মৌমিতা ঘোষ | কেউ বেকার নয় , রামরাজ্য চলছে

মিছিল michil

প্রায়শই শুনি, চাকরি নেই, বেকারত্ব সর্বকালের সেরা এই মুহূর্তে। আমি কেন্দ্র বনাম রাজ্যের বেকারত্ব এসব কচকচানি তে যাচ্ছি না। আমার এত বছরের চাকরির অভিজ্ঞতার টুকরো কিছু ঘটনা বলতে চাইছি। বেকার শব্দটার সঙ্গে চাকরিরই সরাসরি সম্পর্ক। আমাদের দেশের বৃহত্তর জনগণ চাকরি করার জন্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করান, যে সেল্ফ এম্প্লয়েড বা এন্টারপ্রেনিউর হয়ে যায়, তা তার বড় বেলার ইচ্ছেতে। পৈতৃক বড় ব্যবসা আছে এমন পরিবারেই একমাত্র ছেলে বড় হয়ে ব্যবসা সামলাবে ,ভাবা হয়। এই চাকরি করার চিন্তাটি আমাদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। সবার বাবা-মা'ই ছোটবেলায় চান ছেলে বড় চাকরি করবে। আই.পি. এস, আই. এ. এস হবে। নাহলে ব্যাঙ্কের ক্লার্ক, সরকারি স্কুলের শিক্ষক। আমার ছেলে ছোট থেকে বিজ্ঞানী হতে চাইতো। আমি আমার চারপাশে কোন মা বাবাকে ছেলে বা মেয়েকে বলতে শুনিনি, " তুমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয়ো, মডেল হয়ো, পলিটিশিয়ান হয়ো,ইকনমিস্ট হয়ো।"

ইদানিং গত কুড়ি বছর ধরে লোকে তবু ক্রিকেটার বা ফুটবলার বানাতে চাইছে। কিন্তু,বাকি খেলা? নৈব নেব চ। তাও সিকিভাগ আর্থিক ভাবে সবল লোক, এটা ভাবতে পারেন, কোচিং দেন, আর মেরি কমের মতো মেয়েরা নিজেদের অদম্য জেদে এসে জিতে যান, তার পরেও বক্সিং এ পার্টিসিপেশন বাড়ে না। তার মানে প্রথমতঃ আমরা কেরিয়ারের ডাইভার্সিফিকেশনে বিশ্বাসী নই। আমরা শুধু মাথা গুঁজে একই কাজ করে যেতে ভালোবাসি। আর তা রিস্ক ফ্রি ও।খেলতে গেলে, বিজ্ঞানী হতে গেলে, গবেষক হতে গেলে, পলিটিশিয়ান হতে গেলে সম্ভাবনা থাকেই বারবার বিফল হওয়ার। আমরা সেফ জার্নি চাই।এর মূল কারণ ভারতবর্ষের মতো আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বাবা মা এত কষ্ট করে ছেলে মেয়েকে তাদের সব সঞ্চয় উজাড় করে বড় করেন যে বিফলতার আর্থিক দায় নেওয়ার তাদের ক্ষমতা নেই। 

এছাড়া আমরা বেসিক্যালি ভীতু ও চেনা ছকের বাইরে পা রাখতে নিজেরাও পারি না, অন্যকেও রাখতে দিইনা। আউট অফ দি বক্স যেসব ছেলেমেয়েরা ভাবতে পারেন,তারা নিজেদের আত্মবিশ্বাসে এগিয়ে যান।

এবারে আসি, যাদের বেকারত্ব নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের কথায়। এত বছরের চাকরিতে দেখছি এদেশে ইঞ্জিনিয়ার থেকে টেনেটুনে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা ছেলে চাকরির এক লাইনে দাঁড়িয়ে। তাদের চাকরি শুরু হচ্ছে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ প্যাকেজে।রে রে করে তেড়ে আসবেননা। আমি সাধারণ ছেলেমেয়েদের কথা বলেছি, আপনার মেয়ে অসাধারণ বা তার ইনস্টিটিউট খুব দামী হতে পারে, সেখান থেকে campus interview য়ে ,এর চেয়ে ভালো চাকরি পেতেই পারে। যে কোন কথাই absolute ধরে নিয়ে ঝগড়া করাটা এখনকার সংস্কৃতি,জানি। আমার চাকরিটি যেহেতু নতুন এমপ্লয়িদের অনবোর্ডিঙ ও ছমাস অবধি তাদের স্কিলিঙ ও এনেবলমেন্টের এবং অবশ্যই রিটেনশনের ,তার থেকেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো। আর যাদের মনে হবে,তারা সম্পূর্ণ বিপরীত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি,তারা সম্পাদককে জানিয়ে আরেকটি লেখা লিখে ফেলবেন,কেমন?

আমি ইস্টের ছটা রাজ্য , পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, বিহার,ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যার এমপ্লয়িদের দায়িত্বে আছি।একটি লিমিটেড, বড় কোম্পানি গ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়ে ছাড়া নেন না।গ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়েদের নমুনা এবারে দিই।ইংরেজির নমুনা: গুড মর্নিং,আই অ্যাম রাঁচি ফ্রম দীনেশ সিং।

বাংলার নমুনা: "ম্যাডাম, আমার নাম সুনীল ঘোষ। আমি ব্যারাকপুরে থাকি।ম ম ম... আমি আগে অমুক কোম্পানি তে চাকরি করতাম।"

" তোমার আর কিছু বলার নেই নিজের সম্পর্কে?"

" আর কী বলব ম্যাডাম?"

" কোন অ্যাচিভমেন্ট ... পার্সোনাল বা প্রফেশনাল...!"

অনেক ভেবে সে বলে আমার পার্সোনাল অ্যাচিভমেন্ট বলতে আমি বিয়ে করেছি...।"

আমি জল খেয়ে নিই তাড়াতাড়ি।

বাংলা, হিন্দি,ওড়িয়া, ভোজপুরি,অহমীয়া,নেপালী সবকটি ভাষাই আমি এখন বুঝতে পারি,বলতে পারি না। ওরা নিজেদের ভাষাতে কেউ নিজের সম্পর্কে পাঁচ লাইন বলতে পারে না। খুব আশ্চর্য! আমি চাকরি করতে গিয়ে শুনে শুনে মনোযোগ দিয়ে বুঝে নিয়েছি, কেননা আমার চাকরি আমার কাছে প্রিয়। আপনার এদের বেশিরভাগের মাতৃভাষার আর ইংরেজির ( এক্ষেত্রে বাংলা বা ইংরেজী ছাড়া আমি চেক করতে পারি না) বানান দেখলে তিনচারবার একসাথে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করবে।একটা গ্র্যাজুয়েট ছেলে বা মেয়ে একটি ভাষাতেও নিজেকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না, হাজার শেখালেও শিখতে পারে না,বা চায়না। নিজের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে সন্দেহ হয়।এত নীচু মান!

তারপর শুরু হয় একটা নতুন জার্নি। এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালোদের বেছে নিয়ে শুরু হয় তাদের ডেভেলপমেন্ট।

আমিও এই একই জার্নির মধ্যে দিয়ে এসেছি। কিন্তু সাড়ে নটায় অফিস মানে নটা পঁচিশে ঢুকেছি বরাবর,সব training assignmentশেষ করেছি সময়ে , বসকে মিথ্যে বলতে পারিনি সেলসে থেকে ও।আমি এই মিথটা নিজের কাছে ভাঙতে চেয়েছিলাম,সেলসে থাকলে মিথ্যে বলতেই হয়। কাস্টমার থেকে বস কাউকে মিথ্যে না বলে টিকে আছি পনেরো বছর এক ইন্ডাস্ট্রিতে। আসল বিষয় হল চয়েস।আমি কোন কাস্টমারের অভিশাপ কুড়োইনি।

আজকাল যেসব ছেলেমেয়েরা নতুন চাকরি করতে আসে, তাদের অনেকাংশে র বৈশিষ্ট্য ( সিনিয়র বা মিড ম্যানেজমেন্টের লোক নয়, বেস লেভেলের এমপ্লয়িদের কথা বলছি) :

১) রোজ দেরি করে আসা, এবং খুব স্বাভাবিক বিষয় এটা, এরকম ভাবা।

২) যখন তখন ছুটি নেওয়া, একটা মেসেজ করে ফোন অফ করে দেওয়া।

৩) যে কোন প্রশ্ন করা হলে বলা," খুব প্রেশার ম্যাডাম, আমি চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি, আমার দ্বারা হচ্ছে না।"

মানে বেসিক ডেলিভারেবলস নিয়ে প্রশ্ন করলেও তারা চাকরি ছেড়ে দেয়।

৪) আমার ভালো লাগছে না এই কাজটা,যখন তখন এমন একটি 'ভাবে" আক্রান্ত হওয়া।

৫) ফোন না তোলা, সারাদিনে কল ব্যাক না করা।

৬) যত ছুটি আছে সব নিয়ে নেওয়া।

৭) দশ হাজার টাকা বার্ষিক বেশি পেলেও চাকরি ছেড়ে দেওয়া, না পেলেও কিছু না করে ছ মাস,ছ মাস করে ফ্রিতে স্যালারি খাওয়া বিভিন্ন কোম্পানি বদল করে।​

৮) দশ বছর ধরে একই পোজিশনে থেকে যাওয়া ও আরো দুকান কাটা হয়ে যাওয়া।

এখন প্রসঙ্গটা হলো এদের সবার ফ্যামিলি আছে। তবে তারা এত কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে যায় কী করে?

​ আমার অবসারভেশন হল,

১) বৌ সরকারি চাকরি করে বা কর্পোরেটেই ভালো চাকরি করে। সে অনায়াসে সমস্ত দায়িত্ব বৌয়ের উপরে ছেড়ে বগল বাজায়।( মেয়েদের ক্ষেত্রে এটাই বর ভালো চাকরি করে,বাবা খুব প্রোটেকটিভ,তাই।)

২) তার মিনিমাম দায়িত্ববোধ নেই।

৩) সে ভাবছে সে অন্য কোনভাবে ঠিক ইনকাম করে নেবে।

৪) সে সবসময়ই ভাবে সে কারো বাবার চাকর নয় তাই তার কোন accountability থাকা উচিৎ নয়।

এবারে বলি, এটা নিয়ে আমি রীতিমতো কেস স্টাডি করেছি।

আমার অবাক লাগে, কোনো ছেলে বা মেয়েকে যখন আমরা রিটেইন করতে চাই,তার বাবা মা আসেন অফিসে,এসে বলেন ,"আমার ছেলে / মেয়ে চাকরিটা করবে না,আপনারা প্লিজ অনুরোধ করবেন না।"

এরকম প্রোটেকটিভ বাবা মা থাকলে সন্তান সারাজীবন অপদার্থই থাকে। আমি দেখলাম এগিয়ে​ থাকা মানে শুধু আজকাল ছেলে মেয়েদের সাথে একসাথে বসে মদ খাওয়া বুঝছেন বাবা মায়েরা।ভেরি আনফরচুনেট।বাবা ,মা কেন সন্তানের অফিসে যাবেন? কেন তাদের ভুল বা ঠিক সিদ্ধান্তে তাদেরকে থাকতে হবে? সন্তান কবে শিখবে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে? সন্তান যে পরিস্থিতি ফেস করতে পারছেনা,তাতে বাবা মা ঢুকে তার রেসকিউয়ার কেন হবেন? ছোট থেকে যা চাইছে ছেলেমেয়েরা তাই দিচ্ছেন বলে চাকরিতে গিয়ে কোন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেই ছেড়ে দিচ্ছে,পালিয়ে যাচ্ছে।কোন কাজের accountability তৈরি হয়নি কেননা আপনি তাকে ছোট থেকে protect করেছেন, তাকে কোন দায়িত্ব দেননি,নিজে সব করে দিয়েছেন।এখন প্রতি পাড়ায় আপনি দেখবেন ছেলেরা কী নিশ্চিন্তে একটা জায়গায় বসে গভীর রাত অবধি গল্প করে, স্বাভাবিক আড্ডা মানেই গালিগালাজ।এরা কী করে? এরা কেন কোন কাজ করে না? করে তো। দালালি।সবাই মাঝখানের ক্ষীর খাচ্ছে। একটা বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে দেখবেন পাঁচ ছজন ইনভল্ভড। পাড়ার ইস্ত্রির দোকানদার ও তার থেকে হিস্সা নেয়। আপনার সরকারি সুবিধার বিভিন্ন প্রকল্পের কার্ড থেকে সব কিছুর দালালি। পুকুর বোজানোর দালালি,ক্যান্সারের ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার দালালি( আমার পরিচিত একটি ছেলে বাইরে থেকে আসা পেশেন্টদের হোটেলে ক্যান্সারের ওষুধ পৌঁছে দিতো, সেগুলো দোকানে কেন পাওয়া যেতো না, আমার জানা নেই), এমনকি বাংলা বাজারে প্রকাশককে পয়সা দিয়ে বই করানোর লেখক জোগাড় করে দেওয়ার ও দালালি।এক বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুর যে কোন সাহায্য চাইতে গেলে নিঃসংকোচে বলছে,তুই যদি কিছু রাখতে চাস,তুই রাখবি, শুধু কাজটা করিয়ে দে। মানে বন্ধুত্ব, সাহায্য শব্দগুলোকে রিপ্লেস করেছে দালালি। আমার এক ক্যান্সার আক্রান্ত,সর্বস্বান্ত বন্ধুকে একটা বাড়ি খুঁজে দিতে তার বন্ধুর বেনামে দালালি নিতে বাধেনি। হাসপাতালের বেড থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়ার দালালি আমরা দেখেছি প্যান্ডেমিকে ভয়ঙ্করভাবে।একটা বাড়ি বিক্রি করার হলে মাছির মতো ভ্যানভ্যান করবে লোক আপনার চারপাশে। দালালি করতে শুধু দাঁত বের করে কথা বলতে হয়। এফোর্ট লাগে না,দাদার পা চাটা ছাড়া।এত সুখের রোজগার বিনা খাটনিতে সহজলভ্য হলে অফিসে এত ঝক্কি কেন নেবো?

এরপর আসে ড্রিম ইলেভেন। আমি যথেষ্ট দেখেই বলছি, আজ থেকে দশ বছর আগেও ঘরে ঘরে লোকাল ক্রিকেট বেটিং এ লোকে পার্টিসিপেট করতো না।মূল্যবোধে আটকাতো।অন্যায় মনে হতো। এখন ড্রিম ইলেভেন এসে জুয়া লিগালাইজড হয়ে গেল।

ছেলেমেয়েরা ভাবছে ড্রিম ইলেভেন খেলে, অনলাইন নানা গেমের প্রাইজ মানিতে জীবন দিব্য চলবে। অনলাইন গেমে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য মধ্যবিত্তের ছেলে বাবার কাছে চাইছে স্পেশাল মাউস,উপযোগী হেডফোন, সেসব আকাশ ছোঁয়া দামের প্রোডাক্ট সে হাতেও পাচ্ছে। এভাবে একটি প্রজন্ম তাদের মেধা, শারীরিক ক্ষমতা, কর্মক্ষমতাকে ক্ষয় করে ফেলছে।​

দোষ কার? রাষ্ট্রের? বাবা-মায়ের? প্রজন্মের? কেউ জানে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ