শনির বচন | দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ

শব্দের মিছিল

সরকারে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কারা নির্বাচিত করে? দেশেরই জনগণ। কেন করে? না দেশের ভালোর জন্যে। ফলে সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও তার মতাদর্শ নিশ্চয় দেশের হিতের জন্যেই কাজ করবে। কাজ করে। করবে বলেই তো জনগণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বদলে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকেই ক্ষমতার শীর্ষে বসিয়েছে। এখন সেই দলের গঠন করা সরকার যে সকল নীতি প্রণয়ন করবে, করছে সেগুলির বিরোধীতা করা দেশদ্রোহীতারই সামিল নয় কি? এই সহজ কথাটিই তো দেশহিতৈষী সংবাদ মাধ্যমগুলি বিগত সাত বছর ধরে পাখি পড়ার মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বুঝিয়ে যাচ্ছে সরকার এবং তার সকল মেশিনারী। সরকার যখন যে আইনগুলি তৈরী করছে। সেগুলি মেনে চলাই তো দেশপ্রেম। সরকার যখন যে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ও দেবে, তখন সেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়াই তো দেশপ্রেম নাকি। এই যে পেট্রলের লিটার সেঞ্চুরী হাঁকিয়েছে। এত দেশের ভালোর জন্যই নাকি। রাজকোষে অতিরিক্ত অর্থ আসবে। ভারতীয় অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠবে। পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম যত বাড়তে থাকবে, ততই ভর্তি হতে থাকবে সরকারী রাজকোষ। দেশের রাজকোষের সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্যেই তো সরকারের এই উদ্যোগ। এবং সেই সমৃদ্ধি বৃদ্ধির কর্মযজ্ঞে প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে সরকার আমাদেরকে ঘরে ঘরে দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠার সুবর্ণ সুযোগ করে দিচ্ছে নিরন্তর। এখানেই সরকারের মহানুভবতা। বদান্যতা। এখন সরকারের এহেন দেশপ্রেমী উদ্যোগের বিরোধীতা করা আসলেই দেশদ্রোহীতার সামিল। এই সহজ কথাটা কিছু মানুষ আজও বুঝতে চাইছে না। তাদের জন্যেই দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ।

দেশপ্রেমের প্রথম পাঠের শুরু কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শিবিরের মতাদর্শকে মান্যতা দিয়েই। নয়তো তাদেরকে সরকারী ক্ষমতায় নির্বাচিত করার কোন মানেই তো হয় না, তাই না? ফলে সেই বিশেষ মতাদর্শকে না মানলে দেশকেই অমান্য করা হয়। এবং সেই মতাদর্শের পতাকা বহন না করলে সেই মতাদর্শকেই অপমান করা হয়। প্রকারন্তরে যা দেশকে মান্য না করারই সমতুল্য বিষয়। ফলে ক্ষমতার শীর্ষে নির্বাচিত রাজনৈতিক শিবিরের মতাদর্শ ও তার পতাকাকে মান্যতা দিয়েই দেশপ্রেমের প্রথম পাঠের শুরু। একথা স্বীকার করতেই হবে। একথাও স্বীকার করতে হবে, দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমগুলি কিন্তু এই বিষয়ে আমাদের পথপ্রদর্শক। বিগত সাত বছর এই সংবাদ মাধ্যমগুলি কায়মনবাক্যে এই বিষয়টিকে শিরোধার্য্য করেই প্রতিদিন সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। প্রতিদিন দুইবেলা সেই সংবাদ মুখস্থ করার ভিতর দিয়েই আবার দেশবাসী হিসাবে আমাদের দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ নেওয়ার শুভারম্ভ। এই পথেই আমরা ঘরে ঘরে দেশপ্রেমী হয়ে উঠবো, উঠছি। কিছু স্বল্প সংখ্যক বেয়াড়া জনগণ ছাড়া। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসী মাত্রেই আজ দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ নিতে টিভির সামনে বসে রয়েছে। 

না শুধু টিভিই বা কেন। এটা না ইনটারনেটের যুগ। অনন্ত সম্ভাবনার যুগ! হাতে হাতে মোবাইল। হাতে হাতে নেট। সেই নেটের দুনিয়া জুড়ে আজ ভারতীয় গণতন্ত্রের জয়জয়াকার।

বিশ্বের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সর্বত্তোম আইটি সেলের প্রতিদিনের দেশপ্রেমের কোর্স চালু রয়েছে হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটিতে। যে হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি আমরা। সেখানেও চলছে আমাদের দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ নেওয়া। জাতীয় পতাকা আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শিবিরের মতাদর্শের ভিতর কোনরকম পার্থক্য করতে যাওয়াই তো দেশদ্রোহ। সেই শিক্ষার আবর্তেই রয়েছি আমরা। ফলে সরকার যা করছে। আমদের ভালোর জন্যেই করছে। আগেই বলা হয়েছে পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের লাগাম ছাড়া মূল্যবৃদ্ধি আসলে দেশহিতের কারণেই ঘটানো হচ্ছে, এবং হবে। দাম যত বাড়বে, দেশের রাজকোষ ততই স্ফীত হয়ে রাষ্ট্রকে অর্থাৎ আমাদের ভারতবর্ষকে ধনী করে তুলবে। 

তাই সংবাদ চ্যানেলের গুলির দুই বেলার শিক্ষাক্রম যেমন অনুসরণ করতে হবে। ঠিক তেমনই হাতে হাতে পকেটে পকেটে মোবাইলের হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটির সহজপাঠেও আমদের মনোনিবেশ করতে হবে। সকাল সন্ধ্যা। রাত্রি দিন। এবং প্রতিদিনের পাঠক্রমের খুঁটিনাটি ছড়িয়ে দিতে হবে আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব পরিচিত জনেদের মাঝে। যে যত বেশি মানুষের ভিতর প্রতিদিনের পাঠক্রম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে। সেই তত বেশি শিক্ষিত। দেশদরদী এবং দেশপ্রেমী। এটাই আত্মনির্ভরতার প্রথম সোপান। দেশপ্রেমী না হয়ে উঠতে পারলে আমরা আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলবো কি করে? সরকার ও সরকারের সকল মেশিনারীর দ্বারা প্রচারিত বার্তায় একান্ত বিশ্বাস করা এবং সেই বার্তা দেশব্যাপী রাষ্ট্র করার ভিতর দিয়েই আমাদের আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে। আর দেশপ্রেমের সার্টিফিকেটই হবে সেই পথের পাসপোর্ট। 

এই পাসপোর্ট পেয়ে গেলেই আমরা যথার্থ ভক্ত হয়ে উঠতে পারবো। ভক্ত হয়ে উঠবো সরকারের। ভক্ত হয়ে উঠবো সকল সরকারী নীতি ও রীতির। ভক্ত হয়ে উঠবো সরকার গঠনকারী নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তির। এই যে একান্ত ভক্তি, এই একান্ত ভক্তির ভিতর দিয়েই বিকাশ ঘটবে আমাদের আত্মনির্ভরতার। তখন আর আমাদের সরকার বিরোধী কোন শিবিরের দলদাসে পরিণত হতে হবে না। নির্ভর করতে হবে না সরকারী নীতি রীতি কার্যপদ্ধতির বিরোধীতাকারী শক্তি সমূহের উপরে। একান্ত ভক্তির বেদীতেই গড়ে উঠবে আমাদের আত্মনির্ভরতার সোপান। এই আত্মনির্ভর দেশপ্রেম আমাদেরকে এবং আমাদের ভক্তিকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিশেষ মর্য্যাদা প্রদান করবে সন্দেহ কি। 

দেশ ও সরকার যে এক ও অভিন্ন। সেই কথা আজ আর কারুরই অজানা নয়। সরকার ও নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিও যে এক ও অভিন্ন সেই বিষয়েও আমাদের সব সন্দেহের নিরসন ঘটে গিয়েছে বিগত সাত বছরে। ফলে এই কথা সহজেই বোধগম্য যে, দেশ ও নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিও এক ও অভিন্ন। বরং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি সমূহই দেশবিরোধী। এই সহজ কথাটাই দেশপ্রেমের প্রথম পাঠের সারসত্য। যে যত আগে বুঝে নিতে পারবো, সে’ই তত বেশি করে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারবো। এবং সরকারের কার্যনির্বাহীদের গুডবুকে স্থান করে নিতে পারবো। তারপর নোট বাতিলের লাইনেই হোক আর এন-আর-সি’র লাইনেই হোক দাঁড়াতে অসুবিধে হবে না। দেশপ্রেমের জন্য, দেশের জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। পুলওয়ামার শহীদদেরকে স্মরণ করে দেশপ্রধানের কথা মতো নির্দিষ্ট বোতামে আঙুল টিপতে তাই আমাদের আর কোন অসুবিধেই হয় নি সেবারে। এরপরেও হবে না। অন্তত আগামী পঞ্চাশ বছরের দেশপ্রেমের পাঠক্রমের তেমনটাই সিলেবাস।  

দেশপ্রেমের পাঠক্রমের এই সিলেবাসে নাম না লেখালেই দেশদ্রোহের অপরাধে অপরাধী হতে হবে। তারপরেও যদি কেউ এই সিলেবাসের বিরোধীতায় সরব হয়ে ওঠে, তবে তো সে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রদ্রোহের সাথেই যুক্ত। প্রথমে নির্বাচিত রাজনৈতিক শিবিরের কার্যনির্বাহীরা সেই সব রাষ্ট্রদ্রোহীদের চিহ্নিত করবেন। তারপর সরকারের আজ্ঞাবহ প্রচারযন্ত্র তাদেরকে দেশজুড়ে লাইমলাইটের ফোকাসে নিয়ে আসবে। তারপর মাঠে নামবে সরকার। পুলিশ ও আদালতের চক্করে ঘুরপাক খেতে থাকবে রাষ্ট্রদ্রোহীরা। সেটাই তাদের প্রাপ্য শাস্তি। আর আমরা যারা দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ নেওয়া বাধ্য শিক্ষার্থী, আত্মনির্ভর দেশপ্রেমী। ভক্তবৃন্দ সকল। আমরা সমঃস্বরে দুয়ো দিতে থাকবে বিশেষ বিশেষ গালভরা স্লোগানে। মুখরিত হয়ে উঠবে আকাশ বাতাস দেশপ্রেমীদের চোখা চোখা বিশেষণে। 

ভক্তি ও ভক্তবৃন্দের এই যে দেশপ্রেম। এটাই আসলে আত্মনির্ভর ভারত। সেই ভারতে সরকার যখন যেভাবে আমাদের ওঠবোস করতে বাধ্য করবে। আমরা বাধ্য থাকবো তখন তখন সেই ভাবে ওঠবোস করতে। বাধ্য থাকবো সরকারের নামে জয়ধ্বনি দিতে। বাধ্য থাকবো বাধ্য শিক্ষার্থীর মতো পড়া মুখস্থ করে দিনরাত তোতাপাখির মতো মুখস্থ বুলি কপচাতে। তাই পদব্রজী পরিযায়ী শ্রমিকদের দিকে আমরা তাকাবো কেন? পথে বসিয়ে দেওয়া কৃষকদের কথাই বা আমরা শুনবো কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেধরক ঠ্যাঙালেই বা আমাদের কি এসে যায়? শাহিনবাগ থেকে শুরু করে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনেই বা আমরা পা মেলাবো কেন? দিল্লীর দাঙ্গায় কতজনের প্রাণ গেল, তাতে আমাদের কি এসে যায়। দেশব্যাপী সরকারী সম্পত্তি বিক্রীর মেলা যতদিন চলে চলুক। কার চাকুরী যাবে আর থাকবে, সেটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। নতুন কৃষি আইনের কোন ধারায় কার কত সর্বনাশ হবে সেটা ভেবে আমাদের কি হবে? কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, দেশবাসীর যতজন আমাদের মতো দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ নিয়েছে, নিচ্ছে। তারা সকলেই আমাদের স্বজন। এই আমরাই কিন্তু আত্মনির্ভর ভারতের দৃষ্টান্ত। আমাদের সাথেই যে দেশপ্রেমের প্রথম পাঠের সার্টিফিকেট রয়েছে। 

১৯শে ফেব্রুয়ারী’ ২০২১


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ