তনিমা হাজরা | জিগীষা

মিছিল

বৌদি, তোমার মেয়ের ইস্কুলের নম্বরটা একবার দেবে?​

--কেন রে শ্যামলী?

--আমার ছেলেকে এডমিশন করাইতাম?

-- আমার মেয়ের স্কুলে? জানিস, ওটা শহরের কত্ত নামী স্কুল, মাইনে কত? পারবি টানতে?​ নিজেদের জীবনের সুখ সাধগুলো নিয়ে ভাবিস রে শ্যামলী। দিন ফুরোলে আর কিন্তু ফিরবে না। নিজের সাধ্য বুঝে ছেলেকে তেমন স্কুলে দে বরং।​

--ঝানি গ বৌদি, সুদাম খোঁজ নিইচে, আর এট্টা রান্নার কাজ ধরে নিলে ঠিক পারবো। ছেলেটা সারাদিন বইমুকে বসে থাকে, পড়া ছাড়া আর কিচ্ছুটিতে ধ্যান নেইক, সারা বস্তির ছেলেপুলে কিরিকেট খেলচে, টিভি দেখচে হামলে পড়ে, কিন্তু আমার বাবানের সেই এক বই বই বই।।​

-- ভেবে দ্যাখ, শ্যামলী, শুধু মাসের মাইনে না, সারাবছর হাজার রকম এটা সেটা খরচ আছে, একবার ঢুকে পড়লে সব সামলাতে পারবি কিনা।

-- অ বৌদি, তুমি আর বাদ সেদোনি, দাও না একবার নম্বরটা, টেষ্টে বসায়ে একবার পরক করে দেকি যদি উতরোয়।।​

অগত্যা নম্বর দেয় অভিদীপ্তা।। এবং শ্যামলীর বুদ্ধিমান বাবান উতরেও যায়।।​

শ্যামলী আর সুদাম বাবানের জীবনের স্বপ্নে বিভোর। বাবান নিজের পড়ার বাইরে আর কিচ্ছুটি জানে না। শ্যামলী আরও দুটো বাড়িতে কাজ নেয়, খোক্কুরে ক্ষয়াটে চেহারা আরও জীর্ণ হয়।। হার্টের অসুখ ধরা পড়ে।।​ সুদাম ফাইবার ফিটিংস এর মিস্ত্রি।।আরও আরও কাজের​ চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো ফাইবার গ্লাস ফুসফুস ভেদ করে ঢুকে শ্বাসের রোগ ধরা পড়ে।।​

বাবান এতাবৎকাল একটুও ফাঁকি দেয় নি তার নিজস্ব পড়াশোনায়। না,সে কোনো বদসঙ্গে পড়েনি। সুতরাং শ্যামলী বা সুদামের আশাহত হবার কোনো কারণ দেখি না।।​

তারা যে স্বপ্নটা গড়বার জন্য তাদের নিজেদের স্বপ্নগুলোকে একেবারের জন্যও​ ​ প্রশ্রয় দেয়নি, যে স্বপ্নটা দেখবার জন্য নিজেদের জীবন নিয়ে একদম ভাবেনি, যে স্বপ্নটা দেখবার জন্য নিজেদের শরীর নিয়ে একবারও​ ভাবেনি। ভাবনা তো দূর, সারাদিন উদয়াস্ত খেটে ক্লান্ত শরীর দুটো বিছানা পেলেই গভীর ঘুমে ডুবে যেতো। কেউ কারো শরীলের খোঁজ, হিসেব, যৈবন লোভ সব গুলে মেরে বসেছিলো বাবানের স্বপ্নের ঘোরে। সেই যেন সাধনা, সেই যেন নির্মাণ। বাবানের উঁচুতে ওঠার স্বপ্নটার গোড়ায় সার জল ঢেলে চলা সেই জন্যই যেন তাদের বেঁচে থাকা।। সেই স্বপ্নটা এদ্দিনে সার্থক হয়েছে।।​

বাবান আমেরিকা যাচ্ছে।।​

না মেলোড্রামাটিক সিরিয়ালের মতো বাবান মোটেও দায়িত্বজ্ঞানহীন খারাপ ছেলে প্রমাণিত হয়নি। সে সপ্তাহে তিন চারদিন ভিডিও কলে মা বাবার সাথে কথা বলে।। প্রতিমাসে মোটা টাকা পাঠায়।। সেই টাকা দিয়ে শ্যামলী আর সুদাম ডাক্তার দেখায়।। দামী খাবার, দামী ওষুধ কিনে খায়।। তবে তারা দুজনেই খুব​ হাঁপায়, এখন আগের মতো খাবারে তেমন সোয়াদ পায় না।।​

বস্তির এক উঠোন আঠেরো ঘরের জন্য বরাদ্দ এক পায়খানার জীবন ছেড়ে শ্যামলী আর সুদাম ভালো ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে কিছুদিন আগে। বাবানই কিনে দিয়েছে।। কাজের জন্য একটা মেয়েও আছে সারাক্ষণের।। বাবান কিচ্ছুটি অভাব অভিযোগ রাখেনি তাদের।।

জীর্ণ দুটি দেহ দামী দুটো চেয়ারে গা এলিয়ে দামী ফ্ল্যাট বাড়ির ব্যালকনিতে এখন ফুরফুরে হাওয়া খায়। এখানে বস্তির মতো দুর্গন্ধ নেই, এখানে দুজনের জন্য দুটো ঘর, দুটো পায়খানা বাথরুম। রোজ ভোরে মুত হাগা আটকে একটা পায়খানায় আটান্নজন হাগার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার যাতনা নেই।।​

সময় কেমন কলকল করে বেরিয়ে যায় নদীর জলের লাখান।।

আজ হঠাৎ শ্যামলীর কেমন যেন বুক ধড়ফড় করে। সুদামকে বলে, দ্যাকো দিকি বুকটায় হাত দিয়ে খুব কি জোরে জোরে লাফায়?​ কেমন যেন আটুপাটু লাগে।।

বেলাউজের হুক খুলে বুকের বাঁ ধারে নিজের শীর্ণ হাত রাখে সুদাম। দুটো শুকনো মাই পিট পিট করে তাকিয়ে আছে যেন তার দিকে,​ যেন মরা নদীর গায়ে জেগে ওঠা চর। সে চরে এখন জল নেই, সবুজও নেই।। শুধু ইতিউতি ছড়িয়ে আছে পোড়া পোড়া কাঠ।। সে চরে একোন গেরামের শ্মশান।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর ভাবনা। শুধুমাত্র একটি পরিশীলিত আকাঙ্ক্ষাই নয়, সঙ্গে বাপ-মায়ের বাস্তবসম্মত ভাবনা, সেই ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করবার জন‍্য অদম্য প্রচেষ্টা ও আত্মত‍্যাগের বিনিময়েই সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিতভাবে গড়ে তোলা যায়। বাবা-মায়ের স্বপ্নের বৃক্ষটি একদিন মাথা তোলে, এটাই গল্পের মূল বিষয়। ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন

সুচিন্তিত মতামত দিন