■ সুশান্ত কুমার রায় | “হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়..”

শব্দের মিছিল

“আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে
মধুরও অমৃত বানী, বেলা গেল সহজেই
মরমে উঠিল বাজি; বসন্ত এসে গেছে
থাক তব ভুবনের ধুলিমাখা চরণে
মথা নত করে রব, বসন্ত এসে গেছে
বসন্ত এসে গেছে..”।।

শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠছে প্রকৃতি। কুয়াশার চাদরে মোড়া শীত জেঁকে বসতে না বসতেই শীতের বিদায় লগ্নে বসন্তদূত কোকিলের কুহুতান, বসন্তের আগমনী গান, দখিনা মলয়, ঝরাপাতার শুকনো নূপুরের নিক্কণ, গাছে গাছে রক্তিম আভায় পলাশ, মনোহরী অপরূপ কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল ফুলে প্রকৃতি প্রণয়ে আজ জাগ্রত দ্বারে ঋতুরাজ বসন্ত। ঋতু পরিক্রমায় বসন্ত আগত। পহেলা ফাল্গুন, ঋতুরাজ বসন্তের আগমনী দিন। বসন্ত স্বমহিমায় দীপ্যমান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশের সৌন্দর্য মহিমার কোন তুলনা নেই।বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। বাংলা বর্ষের অন্তিম দু’মাস ফাল্গুন ও চৈত্র নিয়ে বসন্ত। ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতু বৈচিত্র্য ও বিষয় বৈভব বিচার বিশ্লেষণে রূপ, রস, আর লাবণ্যে বসন্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত। অনুপম নৈসার্গিক সৌন্দর্য নিয়ে আসে বসন্ত। প্রকৃতির বুকে বসন্ত আসে ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে।বসন্ত বাউরি ‘বউ কথা কও’ বলে থেকে থেকে ডাক দেয়। চারদিকে বসন্তের জয়ধ্বনি বেজে ওঠে। বসন্তের অপূর্ব ফুলসম্ভার বাংলাদেশের চিরশ্যামল প্রকৃতিকে সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে ঝলমল করে তুলে। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়-‘বসন্ত এলো এলো এলোরে, পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে।’বসন্ত ফাগুন হাওয়ায় দোল খেয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুষঙ্গে উপমা, অনুপ্রাস, অলঙ্করণ ও উৎপ্রেক্ষায় সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও।নিসর্গ প্রকৃতিতে আবহমান গ্রামবাংলার মেঠোপথ, নদীর পাড়, তরুলতা, গাছ-গাছালি, মাঠভরা ফসলের খেত বাসন্তী রঙে রঙিন।বসন্তের মাতাল হাওয়া, ফুলে ফুলে মৌমাছিদের গুঞ্জরন, গাছে গাছে কচিপাতা আর কোকিলের কুহুতান, মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গন্ধ সবই বয়ে আনে বসন্তের আগমনী বার্তা। মহাকবি আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্যে লিখেছেন...

মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব॥

ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক, আজ বসন্ত…।’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কালজয়ী কবিতার পঙক্তি।বসন্ত তার নিজস্ব রূপ মেলে ধরবেই। ফাগুনের আগুনে, মন রাঙিয়ে বাঙালি তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হয়। কবির শঙ্কাকে উপেক্ষা করে ফুলে ফুলে ভরে আছে কৃষ্ণচূড়া, অশোক, কাঞ্চন, পলাশ, শিমুল, কুরচি, নাগেশ্বর, মহুয়া, পারুল, বাদরলাঠি, গোলাপ, গাঁদা, সূর্যমুখী, বেলী, জুঁই, মল্লিকা ও মালতি। ফাল্গুনই যেন বসন্তের সঠিক আমেজ। এ সময়েই ঘটে শীত-গরমের সন্ধিক্ষণে বিরহ-মিলনের মধুর খেলা। নব পত্রপল্লব সুশোভিত ঝরঝরে প্রকৃতি, ফুরফুরে মেজাজ আর শীতের শেষে কড়কড়ে রোদ। আজ ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় প্রিয়ার খোঁপায় গোলাপ-গাদা গুজে দেয়ার দিন। বসন্ত মানে নানা বাহারি-রঙিন ফুলের সমাহার। লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, সাদা, বেগুনী, আকাশি, কমলা প্রভৃতি নানা রঙের ফুল ফোটে বসন্তে। এ সময় যেদিকেই চোখ যায় শুধু ফুল আর ফুল। যেন সবুজ প্রকৃতি চারিদিকে রঙিন ফুলের পসরা সাজিয়েছে। কত ফুল, কত শত রঙ। স্বাগত বসন্ত। কবিগুরুর ভাষায়- ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে / এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়…।’ মনের আনন্দে পাখিরা গান গাইতে শুরু করে। চারিদিকে চলে পাখির কলকাকলী। সুবাসিত দক্ষিনা মলয়ে মাতাল হয়ে ওঠে প্রকৃতি, প্রাণমন ভরে উঠে অনুক্ষণ। দখিনা বাতাসের মৃদুদোলা দেহ ও মনের ক্লান্তি জুড়ায়। শীতের পাতাঝরা গাছ গুলোতে নতুন করে প্রাণ আসে, গাছে গাছে নতুন স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতা, পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ, আম্রমুকুলের সৌরভ-“ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল /ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল..”। আমের মুকুলের ম ম গন্ধে হৃদয় ভরে যায়। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলিত হয় এবং মুকুলের গন্ধে মৌমাছি ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসে। মৌমাছিরা সারাক্ষণ মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকে। ফুলের বনে অলিরা গুণগুণ শব্দে বার বার আসে, বার বার ফিরে যায় । এদের গুঞ্জনে মুখরিত হয় চারিদিক। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় মনের সুখে। লাল-নীল-হলুদ আর সবুজের সমারোহে বর্ণবৈচিত্রতায়-নব আনন্দে, নব-আভরণে প্রকৃতি সুশোভিত ও মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বসন্ত অবগাহনে স্রোত ধারায়। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে-প্রাণে প্রাণে ধ্বনিত হয়-

“ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে-কোণে কোণে
রঙে রঙে রঙিল আকাশ
গানে গানে নিখিল উদাস
যেন চল চঞ্চল নব পল্লব দল
মর্মরে মোর মনে মনে” ...।।

পৃথিবীর বুক ফুটিয়ে তোলে নতুন জীবনের স্পন্দন, প্রকৃতির কর্মচক্রে নব উদ্যমে ফিরে আসে মানুষের জীবন বৈচিত্র্য।বসন্তের মধ্যে রয়েছে তারুণ্য ও যৌবনের চঞ্চলতা। বসন্তকালে প্রকৃতি যৌবনা প্রাপ্ত হয়। পত্রঝরা বৃক্ষে নবপল্লবের আশীর্বাদ বয়ে আনে। কুয়াশার আঁচল সরিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত সোনালি রোদে ভরে দেয় আকাশ। প্রাণের উষ্ণতা সঞ্চারিত হয় শীতে মৃতপ্রায় প্রকৃতিতে।ফাগুনের উতল হাওয়ায় ঘটে নব-দম্পতির শুভ পরিণয়। চির যৌবনা ঋতু বসন্তের প্রথম মাস ফাল্গুন। প্রজাপতি মনের আনন্দে রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। ভ্রমর গুনগুন শব্দে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় মধু আহরণে। নবপল্লবিত শাখায় বসে কোকিল সুমধুর কন্ঠে ডেকে ওঠে কুহু কুহু। তাইতো রবি ঠাকুরের গানে ধ্বণিত হয় বসন্তেরই প্রণয়কাহিনী-

“মধুর বসন্ত এসেছে আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে
মধুর মলয় সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরণ ছটাতে” ...।।

কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। বসন্ত মানেই যে পূর্ণতা। বছর ঘুরে আসে বসন্ত। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব, কোকিলের কণ্ঠে বসন্তের আগমনী গান ।বসন্তের এই ফাল্গুন করুণ স্মৃতিতে মনে বিষাদের সুরও তোলে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য জীবন ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ৮ ফাল্গুন (একুশে ফেব্রুয়ারি) শোক আর শ্রদ্ধার মাসে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে নাগরিক ইট-পাথরের জীবনে বসন্ত আসে ।শীতের রুক্ষ প্রকৃতিতে বর্ণিলতা ছড়িয়ে ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে রঙের ছোঁয়া লাগে বাঙালির মনেও।বসন্তের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আমাদের প্রাণকে চঞ্চল করে তোলে। বসন্তের প্রথম প্রহরে তরুণ-তরুণীদের লাল-সাদা-হলুদ পোশাকে অনন্যরূপে দেখা যায়। লাল-সাদা, হলুদ কিংবা বাসন্তী রঙের শাড়িতে মেয়েরা সাজে নিজেকে বসন্তের ছোঁয়ায়।শাড়ির সঙ্গে খোঁপার ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেয় গাঁদা কিংবা বেলি ফুলের বন্ধনী। হাতে পড়ে লাল কিংবা বাসন্তী রঙা চুড়ি। । অন্যদিকে আলতা রাঙা পা আর হাতভর্তি মেহেদি রাঙানো কিংবা বৃত্তের ভাঁজে হাতের তালু সাজিয়ে তোলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কপালের টিপেও থাকে না কোনো কৃপণতা ।কেউ কেউ লাল রঙের বড় টিপে নিজেকে সাজিয়ে তোলে আবার কেউ ছোট টিপের সাজে নিজেকে করে তোলেন প্রিয় মানুষটির চোখে অতুলনীয়।সব শ্রেণীর প্রেমিকেরই ভালবাসা প্রকাশের জন্য মুখ্য সময় যেন বসন্ত। বাহারি রঙের পাঞ্জাবি বা ফতুয়া পড়ে কিশোর-তরুণ-তরুণীরা। শিশুদের পোশাকেও দেখা যায় নানা রঙ-বেরঙের সমাহার। মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের পোশাকেও আসে বসন্তের ছোঁয়া। বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে তোলা হয় চারুকলার বকুলতলা। বসন্ত উৎসবে সাজ সাজ রবে সাজিয়ে ওঠে পাবলিক লাইব্রেরি, টিএসসি প্রাঙ্গণ, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, বাংলা একাডেমি, অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ, রমনা পার্ক, কলা ভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, কার্জন হল, দোয়েল চত্বর, পলাশী মোড়, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বর ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা । দিনে দিনে ফাগুনের এই রঙ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। গ্রামে-গঞ্জেও লেগেছে এখন ফাগুনের ছোঁয়া। গাঁয়ের বধূরা আঙিনা লেপে বরণ করে নেয় ফাগুনকে। তুলে রাখা হলদে শাড়ি পড়ে নতুন সাজে ।তাই কোনও অজুহাতেই আর ঘরে বসে থাকার সময় নয় আজ। আজ ফাগুনের মাতাল হাওয়ায় মনে মনে লাগুক দোলা। কবি সুফিয়া কামালের ভাষায়- “হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায় / বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?” ফাল্গুন ও ভালোবাসার জয়গানে মুখরিত হয়ে ওঠে ঋতুরাজ বসন্ত। ১৫৮৫ সালে মোঘল সম্রাট আকবর ১৪ টি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। যার মধ্যে একটি ছিল ‘বসন্ত উৎসব’। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য, বাঙালিসত্তা। বাঙালির ইতিহাস শেকড় আর আবেগে, মানুষে মানুষে ভালোবাসার, তেমনি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিরও বটে।
 
প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয় ১৪০১ বঙ্গাব্দে। আর ১৯৬২ সালে ‘ছায়ানট’ রমনা বটমূলে বসন্ত উৎসব শুরু করে। সেই থেকে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে।তাই রাজধানী ঢাকাসহ কবিতা ও গানে দেশজুড়ে চলে বসন্ত বরণের নানা আয়োজন। তথ্যপ্রযুক্তির এই ক্ষণে ফেসবুক, মেসেন্জার, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একে আপরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বরণ করা হয় ঋতুরাজ বসন্তকে। মুছে যাক, ঘুচে যাক সকলের মনের ব্যথা-বেদনা ও মান-অভিমান।কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে এ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে বাঙালির নিজস্ব সার্বজনীন প্রাণের উৎসবে।বসন্তের দোলা লাগুক সবার মনে-প্রাণে এটাই প্রত্যাশা। সবাইকে ঋতুরাজ বসন্তের শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন। মননে, চেতনায় ও সংগ্রামী প্রত্যয়ে বাঙালির প্রতিবিম্ব হোক বসন্ত, অশুভ শক্তির বিনাশ হোক, প্রকৃতিতে নিরন্তর বসন্তের সুবাতাস প্রবাহিত হোক, আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি মানুষের মন ও মনন।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .