধ করলো। অনেক করে বলাতে, দুটুকরো ফল মুখে দিয়ে বললেন,

----- জীবনের সব ইচ্ছে অনিচ্ছে , খাওয়া দাওয়া আজকাল তুচ্ছ মনে হয় মা। তুমি বড়ো ভালো মেয়ে। এটুকুই নিলাম কিছু মনে কোরো না।

ক্লান্ত চোখদুটো তুলে বিকাশবাবু রণজয়ের দিকে তাকালেন। বুকের ভেতর থেকে এক তাল কষ্ট তুলে বললেন,

----- তোমাকে যা বলার ছিল সব বললাম। আগেও জানানো যেতো, কিন্তু তার যে কড়া নিষেধ ছিল। আমি সেই নিষেধের বেড়া ভাঙি, এমন সাধ্য কি আমার! যাবার আগে সে-ই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়ে গেল। তাই, এই অথর্ব শরীর নিয়ে আজ নিজেই এলাম, এও তারই হুকুম, ধরে নাও। এটা রাখো। কী আছে জানি না। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তোমার হাতে দিয়ে আমি ভারমুক্ত হলাম। আসি এবার।

রণজয় থমথমে মুখে তেমন‌ই বসে র‌ইলো। মিমি বিকাশবাবুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গিয়ে, হঠাৎ প্রণাম করলো। বিকাশবাবু অবাক মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মিমি বললো,

------ আবার আসবেন কাকাবাবু। আমি আপনার কথা খুব মনে করবো।

ঘরে ঢুকে মিমি দেখলো, রণজয় তেমনি বসে। ও আস্তে করে রণজয়ের কাঁধে হাত রেখে পিছনে দাঁড়িয়ে বললো,

----- তুই এসব কথা আমার কাছে লুকিয়েছিলি কেন রণ? কেন বলেছিলি, তোর মা মারা গেছেন কলেজে পড়ার সময়? কেন বলেছিলি তোর কেউ নেই? সাত বছরের প্রেমের পর তিন বছরের সংসার আমাদের। এখনো কি মনে হয়, আমি তোর জীবনের অংশীদার ন‌ই!

----- তোকে আমি কোনোকিছুর বিনিময়ে হারাতে চাই নি মিমি।

---- তাই বুঝি সব কিছু শেয়ার করতে পারিস না?

---- কী বলতাম? আমার মা একটা লোকের সঙ্গে থাকে, যে আমার বাবা নয়?

----- স্টপ! স্টপ রণ। আই বিলিভ, ইউ আর প্রপারলি এডুকেটেড পার্সন।

----- তো? এডুকেশন নিলে বুঝি ক্ষোভ যন্ত্রণা রাগ দুঃখ অপমানবোধ – কিচ্ছু থাকতে পারে না?

----- পারে। কিন্তু কথায় এবং আচরণে ভদ্রতা ছাড়ানো যায় না।

----- ভদ্রতা! কার জন্য? যে মা কলেজে পড়া ছেলের মানসম্মানের কথা না ভেবে, সমাজকে তুড়ি মেরে বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে থাকতে শুরু করে, তার জন্য? তুই জানিস না, সেসব যন্ত্রণার মুহূর্তগুলো কেমন হয়? হাজার হাজার আলপিন হৃদপিণ্ডটাকে ফুটো ফুটো করে দিলেও এই যন্ত্রণার কাছে সেটা তুচ্ছ – কিচ্ছু না। জানিস না, তুই আমার জীবনে না এলে আমি সুইসাইড করতাম।

---- রণ!

--- এম. এস. সি. -র গোড়ায় একটা রবিবার দেখে বাড়ি গেলাম। মা আমাকে অনেক কিছু রান্না করে খাওয়ালো, তারপর এই বিকাশবাবু নামে লোচ্চাটার সামনে নিয়ে গিয়ে বললো, ‘আমার বন্ধু । তোমার অভিভাবক ভাবতে পারো’। শালা! অভিভাবক! বাস্টার্ড একটা। আর ওই মহিলা ! আনফরচুনেটলি আমার জন্মদাত্রী! কী বলা উচিত তাকে! প্রস্......

----- রণ!

----- কীভাবে সেদিন হোস্টেলে ফিরেছিলাম জানি না, সেইসব বীভৎস দিনরাতগুলো কী করে পার করেছি, তোকে বুঝিয়ে বলতে পারবো নয়া।

রণকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মিমি। রণ থরথর করে কাঁপছে। মিমি ওর লাল হয়ে ওঠা চোখমুখ থেকে চুমোয় চুমোয় ব্যথাগুলো আস্তে আস্তে তুলে নিতে লাগলো।

----- আমায় ঘেন্না করছিস না তো মিমি? বল, প্লিজ বল। তুই ছাড়া আমার কেউ নেই। আমি আর কিছু চাই না, কাউকে চাই না। শুধু তুই আমাকে ছেড়ে যাস না .... লোকটা কেন এলো মিমি? কেন এলো? আমি না হয় নাই জানতাম, আমার মা ফিজিক্যালি মরে গেছে। আমার কাছে তো অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়ে গেছে।

----- প্লিজ রণ, এভাবে বলিস না, আমার কষ্ট হচ্ছে রে।

মিমি আদরে সোহাগে রণকে শান্ত করে। তারপর বেশ কয়েকদিনের দিনের কাউন্সেলিং এ রণজয়কে স্বাভাবিক করে তুলতে পারলো। তারপর একদিন বসলো মুখোমুখি,

------ রণ, আমি তোকে এতো ভালোবাসি কেন জানিস?

রণ একটু অবাক হয়েই মিমিকে দেখলো, তারপর একটু হালকা মেজাজে বললো,

----- কেন রে? প্লিজ বল, তুই আমার মতো হ্যাণ্ডসাম আর দ্বিতীয়টি দেখিস নি!

--- না রে, পারলাম না, তুই তো জানিস আমি মিথ্যে কথা বলতে পারি না।

--- তাহলে আর কি, সত্যিটাই বল – ‘তোমরা যা বলো তা বলো, ওই কালো আমার ভালো লেগেছে’।

--- বি সিরিয়াস রণ। আমি তোর আনসারটা শুনতে চাই।

--- আচ্ছা বাবা! সরি। মিমি, প্রশ্নটা আমারও। সত্যিই আমি জানি না, আমার কী আছে, যার জন্য তুই আমাকে এতো ভালোবাসিস?

----- তোর এই মনটা না ,ওই আকাশটার মতো বড়ো – সীমানাহীন।

----- তাই বুঝি!

----- কখনো তুই আমাকে মুখ ফসকেও এতটুকু হার্ট করিস নি, জেণ্ডার বায়াসড হওয়া তো দূরস্ত, কখনো ভুল করেও মনে করিয়ে দিস নি আমি একটা মেয়ে। আজ পর্যন্ত কোথাও কোনোভাবে আমার অসম্মান হতে দিস নি। কী করে তুই এমনটা হলি বলতো?

----- আমি জানি না।

----- আমি জানি।

----- কী জানিস?

----- তুই তোর মায়ের প্রপার গাইডেন্সে বড়ো হয়েছিস।

----- মিমি স্টপ ইট, প্লিজ ।

----- না, আজ তুই কিছু বলবি না। শুধু আমাকে শুনবি। তোর মা, তোর বাবার ক্রূয়েলটি থেকে তোকে আগলে রাখার জন্য ডিভোর্স নিয়ে তোকে মানুষ করেছেন। সামান্য আয়ে তোকে অসামান্য খুশি এনে দিয়েছেন। তোকে তোর ইচ্ছেমতন লেখাপড়া শিখতে দিয়েছেন। ভাবনার স্বাধীনতা দিয়েছেন। ভাব একবার রণ, কেউ পাশে ছিল না। একা একটা মানুষ দিনের পর দিন নিজেকে উজাড় করে লড়ে গেছেন তোকে একটা সত্যিকার মানুষ হিসেবে বড়ো করার জন্য। তারপর তুই যখন নিজের রাস্তা পেয়ে গেছিস, তখন তিনি একটু নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছেন, একজনকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছেন।

---- মিমি, তুই চুপ করবি?

--- তুই সেদিন বিকাশবাবুর মুখের দিকে ভালো করে তাকাস নি রণ, তাকালে বুঝতিস, তাঁর বুকের কত গভীরে মা বসে আছেন। আচ্ছা বল, সত্যিকার ভালোবাসা ছাড়া একটা মানুষের জীবনে আর কীই বা পাওয়ার আছে! আমি যতটা মানুষ ঠিক ততটাই একজন মেয়ে রণ, আমি বুঝি, তোর কাঁধটা আমার জন্য কত জরুরি। মাকেও ঠিক এই নির্ভরতাটাই কাকাবাবু দিয়েছেন রে।

------ তোর পায়ে পড়ি মিমি! প্লিজ চুপ কর।

----- কষ্ট পাচ্ছিস? একটু কষ্ট নাহয় পা রণ, কষ্টের ভেতর দিয়েই হয়তো ওঁদের রিলেশনটাকে রেসপেক্ট করতে পারবি। আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ জমে রে, কিন্তু তার অনন্ত নীল কি তাতে ঢাকা পড়ে?



তুতান রামধনুটা হাতে নিয়ে একটা নক্ষত্রের দিকে ছুটছে। ওর পিঠে অর্জুনের তীর ভরা সেই তূণীরটা। ও ঘাড় না ঘুরিয়েই হাত দিয়ে ওর বহু আকাঙ্ক্ষিত তীরটা তূণীর থেকে বের করলো। তীরটার গায়ে লেগে আছে সকালের মিষ্টি রোদ্দুর। ও নক্ষত্রটাকে লক্ষ্য করে রামধনুতে তীরযোজনা করলো। আকাশে মেঘ, নক্ষত্রটা ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কিন্তু ওকে যে তীরটা ছুঁড়তেই হবে। আবছা নক্ষত্রটার কান্নাঝরা হাসিটা চিরকালের মতো ঝরিয়ে ফেলে রোদ্দুরমাখা হাসিটা ওর সারা অঙ্গে বসিয়ে দিতে হবে। তবে তো সুমালির মায়ের মতো একটা ঝকঝকে হাসি ওর মায়ের মুখে ও দিতে পারবে । মা, তুমি সরে যেও না। একবার স্থির হয়ে দাঁড়াও, আমি তীরটা ছুঁড়ছি দেখো, হাসিটা ঠিক তোমার মুখে গিয়ে বসবে মা, ঠিক বসবে, বসবেই, মা, ও মা, মা .....! ঘেমে নেয়ে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো রণ। একটু ধাতস্থ হয়ে বুঝলো, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। শৈশবের চেনা স্বপ্নটা আবার ফিরে এলো কেন?

ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে। একটা অচেনা শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, পাশে মিমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নাইট ল্যাম্পের আলোটা ওর মুখে কেমন মায়া ফেলে রেখেছে। ভালোবাসার দেবী কি এইরকমই সুন্দর – পবিত্র! ও আস্তে আস্তে নেমে এলো বিছানা থেকে। জল খেলো। খোলা জানালা দিয়ে দেখলো তারায় ভরা একটা ঝকঝকে আকাশ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কী মনে করে রণ ধীরে ধীরে প্যাকেটটার কাছে গেল। ও এতদিন কী একটা অজানা ভয়ে ওটা কিছুতেই খুলতে পারে নি। মিমি যতবার বলেছে ও ততবার ডিনাই করেছে। হঠাৎ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরলো – মনে হলো মায়ের শীর্ণ হাতের সরু সরু আঙুলগুলো ওর বুকে বুলে যাচ্ছে। নাকের কাছে প্যাকেটটা নিতেই কোথা থেকে যেন ‘মা মা’ গন্ধটা ছুটে এলো – যে গন্ধটা সঙ্গে নিয়ে ও একসময় খেতো, ঘুমোতো, পড়াশোনা করতো। হঠাৎ ভেতরের বস্তুটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। দেখবে কি একবার! জীবনের শেষ ইচ্ছা হিসেবে মা তাকে কী দিতে চেয়েছে? কাঁপা কাঁপা হাতে আস্তে আস্তে মোড়ক খুলতে লাগলো রণজয়। গোটা শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে। কী আছে? কী দেখবে সে! থরথরে বুকে মোড়কের শেষ অংশটা খুলতেই বেরিয়ে এলো, মায়ের ঝকঝকে হাসিমুখের একটা ছবি। ও চমকে উঠলো। এইরকম, ঠিক এইরকম একটা হাসি চেয়েই একদিন ও ওর জীবনের লম্বা দৌড়টায় নেমেছিল না! মা কী করে জানলো? ও তো কোনোদিন বলে নি সেকথা! গলার কাছে একদলা কষ্ট পাকিয়ে যাচ্ছে কেন? রণজয় আধবোজা গলায় চিৎকার করে উঠলো,

----- মিমি, দেখ, দেখ - আমি রামধনুটা পেয়ে গেছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ